Logo
দুরূদ শরীফের গুরুত্ব ও ফদীলত
মুহাম্মদ হবিবুর রহমান
  • ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

প্রিয়নবী সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ  এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ মুমিনের জন্য অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে দুরূদ পাঠের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। এছাড়াও হাদীস শরীফে দুরূদ শরীফ পঠের অসংখ্য ফদীলত বর্ণিত আছে। আলোচ্য প্রবন্ধে দুরূদ শরীফ পাঠের কয়েকটি ফদীলতের আলোচনা করার চেষ্টা করব।
দুরূদ শরীফ পাঠ করার গুরুত্ব
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন—
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাঁর উপর দুরূদ পাঠ কর এবং পরিপূর্ণ সালাম পেশ কর।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূলে কারীম —এর উপর সালাত তথা দুরূদ শরীফ পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন। এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী (র.) লিখেছেন— হযরত ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা নবীর উপর সালাত পেশ করেন অর্থ হলো তিনি নবী করীম —এর প্রতি রহমত বর্ষিত করেন। আর ফিরিশতাদের সালাত পেশ করার অর্থ তাঁরা রাসূল —এর জন্য দুআ করেন। হযরত ইবন আব্বাস (রা.) আরো বলেন, ফিরিশতাদের সালাত পেশ অর্থ তারা বরকতের জন্য দুআ করেন।
আবুল আলিয়্যাহ বলেন, আল্লাহর সালাত অর্থ তিনি ফিরিশতাদের সামনে রাসূল —এর প্রশংসা করেন। আর ফিরিশতাদের সালাত হলো দুআ করা।
আল্লামা পানিপথী (র.) আরো বলেন, মানুষের প্রতি রাসূল —এর উপর সালাত পেশ করার নির্দেশের অর্থ হচ্ছে ‘তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য দুআ কর এবং তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর যেন তিনি রাসূল —এর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন। (তিনি বলেন,) এ আয়াত থেকে রাসূলুল্লাহ —এর উপর সালাত পেশ করা জীবনে একবার হলেও ওয়াজিব হওয়া প্রমাণ করে। ইমাম আবূ হানীফা (র.) ও ইমাম মালিক (র.) মতও হচ্ছে এটি। আর নামাযের তাশাহহুদে দুরূদ শরীফ পাঠ করা আহনাফের মতে ওয়াজিব।
এ আয়াতের তাফসীরে রূহুল বয়ান গ্রন্থকার বলেন, কোনো কোনো উলামায়ে কিরামের মতে এখানে আল্লাহর সালাত পেশ করার অর্থ হলো রাসূল কে মাকামে মাহমুদে পৌঁছে দেওয়া। আর এটি হচ্ছে মাকামে শাফাআত। ফিরিশতাদের সালাতের অর্থ হচ্ছে রাসূল  এর শান বৃদ্ধির জন্য দুআ করা এবং তাঁর উম্মতের জন্য ইস্তিগফার করা। আর মানুষের প্রতি সালাত পেশ করার নির্দেশ হচ্ছে হুযূরে আকদ্দস  এর অনুসরণ, তাঁকে মহব্বত করা এবং তাঁর সুমহান গুণাবলির আলোচনা করা ও তাঁর তা’রীফ করা।
হাদীস শরীফে দুরূদ শরীফ পাঠের গুরুত্ব:
কোনো কোনো উলামায়ে কিরামের মতে রাসূল  এর নাম শুনে তাঁর উপর দুরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। তাঁরা তাঁদের স্বপক্ষে নিম্নোক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা দলীল পেশ করেন।
১. তিরমিযী ও ইবন হিব্বানে হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত হাদীস, রাসূল  ইরশাদ করেন—
رغم انف رجل ذكرت عنده فلم يصل علىّ
অর্থাৎ সেই ব্যক্তির নাক ধুলামলিন হোক যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আমার উপর দুরূদ পাঠ করল না।
২. তাবারানী শরীফে আছে, হযরত জাবির বিন সামূরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল  ইরশাদ করেন—
من ذكرت عنده فلم يصلّ علىّ فدخل النار فابعده الله عزّ وجلّ
