আহলে বাইতের সাথে বনূ উমাইয়ার শত্রুতা
আহলে বাইতের সাথে বনূ উমাইয়ার শত্রুতার সূত্রপাত তাদের পূর্বপুরুষ উমাইয়ার সময়কাল থেকে হয়। এর একটি বিস্তারিত বর্ণনা মুফতী সায়্যিদ আমীমুল ইহসান আল মুজাদ্দিদী আল বারাকাতী (র.) ‘তারীখে ইসলাম’ কিতাবে দিয়েছেন। উক্ত কিতাব থেকে নিম্নে কিছু আলোচনা তুলে ধরা হলো-
নবী e এর পূর্বপুরুষদের মধ্যে ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পূর্বপুরুষ ছিলেন আবদে মানাফ। তাঁর ছয়জন পুত্রসন্তানের মধ্যে হাশিম, মুত্তালিব ও আবদে শামস ছিলেন সহোদর ভাই। হাশিমের সন্তানদেরকে হাশিমী ও মুত্তালিবের সন্তানদেরকে মুত্তালিবী বলা হয়। নবী e ছিলেন হাশিমী। জাহিলী ও ইসলামী উভয় যুগে মুত্তালিবী ও হাশিমীরা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। আবদে শামসের সন্তানরা আবশামী নামে আখ্যায়িত হয়। আবদে শামসের এক পুত্রের নাম ছিল উমাইয়া। তার সন্তানরাই উমাইয়া বা বনূ উমাইয়া নামে পরিচিতি লাভ করে।
হাশিম তাঁর বদান্যতা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার জন্য কুরাইশদের নেতা হিসেবে বরিত হন। কিন্তু তাঁর ভাতিজা উমাইয়া তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। ফলে তাদের মধ্যে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে জাহিলী যুগে হাশিমী ও উমাইয়াদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। ইসলামের সূচনাপর্বেও কিছু সংখ্যক পবিত্রাত্মা ছাড়া বনূ উমাইয়ার আর সকলেই ইসলাম ও ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নবী e এর বিরোধীতায় সকল শক্তি নিয়োগ করে। বদর যুদ্ধের পর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত মক্কাবাসীদের সাথে যতগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে উমাইয়া বংশের আবূ সুফইয়ান তার নেতৃত্ব দেন। কারণ তিনি ইসলামের সমৃদ্ধিকে হাশিমীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি বলে মনে করতেন। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ e এর পবিত্র সত্তার কারণে এ বংশগত শত্রুতা তিরোহিত হয়। কিন্তু খলীফায়ে রাশিদ হযরত উসমান (রা.) এর শাহাদাতের পর হাশিমী বংশোদ্ভূত খলীফায়ে রাশিদ হযরত আলী (রা.) এর খিলাফতের প্রতি উমাইয়াদের সে পুরনো ঘৃণা-বিদ্বেষ আবার জাগ্রত হয়ে ওঠে যা হযরত আলী (রা.) এর খিলাফতের পরিসমাপ্তির পর ৪১ হিজরীতে উমাইয়া শাসনের ভিত্তি রচনা করে। (তারীখে ইসলাম)
কোন কোন আহলে বাইত বিদ্বেষী বলে থাকেন যে, মুফতী সায়্যিদ আমীমুল ইহসান আল মুজাদ্দিদী আল বারাকাতী (র.) সায়্যিদ বংশের লোক ছিলেন, তাই স্বভাবত: তিনি পক্ষপাতমূলকভাবে ইয়াযীদের বিপক্ষে এবং আহলে বাইতের পক্ষে লিখেছেন। এটা মুফতী সাহেবের বিপক্ষে তাদের জঘন্য অপবাদ। কারণ মুফতী আমীমুল ইহসান (র.) কেবল সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন, যা অন্যান্য আরো অনেক ঐতিহাসিক, সীরাত গ্রন্থকার, মুফাসসিরীনে কিরাম ও উলামায়ে কিরাম তুলে ধরেছেন।
রাসূলুল্লাহ e এর সন্তানদের সাথে বিদ্বেষের সূচনা
সর্বপ্রথম মক্কা শরীফের কাফিররাই রাসূলুল্লাহ eকে মানসিক নির্যাতন করার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ e এর সন্তানদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছিল। যার প্রমাণ সকল নির্ভরযোগ্য সীরাতের কিতাবে বর্ণিত আছে।
তবাকাতু ইবন সাদ, সীরাতু ইবন হিশাম ও আনসাবুল আশরাফ গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত কিছু ঘটনার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ-
রাসূলুল্লাহ e এর নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বে আবূ লাহাবের পুত্র উতবার সাথে হযরত রুকাইয়্যা (রা.) এর বিয়ে হয়। ওহী নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ e দ্বীনের দাওয়াত শুরু করেন। কুরাইশদের সাথে তাঁর বিরোধ যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন তারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়ার সকল পথ ও পন্থা বেছে নেয়। তারা সকল নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মুহাম্মাদ e এর বিবাহিতা মেয়েদের স্বামীর উপর চাপ প্রয়োগ অথবা প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের স্ত্রীকে তালাক দেওয়াবে এবং তাদের পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দেবে। তাতে অন্ততঃ তাঁর মনে কষ্ট ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পাবে এবং তিনি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।
