1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
তালেবান প্রসঙ্গ : বাস্তবতা ও করণীয়
মোস্তফা মনজুর
  • ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল হলো। প্রত্যাশিতভাবেই তালেবান কর্তৃক বিনা রক্তপাতে রাজধানী কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্বের যাত্রা শুরু হলো। ক্ষমতার এই পালাবদলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে শরীআ আইন। বস্তুত পূর্বেকার শাসন ও তালেবান শাসনের মূল পার্থক্য এটাই। যে লক্ষ্য নিয়ে কয়েক দশক আগে তালেবানের উদ্ভব হয়, বলা যায়, সাম্প্রতিক ঘটনায় সে পথের শুরু হয়েছে। মনে রাখা উচিত, ক্ষমতা দখল তালেবানের মূল টার্গেট নয়, মূল উদ্দেশ্য শরীআ আইনের বাস্তবায়ন। ফলে ক্ষমতা দখল হয়ে গেছে বলে আত্মতৃপ্তি নিয়ে বসে থাকলে আসল উদ্দেশ্য কিন্তু হাসিল হবে না। সারা দেশে শরীআ আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে বুঝা যাবে যে তালেবান তাঁদের আন্দোলনে সফল হয়েছে।

যাইহোক, আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নই। তালেবানের রাজনীতি, বহিঃর্বিশ্বে তাঁদের অবস্থান, ভবিষ্যতের যাত্রাপথ কেমন হবে, কতটুকু পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যে অটল থাকতে পারবে তা সময়ের হাতেই তোলা থাকুক। আমরা হয়ত অনুমান করতে পারব, কিন্তু নিশ্চিত করে কি কিছুই বলা যায়? অন্তত তালেবানের ক্ষেত্রে? আমি তো অনুমান করতেও ভয় পাই। কেননা বাস্তবিক দুনিয়ার প্রায় সব সমীকরণই তালেবানের হাতে উলটে গেছে। তাই রাজনীতির অনুমান করাটা বাতুলতাই মনে হচ্ছে। অন্তত এই প্রাথমিক পর্যায়ে তো অবশ্যই। ফলশ্রুতিতে রাজনীতি নয়, আজ আমি ধর্মীয় পরিমণ্ডলেই তালেবান প্রসঙ্গে আলোচনা করছি। তালেবানের এই বিজয়ে (যদিও তা আমার হিসাবে আংশিক সফলতা তারপরও আমি বিজয়ই বলতে চাই) মুসলিম হিসেবে আমাদের কি করা উচিত এবং আমাদের বর্তমান বাস্তবতা কী বলছে সে বিষয়েই আজকের আলোচনা।

১. তালেবানের ক্ষমতা লাভ ও আমাদের সামাজিক বাস্তবতা

তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রতিক্রিয়ায় সাধারণত আমাদের সমাজে, মুসলিমদের মধ্যে, তিনধরণের লোক দেখা যাচ্ছে। আমি অমুসলিমদের কথা বলতে যাচ্ছি না। কেননা সেখানে বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবাই এক দলের।

বলছিলাম তিনশ্রেণির মুসলিমের কথা। সেটা কেবল বাংলাদেশেই নয়, আরব ও পাশ্চাত্য মুসলিমের মধ্যেও মোটাদাগে এ বিভাজন দেখা যাচ্ছে। প্রথমপক্ষ, যারা তালেবানের বিজয়ে খুশি ও সমর্থন জানাচ্ছেন। দ্বিতীয়পক্ষ, যারা তালেবানের বিপক্ষে। পক্ষে-বিপক্ষের এই অবস্থান প্রকাশ্যে হতে পারে কিংবা গোপনে; আবার একেবারে চরমভাবে সমর্থন বা বিরোধিতা হতে পারে কিংবা হতে পারে সাধারণভাবে। তৃতীয় এক পক্ষ আছেন, যারা নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করছেন না। কিংবা বলা যায় নিজেদের অবস্থান বুঝতেই পারছেন না। এদের কতিপয় আবার কিছু ক্ষেত্রে সমর্থন করছেন, আবার কিছু ক্ষেত্রে বিরোধিতা করছেন। অর্থাৎ এরা হচ্ছেন দোদুল্যমান শ্রেণি। নিশ্চুপ থাকা জনগণও এ শ্রেণির।

প্রিয় পাঠক, আমরা নিজেরা কোন শ্রেণির নিজেরাই যাচাই করে নিতে পারি। যেহেতু এই যাচাই-বাছাই কোন মুফতির এখতিয়ারে নয়, সেহেতু নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে জেনে নেওয়াই বোধকরি সবচেয়ে নিরাপদ।

১.১ কেন এই বিভাজন?

