1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
বাঙালিত্ব, জাতীয়তাবাদ ও মিল্লাতে ইবরাহীম : আত্মপরিচয়ের সন্ধানে
মারজান আহমদ চৌধুরী
  • ৩ জুন, ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতি, ব্যুরোক্রেসি, সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও মিডিয়ায় সক্রিয় এলিটদের একচেটিয়া বয়ান হচ্ছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনা। এরকম বয়ান শুনে নিশ্চয়ই পাঠকও অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তবে এ বয়ান কেবল আওয়ামী লীগের নয়; নানা শব্দে, নানা বাক্যে এটি বাংলাদেশের পুরো অভিজাতশ্রেণির বদ্ধমূল বিশ্বাস। জাতীয়তাবাদ আসলে কী? কেতাবি সংজ্ঞা বহু আছে, তবে সরল ভাষায়- “জাতীয়তাবাদ (nationalism) হচ্ছে কোনো জাতিসত্তার মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি।” যদি তা-ই হয়, তাহলে আমার অনুভূতি তো অন্য কেউ; এমনকি আমার রাষ্ট্রও ঠিক করে দিতে পারে না। রাষ্ট্র আমার নাগরিক পরিচয় নির্ধারণ করতে পারে। আমার জাতীয়তা (nationality) বাংলাদেশি, আবার বাংলাদেশের এক অবাঙালি আদিবাসীর জাতীয়তাও বাংলাদেশি। এটি আমাদের নাগরিক পরিচয়। কিন্তু আমি কার সাথে ঐক্যের অনুভূতি অনুভব করব, কেন এবং কীসের ভিত্তিতে করব, তা আমি নিজে নির্ধারণ করার কথা। রাষ্ট্রের অভিজাতশ্রেণি আমার কাঁধে একটি অনুভূতির ভার চাপিয়ে দিলেই কি সেটি আমাকে বহন করতে হবে?

নৃতাত্ত্বিক-ভাষাগত (ethno-linguistic) দিক থেকে আমি বাঙালি। এটি আবেগ নয়; গূঢ় বাস্তবতা। বাকি বাঙালিদের সাথে আমার ভাষা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ভৌগোলিকতা, রীতি ও অভ্যাসের মিল আছে। বাকি বাঙালিদের মতো আমি মাছ-ভাত খাই, লুঙ্গি পরি। সিংহভাগ বাঙালির মতো আমার পরিবারও কৃষিভিত্তিক সমাজে বসবাস করে। এসব নিয়ে আমার কোনো দ্বিধা নেই। তা সত্ত্বেও বাঙালি জাতির সাথে আমার শতভাগ ঐক্যের অনুভূতি না-ও থাকতে পারে। ঐক্যের অনুভূতি যে কেবল নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত, স্থানগত বা অভ্যাসগত মিলের কারণেই হবে, এটি তো কেউ বেঁধে দেয়নি। অথবা আমি কোনো প্রাগৈতিহাসিক গোত্রে বাস করি না যে, গোত্রের প্রতিটি কথায় আমাকে জি-হুযুর করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, ঐক্যের অনুভূতির জন্য আদর্শগত, বোধগত ও চেতনাগত মিল থাকাও প্রয়োজন। বাঙালি হওয়ার পাশাপাশি আমি একজন মুসলিম। এটি আমার অন্যতম বড় পরিচয়। অভিজাতশ্রেণি আমাকে শিখিয়েছে, ‘বাঙালি’ পরিচয় আমার ‘জাতীয়’ পরিচয়, আর ‘মুসলিম’ আমার ‘সাম্প্রদায়িক’ পরিচয়। কারণ বাঙালি পরিচয়ের মাঝে সব ধর্মের মানুষ অন্তর্ভুক্ত, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস এক। এ কথা মেনে নিলেও প্রশ্ন আসে, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিকতা এক হওয়ার জন্য যদি কিছু মানুষ একটি জাতি হতে পারে, তাহলে একই বিশ্বাস ও জীবনাদর্শ লালন করা কিছু মানুষ কেন জাতি না হয়ে কেবল সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচিত হবে? এসব প্রশ্ন অহেতুক নয়। এই প্রশ্নগুলো আমাদের ঐতিহাসিক পরিচয় (historical identify) এবং অধিকারবোধের (sense of belongings) সাথে জড়িত। তাই অভিজাতশ্রেণির বয়ানের বাইরে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি, নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগত দিক থেকে বাঙালি হওয়ার কারণে বাঙালি জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্যের সাথে আমার যতটুকু মিল আছে, তারচেয়ে বেশি মিল আছে মুসলিম সভ্যতার সাথে। বিশ্বাসগত, বোধগত ও আদর্শগত দিক থেকে আমার civilizational root বা সভ্যতার শেকড় হচ্ছে মিল্লাতে ইবরাহীম।

