কিছুদিন আগে তালেবান কাবুল দখল করলে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পশ্চিমা বিশ্ব এটাকে তাদের পরাজয় ভেবে নানাভাবে তালেবানের ব্যাপারে তথ্য সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আবার মুসলিম মানসেও কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
পশ্চিমাদের বিরোধটা কোথায়?
অনেকে মনে করেন পশ্চিমারা নারী অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীতার কথা বলে, তাহলে এটা মানতে অসুবিধা কী? কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু নারী অধিকারের সংজ্ঞা কী সেটা খুবই বিবেচ্য। এখন যদি বলা হয় সমলিঙ্গদের বিবাহের অধিকার হচ্ছে নারী অধিকার বা রাস্তাঘাটে ও চুলকাটার দোকানে অর্ধ উলঙ্গ নারীর ছবি রাখা নারীর মর্যাদার প্রতীক তাহলে এটা তালেবান কেন, ইসলামের অনুসারী ও সুস্থ বিবেকসম্পন্ন কেউই একমত হতে পারবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধরন ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি। যেমন অগণিত মানুষের প্রাণের চেয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কার্টুন ছাপা, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’, আবার একই দেশে তাদের প্রেসিডেন্টের কার্টুন ছাপলে তা ‘মানব অধিকার লঙ্ঘন’, এমন দ্বিচারী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে কী বলা যায়?
গণতন্ত্র শুধু কি আফগানিস্তানে প্রয়োজন?
যারা আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করেন তারাই আবার মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রের ব্যাপারে চুপ। আর নিজের পছন্দ না হলে নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে সেনা শাসনেও তাদের আপত্তি নেই! উদাহরণ হিসেবে মিসরের কথা বলা যায়। গণতন্ত্র অর্থ যদি হয় বেশির ভাগ জনগণের চাওয়া তাহলে তালেবানের শরীআহ আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগকে গণতান্ত্রিক বলা যেতে পারে। কারণ পিউ রিসার্চ এর জরিপ অনুযায়ী আফগান মুসলমানদের ৯৯% শরীআহ আইন চায়।
ইসলামী আন্দোলনের গণতন্ত্রপন্থিরা কি বিব্রত?
প্রথমেই বলতে হয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। গণতন্ত্র যদি হয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পরামর্শের ভিত্তিতে দেশ চালানো, মানবাধিকারের সুরক্ষা তাহলে ইসলামের সাথে এর বিরোধ নেই। কিন্তু গণতন্ত্র অর্থ যদি হয় মানুষের সর্বোত সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস ইত্যাদি তাহলে বিশ্বাসগত পর্যায়ের বিচ্যুতির কারণে ইসলাম তা অনুমোদন করে না।
যাই হোক গত শতাব্দীকাল থেকে গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম কায়িম করার প্রচেষ্টা বেশ লক্ষণীয়। কিন্তু এর অভিজ্ঞতা তিক্ত। আলজেরিয়া, তুরস্ক, মিসর, সর্বশেষ তিউনিসিয়া ইত্যাদির দিকে তাকালে এই সমীকরণে আসা খুব স্বাভাবিক যে গণতান্ত্রিকভাবে ইসলাম পরিপূর্ণভাবে কায়িম করা খুবই মুশকিল।
আলজেরিয়ার কথা হয়তো অনেকের মনে আছে। ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচিত হওয়ার পরও সেনাবাহিনী একদিনের জন্যও ক্ষমতায় ইসলামপন্থিদের বসতে দেয়নি।
মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসি এক বছরের বেশি টিকতে পারেন নি। তুরস্কের অভিজ্ঞতা আরো তিক্ত। বহু গণতান্ত্রিক-সহনশীল ইসলামী দল ও ব্যক্তিত্বকে সেক্যুলার সেনাবাহিনী সরকার চালাতে দেয়নি। আদনান মেন্দেরেস এর ফাঁসি (১৯৬১) ও নাজমুদ্দীন আরবাকান এর সেনাবাহিনীর হাতে পদচ্যুতি (১৯৯৭) আজ ইতিহাসের কালো অধ্যায়। আর তিউনিসিয়ার খুবই নমনীয় আপোষকামী সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতাতো সেদিনের। পক্ষান্তরে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইরানী ইসলামী (শিয়া) সরকার হাজার বাধায়ও মাথা উঁচু করে আছে। যদিও আকীদাগত কারণে আমাদের সাথে শিয়াদের মতভিন্নতা সর্বজনবিধিত। আর তালেবান বিপ্লবী ধারার মাধ্যমে ২০ বছর পর আবার ক্ষমতায়। শুনা যায় আমাদের দেশের গণতন্ত্রপন্থি, আধুনিক মনষ্ক, লিবারিজমে বিশ্বাসী কেউ কেউ মনজ্বালায় ভুগছেন। এটা উচিত নয়, ইসলামের বিজয় যেখানে হোক নিজের দল ও ধারার না হলেও খুশি হওয়া উচিত। অবশ্য এ কথা ঠিক পৃথিবীর সব দেশ সশস্ত্র বিপ্লবের পূর্ণ উপযোগী কি না সেটাও আলোচনার দাবি রাখে।
আবার আমাদের মধ্যে এমন সুবিধাবাদীও রয়েছেন যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে কোনোই আগ্রহ রাখেন না। গণতান্ত্রিক হোক আর বিপ্লবী হোক, তাদেরকে নিয়ে কিছু বলার নেই। কারণ তাদের কাছে ইসলামের স্পষ্ট ধারণা আছে বলে মনে হয় না।
তালেবানরা কোন পন্থি?
