1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতামাতা নাজাতপ্রাপ্ত
মূল: আল্লামা মোহাম্মদ আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র.), অনুবাদ: মাওলানা মো. ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী
  • ১১ অক্টোবর, ২০২১

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতা নাজাত পেয়েছেন বলে অধিকাংশ মুসলিম মনিষী মত প্রকাশ করেছেন।

এ সম্পর্কে তিনটি মত রয়েছে-

১. তাঁরা উভয়ই ছিলেন আহলে ফিতরত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বে ইহধাম ত্যাগ করেন। কুরআন শরীফে আছে-

وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُوْلًا

-আমি শাস্তি প্রদান করি না, যতক্ষণ না কোনো রাসূল প্রেরণ করি।

২. তাঁরা মুশরিক ছিলেন না বরং তাঁরা ছিলেন ইবরাহীম (আ.) এর দ্বীনভুক্ত।

৩. আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রকাশের পর উভয়কে পুনর্জীবিত করেন এবং তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান আনেন। মুহাদ্দিসগণের বিরাট একটি জামাআত উক্ত মত গ্রহণ করেছেন। ইবন শাহিন, হাফিয আবু বকর, খতীব বাগদাদী, কুরতুবী, তাবারী, মুনীর প্রমুখ উক্ত মতে বিশ্বাসী।

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র.) এ প্রসঙ্গে ৬টি কিতাব প্রণয়ন করেন-

 م(1) مسالك الحنفاء فى والدى المصطفٰى (2) الدرر المنيفة فى الاٰباء الشريفة (3) المقامة السندسية فى التسمية المصطفوية (4) التعظيم والمنّة فى ان ابوى رسول الله فى الجنة (5) المنيفين فى احياء والدين الشريفين (6) السبل الجلية فى اٰباء العلية

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র.) কুরআন শরীফের আয়াত ও হাদীসসমূহের আলোকে পূঙ্খানুপুঙ্খরূপে তথ্যানুসন্ধান করে তাঁর পুস্তিকাসমূহে উপরোক্ত মতগুলো প্রমাণ করেছেন। এ সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করছি।

ইমাম তাবারী তাঁর সনদ মাধ্যমে হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতাশাগ্রস্ত অবস্তায় ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হুযূনে উপনীত হলেন। আল্লাহর ইচ্ছাঅবধি সেখানে অবস্থান করলেন। তারপর প্রফুল্লচিত্তে প্রত্যাগমন করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি আমার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করলে তিনি জননীকে পুনর্জীবন দান করলেন। মাতা আমার উপর ঈমান আনলেন, অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাঁকে পূর্ববৎ করে দিলেন।

আবুল খাত্তাব বিন দাহইয়া বলেন, “মৃত্যুর সাথে সাক্ষাতের পর যখন ঈমান আনলে কোনো ফল হয় না তবে পুনর্জীবন লাভ করে ঈমানের দীক্ষা গ্রহণের কী সার্থকতা থাকতে পারে?”

ইমাম কুরতুবী জবাবে বলেন, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়া যেমন বর্ণনা পরম্পরায় বহু সংখ্যক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তেমন বিবেকের বিচারেও সম্ভব। কেননা তার দৃষ্টান্ত বিরল নয় এবং শরীআতের দৃষ্টিতেও অবৈধ নয়।

যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতার ঈমান গ্রহণযোগ্য না হয়; তবে বনী ইসরাঈলের নিহত ব্যক্তি পুনর্জীবন লাভের পর যে স্বাক্ষ্য দান করেছিলেন তা কিভাবে মঞ্জুর করা গেল। অথচ নিয়ম হল নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ইবাদত ফলপ্রসু হয় না। সুলাইমান (আ.) এর আসরের নামায পড়ার জন্য সুর্যাস্তের পর পশ্চিমাকাশে পুনরায় সূর্য উদিত হয়েছিল এবং সুলাইমান (আ.) যথাসময়ে আসরের নামায আদায় করেছিলেন। তাঁর নামাযকে কাযা বলা হয় নাই।

যখন সুলাইমান (আ.) এর খাতিরে আল্লাহ তাআলা বিধিবদ্ধ নিয়মের খিলাফ আসরের নামায কবুল করলেন; তখন আশরাফুল মাখলুকাত, নবী ও রাসূলকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদার খাতিরে তদীয় মাতার ইসলামে দীক্ষা মঞ্জুর হওয়া সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনারও নাগালের বাইরে নয়।

এটা স্বীকৃত যে মরণের পর মানুষ স্বাক্ষ্যদানের উপযুক্ত থাকে না। পক্ষান্তরে মুসা (আ.) এর সম্মানে বনী ইসরাঈলের নিহত ব্যক্তিকে পুনর্জীবিত করতঃ স্বাক্ষ্যগ্রহণ করার পর হন্তাকে শাস্তি প্রদান করা হল। অথচ সেক্ষেত্রে স্বাক্ষীর নির্দিষ্ট সংখ্যা পূর্ণ হয় নাই।

তাই মরণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতা পুনরায় জীবিত হয়ে তাওহীদ ও রিসালাতের উপর স্বাক্ষ্য প্রদান করা কেন গ্রহণযোগ্য হবে না?

