নতুন চাঁদ উঠেছে। রামাদান মাসের চাঁদ। আর মাত্র এক মাস পর খুশির ঈদ। সৈয়দ বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুশির জোয়ার। সৈয়দ হাতিম আলী একজন সৎ ও প্রতাপশালী পুলিশ ইন্সপেক্টর। পারিবারিক সূত্রেই অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ। খুব যত্নের সাথে প্রথম তারাবীহ পড়ে আসলেন। এবার ঘুমোতে যাবার পালা। সেহরীতে উঠতে হবে। বছর ঘুরে শুরু হবে নতুন রুটিন। এরমধ্যে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলেন। সবাই অস্থির। তবে কিছুক্ষণ অস্থিরতা কাটিয়ে খুশির সংবাদ আসলো। তিনকন্যার পর দ্বিতীয়বারের মতো পুত্র সন্তানের বাবা হলেন সৈয়দ হাতিম আলী। যেন প্রথম রামাদান শুরু না হতেই ঈদ। হাতিম আলী উযূ করে দুই রাকআত শুকরানা নামায পড়ে নিলেন। সিজদায় কিছুটা দীর্ঘ সময় কাটালেন। আগত পুত্র সন্তানের জন্য না জানি কি দুআ করলেন কে জানে। পুত্র সন্তানের নাম রাখা হলো সৈয়দ ফররুখ আহমদ। রামাদান মাসের প্রথম রাতে আগমনকে স্মরনীয় রাখতে ডাকনাম রাখা হলো—রমজান। জীবন বড় রহস্যময়। সৃষ্টিকর্তার অদৃশ্য ইশারায় এঁকেবেঁকে চলে জীবনের গতিপথ। ফররুখের জীবনেও আসলো এক বিষাদময় সন্ধ্যা। মাত্র ছয়বছর বয়সে মা রওশন আখতার পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। মা হারা ফররুখ দাদির কাছে লালিত-পালিত হতে লাগলেন। দাদির কাছে নানারকম গল্প শুনে কেটে গেল ফররুখের শৈশব। দাদি কখনও পুঁথির কাহিনী শোনান। কখনও কাসাসুল আম্বিয়া থেকে নবী-রাসূলদের জীবনকথা। কখনও তাযকিরাতুল আউলিয়া থেকে ওলী-আল্লাহ,পীর-বুযুর্গদের মহৎজীবন। ফররুখ বড় হতে থাকেন। স্কুল থেকে কলেজ। এরমধ্যে কবিতা লেখার প্রতি আকর্ষণ বাড়ে ফররুখের। বিশেষ করে সনেটের প্রতি। সেই সাথে আবূ রুশদ,আবুল হাশেম,শওকত ওসমান প্রমুখদের বন্ধু হিসেবে পেয়ে আরও গতি পায় লেখালেখি। বিভিন্ন স্বনামধন্য পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে তার কবিতা। চারপাশে বেশ সাড়া। অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু তো কবিতা পড়ে বলেই ফেললেন,আমি একজন তরুণ শেক্সপিয়রকে আবিষ্কার করেছি। সত্যিই বাংলা সাহিত্যে এরকম কাব্য প্রতিভা কমই এসেছে। পরিবেশ,সংস্পর্শ মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলে। ফররুখের বেলায়ও ব্যতিক্রম নয়। নানারকম মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয়। একেকজন একেক চিন্তাধারার। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স অধ্যয়নকালে নাস্তিক্যবাদী কিছু বন্ধু জোটে ফররুখের। তাদের মাধ্যমে কমরেড এম.এন রায়ের শিষ্য বনে যান ফররুখ। সুন্দর বাচনভঙ্গি, মাথার উপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যুক্তি যেন অন্যরকম করে তোলে। মানবতার মুক্তির পথে যেন ধর্মই বড় বাধা। ধর্মব্যবসায়ী, শোষক শ্রেণি আর পুঁজিবাদীদের খপ্পর থেকে মানুষের মুক্তির জন্য অবিরাম গতিতে লিখতে থাকেন ফররুখ। বন্ধুরা বোঝায়,মাথা থেকে ঐ সৃষ্টিকর্তা নামক অশরীরী সত্তার কথা ফেলে দাও। চিন্তাজগতে এক মহা ঝড় বয়ে যায়। আসলেই কি তবে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই? মাঝে মাঝে তর্ক করতে যেয়ে