যেমন চিন্তা তেমন কাজ। তারা প্রথমে গেল রাসূলুল্লাহ e এর বড় মেয়ের স্বামী আবুল আস ইবন রাবীর নিকট এবং বলল তাঁর স্ত্রী যাইনাব বিনতু মুহাম্মাদ eকে তালাক দিয়ে পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি তাদের মুখের উপর সাফ না বলে দিলেন। নির্লজ্জ কুরাইশ নেতৃবৃন্দ এমন জবাব শুনেও থামলো না। তারা গেল রুকাইয়ার (রা.) স্বামী উতবা ইবন আবূ লাহাবের নিকট এবং তার স্ত্রীকে তালাক প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করলো। সাথে সাথে এ প্রলোভনও দিল যে, সে কুরাইশ গোত্রের যে সুন্দরীকেই চাইবে, তাকে তার সাথে বিয়ে দেওয়া হবে। বিবেকহীন উতবা তাদের প্রস্তাব মেনে নিল। সে রুকাইয়ার বিনিময়ে সাঈদ ইবনুল আস মতান্তরে আমর ইবন সাঈদ ইবনুল আসের একটি মেয়েকে পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করল। কুরাইশ নেতারা সানন্দে তার এ দাবি মেনে নিল। তাদের না মানার কোন কারণ ছিল না। তাদের তো মূল উদ্দেশ্য ছিল, যেকোনভাবে এবং যতটুকু পরিমাণেই হোক মুহাম্মদ eকে দৈহিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা। মুহাম্মদ e এর একটু কষ্টতেই তাদের মানসিক প্রশান্তি। নরাধম উতবা তার স্ত্রী সায়্যিদা রুকাইয়া (রা.) কে তালাক দিল।
প্রকাশ থাকে যে, হযরত যাইনাব (রা.) মক্কা শরীফ থেকে হিজরত করে আসার সময় তাঁকে উঠের পিঠ থেকে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি একটি পাথরের উপর ছিটকে পড়লে তাঁর শরীর ফেটে রক্ত বের হতে থাকে এবং গর্ভপাত হয়ে যায়। এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে রাসূল e ইরশাদ করেন- সে ছিল আমার সবচেয়ে ভালো মেয়ে। আমাকে ভালোবাসার কারণেই তাকে কষ্ট পেতে হয়েছে।
বুখারী শরীফসহ অন্যান্য নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলোতে বর্ণিত আছে, এ ঘটনার কারণে রাসূল e এত মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, প্রথমে তিনি আক্রমণকারীদের জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। অতঃপর জ্বালানোর পরিবর্তে হত্যা করার নির্দেশ দেন। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারী,খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ১০৪-১০৫)
তাবারানী শরীফে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে, হযরত যাইনাব (রা.) উঠের পিঠ থেকে পড়ে যে আঘাত পান আমরণ সে ব্যথা অনুভব করতেন এবং সেই ব্যথায় তিনি শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন। এজন্যই তাঁকে শহীদ হিসেবে গণ্য করা হতো। (মাযমাউয যাওয়ায়িদ, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা: ২১৯)
রাসূলুল্লাহ e এর সন্তান হযরত ইবরাহীম (রা.) এর ইন্তিকালে রাসূল e অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। পক্ষান্তরে কাফিররা আনন্দিত হয়ে বলেছিল, মুহাম্মাদ e এর বংশ শেষ হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা সূরা কাওসার নাযিল করে তাদের জবাব দিয়েছেন। কাফিরদের এ কাজকে ঘৃণা করা এবং রাসূলুল্লাহ e এর প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা ঈমানদারের কাজ।
অতএব বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহ e এর সন্তানদের সাথে বিদ্বেষের সূচনা হয়েছিল কাফিরদের থেকে। কাফিররা রাসূলুল্লাহ e এর সন্তানদেরকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেত।
হযরত হাসান-হুসাইন (রা.) কে কেন ভালোবাসবো
রাসূলুল্লাহ e হযরত হাসান ও হুসাইন (রা.) কে ভালোবাসতেন এবং উম্মতকে ভালোবাসার নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সিরাজুল হিন্দ শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর একটি ফাতওয়া প্রাসঙ্গিক-
