1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
একটি ‘ইসলামী’ সংগঠনের রাজনীতির স্বরূপ; এমসি কলেজ প্রসঙ্গ
হামিদ মাশহুর
  • ৫ মার্চ, ২০২৫

গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি সিলেটের এমসি কলেজে তালামীযে ইসলামিয়ার কর্মী মিজানুর রহমান রিয়াদের উপর হামলা চালায় ছাত্র শিবিরের একদল কর্মী। রিয়াদকে রড দিয়ে পিটিয়ে আহত করে ইসলামী রাজনীতির কথা বলা এই দলটি। এই হামলার পুরো ঘটনাপ্রবাহ এদেশে ইসলামী রাজনীতির সকল সমর্থককে নিদারুণ পীড়া দিয়ে যাচ্ছে; শংকিত করছে ভবিষ্যত বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের অবস্থান সম্পর্কেও। ইসলামী রাজনীতির সাথে অন্য রাজনীতির একটি পার্থক্য বোধহয় এটা যে, ইসলামপন্থীরা স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজেদের মূল্যবোধ বিসর্জন দেয় না, মিথ্যার আশ্রয় নেয় না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে তা কি আদৌ সত্যি? ইসলামী ছাত্র শিবির যে কৌশলের রাজনীতি করছে তা কি আদৌ ইসলামপন্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিকভাবেই অনেক চিন্তকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এমসি কলেজের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার যে ওয়াদা ইসলামী সংগঠনগুলো মৌলিক বুনিয়াদ এই ওয়াদা তো কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে নয়। বরং এই ওয়াদা সে মহান রবের প্রতি যিনি কিয়ামতের দিন আমাদের সবার বিচার করবেন। এমসি কলেজে তালামীযে ইসলামিয়ার নেতা রিয়াদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্র শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা যে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের আশ্রয় নিলেন তাতে করে যে কারো মনে হতেই পারে যে সংগঠনটি ইসলামী আদর্শের যে কথা সর্বত্র বলে বেড়ায় আদতে তাদের কার্যক্রমের সাথে এর তেমন কোন মিল নেই। যারা এই ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা প্রথম থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা নিশ্চিত লক্ষ্য করেছেন ছাত্র শিবির ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়িয়েছে। যখন নির্যাতিত তালামীয নেতা রিয়াদ জানালেন তাকে ছাত্র শিবিরের ছেলেরা নির্যাতন করেছে তখন শিবিরের সিলেটসহ কেন্দ্রীয় পর্যায়ের প্রায় সকল কর্মী ও বুদ্ধিজীবী গুজব ছড়ানো শুরু করেন ঘটনাটি মূলত নারীঘটিত। একজন নারীকে নিয়ে রিয়াদের সাথে অন্য এক শিক্ষার্থীর দ্বন্দ্বের জের ধরে ওই শিক্ষার্থী রিয়াদকে নির্যাতন করে।” শিবিরের এই অপতথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি অন্য কোনো ইসলামী সংগঠনের নেতা বা কর্মীর হুরমত তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। তালামীয নেতা রিয়াদ টুপি-পাঞ্জাবি পরা দাড়িওয়ালা এক যুবক যার অবয়বে সুন্নতে নববীর অনুসরণ স্পষ্ট। এরকম একজনকে নারীঘটিত কোন কিছুর অপবাদ দিয়ে শিবির স্পষ্ট করেছে যে তারা নিজের বিরোধী হলে সুন্নতী লেবাসকে নিয়ে উপহাসে লিপ্ত হতেও দ্বিধা করবে না। শিবির এই কাজটি করেছিল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে। তারা জানতো যে এরকম “হুজুর টাইপ” একজনের উপর নারী ঘটিত অপবাদ ছড়িয়ে দিলে রাম ও বামপন্থী মিডিয়া এগুলো ব্যাপক প্রচার করবে, ফলে আসল ঘটনা ধামাচাপা পড়বে। অর্থাৎ নিজেদের আত্মরক্ষার্থে শিবির ইসলামফোবিকদেরকে ইসলামপন্থীদের নিয়ে উপহাস করার সুযোগ তৈরি করে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না।

তালামীযে ইসলামিয়া এবং অন্যান্য সংগঠনগুলোর ব্যাপক  অনলাইন এক্টিভিজমের ফলে যখন এই নোংরা অপবাদ মিথ্যা বলে প্রতিষ্ঠিত হলো তখন ছাত্র শিবির নতুন অপবাদ আরোপ করলো নির্যাতিত রিয়াদ ছাত্রলীগের কাছে তথ্য পাচার করতেন বলে। এই অপবাদের জবাবে বেরিয়ে এলো জুলাই অভ্যুত্থানে রিয়াদের বীরোচিত অংশগ্রহণের গল্প, জানা গেলো জুলাইয়ের ছত্রিশ দিন সিলেটে আন্দোলনে সরব ছিলেন রিয়াদ, এমনকি পুলিশি হামলায় আহতও হন তিনি।

