1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
মাযহাব অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা কী?
জবাব দিচ্ছেন: মাওলানা আবূ নছর মোহাম্মদ কুতুবুজ্জামান তাফাদার
  • ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

চার মাযহাবের চার ইমাম যে কোনো একটি মাযহাবের অনুসরণ না করে কেন চারটি মাযহাব তৈরি করলেন?

এর কি প্রয়োজনীয়তা ছিল? জানতে চাই।

 

প্রশ্নকারী: আব্দুল্লাহ আল মাওসুফ,

ফাযিল (সম্মান) ৩য় বর্ষ, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা

 

জবাব: চার মাযহাবের চার ইমাম একত্র হয়ে একই সময়ে চারটি মাযহাব তৈরি করেননি এবং তাদের নিছক ব্যক্তিগত মতের কারণে চার মাযহাব হয়নি। এমনকি তারা এক যুগেরও ছিলেন না। সুতরাং তাদের সমালোচনা না করে বরং তাদের অবদানের শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কুরআন-সুন্নাহতে একই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী একাধিক বর্ণনা থাকার প্রেক্ষিতে একাধিক মাযহাব হয়েছে। যে ইমাম যে বর্ণনাকে তার শর্ত অনুযায়ী শক্তিশালী মনে করেছেন তিনি সে বর্ণনা অনুযায়ী মত দিয়েছেন। এটিই তাঁর মাযহাব। এটি কোনো ব্যক্তিগত মত নয়। বরং কুরআন-সুন্নাহ থেকে নির্গত ফাতাওয়া।

একজন অনুসন্ধানী পাঠক হাদীসের কিতাবাদি অধ্যয়ন করলে সুন্নাহ’র দলীলের ভিন্নতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। যেমন:

তাকবীরের সময় হাত উঠানো সম্পর্কে হাদীস শরীফে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা রয়েছে।

১. হযরত মালিক বিন হুয়াইরিস থেকে বর্ণিত,

إن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان إذا كبر رفع يديه حتى يحاذى بهما أذنيه

-রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকবীরে তাহরীমার সময় উভয় হাত কান বরাবর উঠাতেন। (সহীহ মুসলিম: ৮৬৬)

২. হযরত বারা ইবনে আযিব (রা.) বলেছেন,

كان النبي صلى الله عليه وسلم إذا كبر لافتتاح الصلاة رفع يديه حتى يكون إبهاماه قريبا من شحمتي أذنيه. (طحاوى)

-নবী (সা.) নামায শুরুর তাকবীর যখন দিতেন তখন দুই হাত এমনভাবে ওঠাতেন যে, বৃদ্ধাঙ্গুল কানের লতির কাছাকাছি থাকত। (তাহাবী)

৩. হযরত কাতাদা (রা.) বর্ণিত,

عن قتادة إنه رأى النبي صلى الله عليه وسلم، وقال: حتى يحاذي بهما فروع أذنيه. (مسلم)

-তিনি নবী করীম (সা.) কে দেখেছেন, দুই হাত কানের লতি বরাবর উপরে ওঠাতে। (সহীহ মুসলিম)

৪. হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত,

إن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يرفع يديه حذوا منكبيه إذا افتتح الصلاة

-রাসূলুল্লাহ (সা.) নামায আরম্ভ করার সময় উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাতেন। (সহীহ মুসলিম)

৫. হযরত ওয়ায়েল বিন হুযর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে নির্দেশপূর্বক বলেন,

إذا صليت فاجعل يديك حذاء أذنيك والمرأة تجعل يديها حذاء ثدييها

-তুমি যখন নামায আরম্ভ করবে উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠাবে এবং মহিলারা তাদের হাত বুক পর্যন্ত উঠাবে। (তাবরানী)

 

এ হাদীসসমূহে ভিন্নধর্মী বর্ণনা রয়েছে। এর মধ্যে একটি বর্ণনার আলোকে মালিকীদের মতে, কাঁধ বরাবর হাত উঠানো মুস্তাহাব। শাফিঈদের মতে, রাফয়ে ইয়াদাইনের পরিপূর্ণ রূপ হলো, পুরুষ ও মহিলা উভয়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি কানের লতি বরাবর, অন্যান্য আঙ্গুলসমূহ কান বরাবর ও হাতের তালু কাঁধ বরাবর রাখবে। হানাফীদের মতে, পুরুষরা কান বরাবর এবং মহিলারা কাঁধ বরাবর হাত উত্তোলন করবে। (আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবাআ)

