1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
আফগানিস্তানে আবার ক্ষমতায় ফিরল তালেবান
রহমান মুখলেস
  • ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আফগানিস্তান এখন তালেবান নিয়ন্ত্রণে এবং তারা সরকার গঠনের পথে। কাবুল দখলের পর তালেবান সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত তারা দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করেনি। তবে তিন জন মন্ত্রীর নাম ঘোষনা করেছে। এরা হলেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা আব্দুল কাইম জাকির, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাদর ইব্রাহিম এবং অর্থমন্ত্রী গুল আগা। এছাড়া গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে নাজিবুল্লাহ, কাবুলের মেয়র হিসেবে হামদুল্লাহ নোমানি এবং কাবুলের গভর্নর হিসেবে মোল্লা শিরিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

কাতারের দোহা থেকে তালেবানের শীর্ষ নেতারা কাবুলে ফেরার পরই সরকার গঠনের তৎপরতা শুরু হয়। তালেবান গণতন্ত্র নয়, ইসলামী শরীআহ আইনে দেশ চালাবে। তারা আগের মতো খুব কঠোর হবে না। শরিয়া আইন মেনে নারীরা পড়াশুনা, স্কুলে যাওয়া ও অফিসে কাজের অনুমতি পাবে। তবে অবশ্যই তাদের হিজাব পরতে হবে। কারো প্রতি প্রতিশোধ নেবেনা তালেবান। শরিয়া আইনে দেশ চললেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে, আফগান ভূমি বিদেশে হামলা চালানোর জন্য সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল হবে না। সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়–এই হবে তালেবানের নীতি।

তালেবানের সরকার হবে অংশগ্রহণমূলক। এতে তালেবান ছাড়াও অন্যান্য ব্যক্তি ও সংগঠন যুক্ত হতে পারে। এমনকি সরকারে সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকেও দেখা যেতে পারে। তালেবানের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ওয়াহিদুল্লাহ হাশিমি সম্প্রতি জানান, এটা পরিষ্কার শরীআহ আইন মোতাবেকই দেশ চলবে এবং এটাই ঠিক। দেশ পরিচালনায় একটি সর্বোচ্চ কাউন্সিল থাকবে। তালেবানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা থাকবেন এই কাউন্সিল ও দেশের মূল নেতৃত্বে। তবে অধীনে থেকে সম্ভবত দেশ চালাবেন তালেবানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান আবদুল গনি বারাদার। তাঁর সঙ্গে থাকবেন আরো দুজন ডেপুটি। তাঁরা হলেন, মোল্লা ওমরের ছেলে মৌলবী ইয়াকুব, হাক্কানির নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। তবে এ সবই এখন জল্পনা। এর পরিবর্তনও হতে পারে। আবদুল গনি বারাদার দোহাতে তালেবানের রাজনৈতিক অফিসের দায়িত্বে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং আশরাফ গনি সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। তিনি তালেবানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ডেপুটি এবং ১৯৯৬–২০০১ সালের তালেবান সরকারের ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২০১০ সালে পাকিস্তানে গ্রেপ্তার হন। পরে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গনি বারাদারকে ছেড়ে দেয় পাকিস্তান। মুক্তি পেয়েই তিনি সোজা চলে যান কাতারের দোহায়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন।

এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছিল তালেবান। সে সময়েও দেশটিতে শরীআহ আইন জারি ছিল। তবে তাতে কিছু বাড়াবাড়িও ছিল। তখন মাত্র তিনটি দেশ- সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

আফগানরা হার না মানা জাতি

যুক্তরাষ্ট্রের ‘জন্য ট্রাজেডি যে, ভিয়েতনামের পর আফগানিস্তান থেকেও বড় পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ঘরে ফিরতে হলো। ইতিহাস সাক্ষী স্বাধীনচেতা আফগানদের ধরে রাখা বা পদানত করার নযীর এ পর্যন্ত নেই। ব্রিটিশ পারেনি, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারেনি, যুক্তরাষ্ট্রও পারলোনা। ১৮ শতাব্দীর শেষ এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকার বার বার চেষ্টা করেছে পুরো আফগানিস্তানকে কব্জা করতে কিন্তু পারেনি। আফগানিস্তানের সামান্য কিছু এলাকা নিজেদের শাসনভূক্ত করতে পারলেও বার বার তারা লড়াইয়ে পরাস্ত হয়েছে। ভারত–পাকিস্তানের অনেক আগেই ১৯২১ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে আফগানিস্তান।