‘আহলুল বাইতের মহব্বত সুন্নাতের প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়,বরং ঈমানের অংশ।’ (ফাতওয়ায়ে আযীযী, পৃষ্ঠা: ২৫০)
এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী e বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবেসেছে, তার উপর ওয়াজিব সে যেন এরা উভয়কেও (হাসান ও হুসাইন) ভালোবাসে। (সুনান আন নাসাঈ, হাদীস-৮১৭০, সহীহ ইবন খুজাইমা, হাদীস-৮৮৭,মাজমাউয যাওয়াইদ, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-১৭৯)হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এই আয়াত-
قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى
অর্থাৎ (হে নবী e!) “আপনি বলে দিন, আমি তোমাদের নিকট থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি সৌহার্দ্য ছাড়া কোন বিনিময় আশা করছি না” (সূরা শূরা, আয়াত ২৩) অবতীর্ণ হয়, তখন সাহাবায়ে কিরাম (রা.) জানতে চাইলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ e! আপনার কোন আত্মীয়ের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের উপর ওয়াজিব? তিনি (e) বললেন, আলী, ফাতিমা এবং তাদের দুই পুত্র সন্তান (হাসান-হুসাইন)। (আল মু’জামুল কাবীর লিত-তাবারানী, হাদীস-২৬৪১, মাজমাউয যাওয়াইদ, খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা: ১০৩)
উসামাহ ইবন যাইদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ e ইরশাদ করেন, এরা দুইজন (হাসান ও হুসাইন) আমার পুত্র এবং আমার কন্যার পুত্র। হে আল্লাহ! আমি এদের দুইজনকে ভালোবাসি, সুতরাং আপনিও তাদেরকে ভালোবাসুন এবং যে এদেরকে ভালোবাসবে, আপনি তাদেরকেও ভালোবাসুন। (সুনান আত তিরমিযী, হা-৩৭৬৮)
হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) বলেন, আমি নবী e কে হাসান-হুসাইন (রা.) সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে তার উপর এরা দু’জনকে (হাসান-হুসাইন) ভালোবাসা ওয়াজিব। (মাজমাউয যাওয়াইদ, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা: ১৮০)
হযরত যর বিন জাইশ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ e বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে তার উপর এরা দুজনকে (হাসান-হুসাইন) ভালোবাসা ওয়াজিব। (মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবা, হাদীস-৩২১৭৪, বাইহাকী, হাদীস-৩২৩৭)
হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম e বলেছেন, যে ব্যক্তি হাসান-হুসাইনকে ভালোবেসেছে, সে বাস্তবে আমাকেই ভালোবেসেছে। (সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং-১৪৩,সুনান আন নাসাঈ, হাদীস-৮১৬১, মুসনাদ আহমদ ইবন হাম্বল, হাদীস-৭৮৬৩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী e হাসান-হুসাইন (রা.) সম্পর্কে বলেছেন, যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালোবেসেছে, সে আমাকেই ভালোবেসেছে। (বাযযার, হাদীস-১৮২০, মাজমাউয যাওয়াইদ, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা: ১৮০, সিফাতুস সাফওয়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ৭৬৩)
হযরত আলী ইবন আবূ তালিব (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করীম e হাসান-হুসাইনের হাত ধরে বললেন, যে ব্যক্তি আমাকে এবং এই দু’জনকে ভালোবাসবে, সাথে সাথে তাদের পিতা-মাতাকেও ভালোবাসবে, সে কিয়ামতের দিন আমার স্থানে আমার সাথেই থাকবে। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৭৩৩, মুসনাদ আহমদ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৭৭)
হযরত আলী ইবন আবূ তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম e বলেছেন, আমি, ফাতিমা ও হাসান-হুসাইনকে যে ভালোবাসে, কিয়ামাতের দিন আমরা সকলে এক জায়গায় একত্রিত হবো। আমাদের খাওয়া-দাওয়াও একসাথে হবে। যতক্ষণ না (হিসাব-কিতাবের পরে) মানুষদেরকে পৃথক করে দেওয়া হবে। (তাবারানী, মুজামুল কাবীর, হাদীস-২৬২৩, মাজমাউয যাওয়াইদ, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-১৭৪)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম e বলেছেন, আমি বৃক্ষ আর ফাতিমা সেই বৃক্ষের ডালস্বরূপ। আলী সেই বৃক্ষের প্রস্ফুটিত পাপড়ি এবং হাসান-হুসাইন হলেন সেই বৃক্ষের ফল। আর যারা আহলুল বাইতকে ভালোবাসে, তারা এই বৃক্ষের পাতা, এরা সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটি দিবালোকের ন্যায় সত্য কথা। (দাইলামী, আল ফিরদাউস, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৫২)