প্রত্যেক মাযহাবের দলীল পূর্বোক্ত কোনো না কোনো হাদীসে রয়েছে। এরূপ দলীলের ভিন্নতার কারণে একাধিক মাযহাব হয়েছে।

বর্তমান সময়ে যে সকল মাযহাববিরোধী সকলের ক্ষেত্রে এক মাযহাব বা একই ধরনের আমলের দাবি তুলেন তাদের পক্ষেও সকল মাসআলায় এক সমান ফাতাওয়া দেওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু কুরআন-সুন্নাহর দলীলের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও মতপার্থক্য রয়েছে। মাযহাববিরোধীদের পরস্পরের মধ্যেও বিভিন্ন বিষয়ে ইখতিলাফ পরিলক্ষিত হয়। যেমন: সিজদায়ে যাওয়ার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করবে কি না এ বিষয়ে মাযহাববিরোধীদের গ্রহণযোগ্য শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায এবং শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উছায়মীন এর মত হলো- সিজদায় যাওয়ার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করবে না। পক্ষান্তরে, শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (র.) এবং আব্দুল হামীদ ফাইযীর মত হলো- সিজদায় যাওয়ার সময় রাফয়ে করতে পারবে। এভাবে বিভিন্ন মাসআলায় আরো অনেক ইখতিলাফ রয়েছে। তাদের পারস্পরিক ইখতিলাফ নিয়ে বহু গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং এক মাযহাবের দাবি সম্পূর্ণ অমূলক, অবাস্তব ও অসম্ভব।

মাযহাব মূলত চারটি ছিল না। মুজতাহিদ কেবল চারজন ছিলেন না। আরো অনেক মুজতাহিদের মাযহাব বা মত-অভিমত রয়েছে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ চারজনের মাযহাব গ্রহণ করেছে। অন্যদের মাযহাব গ্রহণ করেনি। তাই এ চার মাযহাব বিষয়ে উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং বর্তমানে চার মাযহাবের বাইরে অন্য কোনো মত বা মাযহাব গ্রহণযোগ্য হবে না।

ইজতিহাদ ও মাযহাব বিষয়ে মূলকথা হলো-

ইজতিহাদ বা গবেষণা করার যোগ্যতাসম্পন্ন সকল ব্যক্তির জন্য কুরআন সুন্নাহতে সরাসরি নেই এমন বিষয়ে কিংবা যে বিষয়াবলি অস্পষ্ট তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কিংবা সমাধানে আপন ইজতিহাদ অনুযায়ী সিদ্বান্ত গ্রহণ ও তদনুসারে আমল করা অপরিহার্য। অতীতে এ স্তরের ব্যক্তিগণের সংখ্যা অনেক ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে চার জনের গবেষণা মূলনীতি (উসূল)সহ পূর্ণতা লাভ করেছে। তারা যে সকল বিষয় কুরআন-সুন্নাহতে সরাসরি নেই কিংবা এতদুভয়ের সকল অস্পষ্ট বিষয়াবলির উদ্দেশ্য উদঘাটনে সঠিক মূলনীতির (উসূলের) ভিত্তিতে গবেষণা করে সুস্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। অধিকন্তু নব উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদ/ফকীহগণের জন্য অনুসরণযোগ্য মূলনীতি প্রণয়ন করে পরবর্তি সময়ের সকল মুসলমানের জন্য সমাধানের পথ তৈরী করেছেন। এ চারজনের যে কোনো একজনের অনুসরণ শরীআতের ইজতিহাদ সম্বলিত বিধানাবলির শুদ্ধ আমলের ক্ষেত্রে অমুজতাহিদ সকল লোকের জন্য ওয়াজিব (অপরিহার্য)।

চার মাযহাবের ইমামগণ কুরআন-সুন্নাহ’র জ্ঞানে যথার্থ জ্ঞানী ছিলেন। আর জ্ঞানীদের থেকে জেনে আমল করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,