এরপর আফগানদের ওপর আগ্রাসন চালায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা তাদের কমিউনিজমের আদর্শের বার্তা নিয়ে আসে আফগানিস্তানে। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সেনারা প্রবেশ করে দেশটিতে। বারবাক কারমাল, হাফিযুল্লাহ আমিনসহ তাদের বেশ কজন পদলেহী দিয়ে আফগানিস্তানে কমিউনিজম বাস্তবায়নের চেষ্টা চলায়। কিন্তু সে সময় বিভিন্ন মুজাহিদীন গ্রুপ সোভিয়েত সেনা ও আফগান শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত নাস্তানাবুদ হয়ে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গুটায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে ৯/১১ হামলার পর বিন লাদেন ও সন্ত্রাস উৎখাতের নামে ২০০১ সালের শেষের দিকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট হামলা শুরু করে। তখন দেশটির ক্ষমতায় ছিল তালেবান। আল–কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ছিল তাদের আশ্রয়ে। হামলার কয়েকদিনের মধ্যেই ২০০১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই পতন ঘটে তালেবান সরকারের। সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে এসেছিল তাদের আদর্শ (কমিউনিজম) বাস্তবায়নে, আর ব্রিটিশ ও যুক্তরাষ্ট্র এসেছিল স্রেফ দখলদার ও আগ্রাসী শক্তি হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই তিন পরাক্রমশালী শক্তিকেই লজ্জাজনক হার নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে।

ভুল হিসাব যুক্তরাষ্ট্রের

প্রায় ২০ বছর আগে কথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের নামে মিত্র দেশের সেনা ও ন্যাটো বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। দ্রুতই দেশটির তৎকালীন ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের পতন ঘটায়। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই আর আফগানিস্তানজুড়ে সহিংসতার অবসান কখনোই ঘটেনি। দেখা মেলেনি প্রত্যাশিত শান্তি। দুই দশক তাড়া খেয়ে বেড়ানো তালেবানই শেষ পর্যন্ত ফিরে এলো ক্ষমতায়।

তালেবানের সাহসী, সুপরিকল্পিত, ঝোড়োগতির আক্রমণের মুখে আফগান সেনাবাহিনী কোথাও তেমন প্রতিরোধই গড়ে তোলেনি। অনেক প্রদেশ ও শহর বিনা বাধায় দখল করেছে তালেবান। ৬ আগস্ট প্রথম জারাঞ্জ প্রদেশ দখলের মধ্য দিয়ে তালেবানের যে অভিযান শুরু হয়েছিল, তারপর মাত্র ৯–১০ দিনের মধ্যেই ১৫ আগস্ট কাবুল দখল করে তালেবান। এতে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো বিশ্ববাসী বিস্মিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গত ২০ বছরের অর্জন এত দ্রুত বিধ্বস্থ হয়ে পড়বে তা ভাবনারও অতীত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র গত দুই দশকের যুদ্ধে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যাপক প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেছে। এতে তারা ৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি খরচ করেছে।

তালেবান অভিযান শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্যের অনুমান ছিল, ৯০ দিনের মধ্যে কাবুলের পতন ঘটতে পারে। কিন্তু তা যে ৯–১০ দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে সেটা ছিল কল্পনারও অতীত। তালেবানের এমন শক্তির আত্মপ্রকাশে বিস্মিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন । তিনি বলেন, যা ঘটার তাই ঘটেছে, আফগান সেনাদের যুদ্ধ করার কোন মানসিকতাই ছিল না। তিনি আরও বলেন, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিল ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা ও আল–কায়েদাকে খতম করতে, সে খেল শেষ। এখন আফগানিস্তানের দায়–দায়িত্ব আফগানদের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আফগানিস্তানে যাওয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভুল। আবার এভাবে পরাজয় মনে ফেরাটাও বাইডেনের ভুল সিদ্ধান্ত।

পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সন্ত্রাসী দমনের নামে ২০০৩ সাল থেকে আফগানিস্তানে প্রায় ২৭ হাজার বোমা নিক্ষেপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

শুধু গত বছরই ৭ হাজার ৪০০ বোমা নিক্ষেপ করেছে তারা। কিন্তু গত মার্চ মাসে জো বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার থেকে সেখানে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তালেবানের নিশানায় ছিল কেবল আফগান সেনারা। আর তালেবানের এ অভিযানে মার্কিন সেনারাও থাকে নির্বিকার।

