অসীম প্রশংসা রাব্বুল আলামীনের। হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা রাহমাতুল্লিল আলামীনের মর্যাদা দান করে উম্মতকে বিশ্বের সকল দুঃখী মানুষের খিদমত গুজারের মন-মানসিকতা ও চেতনা দান করেছেন। অগণিত সালাত সালাম রাহমাতুল্লিল আলামীনের উদ্দেশ্যে।
যে সকল পবিত্র বাণী পাঠ করে আমি অসহায় অন্ধ ও আতুর মানুষের সাথে আমার ও আপনাদের সম্পর্ক স্থাপন করার প্রচেষ্টায় ব্রত হয়েছি; তার কিছু আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
হাদীসে কুদসী- হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি, তিনি বলেন- নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বলেন, যখন আমি আমার কোন বান্দার দুটি চোখ বিপদগ্রস্ত করি (অর্থাৎ- অন্ধ হয়ে যায়) এবং সে সবর করে, তার দুটি চোখের বদলে আমি তাকে জান্নাত দান করি। (বুখারী শরীফ)
উল্লিখিত পবিত্র হাদীসে কুদসীর আলোকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, ধৈর্যশীল অন্ধ মুসলমান বান্দাকে আল্লাহ তাআলা জান্নাতের আশ্বাস দিয়েছেন। এখন আমরা তাদের সেবা যত্ন ও দুঃখ লাঘব করার চেষ্টায় অধিক উৎসাহিত হই এ জন্য যে, ঐ লোকটিকে আল্লাহ তাআলা জান্নাতের আশা দিয়েছেন।
আমরা যে সকল গরীব-মিসকীন অন্ধদের সাহায্য করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি, তারা সকলেই যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত মিসকীন। তাদের মধ্যে অনেক বিধবা, অন্ধ ও মিসকীন মহিলাও আছেন।
মিসকীন ও স্বামীহারা মহিলাদের সেবা যারা করেন, তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন “স্বামীহারা মহিলা ও মিসকীনদের জন্য প্রচেষ্টাকারী (অর্থাৎ তাদের খিদমতকারী) আল্লাহর পথে জিহাদকারীর ন্যায়। সারাদিন যে রোযা রাখল, সারারাত্রি যে ইবাদত করল তার সমতুল্য।”
প্রকাশ থাকে যে, সঠিক জিহাদের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। কিন্তু যারা মিসকীন ও স্বামীহারা বিধবাদের সেবা করে তাদের আল্লাহর পথে জিহাদকারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। সর্বদা যারা রোযা রাখেন, সমস্ত রাত্রি ইবাদতে অতিবাহিত করেন তাদের সংখ্যা যেমন বিরল তাদের মর্যাদাও তেমন উন্নত। কিন্তু মিসকীন ও স্বামীহারা বিধবাদের সাহায্যকারীগণকে এমন মহৎ ব্যক্তিগণের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
৬০-৭০ বছর কাল অন্ধের জীবনে রাত আসে। রাতের শেষে প্রভাতী তারা উদিত হয়। সূর্যের সোনালি আভায় উজ্জ্বল হয় পথ ও প্রান্তর। কিন্তু অন্ধের জীবনের কালনিশী আরো দীর্ঘায়িত হয়। তমসাচ্ছন্ন দুঃখপূর্ণ জীবনের পথ যেন শেষ হতে চায় না। ৬০-৭০ বছরের অন্ধ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জীবনের দুঃখের কাহিনী কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