আমার দাবির প্রমাণস্বরূপ কয়টি উদাহরণ দিচ্ছি। প্রায় চার হাজার বছরের বাঙালি সভ্যতা বিশ্বাসগত দিক থেকে মূলত একটি বহুঈশ্বরবাদী (polytheistic) সভ্যতা ছিল। বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির মাঝে পৌত্তলিকতার প্রাধান্য চোখে পড়ার মতো। অথচ আমি একেশ্বরবাদী (monotheistic)। কারণ পাঁচ হাজার বছর আগে আমার মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ একেশ্বরবাদের (তাওহীদ) প্রচার করে গেছেন। বাঙালি হিন্দু ও বৌদ্ধরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। পক্ষান্তরে আমি আখিরাতে বিশ্বাসী। কারণ হযরত ইবরাহীম আখিরাতে বিশ্বাসী ছিলেন। বাঙালি সভ্যতায় ঐশ্বরিক অবতারের ধারণা আছে, যাদের মূর্তি বানিয়ে পূজা করা হয়। কিন্তু আমি কোনো নবীর পূজা করি না। কারণ নবীরা খোদা বা খোদার অংশ নন। এসব কেবল আমার ব্যক্তিগত ‘ধর্মমত’ নয়। এ বিশ্বাসগুলো আমার জীবনের গতি-প্রকৃতি, আদর্শ, মূল্যবোধ, পছন্দ-অপছন্দ, বন্ধু-শত্রু নির্ধারণ করে। হযরত ইবরাহীম মক্কা শহরে একটি চারকোণো ঘর নির্মাণ করেছেন, যে ঘরের সাথে বাঙালি সভ্যতা-সংস্কৃতির কোনো লেনদেন নেই। অথচ সে ঘরই আমার কিবলাহ—আমার আস্থা-বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রস্থল। বাঙালি সংস্কৃতিতে খতনা নেই, দাড়ির আবশ্যকতা নেই, আল্লাহর নামে কুরবানীর রীতি নেই। কিন্তু আমি খতনা করেছি, দাড়ি রাখি, কুরবানী দেই। এজন্য নয় যে, আমি অন্য বাঙালির চেয়ে আলাদা হতে চাই। বরং এজন্য যে, এগুলো হযরত ইবরাহীমের সংস্কৃতি। বাঙালির ঐতিহ্যগত উৎসব থেকে আমার মূল উৎসবগুলো আলাদা; উৎসবের রঙ-ঢংও আলাদা। আমার ইবাদত, আমার উৎসব ও সংস্কৃতির পরতে পরতে আমার মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ’র স্মৃতির ছোঁয়া লেগে আছে। এমন বহু উদাহরণ পরখ করে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আমার civilizational root হচ্ছে মিল্লাতে ইবরাহীম এবং মিল্লাতে ইবরাহীমের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্করণ—উম্মাতে মুহাম্মাদী। নিজেকে আমি উম্মাতে মুহাম্মাদীর মাঝে খুঁজে পাই—বিশ্বাসে, আদর্শে, চেতনায়—জাতিগত ঐক্যের অনুভূতিতে। তাই পাশের দেশের বাংলাভাষী, লুঙ্গিপরা, ভাত-খাওয়া বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ বা নাস্তিকের সাথে আমার সেই ঐক্যের অনুভূতি আসে না, যে অনুভূতি আসে ফিলিস্তিনের আরবীভাষী, ইরাকের কুর্দিভাষী, পাকিস্তানের কুর্তা-পরা, মালয় দ্বীপের নাক-বোঁচা, মরোক্কোর রুটি-খাওয়া, কিংবা সুদানের কালো রঙের এক মুসলমানের সাথে। কারণ স্থান, ভাষা ও রীতিতে বেমিল থাকা সত্ত্বেও দ্বীন ও উম্মাতের চেতনায় আমরা ভাই-ভাই।