তালেবানের জয় যে কারণে এত দ্রুত

আমরা আগেই জেনেছি আফগানরা হার না মানা জাতি। এত দ্রুতগতিতে তালেবানের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র ও সারা বিশ্ব বিস্মিত হলেও ঘটনার প্রেক্ষাপটে এটাই ছিল বাস্তবতা। আফগানরা বিদেশি শক্তি কখনো বরদাস্ত করেনি। তারা হার না মানা এক জাতি। মার্কিন সমর্থিত বিগত আশরাফ গণি কিংবা হামিদ কারজাই সরকার কেউই আফগান জনগণের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও দুঃখ–দুর্দশার দিকে নযর দেয়নি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল আফগানিস্তানে তাদের নিজস্ব ফর্মূলায় একটি আধা–মার্কিন বাহিনী গড়ে তুলতে। এভাবে তারা আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরঞ্জাম দিয়েছে। কিন্তু আফগান অধিকাংশ সেনাদের কাছেই এই ফর্মূলা মনপূত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা পেলেও দুর্নীতিবাজ আফগান সরকার অনেক সেনা ও পুলিশ সদস্যদের মাসের পর মাস নিয়মিত বেতন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে সরকারি বাহিনীর মধ্যে ঘটেছে বিদ্রোহের মতো ঘটনাও।

এদিকে তালেবানের মতো একটি সংগঠিত বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরে লড়াই করতে সেনাদের তেমন মনোবল ও ইচ্ছা ছিল না। এছাড়া সেনা কর্মকর্তাদের ভেতরেও গড়ে উঠেছিল দুর্নীতির লম্বা শিকড়। আফগান সেনাদের দুঃখ–দুর্দশা ও চাহিদার দিকে  কখনো নযর দেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষের প্রাণহানি এড়াতে চেয়েছে সেনা সদস্যরা। আর অনেক সেনারই সমর্থন ছিল তালেবানের প্রতি। তালেবান হচ্ছে আফগানিস্তানের সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি পশতুন সম্প্রদায়ের লোক। আর অধিকাংশ সেনারাও ছিল পশতুন সম্প্রদায়ের। এমনকি বিদায়ী আশরাফ গণিও ছিলেন পশতুন সম্প্রদায়ের। কিন্তু আশরাফ গণির সরকারের দুর্নীতির কারণে সেনারা ছিল বিক্ষুব্ধ। ফলে অধিকাংশ সেনারই তালেবান মুকাবেলার মতো সামান্যতম সাহস বা শক্তি কোনোটিই ছিল না। তাই তারা যুদ্ধের মাঠে তালেবানের ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে, অথবা পালিয়ে গেছে। এছাড়া তালেবান তাদের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল আত্মসমর্পণ করলে কোন প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।

তালেবানের দ্রুত জয়ের মূলে আরও যে একটি কারণ, তা হচ্ছে ব্যাপক জনসমর্থন। আফগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পশতুন সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোকজনেরই সমর্থন ছিল তালেবানের প্রতি। বিশেষ করে গ্রাম এলাকার লোকজনের।

পশতুন ছাড়াও আফগানিস্তানে আরো রয়েছে তাজিক, উজবেক, হাজারা, তুর্কিসহ আরও বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় তাদেরও কিছু অংশের সমর্থন ছিল তালেবানের প্রতি। আসলে জনগণের ব্যাপক সমর্থন ছাড়া কখনো এত দ্রুত বিজয় অর্জন সম্ভব ছিল না। যেমন ব্যাপক জনসমর্থনের কারণেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয় হয়েছিল দ্রুত। আর আমরা সেই ইরানেও একই দৃশ্য দেখেছি, মার্কিন সমর্থন পুষ্ট শাহ পাহলভির বিশাল সেনা বাহিনী ও ট্যাংকের বিরুদ্ধে গণঅভ্যূত্থানের মুখে বিজয় অর্জন হয়েছিল নিরস্ত্র আয়াতুল্লাহ খোমেনীর। এটাই ইতিহাস। জনসমর্থনের বিপরীতে থেকে কখনো বিজয় অর্জন করা যায় না। হয়তো সাময়িকভাবে ক্ষমতায় থাকা যায়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

এদিকে কূটনীতিকদের অনেকে মনে করেন আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিল ক্ষমতা ও অহংয়ের লড়াইয়ে আর তালেবানের কাছে ছিল শিকড় রক্ষার লড়াই। তালেবানের জয়ের এটিও এক অন্য দিক।