যুক্তিতর্কের কাছে পরাভূত হয় বিশ্বাসের সাহস। দুমড়ে মুচড়ে যান ফররুখ। ছোট্ট নদী মধুমতী। নদীর ওপাড়ে ছায়া ঘেরা পাখি ডাকা সুন্দর গ্রাম—মাঝ আইল। এ গ্রামেরই সবচেয়ে অভিজাত মুসলিম পরিবার সৈয়দ বংশে ফররুখের জন্ম। রক্তে মাংসে মিশে আছে ধর্মীয়বোধ। কিন্তু এই সবকিছুই যেন এখন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের পারস্পরিক সংঘাতে আহত বিমর্ষ যুবক ফররুখ। কোথায় গেলে শান্তি পাবো? কার কাছে গেলে পাবো অন্তরজ্বালার উপশম? দিশেহারা ফররুখ। গুমরিয়ে ওঠে কবিমন। এমন এক বিষণ্ণ বিকেলে এক আধ্যাত্নিক ব্যক্তির সাথে দেখা হয় ফররুখের। তিনি অধ্যাপক মাওলানা আব্দুল খালিক। ফুরফুরা দরবার শরীফের মুজাদ্দিদে যামান আবূ বকর সিদ্দিক (র.) এর বিশিষ্ট খলীফা। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন প্রফেসর সাহেবের পীরভাই। প্রফেসর আব্দুল খালিক একদিকে যেমন আধ্যাত্মিকতায় কামিল পুরুষ,অন্যদিকে ছিলেন আরবী ও ফার্সীতে গোল্ড মেডেলসহ ডাবল মাস্টার্স অর্জন করা সুবিখ্যাত পণ্ডিত। কবি ফররুখ টেইলর হোস্টেলে যেয়ে দেখা করলেন প্রফেসর সাহেবের সাথে। প্রফেসর সাহেব তখন নবী জীবনচরিত সাইয়্যিদুল মুরসালীন লিখছেন। যা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক তথ্যবহুল নবী জীবনী হিসেবে সর্বমহলে প্রশংসা অর্জন করে। প্রফেসর সাহেব সেই সময় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক। টেইলর হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্টও। ভাবছিলেন নবী জীবনীকে কীভাবে আরও ভাষাশৈলী ও সাহিত্যের নিরিখে অলংকারসমৃদ্ধ করা যায়। সৃষ্টিকর্তার আজব লীলা। যেন দুইজন দুইজনকে খুঁজছেন। প্রফেসর সাহেব খুঁজছেন একজন সাহিত্যবোদ্ধা, আর ফররুখ খুঁজছেন এমন একজনকে যিনি মনের জ্বালা নেভাতে পারবেন। প্রফেসর সাহেবের সামনে এসে বসলেন ফররুখ। প্রথমেই অন্তর্দৃষ্টিতে যেন কী দেখে নিলেন প্রফেসর সাহেব। ফররুখের প্রতি স্নেহ মায়ার মহিমায় উতলে উঠলো মন। তিনি দেখলেন সৌম্যসুন্দর এক কাব্যপ্রতিভা,যার অন্তরে অনন্ত সত্যের চেরাগ প্রদীপ্ত হওয়ার টানে ব্যাকুল। কিন্তু অসৎ সঙ্গের প্রভাবে খোদাদ্রোহী শূন্যতার উপাসক মতবাদ তাকে তিলে তিলে কেমন নিঃস্প্রভ করে ফেলেছে। আরও মায়া বাড়ে প্রফেসর সাহেবের। কিন্তু তিনি উপর দিয়ে স্বাভাবিক থাকেন। স্নেহের পরশ মিশিয়ে ফররুখের কাছে জানতে চান নাম,লেখাপড়া,আব্বা-আম্মার কথা, লেখালেখি, কাব্যচর্চা ইত্যাদি। আস্তে আস্তে ফররুখ সহজ হয়ে উঠছেন লক্ষ্য করে প্রফেসর সাহেব ফররুখকে প্রশ্ন করলেন, মানুষের মুক্তির মতবাদ কোনটি? মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির একমাত্র মতবাদ মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদ, এক নিমিষেই বললেন ফররুখ। অত্যন্ত জোড়ালোভাবে দ্বিমত পোষণ করলেন প্রফেসর সাহেব। বললেন—না, তা কখনও হতে পারে না। মানুষের সার্বিক মুক্তির একমাত্র পথ হলো ইসলাম। একরোখা ফররুখ কিছুতেই মানতে পারেন না সেই কথা। কমরেডদের শেখানো বুলি আর কমিউনিস্ট সাহিত্যের নানারকম যুক্তি ও উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, কমিউনিজম তথা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির খতম ছাড়া