অভিজাতশ্রেণির চেতনার বয়ানের সামান্য গভীরে গেলে দেখতে পাবেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস ভিজে আছে খাজনার বোঝা বইতে না পেরে হিন্দু জমিদারের হাতে নিষ্পেষিত হওয়া বাংলার মুসলিম কৃষকের অশ্রুতে। ১৭৯৩ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর বাংলার সিংহভাগ জমিদারি গিয়ে ওঠে হিন্দুদের হাতে। তারা মুসলমানদেরকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে শোষণ করত। উচ্চবিত্ত হিন্দুরা মুসলিম ভাবাদর্শ ও সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য উনবিংশ ও বিংশ শতকে বেঙ্গল হিন্দু রেনেসাঁর সূচনা করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রত্যেক বাঙালি বুদ্ধিজীবী হিন্দুত্ববাদকে সাংস্কৃতিকভাবে শক্তিশালী করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। সেসময় ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ’ এর প্রবক্তা হয়ে আবির্ভূত হন মুসলিম-বিদ্বেষের গুরু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মুসলমানদেরকে যবন, নেড়ে, ম্লেচ্ছ, পাপিষ্ঠ, পাপাত্মা, দুরাত্মা, নরাধম, নরপিশাচ কোনো গালি দিতে বঙ্কিমবাবু বাদ রাখেননি। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে তিনি লিখেন, “এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধা-মাধবের মন্দির গড়িব?” কম নন বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ‘আলফা মেইল’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। একজন টিপিক্যাল প্রজা-শোষক জমিদার ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে তিনি চাইতেন, মুসলমানরা হিন্দু সমাজে লীন হয়ে যাক। বঙ্গভঙ্গের পর লিখিত ‘শিবাজী উৎসব’ নামক চরম মুসলিম-বিদ্বেষী কবিতায় তিনি ভারতে কেবল একটি ধর্মের (হিন্দু) উপস্থিতি কামনা করেন। সঞ্চয়িতা, দুরাশা, প্রায়শ্চিত্ত, কণ্ঠরোধ, বৌ-ঠাকুরানীর হাট প্রমুখ লেখায় মুসলমানদেরকে তিনি যারপরনাই গালাগাল করেছেন। আর. সি. মজুমদার লিখেছেন, শিখ, রাজপুত ও মারাঠাদের গৌরবকীর্তন করলেও মুসলমানদের কোনো কৃতিত্বকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেননি। আবুল মনসুর আহমদের মতে, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে কতবার আনন্দময়ী (দুর্গা) এসেছে গিয়েছে, কিন্তু সেই বিশ্বভারতীর বিশ্বে একদিনের জন্যও ঈদ-মহররমের চাঁদ ওঠেনি। কম যাননি বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। ১৯২৬ সালের ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ শীর্ষক ভাষণে তিনি ভারতকে হিন্দুদের দেশ এবং মুসলমানদেরকে লুণ্ঠনকারী, সতীত্বহরণকারী ইত্যাদি বলে পরিচয় দিয়েছেন। বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও বিজ্ঞানী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মাঝেও মুসলিম-বিদ্বেষ লক্ষণীয় ছিল। আশুতোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিলেন। কেবল মুসলিম হওয়ার কারণে তিনি তার ছাত্র, বিজ্ঞানী কাজী মোতাহার হোসেনকে প্রশংসাপত্র দেননি। ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর. সি. (রমেশচন্দ্র) মজুমদারের মুসলিম-বিদ্বেষও লুকানো নয়। ভদ্রলোক তার ইতিহাসগ্রন্থে উপমহাদেশে মুসলমানদের ইতিহাসকে হেয় করতে কোনো কসরত বাকি রাখেননি। এরা সবাই বাঙালি হিন্দু রেনেসাঁর পুরোধা। হিন্দুদের ন্যারেটিভ ছিল মুসলমানরা হচ্ছে বহিরাগত, আর হিন্দুরা এ মাটির ভূমিপুত্র। অথচ এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। অন্য কোনো দেশ থেকে লাখে-লাখে মুসলমান কখনও ভারতে পাড়ি জমায়নি। মুসলমানরা এই মাটির সন্তান, এই মাটিও মুসলমানদের।