তাই যত বার আঘাত নেমে এসেছে, ভূপতিত হয়েও বার বার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তালেবান। গুলি-বোমায় একজন তালেবান মারা গেলে তাঁর জায়গায় আরও ১০ জন এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু সক্রিয় তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা খুব বেশি নয়। আফগান সেনা–পুলিশ ও বিমানবাহিনীর প্রায় তিন লাখ সেনার তুলনায় ছিল খুবই কম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের অনুমান, বর্তমানে আফগানিস্তানে সক্রিয় তালেবান যোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ৬০ হাজার।

বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে এই স্বল্প সংখ্যক যোদ্ধা দিয়ে জয় তখনই সম্ভব যখন থাকে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন। এদিকে ২০ বছরের লড়াইয়ে প্রায় ৭০ হাজার আফগান সেনা মারা গিয়েছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার তথ্য থেকে জানা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রর খালি হাতে ফেরা ও লুন্ঠিত ভাবমূর্তি

শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে খালি হাতেই ফিরতে হলো যুক্তরাষ্ট্রকে। সে সাথে ললাটে জুটলো ভিয়েতনামের পরাজয়ের চেয়েও আরেক বড় পরাজয়ের গ্লানি। ‘টুইন টাওয়ারে হামলার প্রতিশোধ’ নিতে বিন লাদেন উৎখাতে আফগানিস্তানে তাদের ২০ বছরের আগ্রাসন এক লহমায় শেষ। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের হারার আরো একটি কারণ আসলে অহংয়ের লড়াই লড়তে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তালেবানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২০ বছরের লড়াইয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে হাজার হাজার জওয়ানের দেহ কফিনবন্দি করে, দেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ করে খালি হাতেই আফগানিস্তান থেকে ফিরে গেল যুক্তরাষ্ট্র।

পেন্টাগন থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুদ্ধের পিছনে ২ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে শুধুমাত্র আফগান সেনাকে প্রশিক্ষণ দিতেই খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে পেন্টাগন জানায়, সরাসরি যুদ্ধেই তাদের ৮৭ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে।

পেন্টাগন রিপোর্ট থেকে আরও দেখা যায়, নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে আফগানিস্তানে গিয়ে প্রায় ৪ হাজার জন মার্কিন সেনা মারা গেছেন। গুরুতর জখম হয়ে ফিরেছেন আরো ২০ হাজার ৬৬৬ জন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন এই দীর্ঘ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মতে, ভিয়েতনাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আফগানিস্তান থেকে আগেই সরে যাওয়া উচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সন্ত্রাস রোধ, গণতন্ত্র, শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়ে আফগানিস্তানে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরে। ২০ বছরের যুদ্ধে আফগানিস্তানে শুধুই ধ্বংসস্তুপ রেখে গেল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আফগানিস্তানে তাদের যাওয়াটা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল। আর ন্যাটোর প্রধান বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে আজ ন্যাটো ও সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে।

তালেবান নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের মনোভাব

তালেবানের বর্তমান অগ্রযাত্রাকে শুরু থেকেই সমর্থন করে আসছে পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়া। তালেবানের কাবুল দখলের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, ‘দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছে আফগানবাসী। তিনি বলেন, আপনি যখন অন্যদের সংস্কৃতি সেরা মনে করে গ্রহণ করবেন, তখন দিনশেষে এর দাসে পরিণত হবেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল আফগানিস্তান পাকিস্তানসহ সমগ্র অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

তালেবানের প্রতি উদার মনোভাব চীনেরও। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি (১৯ আগস্ট) বলেছেন, চাপ দেওয়ার বদলে বিশ্বের উচিত তালেবানকে সমর্থন করা। তিনি বলেন, আফগানিস্তানকে ভূ -রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয় বরং তার স্বাধীনতা এবং জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান করা উচিত। তালেবানের অগ্রাভিযান শুরুর প্রথম দিকে গত জুলাই মাসে উত্তর চীনের তিয়ানজিন শহরে তালেবান নেতা আবদুল গণি বারাদার ও মুখপাত্র সুহাইল শাহিনের নেতৃত্বে আসা প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। বহুদিন ধরেই তালেবানের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালাচ্ছিল বেইজিং। চীন তালেবানকে সরাসরি স্বীকৃতি না দিলেও চীন বরাবরই তালেবানের পক্ষে বলে আসছে।