মুসলিমদের এই তিন শ্রেণিতে বিভক্তির কারণ একটি নয়। বরং বলা চলে, অনেকগুলো কারণ ও প্রভাবে মুসলিম মানস এই তিন প্রকারে (পক্ষাবলম্বনকারী, বিরোধী ও সিদ্ধান্তহীন) বিভক্ত। আমার দৃষ্টিতে এ বিভক্তির প্রধান কারণ দুইটি –

ক. বাহ্যিক কারণ – আফগানিস্তান ও তালেবান প্রসঙ্গে আমাদের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত।

খ. আভ্যন্তরীণ কারণ – আমাদের মনোজাগতিক অবস্থান। বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে আমাদের মানসিক চেতনা ও জ্ঞান।

এ দুটোর প্রভাবেই মূলত আমরা পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান করছি বা নিশ্চুপ থাকছি। উদাহরণত বলছি, মিডিয়াতে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে, প্রাপ্ত সংবাদ আমাদের অনেকের নিকটই তথ্য লাভের একমাত্র উপায়। ফলে ফেইসবুকে আমরা যা দেখছি সে অনুযায়ীই আমাদের সমর্থন বা বিরোধিতা। যদি আমাদের ফেইসবুক সার্কেল বা ফেইসবুক ব্যবহার ইসলামপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত না হয় তবে আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে আমরা অনেকেই আতঙ্কিত বোধ করছি। কেননা কেবল নেতিবাচক খবর, তথ্য আর লিখাই আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ফলে আমাদের বিরোধিতা করাটাই স্বাভাবিক। এটাই হচ্ছে বাহ্যিক কারণ। অন্যদিকে আমাদের সার্কেল এমন হওয়ার কারণ কিন্তু ইসলাম প্রসঙ্গে আমাদের অবস্থানকেই প্রকাশ করে। অর্থাৎ আমরা নিজেরা ইসলামী চেতনা সম্পর্কে এতটাই অজ্ঞ যে, আমাদের সার্কেল কেমন হয়ে ওঠছে তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। ভাবছি এটাই বোধহয় ঠিক ইসলাম। ফলে ইসলাম ও মুসলিম ইস্যুতে বাহ্যিক খবরের ভিত্তিতে মুসলিমদের বিপক্ষে দাঁড়ানোটাই আমরা স্বাভাবিক মনে করছি। তালেবানের পক্ষে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এ সমীকরণ কাজ করছে।

আমি এখানে কেবল ফেইসবুকের উদাহরণ টানলাম, বুঝানোর সুবিধার্থে। নয়ত সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরের চিত্রও খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। দৈনিক পত্রিকার কথাই ধরুন। চেতনাগত দিক থেকে একেবারে দুই মেরুর পত্রিকা আমাদের দেশেও আছে। ফলে এর পাঠকভেদে পক্ষে-বিপক্ষে যাওয়ার প্রবণতা থাকবেই। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার তুলনায় অন্যান্য মিডিয়া, যেমন পত্রিকা, বই-পত্র, টিভি ইত্যাদিতে মুসলিমদের পক্ষে সত্য সংবাদ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম। আমাদের দেশে ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ মিডিয়া খুবই কম, একেবারে নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। ফলে ওসবের মাধ্যমে যারা নিজেদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করছেন তাদের জন্য বিরোধী পক্ষে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অপরদিকে, যারা তালেবানকে সমর্থন করছেন তাদের ক্ষেত্রেও মিডিয়ার প্রভাবের এ বাস্তবতা শতভাগ কার্যকর।

আবার একশ্রেণি আছেন, যারা হয়ত কোন মিডিয়ার সাথেই নেই। ফলে তারা না জেনে নিশ্চুপ। আবার অনেকে ইসলামকে ভালোবাসেন, কিন্তু মিডিয়ার প্রভাবে তালেবানকে সমর্থন করতে পারছেন না। ফলে দ্বিধায় পড়ে সিদ্ধান্তহীন। আমি নিজে এমন অনেক প্র্যাকটিসিং মুসলিম দেখেছি, যারা আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে শঙ্কিত। এরা কোন রাজনৈতিক অনুসারী নন, নন কোন বিশেষ দলের সমর্থক। বাস্তবিকই এরা ইসলামকে ভালোবাসেন, ইসলামকে যথাসাধ্য মানতে চান। কিন্তু মিডিয়ার প্রভাবে তাদের আশংকা মুসলিম তালেবানকে নিয়ে। এটাই মিডিয়ার কারসাজি, সোজা কথায় বলা যায় হলুদ মিডিয়ার খেলা।