অর্থাৎ যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হলো অথচ সে আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করল না, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাঁকে (রহমত থেকে) দূরে সরিয়ে দিবেন।
৩. তাবরানী শরীফে অন্য এক বর্ণনায় আছে হযরত ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল  ইরশাদ করেন—
أتاني جبرئيل من ذكرت عنده فلم يصل عليك فدخل النار فابعده الله عز وجل
অর্থাৎ জিবরাঈল (আ.) আমার কাছে আগমন করলেন এবং বললেন, যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হলো অথচ সে আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করল না, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাঁকে (রহমত থেকে) দূরে সরিয়ে দিবেন।
৪. অন্য এক হাদীসে আছে, হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন—
من ذكرت عنده فلم يصل على فقد شقى—
অর্থাৎ যার সামনে আমার নাম উল্লেখ করা হলো অথচ সে আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করল না, সে হতভাগা।
৫. মুসনাদে ইমাম আহমদ ও তিরমিযী শরীফের হাদীসে আছে, হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল  ইরশাদ করেন—
البخيل من ذكرت عنده فلم يصل علىّ
অর্থাৎ প্রকৃত কৃপণ সেই ব্যক্তি যার সামনে আমার নাম উল্লেখ করা হলো অথচ সে আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করল না। ইমাম তিরমিযী (র.) উক্ত হাদীসকে হাসান, সহীহ, গরীব বলেছেন।
৬. ইমাম তাবারানী (র.) হাসান সনদে বর্ণনা করেন, হযরত হুসাইন বিন আলী (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল  ইরশাদ করেন—
من ذكرت عنده فخطى الصلاة علىّ خطى طريق الجنة
অর্থাৎ যার সামনে আমার নাম উল্লেখ করা হলো আর সে আমার উপর দুরূদ পড়তে ভুলে গেল, সে জান্নাতের পথ ভুলে যাবে।
৭. আল্লামা সাখাভী (র.) হযরত যাইনুল আবিদীন (রা.) হতে বর্ণনা করেন, রাসূল —এর উপর বেশি বেশি করে দুরুদ শরীফ পাঠ করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী হওয়ার নিদর্শন। (আল কাউলুল বাদী’)
৮. আল্লাম যুরকানী (র.) শরহে মাওয়াহিব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, দুরূদ শরীফের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার হুকুম পালন করে তাঁর নৈকট্য লাভ করা এবং আমাদের উপর রাসূল  এর যে হক রয়েছে এর কিছু অংশ হলেও আদায় করার চেষ্টা করা।
দুরূদ শরীফ পাঠ করার পদ্ধতি
বুখারী শরীফে বর্ণিত হযরত কা’ব বিন উজরাহ (রা.) ও হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস—
قيل يا رسول الله اما السّلام عليك فقد عرفنا فكيف الصلاة قال قولوا اللهم صل على محمد الى آخره يعنى قد عرفنا السّلام فى التشهد وهو قوله السّلام عليك ايها النبي ورحمة الله وبركاته فكيف نصلى حينئذ فعلّم رسول الله صلى الله عليه وسلم بقوله اللهم صل على محمد الى آخره
অর্থাৎ (উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর) রাসূল কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আপনার প্রতি সালাম পেশ করার কথা বলা হয়েছে তা তো আমরা জানি। তবে সালাত কিভাবে পেশ করব? তখন রাসূল  শিখিয়ে দিলেন তোমরা এভাবে বলবে—
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا صَلَّيْتَ عَلىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ وَبَارِكْ عَلىٰ مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ كَمَا بَارَكْتَ عَلىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