এ বিশাল পৃথিবীতে এমন একজন অন্ধ মানুষ রাহমাতুল্লিল আলামীনের উম্মতের নিকট তেমন কিছু চায় না। শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্য সামান্য খাদ্য, শীত-বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ছোট্ট একখানা ঘর, বারো মাসে কমপক্ষে এক প্রস্থ কাপড় তারা চায়।
নয়নের আলো নিভিয়া গেল
চেনা জানা এ পৃথিবী আর দেখিব না।
এ ভবের মায়া যেন এক ছায়া
ছায়া দেখে এ জীবনে আর কাঁদিব না।
পাখি তুমি খাঁচা ছাড়ি শূন্য লোকে দিবে পাড়ি
দেহের পিঁজরে পাখি আর কাঁদিও না।
অন্ধ সাহায্য প্রকল্প শুরু হয় ২০০০ সালের আগস্ট মাসে। তার এক বছর পর শুরু হয় আতুর সাহায্য প্রকল্প। ২০০১ সালের ১৮ জুন মনের আবেগে শোকে দুঃখে জর্জরিত এক অবহেলিত গ্রামের কর্দমাক্ত পথ অতিক্রম করতে গিয়ে পতিত হয়ে ডান হাতখানা ভেঙ্গে ফেললাম। পথ থেকে উদ্ধার করে যারা আমাকে নিয়ে এসেছিলেন তাদের শুকরিয়া আদায় করার ভাষা এখনও খুঁজে পাই না। ঘর ছাড়লাম, অ্যাম্বুলেন্সে আরোহণ করে দেখলাম আমার পুত্র, কন্যাসহ বাড়ির সকল সজল নয়নে দাঁড়িয়ে আছেন। ভিড়ের মাঝখান থেকে শুনলাম শিশুকণ্ঠের ফরিয়াদ, আব্বা-আব্বা। তার পরে দেখলাম আমার শিশু পুত্রটিকে কে একজন কোলে তুলে নিয়ে শাড়ির আঁচলে তার অশ্রু ভেজা কচি মুখখানা মুছে দিলেন। অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাঁজিয়ে বিদায় অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করল। প্রাণপ্রিয় পল্লী পিছনে পড়ে রইল। আমার জীবনতরীর কাণ্ডারিকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আমি কি গোরের কাফন পরে ঘরে প্রত্যাবর্তন করব? না জীবিত অবস্থায়?
মনে হলো কালের অ্যাম্বুলেন্স আমার মত কত ব্যথিত আহত মানুষকে আপনজন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক অজানা মঞ্জিলের পথে অগ্রসর হচ্ছে। কেউ আবার ঘরে ফিরে আসছে পঙ্গু হয়ে আবার কেউ কাফনে ঢাকা লাশ হয়ে।
আমার যখন দুর্ঘটনা হয় তখন আমার মহতরম ওয়ালিদ ছাহেব বাংলাদেশের বাইরে ছিলেন। ফোনে আলাপ করলেন। অনেকক্ষণ কাঁদলেন। জানতে পারলাম, তিনি হারামাইন শরীফ, সিরিয়া, জর্ডান ও ইউরোপ সফরকালে সবখানে আমার মতো এক অধম পুত্রের জন্য দুআ করেছেন। নির্জনবাসে অবস্থানকারী আমার ‘মা’ তার ছেলের জন্য রাব্বে কারীমের দরবারে নয়নজল আমানত রাখেন। মা ও বাবার দুআয় সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলাম।
বাংলাদেশের কোনো গরীব পল্লীবাসী যখন আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গু হয় তখন তার অসহায় পরিবার পরিজনের প্রতি যে মহৎপ্রাণ ব্যক্তিগণ সহানুভূতি প্রকাশ করেন তাদের সংখ্যা অতি অল্প। লোকটির বাড়ি অমুক পঙ্গু বা আতুরের বাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। বিত্তশালী দানশীল শহরবাসী ব্যক্তিদের পক্ষে গ্রাম বাংলার দুর্গম পথ অতিক্রম করে পল্লীবাসী আতুরের গৃহ দর্শন সম্ভবপর হয় না। গরীব পথচারী আতুরের বাড়ির পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করার সময় আল্লাহ তাআলার কাছে তার মঙ্গল কামনা করেন। প্রতিবেশীদের অনেকে অনেক সময় সামান্য সাহায্যও করেন।