১.২ মিডিয়া ইস্যু –

*** মিডিয়া যেসব ইস্যু তালেবানের বিপক্ষে টেনে আনছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, নারী ইস্যু। এক্ষেত্রে দুইটা ইস্যু বেশি চোখে পড়ছে। একটি, নারীদেরকে পর্দা করতে হবে। তালেবান পর্দা করা বাধ্যতামূলক করবে। আমাদের সুশীলরা এ ইস্যুকে এতই ফুলিয়ে ফাপিয়ে বর্ণনা করছেন যে, মনে হচ্ছে নারীরা পর্দা না করলেই সব উন্নয়ন হয়ে যাবে। অথচ সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে ফ্রান্সে যখন হিজাব নিষিদ্ধ করা হয় তখন এদের বক্তব্য কেবল প্রশংসাসূচকই দেখা যায়। অথচ একইভাবে সংস্কৃতি, ইসলামী ও আফগান মুসলিম সংস্কৃতি অনুযায়ী যখন পর্দার বিধান করা হয় তখন এটা বর্বরতা। তাছাড়া একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা তারা কেবল মুসলিমদের ক্ষেত্রেই করে থাকেন।

হয়ত অনেকে বলে উঠবেন, মুসলিমরাও তো এমন করেন। প্রিয় পাঠক, মুসলিমরাও বিরোধিতা করেন ঠিকই, তবে আমাদের সুশীলদের মত স্বার্থান্ধভাবে নয়। অর্থাৎ মুসলিমদের বিপক্ষে হলে প্রতিবাদ, আর অন্যদের ক্ষেত্রে হলে চুপ থাকা, এমন নীতিতে নয়। বরং মুসলিমদের প্রতিবাদ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একইরকম। শরীআর বিপক্ষে গেলে তা যে দেশেই হোক প্রতিবাদ হবে। সেটা বাংলাদেশ হোক বা আফগানিস্তান কিংবা ফ্রান্স। ফলে দুই দলের প্রতিবাদে পার্থক্য আছে। মৌলিক পার্থক্যই আছে। একদল আদর্শিক আরেক দল সুবিধাবাদী।

নারী ইস্যুতেই তাদের অবস্থান বলি। যখন ধর্ষণে পাশ্চাত্য দেশগুলোই তালিকার প্রথমে থাকে, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশও থাকে, তখন নারী অধিকার নিয়ে তাদের কোন বক্তব্য নেই। অথচ কেবল পর্দার বিধান নিয়ে তারা যতটুকু বলছেন, তার সিকিভাগ বক্তব্যও ওইসব দেশের ধর্ষণ নিয়ে নেই। মনে হয়, ধর্ষণে নারী অধিকারের তেমন কোন ক্ষতি হয় না। এরাই হচ্ছে আমাদের নারীবাদী সুশীল। এদের বিরোধিতা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং নারীদের ব্যবহার করে ইসলাম ও মুসলিমের বিপক্ষে দাঁড়ানোর।

নারী ইস্যুর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শিক্ষা ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ। প্রথমে তারা সুর তুলেছিলেন তালেবান নারী শিক্ষার বিপক্ষে। পরে তালেবানের বক্তব্যে যখন পৃথক শিক্ষার কথা স্পষ্ট হলো, তখন তাদের অভিযোগ, তালেবান সহশিক্ষার মত প্রগতিশীল একটি বিষয়কে অস্বীকার করছে। ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যহত হবে। আসল কথা হচ্ছে, এদের ইসলাম বিরোধিতা। সহশিক্ষা না হলে নারী অধিকার লঙ্ঘিত হবে এ সমীকরণ কীভাবে আসল তা আমি এখনো বুঝতে পারিনা। হ্যাঁ, পুঁজিবাদী চিন্তা চেতনাতেও বুঝতে পারিনা। দেশের দিকেই তাকাই। কেবল একটি বার জিজ্ঞাসা করি, দেশসেরা স্কুল-কলেজ, যেমন নটরডেম, ভিকারুন্নেসা এসব কলেজ কি সহশিক্ষা না থাকায় পিছিয়ে পড়েছে? এদের নিয়ে তো কোন প্রশ্ন তুলতে দেখলাম না কোনদিন। বলবেন, এসব বাধ্যতামূলক নয়। ফলে যাদের ইচ্ছা তারা সেসবে পড়তে যাবে। আফগানিস্তানের জনগণ এমন চাচ্ছেন না আপনাকে কে বলল। তাছাড়া দেশের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে সহশিক্ষা না থাকলেই বরং শিক্ষাটা ভাল হয়। অন্তত মুসলিম দেশে, মুসলিম সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের গণ্ডিতে।

দ্বিতীয় যে ইস্যু গুরুত্ব পেয়েছে তা হচ্ছে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও মুসলিম হত্যা। তালেবানের সমালোচনায় এটা ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে যে, তারা মুসলিম হয়েও অন্য মুসলিমদের হত্যা করছে। একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই অন্য কোন মুসলিম ভাইকে হত্যা করা মারাত্মক গুনাহ। বিনা কারণে ও শরীআহসম্মত ওজর ছাড়া এরূপ হত্যা সুস্পষ্ট হারাম। কেননা এক মুসলিমের জান-মাল ইজ্জত সবই অন্য মুসলিমের জন্য হারাম। অর্থাৎ এসবের কোনরূপ ক্ষতি বা হানি করা যাবে না।

এখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে তালেবানের এসব হত্যা কিরূপ? সহজ উত্তর হচ্ছে, এসব ছিল প্রয়োজনে, ওজরবশত। তালেবানের যুদ্ধ ছিল মূলত মার্কিন ও দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এমতাবস্থায় আফগান যেসব মুসলিম সেসব দখলদারদের সাহায্য সহযোগিতায় ছিলেন তারাও শরীআ অনুসারে একই পথের পথিক। আফগান মুসলিমরা যদি তাওবা করত দখলদারদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতো তাহলে তাদের জান-মালও হারামই হত। ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামে কোন মুসলিম হত্যা করা হলেও তা শরীআ আইনের পরিপন্থী নয়। সিফফীনের যুদ্ধ, কারবালার যুদ্ধ এমন বহু ঘটনাই এর বাস্তব প্রমাণ। কেননা কুরআনের ভাষ্যানুযায়ী, ‘ইল্লা বিল হাক্ক’ (সত্য বা ন্যায়সম্মত কারণ/ওজর ব্যতীত) মানুষ বা মুসলিম হত্যা নিষেধ। দখলদারদের সাহায্য করে আফগান মুসলিমদের অনেকেই এই আওতা থেকে বের হয়ে গিয়েছেন।

তাছাড়া তালেবানের হাতে নিরপরাধ মুসলিম নিহত হয়েছে বলে খুব একটা শুনা যায় না। অতি সম্প্রতি কাবুল বিমানবন্দরে বোমা হামলার ঘটনার দায়ও কিন্তু তালেবানের নয়, মার্কিনীদের। নির্বিচার শিশু আর বেসামরিক লোকদের হত্যা করা মার্কিন আর পাশ্চাত্য সভ্যতারই (!) সংস্কৃতি, মুসলিমদের নয়।

প্রসঙ্গত, আরো একটি বিষয় খুব বেশি আলোচিত হয়েছে। কাবুল বিমানবন্দরে দেশ ছাড়ার হিড়িকের ছবি গোটা মিডিয়া জগতেই আলোড়ন তুলেছে। আমাদের সুশীলরা এর দায়ও তালেবানের উপর চাপাতে চান। অথচ কাবুল দখলের পর তালেবান যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এর চাইতে উত্তম ও মানবিক প্রতিক্রিয়া সম্ভবত আর হয় না। তাঁরা কেবল নিজ দেশের মুসলিমদের জন্যই সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেননি অমুসলিমদেরও নিরাপত্তা ও নিরাপদে নিজ দেশে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছেন। বিজয়ের পর একটিও প্রতিহিংসাবশত হত্যা হয়নি, হয়নি কোন লুটপাটের ঘটনা। আমার আশ্চর্য লাগে, কীভাবে তালেবান এতটা সহনশীল ও উন্নত মানবিকতার পরিচয় দিলো। মাত্র একটি লুটপাট কিংবা হত্যার ঘটনাও যদি ঘটত পাশ্চাত্য মিডিয়া একে শতশত বলে চালিয়ে দিত, এতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ তেমন কোন সংবাদই আমরা পাইনি।

ইউসুফ (আ.) ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অনুসরণে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা আমাকে কেবলই বিস্মিত করেছে। ইসলামের সৌন্দর্য তো এখানেই। ক্ষমার এমন নযীর আধুনিক বিশ্বে, অমুসলিম বিশ্বে নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। অথচ কতিপয়ের দেশছাড়া নিয়ে উদ্বেগে আমাদের সুশীলদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, আফগানদের যারা ইসলামের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানেন না, কিংবা তালেবানের ক্ষমার উপর আস্থা রাখতে পারেননি অথচ নিজেদের বিচারানুযায়ীই তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তারাই কেবল দেশ ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। হয়ত এমন কিছুই তারা তালেবান ও আফগান জাতিসত্ত্বার বিপক্ষে করেছিলেন যে কারণে দেশে থাকার সাহস তারা হারিয়ে বসেছিলেন। অথচ বিরোধী অনেক নেতাকেও আমরা দেখেছি তালেবানের সাথে সাক্ষাত করেছেন। তাদের গায়ে আচড়ও দেওয়া হয়নি। আরেকটি কারণ সম্ভবত অপরাধ না করেও দেশ ছাড়তে অনেককে উদ্ভুদ্ধ করেছিল, তা হচ্ছে বিনা জটিলতায় পাশ্চাত্যে প্রবেশের হাতছানি। এত সহজে অন্য দেশে চলে যাওয়ার সুযোগ হয়ত অনেকেই ছাড়তে চাননি। যাইহোক, কাবুল দখলের পর কে দেশ ছাড়ল আর কে না, তার দায় কোনভাবেই তালেবানের উপর চাপানো যুক্তিসঙ্গত নয়। কেননা সাধারণ ক্ষমার যে ঘোষণা তালেবানরা দিয়েছিলেন তা তাঁরা বাস্তবেও করে দেখিয়েছেন। এর চাইতে মানবিক কোন পথ অন্য কেউ কি দেখাতে পারবেন?