এদিকে আফগানিস্তান পুনর্গঠনে অংশ নিতে চীনকে স্বাগত জানিয়েছে তালেবান। দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় চীনের ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে তারা। সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল সিজিটিএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন। সিজিটিএনকে সুহাইল শাহিন বলেন, ‘চীন একটি বড় দেশ। তাদের বিশাল অর্থনীতি ও সক্ষমতা রয়েছে। আমি মনে করি, আফগানিস্তান পুনর্গঠনে তারা বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশটিকে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে এবং দেশটি নিয়ে পশ্চিমাদের প্রতি নাক না গলানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ‘বাইরে থেকে মূল্যবোধ’ চাপিয়ে দেওয়া হবে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’। আর প্রয়োজনে তালেবানের সঙ্গে অবশ্যই কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেছেন, ‘আমি মানুষকে আশ্বস্ত করতে চাই, আফগানিস্তানের জন্য একটি সমাধান বের করতে আমাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা থাকবে।’

জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, আফগানিস্তানের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ তালেবান মুভমেন্টের নিয়ন্ত্রণে, এটাই বাস্তব। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ও আফগানিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে পড়া প্রতিরোধে নিতে হবে পদক্ষেপ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র শর্ত সাপেক্ষে তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তালেবান মানবাধিকার, নারী অধিকার, সকল পক্ষকে নিয়ে সরকার গঠন এবং আফগান ভূমিকে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল না করলে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেবে।

তুরস্কের সাড়াও এক্ষেত্রে ইতিবাচক। তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বলেছেন, আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের জন্য তুরস্ককে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, আফগানিস্তান বিষয়ে আমরা সকল পক্ষের সঙ্গে যোগোযোগ রক্ষা করছি। আফগানিস্তানকে ভেঙ্গে পড়তে দেওয়া যাবে না। এছাড়া ভারত কাবুলের নতুন প্রশাসনের আচরণ দেখে ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে। ভারত পরিস্থিতির দিকে নযর রাখছে।

আর্থিক ও খাদ্য সংকটের মুখে

আফগানিস্তানে ক্ষমতায় বসেই তালেবান বড় আর্থিক সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জার্মানি এবং অন্যান্য দাতা দেশ ও সংস্থা আফগানিস্তানে তাদের আর্থিক সহায়তা স্থগিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক তহবিলও (আইএমএফ)দেশটির জন্য তাদের বরাদ্দ আটকে দিয়েছে। এ অবস্থায় শাসনকাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের চেয়ে অনেক কম অর্থকে পুঁজি করে তালেবানকে তাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে সংকটের মুখে পড়েছে ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটে রয়েছে। এতে করে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখে পড়তে পারে আফগানিস্তান। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি)কান্ট্রি প্রধান মেরি এলেন ম্যাকগ্রোয়ার্টি সম্প্রতি  বলেন, পশ্চিমাদের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ায় দেশটি দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। খরা ও বিভিন্ন কারণে দেশটির ৪০ শতাংশ শস্য ধ্বংস হয়ে গেছে। গত তিন বছরের মধ্যে আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো খরা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া করোনার কারণেও দেশটি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে।

তালেবানের সামনে যত চ্যালেঞ্জ

২০ বছর পর ফের আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান। যুদ্ধে জেতা যত সহজ, শান্তি রক্ষা ও দ্বিধাবিভক্ত ও সংঘর্ষ জর্জরিত একটি দেশকে শাসন ও দাঁড় করানো তত কঠিন। এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েই তারা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন তাদের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন আশরাফ গণির সরকার জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছিল।

তালেবান ইতোমধ্যে ব্যাপক সামরিক শক্তি অর্জন করেছে সত্যি, কিন্তু সঠিকভাবে এই শক্তির ব্যবস্থাপনা পরিচালন এবং তা ধরে রাখা এখন তাদের জন্য আরো একটি চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিশেষজ্ঞ জোনাথন শ্রোডেন বলেন, তালেবান কার্যকরভাবে শাসন ক্ষমতা এখনো দেখাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক বিশ্বস্ততা অর্জনে আল-কায়েদা ও আইএস ঠেকানোর কার্যকর দক্ষতা দেখাতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে আল-কায়েদার কারণেই অতীতে তাদের ওপর হামলা ও পতন হয়েছিল। এছাড়া এখন মানবাধিকার নিয়ে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে তাদের। এর মধ্যে নারীদের শিক্ষার বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত। আফগানিস্তান বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর একটি। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন হবে। চীন তাদের পাশে থাকলেও অন্যান্য দাতা দেশের সাহায্যও তাদের প্রয়োজন।

পরিশেষে সব সংকট কাটিয়ে তালেবান সামনে এগিয়ে যাবে এবং বিশ্বের সামনে একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তান উপহার দেবে এটাই সবার কাম্য।

ফেইসবুকে আমরা...