চেনা জানা লোকালয়
বহু দূর মনে হয়
বিকল চরণে আমি চলিতে পারি না।
পিতার ভিটার মায়া
গ্রামের শ্যামল ছায়া
বাঁধিয়া রাখিল মোরে মায়ার ডোরে।
আমার মরণ পরে
দয়াময় দয়া করে
রাখিও অনাথদেরে তোমার নজরে।
রোজগারের উপকরণ: অন্ধ, আতুর ও মিসকিন ফকিরদের সেবাকর্মের একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে সক্ষম ব্যক্তিকে রোজগারের উপকরণ দান করা অথবা ব্যবসার ব্যবস্থা করা। আলহামদুলিল্লাহ! আমরা এই উদ্দেশ্যে ক্রমশ প্রচেষ্টা শুরু করি। যাদের স্ত্রী পুত্র কন্যা বাঁশ বেতের কাজ করতে পারেন তাদের বাঁশ খরিদ করে দেওয়া, যারা পাটি প্রস্তুত করতে পারেন তাদেরকে মূর্তা খরিদ করে দেওয়া, যারা হাঁস-মোরগ পালন করতে পারেন তাদেরকে হাঁস-মোরগ খরিদ করে দেওয়া ইত্যাদি। আমাদের নগণ্য চেষ্টা প্রচেষ্টা মুসলিম হ্যান্ডস সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ সংস্থা অন্ধ, আতুর ও বিধবা এতীম পরিবারকে ৯২টি দোকান তৈরী করে দিয়ে পুঁজি দান করেছে। ফলে তারা ভিক্ষাবৃত্তি সম্পূর্ণ ত্যাগ করে ব্যবসা করছেন। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এমন অনেক মিসকিন পরিবার আছে যারা রোজগার করতে চায়; কিন্তু উপকরণ না থাকায় রোজগার করতে পারে না। অন্ধ, আতুর ছাড়াও এমন অনেক মিসকিন দিনমজুর আছেন যারা ভিক্ষা না করে হালাল রোজগার করতে চান; কিন্তু রোজগারের উপকরণ না থাকায় অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিকে কাজ করেন। যেমন-
ঠেলা: একজন ঠেলাওয়ালা ৩-৪ জনের পরিবারের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা ঠেলা দ্বারা করতে পারেন।
সেলাই মেশিন: সেলাই শিক্ষা করেছেন এমন এতীম মেয়েকে একটি সেলাই মেশিন দান করলে কমপক্ষে পরিবারের দুই জনের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হয়।
ছোট নৌকা: ছোট নৌকা হাওর অঞ্চলে নদীর তীরে বসবাসকারী মিসকিন নৌকায় বর্ষা মৌসুমে মাছ শিকার, খেয়া পারাপার, মাল পরিবহন করে ৫/৬ জনের পরিবার পরিচালনা করতে পারেন।
বাংলাদেশের সীমান্ত: পাহাড়ি এলাকার লোকেরা পাথর ও কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করেন। কুড়াল, সাবল ও করাত তাদের জন্য উত্তম রোজগারের উপকরণ। মাটি কাটার একটি কুদাল দিয়ে মাটি কেটে পরিবার পরিচালনা করেন তাদের জন্য কুদাল একটি উত্তম উপকরণ।