মুসলমানদের অধিকার রক্ষার জন্য ১৯০৬ সালে বাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠন করেন। ১৯২৮ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক কৃষকদের অধিকারের দাবি নিয়ে উঠে দাঁড়ান। ওদিকে খিলাফত আন্দোলনে বাংলার আলিম-সমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বুঝাই যাচ্ছিল, বাংলার মুসলমানদের মধ্যে একটি আত্মবোধ জেগে ওঠেছে। পাকিস্তান-প্রসঙ্গও তখন বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে। এরপর বাঙালি হিন্দুরা যে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করেছিল, জয়া চ্যাটার্জি তাঁর Bengal Divided বইতে তা সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হিন্দু সম্প্রদায় (যারা ‘ভদ্রলোক’ নামে পরিচিত ছিল) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের অধীনে তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে ১৯৩২ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বারবার উস্কে দিয়েছে। বাংলায় তখন যে খুনোখুনি হয়েছিল, তা পড়লে আত্মা কেঁপে ওঠে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলো এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের সাথে চলে গেল। রাতারাতি প্রভুর পদ থেকে নেমে হিন্দুরা পূর্ব বাংলায় সংখ্যালঘু হয়ে গেল। নতুন রাষ্ট্রে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, ক্ষমতাবান। বাংলা বেহাত হয়ে যাওয়ার পর সঙ্গত কারণে হিন্দুরা হিন্দুত্বের পরিবর্তে বাঙালিত্ব ব্যবহার করতে শুরু করে। উনিশ শতকের শুরুতে যা ছিল বেঙ্গল হিন্দু রেনেসাঁ, খোলস পাল্টে সেটিই হয়ে যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

অভিজাতশ্রেণি বলবে, আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ উগ্র নয়। এটি ধর্মনিরপেক্ষ—সফট। কতটুকু ধর্মনিরপেক্ষ, তা দেখে আসছি বছর-বছর। সাংস্কৃতিক অভিজাতশ্রেণির কাছে রবীন্দ্রনাথ কবি থেকে উন্নীত হয়ে ‘নবী’ হয়ে গেছেন, অথচ মুসলিম কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষানুরাগী, সামাজিক-রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ আশ্রয় নিয়েছেন ইতিহাসের ফুটনোটে। কোথায় ব্রিটিশবিরোধী সেনানায়ক তিতুমীর? কোথায় নবাব আব্দুল লতিফ, নবাব নওয়াব আলী, নবাব সলিমুল্লাহ? শেরে বাংলা ও ফররুখ আহমদ আজ কোথায়? নজরুল তো কোনোমতে টিকে আছেন। অবশ্য গত দেড় দশকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ ছাড়া আর কারো নামই শোনা যায়নি। এখানে রবীন্দ্রনাথ মানে বাঙালিয়ানা, আর আল্লামা ইকবাল মানে মৌলবাদ। এখানে ঈদকে বলা হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব, অথচ দুর্গাপূজাকে বলা হয় সার্বজনীন। দেশে কলকাতাপন্থী রাবীন্দ্রিক চেতনার নামে রাজনীতি করলে সেটি হয় জাতীয়, কিন্তু ইসলামের নামে একটি সামাজিক কাজ করলেও তা হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক। গত দেড় দশকে কত মেয়েকে নিকাব-হিজাবের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক হয়রানি করা হয়েছে, দাড়ি-টুপির কারণে কত ছেলে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অথচ কপালের টিপ নিয়ে কিছু বললেই জুটেছে উগ্র মৌলবাদীর খেতাব। মঙ্গল শোভাযাত্রার পৌত্তলিক উৎসবকে বাঙালির প্রাণের উৎসব হিসেবে পালন করতে বাধ্য করা হয়েছে। মোটকথা, হিন্দুত্বের উদর থেকে জন্ম নেওয়া ‘বাঙালিয়ানা’ হিন্দু সংস্কৃতিকে আপন করে নিলেও মুসলিম সংস্কৃতিকে সহ্যই করতে পারে না। আবারও বলছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বয়ান কেবল আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত নয়। এটি দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরতে পরতে গাঁথা। একটি উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। হিন্দুরা ১৯৪৭-এ ভারতমাতার বিভাজনকে মানতে পারেনি। তাই তারা ৪৭-কে সেপারেশন বা দেশভাগ বলে। তাদের সাথে সুর মিলিয়ে দেশের মুসলমানরাও ৪৭-কে দেশভাগ বলে। অথচ ৪৭ ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বাধীনতা। ৪৭ না হলে ৭১ হতো না। কিন্তু আজ পর্যন্ত দেশের একটি রাজনৈতিক দলও ৪৭-কে ধারণ করতে পারেনি। সম্ভবত অভিজাতশ্রেণির নারাযির ভয়ে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিন্দা করার অর্থ এই না যে, আমি অন্য কোনো জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। আমি সে অর্থে মুসলিম জাতীয়তাবাদীও নই। উম্মাতে মুহাম্মাদী কোনো ‘কউম’ বা ‘জাত’ নয় যে, আমাকে জাতীয়তাবাদী হতেই হবে। এটি একটি উম্মাহ—বহু জাত, বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু বর্ণ, বহু স্থান-কালকে বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আদর্শের ভিত্তিতে বুকে ধারণ করা বহু মানুষের এক সম্মিলন। জাতীয়তাবাদের সমস্যা হচ্ছে, অতিরিক্ত জাতীয়তাবাদীরা নিজ জাতিকে অতি-মানব (ফ্রেডরিখ নিৎশের ভাষায় ‘উবারমেনশ’), আর অন্য জাতিকে অপ-মানব (নাৎসিদের ভাষায় ‘উন্টারমেনশ’) মনে করে। যেভাবে হিটলার করেছিল, যেভাবে আজ ইসরায়েল করছে। অপরদিকে, আমি কাউকে উবারমেনশ বা উন্টারমেনশ মনে করতেই পারি না। কেউ মুসলিম হওয়ার কারণে জন্মগতভাবে অতি-মানব, আর হিন্দু হওয়ার কারণে অপ-মানব, এ আমার বিশ্বাস নয়। আমাদের নবী পুরো সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত, পুরো মানবজাতির কল্যাণকামী। এই সাম্য আমাদের মিল্লাত ও সংস্কৃতির ভিত্তি। তাই আমি জাতীয়তাবাদী নই; আমি এক বিশ্বজনীন উম্মাহর অংশ।

বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের স্বাধিকারের প্রশ্নে এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। বাংলার ভাষা-সাহিত্য, খাদ্য-পোষাক, মাটি ও মানুষ আমার আপন। এই দেশ ও জাতির প্রতি আমার বিশ্বস্ততা, মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ আছে। কিন্তু দেশকে আপন করার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামক এক উদোর পিণ্ডি ঘাড়ে তুলে অন্য দেশের মুসলমানদের আমি শত্রু মনে করব না। আমার মুসলিমবোধ এতে প্রবলভাবে বাধা দেয়। অভিজাতশ্রেণির বানানো জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের গালভরা চেতনাগুলো না গিলেই এতদিন ধরে আমি আমার দেশ-জাতিকে ভালোবেসে যাচ্ছি, ভবিষ্যতেও ভালোবেসে যাব।

ফেইসবুকে আমরা...