1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
উপমহাদেশের সমসাময়িক বাস্তবতায় বালাকোটের প্রাসঙ্গিকতা
হামিদ মাশহুর
  • ৩ মে, ২০২৩

এই উপমহাদেশে মুসলমানদের সংগ্রামী ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় বালাকোট।  প্রতিবছর মে মাস আসলেই ইতিহাসের ছিন্নপত্র থেকে আমরা তালাশ করতে থাকি বালাকোটের সেই সুমহান আত্মদানের স্মৃতি, স্মরণ করি ঘুমিয়ে থাকা মুসলিমদের আবারো জিহাদের বাস্তব রূপ দেখিয়ে যাওয়া মুক্তি সংগ্রামের পথিকৃৎদেরকে। প্রায় দুই শতাব্দী পার হতে চললেও বালাকোটের সংগ্রামী চেতনা, বালাকোটের মুজাহিদদের রণহুঙ্কার আজ উপমহাদেশের মুসলমিদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকিই কেবল নয় বরং টালমাটাল মুসলিম সমাজের জন্য দিকনির্দেশক আলোকবর্তিকা, পাঞ্জেরি।
বর্তমান পাকিস্তানের  উত্তর-র্পূবাঞ্চলের হাযারা এলাকার অর্ন্তভুক্ত অঞ্চল বালাকোট। ১৮৩১ সালরে ৬ মে এই বালাকোটেই ব্রিটিশ মদদপুষ্ট অত্যাচারী শিখদের বিরুদ্ধে নিজের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত জিহাদ করে শাহাদাতের শরাব পান করেন আযাদী আন্দোলনের প্রথম ও সর্বোচ্চ সিপাহসালার, আমীরুল মুমিনীন,  সায়্যিদ আহমদ শহীদ রায় বেরেলী (র.)। শাহাদাতবরণ করেন ভারতের নানাপ্রান্ত থেকে আসা আজাদ হিন্দের স্বপ্নে বিভোর ঈমানদারদের এক বিরাট বহর। এ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফল বিশ্লেষনে মুজাহিদীনদেরকে সুষ্পষ্টভাবে বাহ্যিক বিজয়ী বলা যায় না। কিন্তু বালাকোটের মুজাহিদদের জিহাদই এই উপমহাদেশে এখনো ইসলামের নূর প্রজ্জলিত রাখার প্রধানতম উপাদান, এ কথা অকপটে বলা যায়। ১৮৩১ সালের বালাকোটের জিহাদ কেবল কয়েক হাজার শিখ সেনার বিরুদ্ধে কয়েকশত মুজাহিদের নিছক এক যুদ্ধ ছিলনা। এ জিহাদ ছিল পুনর্জাগরণের। এ জিহাদের শিকড় যুক্ত ছিল, বদর, কারবালা, আইন জালুত আর নদিয়ার সাথে। বাংলায় ইসলামের নবযুদের সূচনায় বখতিয়ারের নদিয়া বিজয় যতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, উপমহাদেশে দ্বীনের নিভু নিভু আলোকে প্রজ্জ্বলিত রাখতে এবং এই জনপদে ইসলামের অস্তিত্বের জানান দিতে সায়্যিদ আহমদের বালাকোটর জিহাদও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বালাকোটের প্রভাব আজকাল অনেকেই এড়িয়ে যেতে চান। তাদের দেখে অবাক হইনা। এদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাঠ্যবইয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের যে ইতিহাস পড়ছে তাতে বালাকোটের অনুপস্থিতি অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক হলেও বাস্তব। আমরা পাঠ্য বইয়ে ১৮৫৭ সালের, তিতুমীরের বাশেঁরকেল্লা ইত্যাদির কথা পড়ে আসলেও তিতুমীর যেখান থেকে ঈমানের, জিহাদের দীক্ষা নিয়েছিলেন সেই জিহাদী পীর সায়্যিদ আহমদ (র.) ও বালাকোটের বাইআতকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে বারবার। তাই যাদের ইতিহাসের জ্ঞান কেবল পাঠ্যবইয়েই সীমাব্ধ তাদের জন্য বালাকোটের প্রভাব বুঝা খানিকটা দুস্কর বৈকি।