আমাদের প্রগতির ফেরিওয়ালাদের নিকট আরো একটি সমস্যা হচ্ছে, তালেবানের শরীআ আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা। আমি এখনো বুঝতে পারিনা, তাতে তাদের কী সমস্যা। শরীআ আইন বাস্তবায়িত হলে তো ভয় পাবার কথা চোর-ডাকাত, দুর্নীতিবাজ, ব্যভিচারী, গুম-খুন আর অত্যাচারীদের। সাধারণ মানুষের তো তাতে খুশি হওয়ারই কথা। এবং তা হয়েছেও।

সুশীলদের শরীআ আইন নিয়ে ভয়ের কারণ, আমার মতে, সম্ভবত নিজেদের ইচ্ছামত যা খুশি করতে না পারার আশংকা। শরীআ আইন হলে মিডিয়া আর সংস্কৃতির নামে বেলেল্লাপনা আর অশ্লীলতা বন্ধ হয়ে যাবে, হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে কৌশলে নিজ মতবাদ আর সুবিধা প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, মিথ্যার বেসাতি ছড়ানো যাবে না, নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লুটা যাবে না, ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করা যাবে না, আইনকে নিজ সুবিধামত চালানো যাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে সুশীলরা নিজেদের স্বার্থেই শরীআ আইনকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে। মজার ব্যাপার হলো, এ ব্যাপারে সবদলের সুশীলই এক। তা সে রাজনীতির ময়দানের হোক, বা সংস্কৃতির ময়দানের।

মিডিয়ায় এমন আরো অনেক ইস্যুই আসছে। পাঠকগণ নিজেরাও এ বিষয়ে অনেক জানেন। কিন্তু মিডিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ না করতে পারলে তালেবানের বাস্তবতা আমরা কেউই বুঝতে পারব না।

১.৩ আকীদা প্রসঙ্গ

তালেবানের বিরোধীতার ক্ষেত্রে মুসলিমদের আরো একটি গ্রুপ আছে যারা আকীদাকে সামনে নিয়ে এসে বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে আমরা আহলে হাদিস নামধারী মুসলিমদের বিরোধিতা বেশ বড় আকারে দেখতে পাই। তাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে, তালেবানের আকীদাতে ভুল আছে। ফলে তাদের সমর্থন করা মুসলিমদের উচিত নয়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, তালেবান পূর্ববর্তী মার্কিন মদদপুষ্ট আশরাফ গণির শাসনেই তারা সন্তুষ্ট ছিলেন। কী আশ্চর্য!

যেকোনো মুসলিমদের উত্থানে আকীদার এসব ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে তাতে বাঁধা প্রদান করা আজকের এসব নামধারী সালাফীদের মূল এজেন্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সন্দেহ থেকেই যায়, আদতেই তারা ইসলামের কাজ করছেন, মুসলিমদের পক্ষে কাজ করছেন নাকি বিপক্ষে। এদের কাছে আকীদার ব্যাখ্যাসর্বস্ব বিষয়গুলিই কেবল গুরুত্বপুর্ণ। মুসলিম ঐক্য, মুসলিমদের সাহায্য, জিহাদ ইত্যাদি সুস্পষ্ট বিধানের কোনই গুরুত্ব নেই। থাকলেও সেসব নিয়ে কোন ভাষ্য নেই। ইসলামকে বিজয়ী হিসেবে তোলে ধরতে অমুসলিমদের বিপক্ষে সত্য ভাষণের কোন গুরুত্ব নেই; বরং আপোষ ও সত্য এড়ানোর কৌশলই এদের মূল সম্বল। তালেবান ইস্যুতেও এমন অবস্থান কিছু সাধারণ মুসলিমকেও ধোঁকায় ফেলছে নিঃসন্দেহে।

২. আমাদের করণীয়

তালেবানের এই বিজয়ে মুসলিম হিসেবে আমাদের করণীয় কী হওয়া উচিত তার কিছুটা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

২.১ প্রথম কাজ হচ্ছে, তালেবানের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা।

প্রত্যেক মুমিন মুসলিম প্রসঙ্গে ভালো ধারণা রাখা ঈমানের দাবী। এটাই মুসলিমদের কর্তব্য। ইফকের ঘটনায় আয়িশা (রা.) কে অপবাদ দেওয়ার পরও তাঁর সম্পর্কে ভালো ধারণা না রাখার জন্য স্বয়ং আল্লাহ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “তোমরা যখন একথা শুনলে, তখন ঈমানদার পুরুষ ও নারীগণ কেন নিজেদের লোক সম্পর্কে উত্তম ধারণা করনি এবং বলনি যে, এটা তো নির্জলা অপবাদ?” (সূরা নূর, আয়াত-১2)