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী মূল ছাত্রনেতাদের কেউই তাদের ছাত্র শিবিরের সাথে যুক্ত না থাকলেও বিজয়ের পর থেকেই শিবির নানাভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করছে যে এই অভ্যুত্থানে তারাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। জুলাই আন্দোলনে নিজেদের হিস্যা আদায়ে সরব ছাত্র শিবির যখন এই আন্দোলনে আহত একজন কর্মীকে ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ততার অপবাদ দেয় তখন বুঝা যায় কোন ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলনে অন্যান্য সংগঠন (এমনকি ইসলামী সংগঠনগুলোও) কেন ছাত্র শিবিরকে সম্পৃক্ত করতে দ্বিধান্বিত হয়। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্দোলনের সহযাত্রীদেরকে এভাবে ট্যাগ দেওয়া সংগঠন হিসেবে ছাত্র শিবিরকে একটি বিপজ্জনক এবং অবিশ্বস্ত দল হিসেবে সবার মাঝে উপস্থাপন করে। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নির্যাতনে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে তুলপাড় চলছে তাও বেশ প্রাসঙ্গিক। ছাত্র শিবিরের সাথে জড়িত না থাকলেও আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয় শিবির অপবাদ দিয়ে। সুতরাং প্রত্যাশিত ছিল যে ছাত্র শিবির আবরার ফাহাদের স্মৃতির প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা দেখাবে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী স্পিরিটকে সমুন্নত রাখবে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম ছাত্র শিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিশির মনির হাইকোর্টে আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের পক্ষে ডিফেন্স লয়ার হিসেবে কাজ করছেন। আরোও লজ্জার বিষয় শিশির মনিরকে তার দল আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী হিসেবেও বিবেচনা করছে।

রিয়াদের উপরে হামলার ঘটনার পরবর্তী আটচল্লিশ ঘণ্টায় শিবির একে একে আটটি গুজব ছড়ায়। শিবিরের কর্মীরা নিজেদেরকে অতি মেধাবী দাবি করলেও এমসি কলেজে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় তারা ধূর্তামি করে কূল পায়নি। রাতে শিবির দায়ী নয়, সকালে নারীঘটিত, দুপুরে দুইপক্ষের মারামারি, রাতে হাসপাতাল থেকে আহত রিয়াদ পালিয়েছে, এরকম সিরিজ মিথ্যাচার প্রচার করতে থাকে। পরদিন অপচিকিৎসা দেওয়ার গুজব হাজির করে। মজাদার বিষয় হলো, হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে- বলার ঘণ্টাদুয়েক পরে মহানগর শিবির নেতৃবৃন্দ রিয়াদকে দেখে আসেন। সর্বশেষ ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে এই ঘটনায় শিবিরের সম্পৃক্ততা যখন পুরোপুরি অস্বীকার করেন তার মাত্র দুই ঘণ্টা পরেই সিলেট মহানগর ও জেলা জামায়াতের নেতৃবৃন্দ এই ঘটনায় শিবিরের জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেন। এতে করে অনলাইনে অফলাইনে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়, নির্যাতিত রিয়াদের সংগঠন তালামীযে ইসলামিয়া এবং আল ইসলাহ নেতৃবৃন্দও সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সিলেট মহানগর ছাত্র শিবির পুনরায় এই হামলার ঘটনা অস্বীকার করে মহানগর জামায়াতের আমীরের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় এবং তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে। মূল সংগঠন এবং ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মুখোমুখি অবস্থান পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনে হাসির খোরাক জোগায়। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে শিবিরের এমন প্রকাশ্য অবস্থান দল দুটির চেইন অব কমান্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এমনকি সিলেট মহানগর শিবিরের কর্মীরা, জেলা জামায়াত নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে।

শিবিরের এমসি কলেজ সেক্রেটারিকে জামায়াত নেতা লুকমান আহমদের ছেলে উল্লেখ করে শিবিরের কেউ নয় বলে অস্বীকার করে। সেক্রেটারি যদি সংগঠনের কিছু না হয় তবে কি দলের সবকিছুই অন্তরালে।

এমসি কলেজের এই ঘটনায় ছাত্র শিবিরের রাজনীতির গুমর নতুন করে ফাঁস করে দিয়েছে বলাই বাহুল্য। এর থেকে বড় বিষয় হলো এ ঘটনা জাতির সামনে প্রকাশ করে দিয়েছে ছাত্র শিবিরের দুর্বৃত্তায়নের সামনে জামায়াতে ইসলামী কতোটা অসহায়। অনেকেই বলেন ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তায়নের লাগাম আওয়ামিলীগের হাতে ছিলো, কিন্তু ছাত্র শিবিরের দুর্বৃত্তায়নের লাগাম জামায়াতের হাতে নেই।ছাত্র শিবিরকে যদি জামায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তবে  তাদের ভোটের রাজনীতি তো ভেস্তে যাবেই, নানামুখী বিভাজন এবং কাদা ছুড়াছুঁড়ি বাড়বে এদেশের ইসলামী রাজনৈতিক পরিমন্ডলে; এমনকি হুমকি তৈরি হবে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায়ও। শিবিরের এমন আগ্রাসী কার্যক্রম এবং তথ্য সন্ত্রাসের দায় জামায়াতকেই নিতে হবে; তাদেরকেই আটকাতে হবে।

ফেইসবুকে আমরা...