জাল: বর্ষা মৌসুমে জাল রোজগারের উত্তম একটি উপকরণ। আমরা এমন কয়েকটি পরিবারকে জাল, নৌকা, ঠেলা, গাছ কাটার করাত, সেলাই মেশিন, দা, কুড়াল, কুদাল, সাবল ইত্যাদি দান করে দেখলাম অন্যের কাছে হাত পাততে হয় না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসকীন ফকীরদের মধ্যে যারা অক্ষম অর্থাৎ কোনো কর্ম করতে পারেনা তাদের খাদ্য দান করা ও খিদমত করার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে যারা সক্ষম অর্থাৎ কোনো কাজ করতে সক্ষম, তাদেরকে অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজে পরিশ্রম করে উপার্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের রোজগারের উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীসের তরজমা নিম্নে উদ্ধৃত করলাম- হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক আনসার ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উপস্থিত হয়ে সাওয়াল করলেন, তিনি বললেন, “তোমার ঘরে কোনো জিনিস আছে কি? (আনসার) নিবেদন করলেন, হ্যাঁ আছে, এক খ- কাপড় যে কাপড়ের একাংশ উপরে এবং এক অংশ নিচে বিছাই। আর একটি পিয়ালা আমি পানি পান করি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দুটি জিনিস নিয়ে এসো। (নির্দেশমত) ঐ ব্যক্তি দুটি জিনিস নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিনিস দুটি হাতে তুলে নিয়ে বললেন- কে খরিদ করবে এ দুটি জিনিস? এক ব্যক্তি বললেন আমি এক দিরহামের বিনিময়ে জিনিস দুটি গ্রহণ করব। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইবার বা তিনবার বললেন কেউ কি এক দিরহামের অধিক দিতে পারবে।” তখন অন্য ব্যক্তি বললেন, আমি দুই দিরহাম দিতে পারব। তখন ঐ ব্যক্তিকে জিনিস দুটি দিয়ে দুটি দিরহাম গ্রহণ করলেন এবং আনসার কে দিয়ে বললেন, তুমি এক দিরহামের খাদ্য দ্রব্য খরিদ করে তোমার পরিবার পরিজনকে দাও আর এক দিরহাম দ্বারা তুমি কুড়াল খরিদ করে আমার নিকট নিয়ে এসো।
নির্দেশমত আনসারী কাজ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুড়ালখানায় নিজ হাতে কাঠের বাট বা হাতল লাগিয়ে দিয়ে বললেন, কাঠ সংগ্রহ করে বিক্রয় করো। পনের দিন যেন তোমাকে না দেখি। (অর্থাৎ ১৫ দিন একাধারে কাঠের ব্যবসা করো) ঐ ব্যক্তি নির্দেশমত কাঠ এনে বিক্রয় শুরু করলেন। তারপর দশ দিরহাম উপার্জন করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ দ্বারা কিছু খাদ্য ও কিছু বস্ত্র খরিদ করো। ইহা তোমার জন্য সাওয়ালের উদ্দেশ্যে আসার চেয়ে উত্তম।
বড় অবহেলা ভরে যৌবনের দিনগুলি শেষ করেছি। এখন আমি বৃদ্ধ; কিন্তু অন্ধ, আতুর, এতীমদের দুঃখের আলয় দর্শনের অভিলাষে আমাকে যুবকের শক্তি দান করে। আমার আত্মার আত্মীয় অন্ধ, আতুর, এতীম ও বিধবার একটি বিরাট শোক মিছিলে আত্মগোপন করতে চাই। এ কাফেলায় সবচেয়ে অসহায় মানুষরূপে আমার আমিত্মকে বিসর্জন দিতে চাই।
হয়তো আমার এ পৃথিবী থেকে বিদায়ের শেষ মিছিলে দুএকজন অন্ধ, আতুর ও এতীম অংশগ্রহণ করবে। কম্পিত হাতে হয়তো বা কোন অন্ধ ও আতুর আমার কবরের বুকে তার নয়নজলে সিক্ত একমুঠো মাটি রাখবে। হয়তো কোন এতীম তার কচি হাতে আমার এতীম ছেলেদের সাথে আমার কবরের বুকে তার নিষ্পাপ চোখের জলে সিক্ত এক মুঠি মাটি রাখবে।
জানিনা কখন হবে জনমের ইতি
তাই মাটিতে ছড়ায়ে দেই একমুঠো প্রীতি।