বস্তুত যেকোনো মুসলিম সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে সুধারণা রাখা উচিত, চাই সে মুমিন পরিচিত হোক বা অপরিচিত। আর কারো সম্পর্কে যদি কোন খারাপ বা মন্দ কিছু নিশ্চিত হওয়া যায়, তারপরও তাকে সার্বিকভাবে খারাপ বলা উচিত নয়। হয়তো সে কেবল ঐ একটি ব্যাপারেই মন্দ ছিল, অন্যান্য ব্যাপারে উত্তম। ফলে একেবারেই প্রকাশ্য মন্দ না হলে কোন মুমিনের ব্যাপারেই খারাপ ধারণা করা উচিত নয়। কেননা অনেক অনুমানকে আল কুরআনেই পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সূরা হুজুরাত, আয়াত-১২)

তালেবান প্রসঙ্গেও আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব তাদের সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা। বাহ্যিক কার্যক্রমে তারা ইসলাম ও মুসলিমের পক্ষেই কাজ করছেন, ফলে তাদের বিরোধিতা করা একেবারেই অনুচিত।

২.২ দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, প্রাপ্ত সংবাদের যাচাই-বাছাই করা।

বিশেষ করে মিডিয়ার প্রদত্ত সংবাদ বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করা একেবারেই অনুচিত। হাদীসে যা শুনে তাই প্রচার করাকে মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট বলা হয়েছে (বুখারী)। তাছাড়া কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হচ্ছে, “মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও”। (সূরা হুজুরাত, আয়াত-৬)

তালেবান ইস্যুতে এ আয়াতটি আমাদের জন্য খুবই উপযোগী। পাশ্চাত্য মিডিয়া এমন কিছু নয় যে, সর্বদাই সত্য প্রকাশ করে। বরং উল্টোটাই সত্যি। এক্ষেত্রে কাদের সংবাদের উপর নির্ভর করে আমরা নিজেদের ভাইদের বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছি তা ভাবা উচিত। হয়তো এজন্য কোন একদিন অনুতপ্তই হতে হবে। হয়তো এখানে নয়তো আখিরাতে।

২.৩ মুহাসাবা বা আত্মসমালোচনা

বস্তুত দুনিয়ার সব বিষয়েই ঈমানের পরীক্ষা হতে পারে। তালেবান ইস্যু আমাদের জন্য ঈমানের একটি পরীক্ষাও বটে। এখানে দুটি দিক ঈমানী পরীক্ষার খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে আনছে।

প্রথমত, তালেবানের বিজয়ে আমরা আনন্দিত কি না? যে কোন মুসলিমের বিজয়ে, সফলতায় কিংবা সামান্য অর্জনেও খুশি হওয়া ঈমানের দাবি। কেননা মুসলিমগণ যেখানেই থাকুক একসূত্রে আবদ্ধ। একই দেহের মত। ফলে এক অঙ্গ ব্যথা পেলে যেমন সারা দেহেই ব্যথা অনুভূত হওয়ার কথা, তেমনই উল্টোটাও সত্যি। মুসলিমদের বিজয়ে খুশি না হয়ে ব্যথিত হলে ঈমানী চেতনা বাকী থাকার কথা না।

হয়তো বলতে পারেন, তালেবানের পূর্বেও তো মুসলিমরাই ক্ষমতায় ছিল। এমন চিন্তা-ভাবনা আসলে দূর্বল ঈমান ও ইলমের পরিচায়ক। তালেবান আর পাশ্চাত্যের ক্রীড়ানক সরকারের পার্থক্য না খোঁজে মিল খোঁজাই সম্ভবত বেশি সহজ। কারণ হাতেগোনা কিছু মিল থাকলেও অমিলই বেশি। আর এদের মধ্যে কে ইসলাম ও মুসলিমের জন্য কল্যাণকর তা বিচারের জন্য শিক্ষিত হওয়ারও দরকার নেই। ফলে তালেবানের বিজয় ইসলামের বিজয় হিসেবে আনন্দিত হওয়ার দাবি রাখে।

দ্বিতীয়ত, এই বিষয়টি প্রথম পরীক্ষার চাইতেও অনেক বেশি স্পষ্ট ও স্পর্শকাতর। তালেবানের বিজয়ে আনন্দিত না হওয়ায় ইসলামী চেতনা বাকী থাকে না, আর এ পরীক্ষায় খোদ ঈমানই বাকী থাকে না। আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, শরীআ আইন বাস্তবায়নের বিরোধিতা করা কুফরী। মনে রাখবেন তালেবানেরকে আমাদের পছন্দ নাও হতে পারে। তাদের বেশভূষা, আচরণ, কথাবার্তা সবকিছুই আমাদের নিকট খারাপ লাগতে পারে, তাতে ঈমান চলে যাবে না। কিন্তু শরীআ আইন প্রতিষ্ঠায় তাদের উদ্দেশ্যের বিরোধিতা ইসলামের বিরোধিতারই শামিল। এটা কেবল আফগানিস্তানে নয়, দুনিয়ার যে কোন প্রান্তেই শরীআ আইন বাস্তবায়নে বিরোধিতা ঈমান-ইসলামের বিরোধিতারই নামান্তর।