মৃত ব্যক্তির জীবন লাভ

কুরআন ও হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঈসা (আ.) মৃতকে পুনরায় জীবিত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা কাসতালানী লিখেছেন-

وكان عيسٰى عليه السّلام يحي الموتى فكذالك نبينا صلّى الله عليه وسلّم احيا الله علٰى يده جماعة من الموتى

-ঈসা (আ.) মৃতদেহকে আল্লাহর হুকুমে জীবিত করতেন তদ্রুপ আল্লাহ তাআলা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা একদলকে পুনর্জীবিত করেছিলেন। যার বিস্তারিত বিবরণ যুরকানী ১ম খ-, ১৭০ পৃষ্ঠায় আছে। আল্লামা যুরকানী ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত মারফু হাদীসের বরাত দিয়ে লিখেছেন যে, আসহাবে কাহফকে বিশেষ মর্যাদা দানের জন্য শেষ যুগে জীবিত করা হবে। আসহাবে কাহফ হজ্জ করবেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতে দাখিল হবেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত হয়ে বিশেষ মর্যাদা লাভের জন্য আসহাবে কাহফের জীবনের কিছু অংশ যখন আল্লাহ তাআলা বাকী রাখলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতার জীবনের একাংশ অবশিষ্ট রাখা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ইবন জারীর আল্লাহ তাআলার বাণী- وَلَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضَىٰ এর তাফসীরে লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لا يدخل احد من اهل بيته النار -“তাহার পরিবারের কেহই দোযখে যাবে না।” অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতা নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন, তাই তাঁদের আহলে ফিতরাত বলে গণ্য করা হয়। ইমাম কাসতালানী (র.) লিখেছেন, উসূলবেত্তা ইমামগণ ও শাফিঈ মাযহাববলম্বী শাস্ত্রবিদগণ একমত পোষণ করেন যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের দাওয়াত পৌঁছার পূর্বে যারা মারা যান তারা মুক্তিপ্রাপ্ত। তাছাড়া কুরআন শরীফের আয়াত-

وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتّٰى نَبْعَثَ رَسُولًا

-আমি শাস্তি প্রদানকারী নই যতক্ষণ না কোনো রাসূল প্রেরণ করি। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-১৫)

ইমাম রাযী আসরারুত তানযীল কিতাবে تَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ আয়াতের তাফসীর উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলেন যে, আয়াতের অর্থ হলো- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূর এক সিজদাকারী থেকে অন্য সিজদাকারীতে স্থানাস্তরিত করা হয়েছে। ইমাম রাযী বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উর্দ্ধতন পুরুষের সবাই যে মুসলমান ছিলেন এখানে তার প্রমাণ রয়েছে। জীবন সায়াহ্নে মা আমিনা যে কবিতাগুলো আবৃত্তি করেছিলেন তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কথাই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। যেমন-

بارك فيك الله من غلام    ٭  يا ابن الّذى من حومة الحمام

نجا بعون الملك العلام   ٭  فودّى غداة الضّرب بالسّهام

بمائة من ابل سوّام   ٭  ان صحّ ماابصرت فى المنام

فانت مبعوث فى الانام    ٭  تبعث فى الحلّ وفى الحرام

تبعث فى التحقيق والاسلام   ٭  دين ابيك البر ابراهام

فالله انهاك عن الاصنام   ٭  وان لا توليها مع الاقوام

কবিতার অনুবাদ- যে প্রভাতে পণ নির্ধারণের জন্য তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সে প্রভাতে বলিষ্ট ও দীর্ঘাকৃতি একশত উষ্ট্রের বিনিময়ে সর্বজ্ঞাত অধিপতির কৃপায়, বিভিষীকাময় মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত জনকের সন্তান। আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন। আমি যদি সত্যই স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে থাকি তবে বলছি, তুমি মানব ও দানবের জন্য প্রেরিত হবে। হারাম (হেরেম শরীফ) ও হারামের বাইরে তোমার সত্যপস্থি পিতা ইবরাহীমের ইসলামের তরে সত্য-মিথ্যা প্রভেদকারীরূপে আবির্ভূত হবে। আল্লাহর শপথ! অন্য জাতির মত প্রতিমা পূজা ও তৎসংলগ্ন যাবতীয় গর্হিত কাজ থেকে তিনি তোমাকে মুক্ত রাখবেন।