আবূ হাযিম বর্ণনা করেন, আমি হাসান (রা.) এর শাহাদাতের সময় হুসাইন (রা.) এর পাশে উপস্থিত ছিলাম। তিনি সাঈদ বিন আল আস (রা.) এর ঘাড় ধরে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, (জানাযার নামায পড়ানোর জন্য) সামনে অগ্রসর হও। এটি রাসূলুল্লাহ e এর আদর্শ না হলে আমি আপনাকে সামনে ঠেলে দিতাম না। সে সময় হযরত সাঈদ (রা.) ছিলেন মদীনার আমীর। সকলে যখন জানাযার নামায আদায় করে নিল, তখন হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) দাঁড়ালেন, অতঃপর বললেন,তোমরা নবী করীম e এর সন্তানকে মাটিতে দাফন করার দিকে ঝুঁকে পড়ছো, অথচ আমি রাসূলুল্লাহ eকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি হাসান (রা.) কে ভালোবাসলো, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকেই ভালোবাসলো। (মুসান্নাফু ইবন আব্দুর রাযযাক, হাদীস-৬৩৬৯, মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস-৪৭৯৯, তাহযীবুত তাহযীব, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২২৬)
হযরত সালমান ফারসী (রা.) বর্ণনা করেন, আমি নবী করীম e কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি হাসান-হুসাইন (রা.) কে ভালোবাসবে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন। আর যাকে আল্লাহ ভালোবাসবেন, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস-৪৭৭৬)
হযরত সালমান ফারসী (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ e হযরত হাসান-হুসাইন (রা.) সম্পর্কে বলেন, যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালোবাসবে, তাকে আমি ভালোবাসবো, আর যাকে আমি ভালোবাসবো, আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন, আর যাকে আল্লাহ ভালোবাসবেন তাকে তিনি নিআমতপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, খণ্ড-২৬, পৃষ্ঠা: ৫৫, মাজমাউয যাওয়াইদ, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা: ১৮১)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ বকর (রা.) বলেন, মুহাম্মাদ e এর সন্তুষ্টি তাঁর পরিবারবর্গের (প্রতি সদাচরণের) মাধ্যমে অর্জন কর। (সহীহ বুখারী,হাদীস-৩৭৫১)
হযরত হাসান ও হুসাইন (রা.) কে রাসূলুল্লাহ e এর সন্তান বলা হয়
হযরত হাসান ও হুসাইন (রা.) রাসূলুল্লাহ e এর মেয়ের সন্তান হলেও বিভিন্ন হাদীস শরীফে পাওয়া যায়, তিনি তাদেরকে তাঁর নিজের সন্তান বলেছেন। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস নিম্নে তুলে ধরা হলো-
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি দেখেছি, নবী করীম e হযরত হাসান-হুসাইন (রা.) এর হাত ধরে বলেছেন, এরা আমার ছেলে। (সিয়ারু আলামীন নুবালা, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ২৮৪; দাইলামী, আল ফিরদাউস, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা: ৩৩৬; সিফাতুস সাফওয়া, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ৭৬৩)
হযরত ফাতিমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী করীম e আমার ঘরে এসে বললেন, আমার ছেলে দুটি কোথায়? আমি বললাম, হযরত আলী (রা.) তাদেরকে সাথে নিয়ে গেছেন। রাসূল e তাদেরকে খুঁজতে বের হলেন। খুঁজতে খুঁজতে একটি নহরে তাদের সন্ধান পেলেন, সেখানে তাঁরা খেলছিলেন। তাদের সামনে কিছু খেজুর পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখা গেল। তিনি বললেন, হে আলী! দেখো, রোদের তাপ বেড়ে যাওয়ার আগেই আমার ছেলেদ্বয়কে নিয়ে এসো। (মুসতাদরাক হাকিম, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ১৮০)
