আল আকসার তুফান তখনো শুরু হয়নি। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী হন্য হয়ে খুঁজছিল তাঁকে। ২০২১ সালের যুদ্ধে তাঁকে না পেয়ে গুড়িয়ে ফেলে তার বাড়ি। যুদ্ধ শেষে সেই বাড়ির ধ্বংসস্তুপের মধ্যে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় আরাম কেদারায় বসা অবস্থায় তাঁর যে ছবিটি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তাঁর শাহাদতের সময়কার ছবি দেখে বারবার সেই ছবিটির কথা মনে পড়ছে। আরেক বার তো তিনি ঘোষণা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে গাযার রাজপথ ধরে বাড়ি ফিরেছিলেন, দখলদার বাহিনী সেবারও তার কিছুই করতে পারেনি। এবার, আল আকসার তুফান শুরু হওয়ার পরও তার বাড়ি গুড়িয়ে ফেলে দখলদার বাহিনী সেই বাড়ির ধ্বংসাবশেষে তল্লাশি চালিয়ে তার জুতা উদ্ধার করতে পেরেছিল, এবং সেটি ছিল সেই দিনের ইসরায়েলী গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় খবর! বলছি ইয়াহইয়া সিনওয়ারের কথা। দুনিয়ার অন্যতম শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা যার জুতা আবিষ্কার করে উল্লাসিত হয়, যাঁর নাগাল পেতে টানা এক বছরেও সাফল্যের দেখা পায়নি দখলদার বাহিনী, সবশেষে তার বীরোচিত শাহাদত হলো বটে, কিন্তু সেই অভিযানে অংশগ্রহণকারীরাও শাহাদতের পূর্বাবধি তাঁর পরিচয় পায়নি।
ইয়াহইয়া সিনওয়ার হামাসের অন্যতম রহস্যপুরুষ ছিলেন বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। শীর্ষ হামাস নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন ইসরায়েলের কারাগারে থেকেছেন, ইউরোপ থেকে আগত বহু ইসরায়েলি দখলদারদের চেয়ে ভালো হিব্রু বলতে পারতেন, গাযায় হামাসের প্রধান হিসেবে গত বছর ৭ই অক্টোবরের তুফানের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে তার নামই বিশ্বমিডিয়ায় বহুল আলোচিত, সবশেষ অতি সম্প্রতি ইরানে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়্যার শাহাদাতের পর হামাস সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে হামাসের প্রধান নিযুক্ত করে।
হামাস প্রধান হিসেবে তাকে একই সাথে যেমন গাযার বেসামরিক কার্যাবলি পরিচালনা করতে হচ্ছিল, সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছিল, আবার হামাসের কূটনৈতিক কার্যক্রমের দিকেও তাকেই নজর রাখতে হচ্ছিল। দখলদার বাহিনী প্রায় নিশ্চিত ছিল, তিনি হয়তো গাযারে ভূগর্ভস্থ কোন এক নিরাপদ সুড়ঙ্গে বসে ঠান্ডা মাথায় যুদ্ধ ও কুটনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন, যে কোন সাধারণ মানুষের মাথায় এমন চিন্তাই আসবে, কিন্তু হামাসের রহস্যমানব সিনওয়ার যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতুতে গড়া এক বীরযোদ্ধা! গাজায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ চলছে রাফা অঞ্চলে, এই অঞ্চলের তেল সুলতান এলাকা সবচেয়ে বিপজ্জনক, আর সিনওয়ারের শাহাদত হয়েছে সেই তেল সুলতানের এক পরিত্যক্ত বাড়িতে।
ইসরায়েলীদের অপপ্রচার ছিল তিনি কোন সুড়ঙ্গে লুকিয়ে আছেন, নয়তো ইসরায়েলের যে সকল নাগরিক হামাসের হাতে বন্দী তাদেরকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আত্মরক্ষা করছেন কিংবা নারী-শিশুদের মধ্যে লুকিয়ে আছেন তাই তাঁর উপর আক্রমণ করতে পারছে না। অথচ দেখা গেলো, তাদের সব অপপ্রচার ভুল প্রমাণিত করে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধের ময়দানে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে বীরের মতো পরম আকাঙ্খার শাহাদাতকে আক্ষরিক অর্থেই “বরণ” করে নিলেন।