তারপরও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতাকে জাহান্নামী বলে মনে করা বড় অন্যায়। উপরন্তু অনেক হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঊর্ধ্বতন পুরুষদের কেউই মুশরিক ছিলেন না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

لم ازل انقل من اصلاب الطاهرين الىٰ ارحام الطاهرات

-সব সময়ই পুত চরিত্রের অধিকারী মানুষের মেরুদ- থেকে অনুরূপ চরিত্রের অধিকারী স্ত্রীলোকদের মধ্যে আমাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। কুরআন শরীফে আছে, إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ -নিশ্চয়ই মুশরিকগণ অপবিত্র। এ কথা স্থির নিশ্চিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো উর্দ্ধতন পুরুষ মুশরিক হতে পারেন না।

শিফা গ্রন্থের ভাষ্যকার সানূসী ও তিলমিছানী লিখেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জনক জননী যে পৌত্তলিক তা প্রমাণ করা আদৌ সম্ভব নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাক্রমে সৎ মহিলার গর্ভাশয়ে স্থানান্তরিত হয়েছেন। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী বলেন, আমি ইমাম রাযীর উক্তি দ্বারা যে অকাট্য প্রমাণ লাভ করলাম তা আম ও খাসের মধ্যবর্তী। আম দুটি ভূমিকা সম্বলিত। প্রথম ভূমিকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উর্দ্ধতন পুরুষদের সবাই সমকালীন ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন। তা বুখারী শরীফের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস-

بُعِثْتُ مِنْ خَيْرِ قُرُونِ بَنِي آدَمَ قَرْنًا فَقَرْنًا حَتَّى كُنْتُ مِنَ الْقَرْنِ الَّذِي كُنْتُ فِيهِ

-আমি যুগে যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ আদম সন্তানদের মাধ্যমে এসেছি। এভাবেই আমি সে যুগে এসেছি যে যুগ আমার জন্য নির্ধারিত ছিল। (বুখারী, কিতাবুল মানাকিব, বাব- সিফাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)

২য় ভূমিকা- পৃথিবী কখনও সাতজন বা ততোধিক মুমিন থেকে খালি হয় না। যাদের কারণে আল্লাহ তাআলা শাস্তি প্রদান করেন না। যার প্রমাণ স্বরূপ নিম্নোক্ত হাদীস রয়েছে।

اخرج عبد الرزاق وابن المنذر بسند صحيح علىٰ شرط الشيخين عن على (رض) قال لم يزل علىٰ وجه الدهر سبعة مسلمون فصاعدا فلولا ذالك هلكت الارض ومن عليها (১)

-আব্দুর রাজ্জাক ও ইবন মুনযির, ইমাম বুখারী (র.) ও মুসলিম (র.) এর শর্তসিদ্ধ সনদ মাধ্যমে আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, পৃথিবী কখনও সাত বা ততোধিক মুসলমান থেকে খালি হয় নি। অন্যথায় পৃথিবী ও তার বাসিন্দারা ধ্বংস হয়ে যেত।

 واخرج احمد فى الزهد والخلال فى كرامات الْاولياء بسند صحيح علىٰ شرط الشيخين عن ابن عباس (رض) قال ما خلقت الارض من بعد نوح من سبعة يدفع الله بهم عن اهل الارض (২)

-ইমাম আহমদ ‘আয যুহদ’ এর মধ্যে এবং খাল্লাল ‘শারামাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে ইমাম বুখারী (র.) ও মুসলিম (র.) এর শর্তসিদ্ধ সহীহ সনদ মাধ্যমে ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নূহ (আ.) এর পর থেকে কমপক্ষে সাতজন (মুমিন) আল্লাহ তাআলা সর্বদা সৃষ্টি করেন যাদের ওসীলায় পৃথিবীবাসী থেকে আযাব দূরে রাখেন।

যদি উপরোক্ত ভূমিকাদ্বয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায় তবে তার ফল দুটির একটি হবেই। (১) হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উর্ধ্বতন পুরুষগণ উল্লেখিত সাতজনের একজন হবেন; তবেতো আমাদের দাবী প্রমাণিত হয়ে গেল। অন্যথায় দুটি অবস্থার সৃষ্টি হবে। (ক) হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উর্ধ্বতন পুরুষ অন্যদের তুলনায় ভাল ছিলেন না; আর তা আদৌ গ্রহণ যোগ্য নয়। কেননা তা সহীহ হাদীসের পরিপন্থি। (খ) অথবা বলতে হয় তারা মুশরিক, তাও সর্বসম্মতিতে বর্জিত। কুরআন শরীফে আছে- وَلَعَبْدٌ مُّؤْمِنٌ خَيْرٌ مِّن مُّشْرِكٍ

-মুশরিক থেকে মুমিন ক্রীতদাসও উত্তম। এতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা তাওহীদবাদী ছিলেন কেননা সমকালীন বিশ^বাসীর তুলনায় তাঁরা ছিলেন সর্বোত্তম।