বঞ্চিত মানুষের মুক্তি নেই। অসম এই যুক্তিতর্ক তিনদিন চলে। প্রজ্ঞাবান প্রফেসর সাহেব মনোযোগ ও ধৈর্য্যের সাথে ফররুখের সব কথা শোনেন। এক সময় ফররুখের যুক্তিতর্কের ভান্ডার ফুরিয়ে আসে। রূহানীয়াত ও হিকমাতের অধিকারী সূফী প্রফেসর সাহেব এবার বলতে শুরু করলেন, কমিউনিজমের ঠুনকো যুক্তি ও দর্শন দেখো বাস্তবতার নিরিখে কত অসাড়। অন্যদিকে কমরেডদের ব্যক্তিজীবনের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরলেন। তিনি দেখালেন কৃষক শ্রমিক দিনমজুরের অধিকারের বাহানায় তারা কত আন্দোলন করলো কিন্তু সেই গরীব মানুষগুলো গরীবই রয়ে গেল। আরও অনেকে কথা…
তারপর বুঝালেন স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্য। পথহারা মানুষের মুক্তির জন্য নবী-রাসূল প্রেরণের কারণ। তথ্যউপাত্ত, যুক্তি, দর্শন দিয়ে সহজ কিন্তু সাহসী উচ্চারণে তিনি বলতে লাগলেন, জাহিলিয়াতের চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন বিশ্ব সভ্যতা, যখন বিশ্ব মানবতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিচ্ছে জাহিল মানুষগুলো, ঠিক তখনই নবূওয়্যাতের আশ্চর্য আলো হয়ে মানবতার মহামুক্তির সনদ নিয়ে আসলেন মহাকালের মহানায়ক মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মদীনার সনদ, বিদায় হজ্জের ভাষণ, মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সার্বজনীন সমাধান ও মহানবীর চারিত্রিক মাধুর্যে কীভাবে বদলে গেল সেই মানুষগুলো। হয়ে গেল সোনার মানুষ। মানবাধিকারের কী অসাধারণ অনবদ্য বিপ্লব। এই বিপ্লবের ইতিহাস না কেউ আগে দেখেছে, না কেউ দেখবে কখনও। তারপর শুনালেন, খুলাফায়ে রাশিদার মাধ্যমে দ্বীনের সেই ধারাবাহিক বিজয় অভিযাত্রার কথা। জ্ঞান-বিজ্ঞান সর্বক্ষেত্রে পদবিক্ষেপ। যেখানেই মদীনার ইসলাম সেখানেই মানবতার বিজয়। এরপর কিছুটা থমকে গেলেন প্রফেসর সাহেব। বিষণ্ণ মন নিয়ে বললেন, অথচ সেই গৌরবময় ঐতিহ্য থেকে আজ কত দূরে ভারতীয় মুসলমান। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর তাসাওউফের মূল চর্চা থেকে ছিটকে পড়ে তারা যেন পশ্চাৎপদতায় ক্রমশ ধাবমান। ঐদিকে কুওয়াতে কুলূবের মহিমায় ফররুখ তখন অন্য আবেশে। সমস্ত লোমকূপে যেন জযবার তড়িৎ প্রবাহ। ইত্তিহাদী তাওয়াজ্জুর প্রবল প্রভাব। প্রফেসর সাহেব এবার ফররুখের চোখে চোখ রাখলেন। দুই হাত ফররুখের ঘাড়ের উপরে রেখে বললেন প্রিয় ফররুখ, তুমি কি পারবে না তোমার কাব্য প্রতিভা কাজে লাগিয়ে এই ঘুমন্ত জাতিকে আবার জাগিয়ে তুলতে? আল্লাহর ওলীর পরশে সঙ্গে সঙ্গে একবাক্যে কবি ফররুখ বলে উঠলেন, জি স্যার। আপনার দুআ থাকলে অবশ্যই পারবো ইনশাআল্লাহ! কবির কলমে এখন অন্যকিছু। যেন মদীনার খুশবু। হৃদয়ে জ্বলে উঠেছে সিরাজাম মুনীরার বাতি। আবূ বকরের প্রজ্ঞা,উমরের সাহস, উসমানের বিনয়, আলীর জ্ঞানের আভিজাত্য। ফররুখ লিখলেন ঐতিহাসিক সাত সাগরের মাঝিসহ আরো কালজয়ী কবিতা। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সিরাজাম মুনীরা উৎসর্গ করলেন আপন পীর ও মুরশীদ প্রফেসর আব্দুল খালিককে। যাঁর জ্যোতির্ময় পরশে কবি নাস্তিকতার নষ্ট কবল থেকে মুক্তি পেয়ে ইতিহাসে স্থান পেলেন এক বিরল অভিধায়—মুসলিম রেঁনেসার কবি।