যতটুকু জানা যায় তালেবানরা সুন্নী, হানাফী, সূফী অর্থাৎ তারা আকীদায় মাতুরীদি, মাযহাবে হানাফী এবং তাযকিয়া-তাসাউফ চর্চায় অভ্যস্ত। বিশেষত: তাদের সূরা নসর পড়ে বিজয় উদযাপনের শেষপ্রান্তে সারা বিশ্বে সূফীদের কাছে সমাদৃত ও বহুল পঠিত বিখ্যাত ওয়াযীফাগ্রন্থ ‘দালাইলুল খাইরাত’ থেকে দুরূদ পাঠ তাদের তাসাওউফ চর্চার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ থেকে দুটি কথা বলা যায়, প্রথমত; তালেবানরা ‘দুরূদে ইবরাহীমী ছাড়া আর কোন দুরূদ নেই বা পড়া যাবে না’ তত্ত্বে বিশ্বাসী নয়। দ্বিতীয়ত; রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সূফীরা কোন ভূমিকা রাখেন না এ অপপ্রচারের পক্ষে অতীত ইতিহাসে যেমন সমর্থন নেই তেমনি তালেবানের বিজয়ও এ তথ্যকে ভুল প্রমাণ করে।
তালেবানের ভবিষ্যৎ কী?
একটি দেশ পরিচালনা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। দেশের অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি, বৈদেশিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক পথপরিক্রমা এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ। সবাই জানেন আফগানরা জাতি হিসেবেই যুদ্ধপ্রেমী, আবার তাদের দেশে আঞ্চলিক ও গোষ্টিগত নানা বিভাজন রয়েছে। যেমন-পশতুন, তাকিজ, হাজারা ইত্যাদি। সুতরাং এ বিষয়ে তালেবানরা কীভাবে ‘ডিল’ করবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকেই মনে করেন তালেবানের প্রথম শাসনামলে কিছু বিষয়ে তাড়াহুড়া বা অপরিপক্কতা ছিল। এবারে তারা অনেক ‘পরিপক্ক’। তাই তারা পূর্বের মতো অপরিপক্ক কোন কাজ করবেনা আশা করা যায়।
অর্থনৈতিক দিক থেকে তালেবানরা বহুমুখী চাপে থাকবে এটা নিশ্চিত। কারণ, ইতোমধ্যে অর্থনীতির দুই বিশ্বমোড়ল ফেডারেল ব্যাংক ও আইএমএফ তালেবানের ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থানের কথা জানিয়েছে। আর বৈদেশিক শক্তি বিশেষতঃ পশ্চিমা ও দোসররা তালেবানের উপর খুশি হবে কি না? এ প্রশ্নের উত্তর কুরআন থেকে দিতে চাই, আল্লাহ বলেন,
وَلَن تَرْضَىٰ عَنكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ
-আপনার ব্যাপারে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা কখনই খুশি হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি তাদের মতবাদ অনুসরণ করবেন। (সূরা বাকারা, আয়াত-১২০)
সুতরাং আমাদের ধারণা তালেবান যত লিবারেল হোক পশ্চিমারা পুরোপুরি খুশি হওয়ার আশা নেই। মুমিনের চাওয়া হলো ইসলামের পতাকা হাতে বিজয়ী এ শক্তি যেন সকল বাধা অতিক্রম করে মদীনার সোনালী সময়ের সুবাস বিলাতে সক্ষম হয়।