খাস এর ক্ষেত্রে ইবন সাদ, ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আদম (আ.) পর্যন্ত নূহ (আ.) এর উর্ধ্বতন পুরুষরা মুসলমান ছিলেন। ইবন জারীর, ইবন আবি হাতিম, ইবনুল মুনযির বাযযার ও হাকিম সহীহ সনদ মাধ্যমে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আদম (আ.) থেকে নূহ (আ.) পর্যন্ত দশ পুরুষ সত্যপন্থি ছিলেন। পরে তাদের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। ফলে আল্লাহ তাআলা নবীগণকে প্রেরণ করেন।

কুরআন শরীফ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নূহ (আ.) এর ছেলে ‘সাম’ ছিলেন মুমিন। সামের ছেলে আরফখশদ যে মুমিন ছিলেন তারও প্রমাণ আছে।

কালবীর নদ মাধ্যমে ইবন সাদ রিওয়ায়াত করেন যে, নূহ (আ.) এর যুগ থেকে নমরূদ কর্তৃক বাবেল অধিকৃত না হওয়া পর্যন্ত সেখানকার অধিবাসীরা ছিল ইসলাম বিশ্বাসী। নমরূদ তাদের মূর্তিপূজার দিকে আহবান করে। তখন আযর ও ইবরাহীম (আ.) বর্তমান ছিলেন। ইবরাহীম (আ.) এর পরবর্তী বংশধর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاءٌ مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ

-ইবরাহীম (আ.) যখন তাঁর পিতা ও সগোত্রীয় লোকদের বললেন, তোমরা যাদের উপাসনা কর তাদের থেকে আমি মুক্ত। আমি তাঁরই ইবাদত করি যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন। (সূরা যুখরুফ, আয়াত: ২৬-২৭)

ইবন আবু হাতিম সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, সুফিয়ান বিন উয়াইনাকে প্রশ্ন করা হল- ইসমাঈলের সন্তানদের মধ্যে কেউ কি মূর্তিপূজা করেছিলেন? তিনি জবাবে বলেন, না। আপনারা কি শুনেন নাই- وَاجْنُنِىْ وَبَنِىَّ اَنْ نَعْبُدُ   الْاَصْنَام “দেবতার উপাসনা থেকে আমাকেও আমার সন্তানকে তুমি পবিত্র রাখ।” পূনরায় প্রশ্ন করা হলো- ইসহাক (আ.) এর আওলাদ কি দুআর অন্তর্গত নন। তিনি উত্তর দিলেন, না। কেননা নির্দিষ্ট শহরের জন্যই দুআ করেছিলেন যেন তারা মূর্তিপূজা না করে। বসবাসের ব্যবস্থা করার জন্য শুধু ইসমাঈল (আ.) কে মক্কা শরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দুআ করেছিলেন,

رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا بَلَدًا آمِنًا

“হে রব! এ শহরকে নিরাপদ রাখ।” এখানে অন্য কোন শহরের কথা বলেন নাই। দুআ করেছিলেন, “আমাকে ও আমার সন্তানকে মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা কর।” মোটকথা- দুআটি ছিল কেবলমাত্র ইসমাঈল (আ.) ও তাঁর সন্তানদের জন্যই সীমাবদ্ধ।

ইবন মুনযির ইবন জুরাইজ থেকে رَبِّ اجْعَلْنِىْ مُقِيْمَ الصَّلٰوةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِىْ আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ.) এর বংশধরদের মধ্যে একটি দল সব সময়ই আল্লাহর ইবাদত করতেন এবং তাঁরা ছিলেন ফিতরাতের উপর।

ইবরাহীম (আ.) এর যুগ থেকে আমর বিন আমীর আল খুজাঈ পর্যন্ত আরবগণ দ্বীনে ইবরাহীমে দীক্ষিত ছিলেন এবং তন্মধ্যে কেউই মূর্তিপূজা করেন নাই বলে বুখারী শরীফসহ বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমর বিন আমীরকে আমর বিন লুহাইও বলা হয়। ঐ ব্যক্তিই সর্বপ্রথম দ্বীনে ইবরাহীমির পরিবর্তন সাধন করে মূর্তিপূজা আমদানি করে। উক্ত আমরুবনু আমির রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বপুরুষ কেনানার কাছাকাছি সময়ে ছিলেন। উলামাগণের উপস্থাপিত দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে আদনান, মা’আদ, রবিআ, মুদার, খুযাইমা, আসাদ, ইলইয়াছ, কা’ব দ্বীনে ইবরাহীমির অনুসারী ছিলেন।