উল্লেখ্য যে, এখানে দুরূদ শরীফের শব্দাবলিকে খাস করা হয়নি, বরং দুরূদ শরীফের পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ এ শব্দগুলো ছাড়াও আরো অনেক শব্দ হাদীস শরীফ থেকে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা হবে। এখানে কেবল এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রাসূল  এর প্রতি দুরূদ শরীফ পাঠের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তাঁর শান ও মান অনুুযায়ী দুরূদ পাঠ করা মানুষের জন্য সম্ভব নয়। এ কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দুআ করতে হবে যেন তিনি যথাযথভাবে পাঠকের পক্ষ থেকে দুরূদ শরীফ রাসূল  এর কাছে পৌঁছে দেন। (আল্লামা সাখাভী (র.) ‘আল—কাইলুল বদী’ কিতাবে অনুরূপ বলেছেন।)
আল্লামা নিশাপুরী (র.) বলেন, নামাযে মুসাল্লীদের صليت علي محمد উচিত নয়, কারণ বান্দাহ এক্ষেত্রে (তাঁর উপর যথাযথ দুরূদ পাঠ করতে) অক্ষম। (لطائف وحكم)
দুরূদ শরীফ পাঠের ফযীলত
দুরূদ শরীফ পাঠের ফদীলত সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো—
১. মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরাইরা (র.) হতে বর্ণিত হাদীস, রাসূল  ইরশাদ করেন—
من صلّى علىّ واحدة صلى الله عليه عشرا
অর্থাৎ যে আমার উপর একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, আল্লাহ পাক তাঁর উপর দশবার সালাত পেশ করেন।
যেহেতু আল্লাহ পাকের সালাত পেশ করার অর্থ হচ্ছে রহমত অবতীর্ণ করা, তাই এ হাদীস শরীফের অর্থ হবে একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করলে আল্লাহ সে ব্যক্তি উপর দশটি রহমত নাযিল করেন।
২. হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল  ইরশাদ করেন—
من صلّى علىّ صلاة واحدة صلى الله عليه عشر صلوات وحطت عنه عشر خطيئات ورفعت له عشر درجات—
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমার উপর সালাত পেশ করে আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত অবতীর্ণ করেন, তাঁর দশটি গুনাহ মা’ফ করে দেন এবং দশটি দরজা বৃদ্ধি করে দেন। (আহমদ, নাসাঈ, আদাবুল মুফরাদ লিল বুখারী)
৩. হযরত ইবন মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল  ইরশাদ করেন—
اولى الناس بي يوم القيامة أكثرهم صلاة—
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট হবে যে আমার প্রতি বেশি দুরূদ পাঠ করবে। (তিরমিযী)
৪. হযরত ইবন মাসউদ (রা.) থেকে অন্য একটি বর্ণনায় আছে রাসূল  ইরশাদ করেন—
ان لله ملائكة سياحين فى الأرض يبلغونى من أمتي السّلام
অর্থাৎ পৃথিবীতে আল্লাহ পাকের কিছু ফিরিশতা নিয়োজিত আছেন যারা আমার উম্মতের সালাম আমার কাছে পেঁৗছে দেন। (নাসাঈ)
৫. হযরত আবূ তালহা (রা.) হতে বর্ণিত নাসাঈ ও দারিমী শরীফের হাদীস—
ان رسول الله صلى الله عليه وسلم جاء ذات يوم والبشر فى وجهه فقال انه جاءنى جبرئيل فقال ان ربك يقول اما يرضيك يا محمد ان لا يصلى عليك أحد من أمتك الا صليت عليه عشرا ولا يسلم عليك أحد من أمتك الا سلمت عليه عشرا—
অর্থাৎ (হযরত আবূ তালহা (রা.) বলেন, একদিন রাসূল  (সাহাবায়ে কিরামের কাছে) তাশরীফ আনলেন। তখন তাঁর চেহারা মুবারকে আনন্দ দেখা যাচ্ছিল। এর পর তিনি ইরশাদ করেন, আমার কাছে জিবরাঈল এসেছিলেন। তিনি বললেন, আপনার রব আপনাকে বলছেন, হে মুহাম্মদ, আপনি কি (এ কথা শুনে) সন্তুষ্ট হবেন না যে, আপনার উম্মতের মধ্যে কেউ আপনার উপর এক বার দুরূদ শরীফ পাঠ করলে আমি তার উপর দশটি রহমত অবতীর্ণ করব? আর কেউ আপনার উপর একবার সালাম পেশ করলে আমি তার উপর দশবার সালাম পেশ করব? (নাসাঈ ও দারিমী)
৬. আল্লামা সাখাভী (র.) তাবারানীর সনদে বর্ণনা করেন, রাসূল  ইরশাদ করেছেন—
من صلى علي حين يصبح عشراً وحين يمسي عشراً أدركته شفاعتي يوم القيامة
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সকালে দশবার এবং বিকালে দশবার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, সে কিয়ামতের দিন আমার শাফা’আত লাভ করবে। (আল—কাউলুল বাদী’)