প্রিয় পাঠক, আপনার মনে যদি শরীআহ আইনের বিপক্ষে অবস্থানের সামান্যতম স্পৃহাও থাকে, আপনার ঈমান নিয়ে খুব গভীরভাবে ভাবুন। এই ঈমান আপনার নাযাতের জন্য যথেষ্ট হবে না। যদি মনে করে থাকেন, শরীআহ বর্তমানকালের জন্য অনুপযোগী, কিংবা মানব রচিত আইন শরীআহ আইনের চাইতে ভালো, তবে তা নিঃসন্দেহে কুফরী। সম্ভবত দুনিয়ার কোন মুফতীই আপনাকে কুফরির হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন না। সূরা মায়িদায় আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, “তারা কি জাহেলিয়াতের আইন চায়? দৃঢ়বিশ্বাসীগণের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম হুকুম-বিধানদাতা আর কে হতে পারে?” (সূরা মায়িদা, আয়াত-৫০)। আগের কয়টি আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করে না, তারা কাফির (মায়িদা, আয়াত-৪৪), তারাই যালিম (মায়িদা, ৪৫), তারাই পাপাচারী/ফাসিক (মায়িদা, ৪৭)।

সুতরাং, শরীআহ আইনের বিরোধিতা বা এর বিরোধীদের সমর্থন-সহায়তা করা, কিংবা কথা ও লিখনী ইত্যাদি দ্বারা মুসলিমদেরকে এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত করা সবই একই হুকুমের আওতাধীন। এমতাবস্থায় নিজের ঈমান নিয়েই চিন্তা করুন। তালেবানের বিরোধিতার চাইতেও শরীআহ আইনের বাস্তবায়ন না চাওয়াটা নিজের আখিরাত বরবাদের কারণ হতে পারে। এমতাবস্থায় নিজের ঈমানই যদি বাকী না থাকে, তখন আকীদার দোহাই দিয়ে কী লাভ। আকীদা তখন গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কেননা ঈমানই না থাকলে আকীদার প্রশ্ন তো অবান্তর।

২.৪ তালেবানের সাহায্য-সহযোগিতা

নানাভাবেই আমরা এটা করতে পারি। যেমন, দুআ করা, আর্থিক সাহায্য, পরামর্শ দিয়ে, তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বাঁধা দিয়ে, নিজেদের সরকারকে তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে, বিশ্বব্যাপী মিডিয়ায় নিজেদের অবস্থান ও সমর্থন ব্যক্ত করে। [কলেবরের কারণে বিস্তারিত লিখছি না, পাঠকগণ জানেন আশা রাখি।]

২.৫ নিজেদের পরিমণ্ডলে কর্তব্য

নিজেদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের মধ্যে ইসলাম বিরোধিতার বিষয়টি স্পষ্ট করে বুঝানো, ইলমী জবাব দানের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি – এসবই হতে পারে আমাদের নিজস্ব কার্যক্রম। একেবারে চুপ করে না থেকে নিজেদের আওয়াজ তোলে ধরা ও অবস্থান স্পষ্ট করাও কিন্তু অনেক সময়ই জিহাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়। পাশাপাশি তালেবানের পদ্ধতি ও পলিসির আগাগোড়া পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা উচিত। পৃথিবীর যেকোনো দেশে, যেকোনো সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তালেবান মডেলের গবেষণাও বেশ গুরুত্বের দাবিদার।

শেষ করছি নিজের কিছু ভাবনা শেয়ার করে।

তালেবানের কোন ভুল নেই এমন দাবি অযৌক্তিক এবং অনৈসলামিকও বটে, কিংবা তারা সম্পূর্ণরূপে ইসলামী চেতনার প্রতিনিধিত্ব করছেন, এমন দাবি করার সময় এখনো আসেনি। কেননা বিশ্বরাজনীতি, মানবীয় ভুল-ত্রুটি, শিক্ষা-অভিজ্ঞতার অভাব, কৌশলী না হওয়া, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রভাব, শয়তানের প্ররোচনা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে তালেবানের ক্ষমতা দখল পুরোপুরি সফল নাও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে তাদের প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। পাশাপাশি দু`একটি ভুলের কারণে তাদের সব কাজকে ঢালাওভাবে সমালোচনা করার সুযোগও নেই।