[জাস্টিস পীর করমশাহ আল আযহারী (র.) ضياء النبىۖ কিতাবের ১ম খ-ের حضورکے والدیں کریمن کاایماں এই অধ্যায় পাঠ করলে বিজ্ঞ পাঠকবর্গ উপকৃত হবেন। কিতাবখানা উর্দূ ভাষায় রচিত ও ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। -অনুবাদক]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতা নাজাত পেয়েছেন বলে অধিকাংশ মুসলিম মনিষী মত প্রকাশ করেছেন।

এ সম্পর্কে তিনটি মত রয়েছে-

১. তাঁরা উভয়ই ছিলেন আহলে ফিতরত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে ইহধাম ত্যাগ করেন। কুরআন শরীফে আছে-

وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُوْلًا

-আমি শাস্তি প্রদান করি না, যতক্ষণ না কোনো রাসূল প্রেরণ করি।

২. তাঁরা মুশরিক ছিলেন না বরং তাঁরা ছিলেন ইবরাহীম (আ.) এর দ্বীনভুক্ত।

৩. আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াত প্রকাশের পর উভয়কে পুনর্জীবিত করেন এবং তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ঈমান আনেন। মুহাদ্দিসগণের বিরাট একটি জামাআত উক্ত মত গ্রহণ করেছেন। ইবন শাহিন, হাফিয আবু বকর, খতীব বাগদাদী, কুরতুবী, তাবারী, মুনীর প্রমুখ উক্ত মতে বিশ্বাসী।

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র.) এ প্রসঙ্গে ৬টি কিতাব প্রণয়ন করেন-

 م(1) مسالك الحنفاء فى والدى المصطفٰى (2) الدرر المنيفة فى الاٰباء الشريفة (3) المقامة السندسية فى التسمية المصطفوية (4) التعظيم والمنّة فى ان ابوى رسول الله فى الجنة (5) المنيفين فى احياء والدين الشريفين (6) السبل الجلية فى اٰباء العلية

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র.) কুরআন শরীফের আয়াত ও হাদীসসমূহের আলোকে পূঙ্খানুপুঙ্খরূপে তথ্যানুসন্ধান করে তাঁর পুস্তিকাসমূহে উপরোক্ত মতগুলো প্রমাণ করেছেন। এ সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করছি।

ইমাম তাবারী তাঁর সনদ মাধ্যমে হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতাশাগ্রস্ত অবস্তায় ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হুযূনে উপনীত হলেন। আল্লাহর ইচ্ছাঅবধি সেখানে অবস্থান করলেন। তারপর প্রফুল্লচিত্তে প্রত্যাগমন করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি আমার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করলে তিনি জননীকে পুনর্জীবন দান করলেন। মাতা আমার উপর ঈমান আনলেন, অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাঁকে পূর্ববৎ করে দিলেন।

আবুল খাত্তাব বিন দাহইয়া বলেন, “মৃত্যুর সাথে সাক্ষাতের পর যখন ঈমান আনলে কোনো ফল হয় না তবে পুনর্জীবন লাভ করে ঈমানের দীক্ষা গ্রহণের কী সার্থকতা থাকতে পারে?”

ইমাম কুরতুবী জবাবে বলেন, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়া যেমন বর্ণনা পরম্পরায় বহু সংখ্যক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, তেমন বিবেকের বিচারেও সম্ভব। কেননা তার দৃষ্টান্ত বিরল নয় এবং শরীআতের দৃষ্টিতেও অবৈধ নয়।

যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতার ঈমান গ্রহণযোগ্য না হয়; তবে বনী ইসরাঈলের নিহত ব্যক্তি পুনর্জীবন লাভের পর যে স্বাক্ষ্য দান করেছিলেন তা কিভাবে মঞ্জুর করা গেল। অথচ নিয়ম হল নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ইবাদত ফলপ্রসু হয় না। সুলাইমান (আ.) এর আসরের নামায পড়ার জন্য সুর্যাস্তের পর পশ্চিমাকাশে পুনরায় সূর্য উদিত হয়েছিল এবং সুলাইমান (আ.) যথাসময়ে আসরের নামায আদায় করেছিলেন। তাঁর নামাযকে কাযা বলা হয় নাই।

যখন সুলাইমান (আ.) এর খাতিরে আল্লাহ তাআলা বিধিবদ্ধ নিয়মের খিলাফ আসরের নামায কবুল করলেন; তখন আশরাফুল মাখলুকাত, নবী ও রাসূলকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদার খাতিরে তদীয় মাতার ইসলামে দীক্ষা মঞ্জুর হওয়া সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনারও নাগালের বাইরে নয়।

এটা স্বীকৃত যে মরণের পর মানুষ স্বাক্ষ্যদানের উপযুক্ত থাকে না। পক্ষান্তরে মুসা (আ.) এর সম্মানে বনী ইসরাঈলের নিহত ব্যক্তিকে পুনর্জীবিত করতঃ স্বাক্ষ্যগ্রহণ করার পর হন্তাকে শাস্তি প্রদান করা হল। অথচ সেক্ষেত্রে স্বাক্ষীর নির্দিষ্ট সংখ্যা পূর্ণ হয় নাই।

তাই মরণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতা পুনরায় জীবিত হয়ে তাওহীদ ও রিসালাতের উপর স্বাক্ষ্য প্রদান করা কেন গ্রহণযোগ্য হবে না?