৭. সিদ্দীকে আকবর হযরত আবূ বকর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল কে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন—
من صلى علي كنت شفيعه يوم القيامة
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, আমি কিয়ামতের দিন তাঁর সুপারিশকারী হব। (আল—কাউলুল বাদী’)
৮. হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—
من صلّى على النبي صلى الله عليه وسلم واحدة صلى الله عليه وملائكته سبعين صلوة—
অর্থাৎ যে ব্যক্তি রাসূল —এর উপর একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, ফিরিশতাগণ তার উপর সত্তরবার দুরূদ পাঠ করবেন। (আহমদ)
৯. হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল  ইরশাদ করেন—
من صلّى علىّ صلاة كتب له قيراط والقيراط مثل أحد
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, তার জন্য এক কিরাত সওয়াব লিখে দেয়া হবে। আর কিরাত হচ্ছে উহুদ পাহাড়ের সমপরিমান। (মুসাননাফে আব্দুর রাযযাক)
১০. তিরমিযী শরীফে হযরত উবাই বিন কা’ব (রা.) হতে বর্ণিত হাদীস। হযরত উবাই (রা.) বলেন— তিরমিযী শরীফে
قلت يا رسول الله انى اكثر الصلاة عليك فكم اجعل لك من صلاتى قال ما شئت قلت الربع قال ما شئت وان زدتّ فهو خير لك قلت النصف قال ما شئت وان زدتّ فهو خير لك قلت فالثلثين قال ما شئت فان زدتّ فهو خير لك قلت اجعل لك صلاتى كلها قال إذا تكفى همك ويكفر لك ذنبك— رواه الترمذي
অর্থাৎ আমি রাসূল  এর কাছে আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার প্রতি বেশি বেশি দুরূদ শরীফ পাঠ করি। আমি আমার (যিকর ও দুআর) কতটুকু দুরূদ শরীফ পাঠ করব? রাসূল  জবাবে বললেন, তুমি যা চাও। আমি বললাম এক চতুর্থাংশ। রাসূল  বললেন, তুমি যা চাও, তবে এর বেশি করলে তোমার জন্য অধিক কল্যাণকর হবে। আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক নির্ধারণ করব। রাসূল  বললেন, তুমি যা চাও, তবে এর বেশি করলে তোমার জন্য অধিক কল্যাণকর হবে। আমি বললাম, তাহলে দুই তৃতীয়াংশ করব। রাসূল  বললেন, তুমি যা চাও, তবে এর বেশি করলে তোমার জন্য অধিক কল্যাণকর হবে। আমি বললাম, তাহলে আমি আমার দুআর পূর্ণ অংশই দুরূদ পাঠ করব। রাসূল  বললেন, এমন করলে তোমার দুশ্চিন্তা দূর করে দেওয়া হবে এবং তোমার গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেওয়া হবে। (তিরমিযী)
১১. ইমাম আহমদ (র.) হযরত রুআইফি’ (রা.) হতে হাদীস উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন, রাসূল  ইরশাদ করেছেন—
من صلّى على محمّد وقال اللّٰهم أنزله المقعد المقرب عندك يوم القيامة وجبت له شفاعتى— رواه احمد
অর্থাৎ যে মুহাম্মদ  এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করে এবং বলেاللهم أنزله المقعد المقرب عندك يوم القيامة তার জন্য আমার শাফা’আত আবশ্যক হয়ে যায়। (আহমদ)
১২. ইমাম বাগাবী (র.) আল—জামে কিতাবে হাসান সনদে বর্ণনা করেন, হযরত আবদুল্লাহ বিন আমির বিন রবী’আহ (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, তিনি রাসূল কে বলতে শুনেছেন—
من صلّى علىّ صلاة صلت عليه الملائكة ما صلى علىّ فليقلل العبد من ذلك او ليكثر—
অর্থাৎ যে ব্যক্তি একবার আমার উপর সালাত পাঠ করে ফিরিশতাগণ তার উপর একবার সালাত পাঠ করেন। সুতরাং বান্দাহর ইচ্ছাধীন রয়েছে সে দুরূদ শরীফ কম পড়বে, নাকি বেশি করে পড়বে।
১৩. তিরমিযী শরীফে হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
ان الدعاء موقوف بين السماء والأرض لا يصعد منه شىء حتى تصلى على نبيك—
অর্থাৎ দুআ আসমান ও যমীনের মধ্যখানে আটকে থাকে। যতক্ষণ না তুমি তোমার নবীর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, ততক্ষণ তা উপরে ওঠবে না। (তিরমিযী)
