ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধাদের (বিশেষত হামাসের) বিরুদ্ধে জায়োনিস্ট এবং আরব রাজতন্ত্রের সেবক মাদখালীরা মিলে নতুন করে প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো শুরু করেছে। এই প্রোপাগাণ্ডার অংশ হিসেবে এদেশের মাদখালী, সালাফী, নজদীরাও হামাসের বিরুদ্ধে নিত্য নতুন প্রোপাগাণ্ডা তৈরি করছে৷ এসবে বিভ্রান্ত হয়ে ইদানিং অনেক সাধারণ মুসলমানকেও হামাসের ব্যাপারে বিভ্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। আল আক্বসার জন্য জিহাদে শামিল হতে না পারার অক্ষমতা আমাদের প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে। কিন্তু জায়োনিস্ট আর মাদখালীদের যৌথ ষড়যন্ত্রে আমরা যারা মুজাহিদ বাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধা রাখি তাদের শ্রদ্ধা যেন নষ্ট না হয় সে লক্ষ্যে কিছুদিন সময় নিয়ে হামাসের বিরুদ্ধে চালানো বিভিন্ন অপপ্রচারের জবাব লিখেছি। দীর্ঘ এ লেখাগুলো পড়লে আশা করি সকল বিভ্রান্তি দূর হবে। লেখাটির প্রথম পর্বে আছে নিচের প্রশ্নের উত্তর-
ইজরাইলে হামলা চালালে পরণতি ভয়াবহ হতে পারে জেনেও হামাস কেনো ৭ই অক্টোবর হামলা চালালো?
০১.
ইজরাইলে হামলা চালালে পরণতি ভয়াবহ হতে পারে জেনেও হামাস কেনো ৭ই অক্টোবর হামলা চালালো?
আজকাল নজদি মাদখালীদের প্রোপাগাণ্ডায় অনেকেই ভাবা শুরু করেছেন হামাস যুদ্ধারা হয়তো ৭ই অক্টোবর হামলা করে ভুল করেছেন। এই চিন্তা যারা করছেন তারা গাযার মুজাহিদিনদের আসলে অপমানই করছেন। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে ২০২৩ সালে আসলে বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন ছিলো। এখানে স্বরণ করিয়ে দেই, এমবিএস, এমবিজেড, বাইডেন এবং নেতানিয়াহুর মধ্যে সম্পর্ক তখন স্মরণকালের ঘনিষ্ঠতম ছিলো। আব্রাহাম একর্ডের মাধ্যমে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো, সুদান ইজরাইলের সাথে সম্পর্ক নরমালাইজ করে ফেলেছিলো। রয়টার্স, বিবিসি ও আল জাযিরার রিপোর্ট অনুযায়ী সৌদি আরবও নরমালাইজেশনের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলো। আগে থেকেই মিশর এবং জর্ডানের সাথে ইজরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকই ছিলো। এর মধ্যেই ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নেতানিয়াহু জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভবিষ্যত মধ্যপ্রাচ্যের যে মানচিত্র উপস্থাপন করে সেখানে গাযা ও পশ্চিম তীরকে ইজরাইলের অংশ হিসাবে দেখানো হয়। অর্থাৎ নেতানিয়াহুর ভবিষ্যত মধ্যপ্রাচ্য চিন্তায় ফিলিস্তিনের কোন অস্তিত্ব ছিলো না। এই বক্তব্যের পরও আরব রাষ্ট্র সমূহের দিক থেকে কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া ছিলো না। একদিকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শর্ত বাদ দিয়েই ইজরাইলের সাথে সম্পর্ক নরমালাইজেশন করে ফেলা অন্যদিকে বিশ্বমঞ্চে নেতানিয়াহুর মধ্যপ্রাচ্য রূপকল্পে ফিলিস্তিনকে মুছে দেওয়ার পরও আরবদের চুপ থাকা ফিলিস্তিনের মুজাহিদিনদের পরিষ্কার বার্তা দিয়েছিলো যে এসব রাষ্ট্র আর কখনোই ফিলিস্তিনের দাবি নিয়ে সামনে আসবে না। আর আরবরা স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি থেকে সরে আসলে আল আক্বসার আজাদি যে কত কঠিন তা জিওপলিটিক্স যারা টুকটাক বুঝেন তারাই জানেন।
আক্বসা যে আরবদের কাছে বিনিময়যোগ্য সম্পদে পরিণত হয়েছে তা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো আরো কয়েক বছর পূর্বে ২০১৭ সালে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইজরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সেখানে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনের নির্দেশনা দেয়। এই নির্দেশের পরেও কোন আরব রাষ্ট্রের সাথেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের তেমন কোন দৃশ্যমান টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়নি। গত এক শতাব্দি ধরে আরবদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বা পশ্চিমাদের সম্পর্কের প্রধান নিয়ামক হিসাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায়। গুপ্ত অথবা ব্যক্ত আরো অনেক নিয়ামক থাকলেও অন্তত আরব রাষ্ট্রনেতাদের হাবভাবে, কথাবার্তায় তারা জেরুজালেম তথা ফিলিস্তিনের বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দেন বলেই সবার মনে হতো। তবে গত এক দশকে ফিলিস্তিনের স্বার্থ বিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের পরেও আরবদের নিশ্চুপ ভূমিকা সবার কাছে এ বার্তা পৌছে দেয় যে আরব পররাষ্ট্রনীতিতে জেরুজালেম এখন খুবই গৌন উপাদান অথবা আদতে কোন উপাদানই নয়।
২০২২-২০২৩ সালের বিশ্ব রাজনীতি আমরা স্মরণ করলে আরো দেখতে পাবো ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে পূর্ব ইউরোপে পশ্চিমা বিশ্ব বনাম রাশিয়া দ্বন্দ্ব আর ইন্দো প্যাসিফিকে চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বনাম আমেরিকার কোয়াড বলয়ের দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছিলো। এমতাবস্থায় বিশ্বের ফোকাল ব্যাটল গ্রাউন্ড মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে পূর্ব ইউরোপ আর ইন্দো প্যাসিফিকে শিফট হচ্ছে বলেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা ধরে নিয়ছিলেন। ফলে ফিলিস্তিন ইস্যু সবার ফোকাসের বাইরেই চলে গিয়েছিলো। আরবদের সাথে ইজরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে সাথে সাথে সারা বিশ্বের মানুষের ফোকাস থেকেও যদি ফিলিস্তিন সরে যায় তাহলে তাদের ভূমি দখলে আর ইজরাইলিদের কোন বাধা থাকতো না। শত শত বুল্ডোজার ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করতো কিন্তু আমরা এ খবর শুনেও না শুনার ভান করে থাকতাম। এই অবস্থায় ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের কাছে একটা উপায়ই খোলা ছিলো। আর তা হলো ফিলিস্তিনে নতুন করে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করা, নিজেদেরকে শহীদ করা, যেন এই জালিম ও জাহিল আরব শাসকরা তাদের চক্ষুলজ্জা থেকে হলেও দখলদার ইজরাইলিদের সাথে নরমালাইজেশন থেকে পিছিয়ে এসে পুনরায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি করে, একই সাথে বিশ্বের সাধারণ মানুষ যেন ফিলিস্তিনের মজলুমদের না ভুলে।