মৃত ব্যক্তির জীবন লাভ

কুরআন ও হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঈসা (আ.) মৃতকে পুনরায় জীবিত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা কাসতালানী লিখেছেন-

وكان عيسٰى عليه السّلام يحي الموتى فكذالك نبينا صلّى الله عليه وسلّم احيا الله علٰى يده جماعة من الموتى

-ঈসা (আ.) মৃতদেহকে আল্লাহর হুকুমে জীবিত করতেন তদ্রুপ আল্লাহ তাআলা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা একদলকে পুনর্জীবিত করেছিলেন। যার বিস্তারিত বিবরণ যুরকানী ১ম খ-, ১৭০ পৃষ্ঠায় আছে। আল্লামা যুরকানী ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত মারফু হাদীসের বরাত দিয়ে লিখেছেন যে, আসহাবে কাহফকে বিশেষ মর্যাদা দানের জন্য শেষ যুগে জীবিত করা হবে। আসহাবে কাহফ হজ্জ করবেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতে দাখিল হবেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত হয়ে বিশেষ মর্যাদা লাভের জন্য আসহাবে কাহফের জীবনের কিছু অংশ যখন আল্লাহ তাআলা বাকী রাখলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতার জীবনের একাংশ অবশিষ্ট রাখা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ইবন জারীর আল্লাহ তাআলার বাণী- وَلَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضَىٰ এর তাফসীরে লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, لا يدخل احد من اهل بيته النار -“তাহার পরিবারের কেহই দোযখে যাবে না।” অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতা নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন, তাই তাঁদের আহলে ফিতরাত বলে গণ্য করা হয়। ইমাম কাসতালানী (র.) লিখেছেন, উসূলবেত্তা ইমামগণ ও শাফিঈ মাযহাববলম্বী শাস্ত্রবিদগণ একমত পোষণ করেন যে, নবুওয়াত ও রিসালাতের দাওয়াত পৌঁছার পূর্বে যারা মারা যান তারা মুক্তিপ্রাপ্ত। তাছাড়া কুরআন শরীফের আয়াত-

وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتّٰى نَبْعَثَ رَسُولًا

-আমি শাস্তি প্রদানকারী নই যতক্ষণ না কোনো রাসূল প্রেরণ করি। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-১৫)

ইমাম রাযী আসরারুত তানযীল কিতাবে تَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ আয়াতের তাফসীর উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলেন যে, আয়াতের অর্থ হলো- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূর এক সিজদাকারী থেকে অন্য সিজদাকারীতে স্থানাস্তরিত করা হয়েছে। ইমাম রাযী বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উর্দ্ধতন পুরুষের সবাই যে মুসলমান ছিলেন এখানে তার প্রমাণ রয়েছে। জীবন সায়াহ্নে মা আমিনা যে কবিতাগুলো আবৃত্তি করেছিলেন তার মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কথাই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। যেমন-

بارك فيك الله من غلام    ٭  يا ابن الّذى من حومة الحمام

نجا بعون الملك العلام   ٭  فودّى غداة الضّرب بالسّهام

بمائة من ابل سوّام   ٭  ان صحّ ماابصرت فى المنام

فانت مبعوث فى الانام    ٭  تبعث فى الحلّ وفى الحرام

تبعث فى التحقيق والاسلام   ٭  دين ابيك البر ابراهام

فالله انهاك عن الاصنام   ٭  وان لا توليها مع الاقوام

কবিতার অনুবাদ- যে প্রভাতে পণ নির্ধারণের জন্য তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সে প্রভাতে বলিষ্ট ও দীর্ঘাকৃতি একশত উষ্ট্রের বিনিময়ে সর্বজ্ঞাত অধিপতির কৃপায়, বিভিষীকাময় মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত জনকের সন্তান। আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন। আমি যদি সত্যই স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে থাকি তবে বলছি, তুমি মানব ও দানবের জন্য প্রেরিত হবে। হারাম (হেরেম শরীফ) ও হারামের বাইরে তোমার সত্যপস্থি পিতা ইবরাহীমের ইসলামের তরে সত্য-মিথ্যা প্রভেদকারীরূপে আবির্ভূত হবে। আল্লাহর শপথ! অন্য জাতির মত প্রতিমা পূজা ও তৎসংলগ্ন যাবতীয় গর্হিত কাজ থেকে তিনি তোমাকে মুক্ত রাখবেন।