১৪. হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—
خرج رسول الله صلى الله عليه وسلم حتى دخل نخلا فسجد فأطال السجود حتى خشيت أن يكون الله توفاه قال فجئت أنظر فرفع رأسه فقال مالك فذكرت ذلك له قال فقال أن جبرئيل عليه السلام قال لى ألا أبشرك ان الله عزّ وجلّ يقول لك من صلّى عليك صليت عليه ومن سلّم عليك سلمت عليه—
অর্থাৎ রাসূল  (হুজরা মুবারক থেকে) বের হলেন এবং একটি খেজুর বাগানে তাশরীফ নিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি নামায পড়তে লাগলেন। এত দীর্ঘ সিজদাহ করলেন যে আমার আশংকা হলো আল্লাহ তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন। আমি তােঁক দেখার জন্য গেলাম। তিনি মাথা মুবারক ওঠালেন এবং বললেন, তোমার কি হয়েছে। আমি আমার আশঙ্কার কথা বললাম। তিনি বললেন, জিবরাঈল (আ.) আমার কাছে এলেন এবং বললেন, আমি আপনাকে সুসংবাদ দিচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলা আপনার উদ্দেশ্যে বলেছেন, যে আপনার উপর সালাত পাঠ করবে, আমি তার উপর রহমত অবতীর্ণ করব। আর যে আপনাকে সালাম প্রদান করবে, আমি তাকে সালাম দিব। (তিরমিযী, আহমদ)
বিভিন্ন শব্দের দ্বারা দুরূদ শরীফ
দুরূদ শরীফের জন্য রাসূল  কোনো বিশেষ শব্দ খাস করেননি। বিভিন্ন হাদীসে ভিন্ন ধরনের দুরূদ শরীফের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূল  এক সাহাবীর প্রশ্নে দুরূদ শরীফের শব্দাবলি উল্লেখ করে শিখিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়াও আরো অনেক শব্দ ও বাক্যে দুরূদ শরীফ স্বয়ং রাসূল  থেকে বর্ণিত আছে। নিম্নে এ ধরনের কয়েকটি বর্ণনা তুলে ধরছে।
১. আবূ দাউদ শরীফে হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল  দুরূদ শরীফের ফদীলত সম্পর্কে বলেছেন—
من سرّه ان يكتال بالمكيال الأوفى إذا صلّى علينا اهل البيت فليقل اللهم صل على محمدن النبي الأمي وأزواجه أمهات المؤمنين وذريته واهل بيته كما صليت على ابراهيم انك حميد مجيد—
অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার ওযনের পাল্লা পরিপূর্ণ হতে পছন্দ করে, সে আমাদের আহলে বাইতের উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করলে এরূপ বলে— اللهم صل على محمد النبي الأمي وأزواجه أمهات المؤمنين وذريته واهل بيته كما صليت على ابراهيم انك حميد مجيد—
২. আল—কাউলুল বাদী’ গ্রন্থকার হযরত সাহাল বিন সাঈদ (রা.) হতে বর্ণনা করেন। রাসূল  ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জুুমুআর দিনে আসর নামাযের পর আশি বার নিম্নোক্ত দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, আল্লাহ তাআলা তার আশি বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন। দুরূদ শরীফটি হলো— اللهم صل على محمد النبي الأمي وعلى آله وسلم تسليماً
৩. আল্লামা সাখাবী (র.) আরো বর্ণনা করেন, রাসূল  ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি اللهم صل على روح محمد في الأرواح وعلى جسده في الأجساد وعلى قبره في القبور رآني في منامه এ দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, সে স্বপ্নে আমাকে দেখবে। (আল—কাউলুল বাদী’)
৪. অন্য এক বর্ণনায় আল্লামা সাখাবী (র.) বলেন, যে ব্যক্তি স্বপ্নে রাসূল কে দেখার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন নিম্নোক্ত দুরূদ শরীফ পাঠ করে:
اللهم صلي على محمد كما أمرتنا أن نصلي عليه اللهم صل على محمد كما هو اهله اللهم صل على محمد كما تحب وترضى له
এরপর পড়বে—
اللهم صل على روح محمد في الأرواح— اللهم صل على جسد محمد في الأجساد— اللهم صل على قبر محمد في القبور.