‎ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (النحل: ٤٣)

-জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করে যদি তোমাদের জানা না থাকে। (সূরা আন নাহল, আয়াত: ৪৩)

মহান আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন,

فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ (التوبة: ١٢٢)

-তাদের প্রত্যেক দলের থেকে কতিপয় লোক কেন দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে বের হলো না যারা তাদের নিকট ফিরে এসে তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারতো। (সূরা আত তাওবাহ; আয়াত: ১২২)

এ মর্মে হাদীস শরীফে এসেছে-

‎عن معاذ، أن النبي صلى الله عليه وسلم لما بعثه، قال: كيف تقضي؟، قال: أقضي بكتاب الله، قال: فإن لم يكن كتاب؟ قال: أقضي بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم، قال: فإن لم كن سنة من رسول الله صلى الله عليه وسلم؟، قال: أجتهد برأيي، قال: فقال النبي صلى الله عليه وسلم: الحمد لله الذي وفق رسول رسول الله

-হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাকে ইয়ামানে পাঠানোর ইচ্ছা করলেন তখন বললেন, তোমার নিকট যখন কোনো মুকদ্দমা আনা হবে, তখন তুমি কিসের ভিত্তিতে এর ফায়সালা করবে? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব মুতাবেক। নবী (সা.) বললেন, তুমি যদি আল্লাহর কিতাবে এর কোনো ফায়সালা না পাও? মুআয (রা.) বললেন, তাহলে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাত অনুযায়ী। নবী (সা.) বললেন, তুমি যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাত এবং আল্লাহর কিতাবে এর ফায়সালা না পাও? মুআয (রা.) বললেন, তাহলে আমি ইজতিহাদ করবো এবং অলসতা করবো না। তখন নবী (সা.) মুআযের বুকে হাত মেরে বললেন, সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতিনিধিকে আল্লাহর রাসূলের মনঃপুত কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন। (আবূ দাউদ: ৩৫৯২, তিরমিযী)

উপরোক্ত হাদীসে স্পষ্টত উল্লেখ হয়েছে যে, যে সকল বিষয়াবলি সরাসরি কুরআন বা সুন্নাহতে পাওয়া যায় না এমন বিষয়ে মুজতাহিদ গবেষণা করে (কিয়াসের মাধ্যমে) সিদ্ধান্ত নিবেন এবং তদনুসারে আমল করবেন।

আর এ কারণেই ইমামগণ স্বতন্ত্রভাবে ইজতিহাদ করেছেন। আর যেহেতু ইজতিহাদের মূলনীতিতে ভিন্নতা ছিল তাই সিদ্ধান্ত ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে। তবে যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদের ইজতিহাদে কখনো ভুল হলে ও তারা পুরস্কৃত ও সওয়াব প্রাপ্ত হন। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে:

عن عمرو بن العاص، أنه سمع رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: إذا حكم الحاكم فاجتهد ثم أصاب فله أجران، وإذا حكم فاجتهد ثم أخطأ فله أجر

-হযরত আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে এ কথা বলতে শুনেছেন, কোনো বিচারক ইজতিহাদে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তার জন্য আছে দুটি পুরস্কার। আর বিচারক ইজতিহাদে ভুল করলে তার জন্যও রয়েছে একটি পুরস্কার। (সহীহ বুখারী: ৭৩৫২)

মোটকথা, ইমামগণের ইজতিহাদপ্রসূত ভিন্নতা রাসূল (সা.) এর সাধারণ উম্মতের জন্য শরীআতের আমলকে সহজতর করেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাহ তথা আমলযোগ্য সকল হাদীসকে আমলে এনে দিয়েছে। তাই হাদীস শরীফে এ মর্মে এসেছে: اختلاف أمتي رحمة “আমার উম্মতের মতানৈক্য রহমত তুল্য।” (মিরকাত শরহে মিশকাত: ১/২০, শরহুন্নববী আলা মুসলিম: ১১/৯২)

 

জবাবদাতা: প্রিন্সিপাল ও খতীব, আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টার 

মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র

ফেইসবুকে আমরা...