তারপরও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতা-পিতাকে জাহান্নামী বলে মনে করা বড় অন্যায়। উপরন্তু অনেক হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঊর্ধ্বতন পুরুষদের কেউই মুশরিক ছিলেন না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

لم ازل انقل من اصلاب الطاهرين الىٰ ارحام الطاهرات

-সব সময়ই পুত চরিত্রের অধিকারী মানুষের মেরুদ- থেকে অনুরূপ চরিত্রের অধিকারী স্ত্রীলোকদের মধ্যে আমাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। কুরআন শরীফে আছে, إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ -নিশ্চয়ই মুশরিকগণ অপবিত্র। এ কথা স্থির নিশ্চিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো উর্দ্ধতন পুরুষ মুশরিক হতে পারেন না।

শিফা গ্রন্থের ভাষ্যকার সানূসী ও তিলমিছানী লিখেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জনক জননী যে পৌত্তলিক তা প্রমাণ করা আদৌ সম্ভব নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাক্রমে সৎ মহিলার গর্ভাশয়ে স্থানান্তরিত হয়েছেন। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী বলেন, আমি ইমাম রাযীর উক্তি দ্বারা যে অকাট্য প্রমাণ লাভ করলাম তা আম ও খাসের মধ্যবর্তী। আম দুটি ভূমিকা সম্বলিত। প্রথম ভূমিকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উর্দ্ধতন পুরুষদের সবাই সমকালীন ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন। তা বুখারী শরীফের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হাদীস-

بُعِثْتُ مِنْ خَيْرِ قُرُونِ بَنِي آدَمَ قَرْنًا فَقَرْنًا حَتَّى كُنْتُ مِنَ الْقَرْنِ الَّذِي كُنْتُ فِيهِ

-আমি যুগে যুগে সর্বশ্রেষ্ঠ আদম সন্তানদের মাধ্যমে এসেছি। এভাবেই আমি সে যুগে এসেছি যে যুগ আমার জন্য নির্ধারিত ছিল। (বুখারী, কিতাবুল মানাকিব, বাব- সিফাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)

২য় ভূমিকা- পৃথিবী কখনও সাতজন বা ততোধিক মুমিন থেকে খালি হয় না। যাদের কারণে আল্লাহ তাআলা শাস্তি প্রদান করেন না। যার প্রমাণ স্বরূপ নিম্নোক্ত হাদীস রয়েছে।

 اخرج عبد الرزاق وابن المنذر بسند صحيح علىٰ شرط الشيخين عن على (رض) قال لم يزل علىٰ وجه الدهر سبعة مسلمون فصاعدا فلولا ذالك هلكت الارض ومن عليها (১)

-আব্দুর রাজ্জাক ও ইবন মুনযির, ইমাম বুখারী (র.) ও মুসলিম (র.) এর শর্তসিদ্ধ সনদ মাধ্যমে আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, পৃথিবী কখনও সাত বা ততোধিক মুসলমান থেকে খালি হয় নি। অন্যথায় পৃথিবী ও তার বাসিন্দারা ধ্বংস হয়ে যেত।

 واخرج احمد فى الزهد والخلال فى كرامات الْاولياء بسند صحيح علىٰ شرط الشيخين عن ابن عباس (رض) قال ما خلقت الارض من بعد نوح من سبعة يدفع الله بهم عن اهل الارض (২)

-ইমাম আহমদ ‘আয যুহদ’ এর মধ্যে এবং খাল্লাল ‘শারামাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে ইমাম বুখারী (র.) ও মুসলিম (র.) এর শর্তসিদ্ধ সহীহ সনদ মাধ্যমে ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নূহ (আ.) এর পর থেকে কমপক্ষে সাতজন (মুমিন) আল্লাহ তাআলা সর্বদা সৃষ্টি করেন যাদের ওসীলায় পৃথিবীবাসী থেকে আযাব দূরে রাখেন।

যদি উপরোক্ত ভূমিকাদ্বয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায় তবে তার ফল দুটির একটি হবেই। (১) হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উর্ধ্বতন পুরুষগণ উল্লেখিত সাতজনের একজন হবেন; তবেতো আমাদের দাবী প্রমাণিত হয়ে গেল। অন্যথায় দুটি অবস্থার সৃষ্টি হবে। (ক) হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উর্ধ্বতন পুরুষ অন্যদের তুলনায় ভাল ছিলেন না; আর তা আদৌ গ্রহণ যোগ্য নয়। কেননা তা সহীহ হাদীসের পরিপন্থি। (খ) অথবা বলতে হয় তারা মুশরিক, তাও সর্বসম্মতিতে বর্জিত। কুরআন শরীফে আছে-

وَلَعَبْدٌ مُّؤْمِنٌ خَيْرٌ مِّن مُّشْرِكٍ

-মুশরিক থেকে মুমিন ক্রীতদাসও উত্তম। এতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা তাওহীদবাদী ছিলেন কেননা সমকালীন বিশ^বাসীর তুলনায় তাঁরা ছিলেন সর্বোত্তম।