৫. হযরত সালামা আল—কিনদী (র.) হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আলী (রা.) মানুষকে নিম্নোক্ত দুরূদ শরীফ শিক্ষা দিতেন:
اللهم داحي المدحوات وباري المسموكات وجبار القلوب على فطرتها شقيها وسعيدها اجعل شرائف صلاتك ونوامي بركاتك ورأفة تحننك على محمد عبدك ورسولك الخاتم لما سبق والفاتح لما أغلق والمعلن الحق بالحق والدافع لجيشات الأباطيل كما حمل فاضطلع بأمرك بطاعتك مستوفزاً في مرضاتك بغير نكل عن قدم ولا وهن في عزم، واعيا لوحيك حافظاً لعهدك ماضياً على نفاذ أمرك حتى أورى قبسا لقابس آلاء الله تصل بأهله أسبابه به هديت القلوب بعد خوضات الفتن والإثم وأبهج موضحات الإعلام
এ বর্ণনাটি সাঈদ বিন মনসূর, তাবারী ও তাবরানী বর্ণনা করেছেন।
ইবন হাজার আসকালানী (র.) ‘ফাতহুল বারী’ কিতাবে এ দুরূদ শরীফকে পরিপূর্ণ ও অধিক বলিষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন।
৬. ইমাম সাখাবী (র.) স্বীয় কিতাবে সর্বোত্তম দুরূদ শরীফের ধরন সম্পর্কে একটি অধ্যায় উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি ইমাম নববী (র.) এর মতামত উল্লেখ করত লিখেছেন— কেউ যদি সর্বোত্তম দুরূদ শরীফ পড়ার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন এ দুরূদ পড়ে—
اللهم صل على محمد وعلى محمد كلما ذكره الذاكرون وكلما سهى عنه الغافلون
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দুরূদ শরীফের শব্দাবলি নির্ধারিত নয়। বরং রাসূল , সাহাবায়ে কিরাম ও উলামায়ে সলফ থেকে বিভিন্ন শব্দে দুরূদ শরীফ পাঠের ভিন্ন ভিন্ন ফযীলতের কথা বর্ণিত আছে।
একই শব্দে একাধিকবার দুরূদ শরীফ পাঠের বর্ণনা
প্রশ্ন আসতে পারে যে, দালাইলুল খাইরাত শরীফসহ বিভিন্ন দুরূদ শরীফের কিতাবে একই বাক্যে দুরূদ শরীফের সংখ্যার আধিক্যের কথা বলা হয়েছে। যেমন ملء اللوح:عدد القطر والحصي: عدد الرمل এ সকল শব্দ দ্বারা কি একবারই দুরূদ শরীফ পাঠ হবে না কি যতবার বলবে ততবার পাঠ করা হবে। এর উত্তরে আল্লাম সায়্যিদ আলাভী (র.) লিখিত ‘মাজমু’ ফাতাওয়া কিতাবে একটি আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি মুস্তাদরাকে হাকিমের একটি হাদীস উল্লেখ করে প্রমাণ করেছেন যে, এরূপ ক্ষেত্রে যতবারের কথা উল্লেখ করবে ততবার পাঠ করার সওয়াব হবে। হাদীসখানা নিম্নরূপ—
عن صفية رضي الله عنها قالت : دخل علي رسول الله صلى الله عليه و سلم و بين يدي أربعة آلاف نواة أسبح بهن فقال : يا بنت حيي ما هذا ؟ قلت أسبح بهن قال : قد سبحت منذ قمت على رأسك أكثر من هذا قلت : علمني يا رسول الله قال : قولي سبحان الله عدد ما خلق من شيء
অর্থাৎ উম্মুল ম’মিনীন হযরত সাফিয়্যাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল  একদিন আমার কাছে তাশরীফ আনলেন এমন সময় আমার হাতে চার হাজার দানা ছিল, যেগুলো দিয়ে আমি তাসবীহ পাঠ করছিলাম। তিনি বললেন, হে হুয়াই এর মেয়ে! এগুলো কী? আমি বললাম, আমি এগুলো দিয়ে তাসবীহ পাঠ করছি। রাসূল  ইরশাদ করলেন, আমি যতক্ষণ থেকে তোমার মাথার কাছে দাঁড়ানো আছি এ সময়ে এর চেয়ে বেশিবার তাসবীহ পাঠ করেছি। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে তা শিখিয়ে দিন। রাসূল  ইরশাদ করলেন, তুমি বল— سبحان الله عدد ما خلق من شيء
সায়্যিদুল মুরসালীন  এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করা একটি অতি উত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি ইহ—পরকালীন কল্যাণের ওসীলা। আল্লাহ আমাদের বেশি বেশি করে দুরূদ শরীফ পাঠ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

ফেইসবুকে আমরা...