বালাকোট কেন গুরুত্বর্পূণ ছিলো এর নানামুখী আলোচনা, গবেষণা হয়েছে। এর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে দিক তা হলো বালাকোটের সর্বজনীনতা। শতধা বিভক্ত মুসলিম সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু অংশ ছাড়া উপমহাদেশের প্রায় সকল দল-উপলদলই বালাকোটকে নিজেদের দাবি করে। তরীকদের বিভিন্ন ঘরানা, দেওবন্দী-কওমীরা তো বটেই আজকাল আহলে হাদীস লা-মাযহাবীদের মুখেও শুনা যায় বালাকোট তাদের আন্দোলন ছিল। মুষ্টিমেয় কিছু মুজাহিদের এই জিহাদকে দুইশত বছর পরে এসেও কেন সবাই নিজেদের আন্দোলন বলে দাবি করতে চায় এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই বালাকোটের অবদান নিহিত। যারা বালাকোট নিজেরদর আকাবিরদের আন্দোলন দাবি করেন তারা সহ যারা দাবি করেন নর তারাও জানেন যে এই জিহাদই ছিলো পরাধীন ভারতে মুসলামানদের প্রথম সংঘবদ্ধ সশস্ত্র প্রতিরোধ।

তরীকায়ে মুহাম্মদীয়ার জিহাদের মাধ্যমে যে আত্মসচেতনতা সায়্যিদ আহমদ (র.) উপমহাদেশের মুসলিমদের হৃদয়ে ফুৎকার করে গিয়েছিলেন সেই আত্মসচেতনতাই তাদেরকে বারবার স্মরণ করিয় দিয়েছে তারা পরধীন, তাদের স্বাধীন হতে হবে। শহীদে বালাকোটের আত্মদানের উপরই নির্মিত হয়েছে বাশেঁরকেল্লা, বালাকোটের  শাহাদাতই সিপাহী জনতার কণ্ঠে ফিরে এসেছিলো ১৮৫৭ সালৈ। বালাকোটের জিহাদের পরবর্তী একশ বছর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উলামায়ে কিরামের যে সরব উপস্থিতি তারও মূলে রয়েছে শহীদে বালাকোটের হাতে মুজাহিদদের বাইআতের স্মৃতি। এই বাইআতের স্মৃতিকে ধারণ করেই কারামত আলী জৌনপুরী (র.) বাংলার অলিতে গলিতে ঘুরেছেন মুসলমানদের কুসংস্কার মুক্ত করতে এবং একটি জাতীয় চেতনার দীক্ষা দিতে, এই বাইআতের স্মৃতিকে ধারণ করেই দেওবন্দের সংগ্রাম চলছে, ফুরফুরার সংস্কার চলছে এমনকি পাকিস্তান আন্দোলন হয়েছে। বস্তুত সায়্যিদ আহমদ (র.) এর তরীকায়ে মুহাম্মদিয়ার এই বাইআত আমার কাছে আমার কাছে তাই মাঝে মাঝে প্রমত্তা মেঘনা নদীর মতো মনে হয়। এই বাংলায় পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমাসহ আরো কত নদী বয়ে গেছে। কিন্তু এ সবেরই মিলিত স্রোত মেঘনা নাম ধরে মিশে গেছে সাগরের সাথে। ভারতীয় উপমহাদেশে তরীকায়ে মুহাম্মদিয়া ঠিক সেরকমেই । নানা সিলাসিলার নানা পথ, নানা মতের প্রচার  থাকলেও প্রায় সকল মত ও পথের ঠিকানা মিশে বালাকোট, তরীকায়ে মুহাম্মদীয়ায় তথা সায়্যিদ আহমদ রায়বেরেলী (র.) এর কাছে।

উপমহাদেশে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপটে বালাকোটের প্রাসঙ্গিকতা এতো প্রসিদ্ধ যে এ সম্পর্কে  নতুন করে আলোচনার তেমন প্রয়োজন রাখেনা। বরং সমসাময়িক উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে বালাকোট যে আবারো ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এ বিষয়ে আলোচনা এবং গবেষণা জরুরী। এই ভারত উপমহাদেশে যে নতুন করে একটি আজাদী মুজাহিদ ফৌজের অপেক্ষার প্রহর গুনছে তা মিডিয়ায় যারা নিয়মিত চোখ রাখেন তারা বেশ ভালভাবেই ওয়াকিফহাল। কয়দিন আগেই যোগীরাজ্যের বুলডোজার চলেছে শের শাহের তৈরী চারশত বছরের পুরনো মসজিদের উপর, উগ্র গো-পূজারীদের চারণভূমিকে পরিণত হওয়া হিন্দাস্থান মুসলমানদের জন্য ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এই অবস্থা তো আমাদের বালাকোটরে সেই সময়কার  শিখদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় তখন যেমন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদেরে মদদপুষ্ট রনজিৎ সিংরা ছিলৈা এখনো তেমনি সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট যোগী, মোদিরা আছে। ভারতের তথা গোটা হিন্দুস্থানের মুসলমানরা এই যোগী-মোদি বিভীষিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রেরণা পেতে পারেন বালাকোট থেকে যে শিক্ষা নিতে পারেন বালাকোট থেকে। নানা মত, নানা পথে বিভক্ত হিন্দস্থানের মুসলমানদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যা তার নাম ইত্তিহাদ, ঐক্য। আর বালাকোট তো এ উপমহাদেশে ঐক্যের ট্রেডমার্ক। আমাদের সকল পথের মিলিত স্রোতের নাম বালাকোট। এই চেতনাকে সামনে রেখেই এখন উপমহাদেশের মুসলমানদের পথচলা উচিত।