হযরত উম্মু সালামা (রা.) হতে বর্ণিত, একদা নবী করীম e হযরত ফাতিমা, হযরত আলী, হাসান ও হুসাইন (রা.) কে একত্রিত করলেন এবং তাদেরকে একটি কাপড়ে আবৃত করে নিলেন। অতঃপর বললেন, হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত। (তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর,খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ৫৩; মুসতাদরাক হাকিম, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ১৫৮; তাফসীরু ইবন কাসীর, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ৪৮৬)
হযরত সাআদ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, যখন ‘মুবাহালা’ (একে অপরকে অভিসম্পাদন করা) এর আয়াত فَقُلْ تعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ –“আপনি বলে দিন, এসো! আমরা আমাদের সন্তানদেরকে ডাকছি, আর তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে ডাকো” অবতীর্ণ হলো, তখন নবী করীম e হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান এবং হুসাইন (রা.) কে ডাকলেন। অতঃপর বললেন, হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৪০৪; সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-২৯৯৯)
হযরত হাসান ও হুসাইন (রা.) এর সাথে বিদ্বেষের পরিণাম
উত্তর: হযরত হাসান ও হুসাইন (রা.) এর সাথে বিদ্বেষের পরিণাম কী হতে পারে- এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস নিম্নে তুলে ধরা হলো:
হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ e বলেছেন, যে ব্যক্তি হাসান ও হুসাইনের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল, সে আমার সাথেই বিদ্বেষ পোষণ করল। (সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-১৪৩; সুনান আন নাসাঈ, হাদীস-৮১৬৮)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ e বলেছেন, যে ব্যক্তি হাসান-হুসাইনের সাথে শত্রুতা পোষণ করল, সে আমার সাথেই শত্রুতা পোষণ করল। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ২৮৪)
হযরত সালমান ফারসী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম eকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি হাসান-হুসাইনের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল, সে আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল, আর যে আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবে, তার সাথে আল্লাহ বিদ্বেষ পোষণ করবেন। আর আল্লাহ যার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবেন, তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। (মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস-৪৭৭৬)
হযরত যাইদ ইবন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম e হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, হযরত হাসান এবং হযরত হুসাইন (রা.) এই চারজনকে বললেন, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে, আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব, আর যারা তোমাদের সাথে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সাথে সন্ধি করব। (তিরমিযী, হাদীস-৩৮৭০; নাসাঈ, হাদীস-১৪৫; মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ, হাদীস-৩২১৮১; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস-৪৭১৪; তাবারানী, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা: ৪০; সিয়ারু আলামীন নুবালা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা: ১২৫)
অনুরূপ হাদীস সহীহ ইবন হিব্বানসহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ e হযরত আলী, হযরত ফাতিমা, হযরত হাসান এবং হযরত হুসাইন (রা.) এর দিকে তাকিয়ে বললেন, যে তোমাদের সাথে লড়বে, আমি তাদের সাথে লড়বো, আর যে তোমাদের সাথে সন্ধি করবে, আমি তার সাথে সন্ধি করব। (অর্থাৎ যারা তোমাদের দুশমন, তারা আমার দুশমন। আর যারা তোমাদের বন্ধু, তারা আমারও বন্ধু।) (মুসনাদ আহমদ ইবন হাম্বল, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৪২; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস-৪৭১৩; তাবারানী, মুজামুল কাবীর, হাদীস-২৬২১; সিয়ারু আলামীন নুবালা, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-২৫৭)