আবার সেইসাথে তাদের সমর্থনে ভুল তথ্য কিংবা গুজব ছড়ানোরও বৈধতা ইসলাম কাউকে দেয়নি। বরং নির্মোহভাবে সত্যকে মেনে নিয়ে মুসলিম হিসেবে তাদের সমর্থন করাই আমাদের কাজ। তাদের ভুলত্রুটি সংশোধনের নিয়তে ধরে দিয়ে কিংবা তাদের অনুপযুক্ত পলিসির সমালোচনা করে উত্তম পলিসি নিরূপণে সহায়তা করা ইসলামী চেতনারই দাবি।

কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, যখন মুসলিম হয়েও আমরা পাশ্চাত্য মিডিয়া ও সুশীল মননের প্রভাবে তালেবানের বিচার করতে বসছি। আমাদের সুশীলদের বিরোধিতা তো মানবতার খাতিরে নয়, বরং ইসলাম বিরোধিতার জন্যই। কেননা এতই যখন আফগানিস্তানের উন্নয়ন চিন্তা, তখন এসব সুশীলরা কোথায় ছিলেন, যখন জঙ্গিবাদ নির্মূলের মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে একটি দেশকে টনকে টন বোমা ফেলে ধংসস্তুপে পরিণত করা হলো। এরা কোথায় যখন এখনো সারা বিশ্বে – সিরিয়া, কাশ্মীর, উইঘুর, সোমালিয়া, ইত্যাদিতে যুদ্ধের নামে মানুষের মৌলিক অধিকার নষ্ট করা হচ্ছে।

একটা দেশ যখন নতুন করে দাঁড়াতে যাচ্ছে, তখন এরকম ঠুনকো কিছু ইস্যু দাঁড় করানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে সে দেশের অগ্রগতিকে নস্যাত করার জন্য। এরূপ প্ররোচনার মাধ্যমে মুসলিমদেরকে মুসলিমদের বিপক্ষে দাঁড় করানো হচ্ছে। কারণ মুসলিমদের ঐক্যের ক্ষমতা কতটুকু তালেবানরা কিছুটা হলেও দেখাতে পেরেছে। আফসোস, আমরা মুসলিমরা এখনো এটা বুঝতে পারছি না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে, একটা বিষয় দেখার জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি। তালেবান যখন শরীআহ আইন পুর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করবে, তখনকার আফগানিস্তান কেমন হবে? যেসব আপত্তি আমরা নানাদিকে দেখছি সেসবের বাস্তবতা কেমন হবে? কেননা শরীআহর পূর্ণ বাস্তবায়ন আমরা আজ পর্যন্ত আধুনিক বিশ্বের কোথাও দেখছি না। ফলে এক ধরণের প্রত্যাশা আমাদের সব মুসলিমেরই আছে। সব মুসলিম দেশ এমনকি অমুসলিম দেশও নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখছে।

তবে দু-দলের এই পর্যবেক্ষণে মৌলিক পার্থক্য আছে। আমরা মুসলিমরা যেখানে সুন্দর একটি সমাজের  প্রত্যাশা নিয়ে চেয়ে আছি, সেখানে অমুসলিমরা কিছুটা ভয়েই আছে বলে মনে হয়। শরীআহ আইনের সুফল যদি আফগানরা দেখাতে পারে, তবে সেটা সব ধরণের মানবরচিত মতবাদ ও ইযমের মূলে কুঠারাঘাত হানবে। ইসলাম ও মুসলিমদের মধ্যযুগীয় বর্বরতার জন্য দায়ী করার পাশ্চাত্য অস্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে। [‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ পরিভাষাটিই বিভ্রান্তিকর। মধ্যযুগে পাশ্চাত্যরা বর্বর থাকলেও মুসলিমগণ নিশ্চিতরূপেই বর্বর ছিল না। বরং আধুনিক সভ্যতাকে গড়ে দিয়েছিল মুসলিমদের মধ্যযুগীয় সভ্যতা।]

এমতাবস্থায় তাদের পর্যবেক্ষণ কেবল দেখাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে এমন মনে করি না। বরং নানাভাবে বিশেষ করে মিডিয়ার মাধ্যমে আফগান ও তালেবানের বিরোধিতা চলতেই থাকবে। আমার তো আশংকা, মিডিয়ার এই আগ্রাসন তালেবানের বিপক্ষে আগের যে কোন সময়ের চাইতে বেশিই হবে। এটাই ইসলাম ও মুসলিমদের বিপক্ষে ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

এমতাবস্থায় মুসলিমদের দায়িত্ব সম্ভবত আরো একটু বেশি। কেবল আন্তরিক সমর্থন ও দুআই নয়, বরং মিডিয়া কেন্দ্রিক সহযোগিতাও তালেবানের একান্ত দরকার। অন্তত সোশ্যাল মিডিয়াও তালেবানের ইতিবাচক ইমেজ সৃষ্টি করা; নেতিবাচক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলুদ সাংবাদিকতার হাত থেকে মানবতাকে রক্ষার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলেই মনে করি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ফেইসবুকে আমরা...