খাস এর ক্ষেত্রে ইবন সাদ, ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আদম (আ.) পর্যন্ত নূহ (আ.) এর উর্ধ্বতন পুরুষরা মুসলমান ছিলেন। ইবন জারীর, ইবন আবি হাতিম, ইবনুল মুনযির বাযযার ও হাকিম সহীহ সনদ মাধ্যমে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আদম (আ.) থেকে নূহ (আ.) পর্যন্ত দশ পুরুষ সত্যপন্থি ছিলেন। পরে তাদের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। ফলে আল্লাহ তাআলা নবীগণকে প্রেরণ করেন।

কুরআন শরীফ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, নূহ (আ.) এর ছেলে ‘সাম’ ছিলেন মুমিন। সামের ছেলে আরফখশদ যে মুমিন ছিলেন তারও প্রমাণ আছে।

কালবীর সনদ মাধ্যমে ইবন সাদ রিওয়ায়াত করেন যে, নূহ (আ.) এর যুগ থেকে নমরূদ কর্তৃক বাবেল অধিকৃত না হওয়া পর্যন্ত সেখানকার অধিবাসীরা ছিল ইসলাম বিশ্বাসী। নমরূদ তাদের মূর্তিপূজার দিকে আহবান করে। তখন আযর ও ইবরাহীম (আ.) বর্তমান ছিলেন। ইবরাহীম (আ.) এর পরবর্তী বংশধর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاءٌ مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ

-ইবরাহীম (আ.) যখন তাঁর পিতা ও সগোত্রীয় লোকদের বললেন, তোমরা যাদের উপাসনা কর তাদের থেকে আমি মুক্ত। আমি তাঁরই ইবাদত করি যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন। (সূরা যুখরুফ, আয়াত: ২৬-২৭)

ইবন আবু হাতিম সুফিয়ান বিন উয়াইনাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, সুফিয়ান বিন উয়াইনাকে প্রশ্ন করা হল- ইসমাঈলের সন্তানদের মধ্যে কেউ কি মূর্তিপূজা করেছিলেন? তিনি জবাবে বলেন, না। আপনারা কি শুনেন নাই- وَاجْنُنِىْ وَبَنِىَّ اَنْ نَعْبُدُ   الْاَصْنَام “দেবতার উপাসনা থেকে আমাকেও আমার সন্তানকে তুমি পবিত্র রাখ।” পূনরায় প্রশ্ন করা হলো- ইসহাক (আ.) এর আওলাদ কি দুআর অন্তর্গত নন। তিনি উত্তর দিলেন, না। কেননা নির্দিষ্ট শহরের জন্যই দুআ করেছিলেন যেন তারা মূর্তিপূজা না করে। বসবাসের ব্যবস্থা করার জন্য শুধু ইসমাঈল (আ.) কে মক্কা শরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দুআ করেছিলেন,

رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا بَلَدًا آمِنًا

“হে রব! এ শহরকে নিরাপদ রাখ।” এখানে অন্য কোন শহরের কথা বলেন নাই। দুআ করেছিলেন, “আমাকে ও আমার সন্তানকে মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা কর।” মোটকথা- দুআটি ছিল কেবলমাত্র ইসমাঈল (আ.) ও তাঁর সন্তানদের জন্যই সীমাবদ্ধ।

ইবন মুনযির ইবন জুরাইজ থেকে رَبِّ اجْعَلْنِىْ مُقِيْمَ الصَّلٰوةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِىْ আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ.) এর বংশধরদের মধ্যে একটি দল সব সময়ই আল্লাহর ইবাদত করতেন এবং তাঁরা ছিলেন ফিতরাতের উপর।

ইবরাহীম (আ.) এর যুগ থেকে আমর বিন আমীর আল খুজাঈ পর্যন্ত আরবগণ দ্বীনে ইবরাহীমে দীক্ষিত ছিলেন এবং তন্মধ্যে কেউই মূর্তিপূজা করেন নাই বলে বুখারী শরীফসহ বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমর বিন আমীরকে আমর বিন লুহাইও বলা হয়। ঐ ব্যক্তিই সর্বপ্রথম দ্বীনে ইবরাহীমির পরিবর্তন সাধন করে মূর্তিপূজা আমদানি করে। উক্ত আমরুবনু আমির রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্বপুরুষ কেনানার কাছাকাছি সময়ে ছিলেন। উলামাগণের উপস্থাপিত দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে আদনান, মা’আদ, রবিআ, মুদার, খুযাইমা, আসাদ, ইলইয়াছ, কা’ব দ্বীনে ইবরাহীমির অনুসারী ছিলেন।

ফেইসবুকে আমরা...