ভারতে উগ্র হিন্দুদের জিঘাংসা এবং পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহে ভারতের প্রভুত্ব কায়িমের প্রচেষ্টা একটি প্রতিশ্রুত গাওয়ার প্রতিধ্বনিই যেন আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দ্বীনের জন্য, ঈমানের জন্য যে ফৌজ তৈরী হবে তাদের জন্য বালাকোট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ  বার্তা দিয়ে যায়। বালাকোটে মুজাহিদীনদের যে বিপর্যয় হয়েছিলো এর কারণ শিখদের  সংখ্যাধিক্য ছিলনা, মুজাহিদদের দুর্বলতাও ছিলোনা। এর কারণ ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। দ্বীনের সঠিক মর্ম  সম্পর্কে বেখবর রুসম-রেওয়াজকে দ্বীন মনে করা গোষ্ঠী সেসময় বালাকোটের জিহাদী ও তাজদীদি চেতনা পছন্দ করেনি। ফলে আমীরুল মুমিনীন এর হাতে বাইআত হয়েও তারা শপথ ভঙ্গ করছে, বিদ্রোহ করছে। সায়্যিদ ছাহেবের প্রায় দশ সহস্রাধিক মুজাহিদের বাহিনী একসময় তাই সাত আটশোতে এসে ঠেকেছিলো। শপথ ভঙ্গ আর বিদ্রোহই তাদের শেষ হয়নি, বরং বালাকোটের প্রান্তরে শিখদের পক্ষাবলম্বন করে বিশ্বাসঘাতকতাও করেছিলো তারা। সে রেওয়াজী মুসলিমরা আজো বালাকোটের নামে নানা অপবাদ প্রচারে ব্যস্ত; পূর্বে  যেমন ব্রিটিশদের পদলেহন করে স্বার্থ আদায় করছে এখনো ক্ষমতাধরদের পদলেহনে ব্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে তারা আতাত করবে না একথা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।

সায়্যিদ আহমদ রায়বেরেলীর আন্দোলন সংগ্রাম কেবল সশস্ত্র জিহাদই ছিলোনা বরং তার তাজদিদী অবদানও সর্বজন স্বীকৃত। বস্তুত শাহ ওয়ালীউল্লাহর এই রূহানী সন্তানের সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন তাদের মাধ্যমে উপমহাদেশে ইসলামের সাংস্কৃতিক ও আধ্যত্মিক পুনর্জাগরণও সাধিত  হয়েছিলো। পলাশীর আম্রকানন আর বক্সারে ক্লাইভদের বিজয়ের পর দ্বীনি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে ওয়াকফিয়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, খ্রিষ্টবাদের প্রসারে মিশনারীদের ব্যাপক আগমন, ফোর্ট  উইলিয়াম কলেজ, বেঙ্গল থিয়েটার ইত্যাদির সূচনা এসব উপমহাদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশকদের কালাচারাল ক্রুসেডেরই অংশ ছিল। অধুনাকালের ভুলোমনা বাংলাদেশীরা খেয়ালই করছেন না। কিছু সংস্থা এই ভূখণ্ডে এখন পানির বদলে জল পান করাচ্ছে, খাবারের বদলে আহার বিলাচ্ছে, গরীবের হক্ব যাকাতের টাকা মেরে দেওয়ার ফন্দি আটঁছে। আজকের এই সময়ে শহীদে বালাকোটের কর্মপন্থার অনুসরণ করেই আমাদেরকে ইসলামী আন্দোলনের সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

ফেইসবুকে আমরা...