প্রতিরোধযুদ্ধের এই প্রবাদপুরুষের জীবনের শেষ মুহূর্ত আরবদের নিকট সত্যিকারের প্রবাদে পরিণত হলো, শেষ মুহূর্তে আহত অবস্থায় যে লাঠি দখলদারদের ড্রোনের দিকে ছুঁড়েছিলেন, আরবী ভাষায় সেই লাঠিও প্রবাদের অংশ হয়ে পড়লো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন “প্রাণপণে লড়া” অর্থে “সিনওয়ারের লাঠি ছোঁড়া” কথাটি প্রবাদের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এক আহত সিংহের মুখোমুখি হতে বিশাল বাহিনীর আর উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার করে দখলদার বাহিনী পরিণত হয়েছে হাস্যরসের খোরাকে।
সিনওয়ারের শাহাদাতের পর এমনকি তার সমালোচকরাও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে, তিনি সত্যিকারের মহাবীরের মতো মহাকাব্যিক মৃত্যুবরণ করেছেন, কাপুরুষের মতো সাইরেনের আওয়াজে মাটির নিচে পালিয়ে যাননি, যেমনটা তার প্রতিপক্ষ দখলদার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গ প্রতিদিন করছেন। দখলদার বাহিনী হয়তো তাঁর শাহাদাত নিয়ে মিথ্যা গালগল্প ছড়াতো, কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে সে সুযোগ দেননি। শাহাদাতের পরও তাঁকে চিনতে না পেরে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার আগেই সেই অভিযানের ভিডিও অভিযানে অংশগ্রহণকারী দখলদার সেনারা প্রকাশ করে ফেলায় তার শৌর্যবীর্যের বিষয়ে কোন ধরনের অপপ্রচারের সুযোগ হয়নি দখলদারদের। বরং শাহাদাতের পরও তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন, সারা দুনিয়ার স্বাধীনতাকামী মানুষের নিকট তিনি হয়ে উঠেন মহানায়ক।
তাঁর শাহাদাতের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ্যে এলে শুধু আরব বা মুসলিমগণই নয়, পশ্চিমাদের অনেকেই শ্রদ্ধাভরে তাঁকে নিয়ে কথা বলেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। স্বজাতির স্বাধীনতার জন্য তাঁর এই আত্মোৎসর্গের চিত্র সবার হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে। মুসলিম বিশ্বে তিনি রীতিমতো কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন, অথচ এই পরিস্থিতিতেও আপাদমস্তক ইসরায়েলের দালালিতে ব্যস্ত মুসলিম নামধারীদের আচরণ ঠিক বিপরীত। দুনিয়াজুড়ে সালাফী ঘরানার বেশির ভাগ শাইখ নামধারী লোকেরা সিনওয়ার আর তাঁর লড়াইকে নিয়ে নানা অসংবেদনশীল মন্তব্য করছে, কেউ সরাসরি তাঁর সমালোচনা করছে, কেউবা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করছে।
পুরো আরববিশ্ব যখন তাঁর শাহাদাতে শোকাহত, সৌদি মালিকানাধীন আল-আরাবিয়া আর এমবিসি চ্যানেল সিনওয়ারকে নিয়ে যাচ্ছে তা প্রচার করছে। এমবিসির এক উপস্থাপক সরাসরি সিনওয়ারকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে, শেষ পর্যন্ত গণরোষের মুখে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ তাকে সরাতে বাধ্য হয়। কিন্তু এ সকল সৌদি সংবাদমাধ্যমের গত এক বছরের সংবাদ বিশ্লেষণ করলে সহজেই বুঝা যায়, এটাই মূলত তাদের অফিসিয়াল অবস্থান, হয়তো বা গণরোষের মুখে কিছুটা পিছু হটেছে। সৌদি শাসকগোষ্ঠী থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, সকলেই যেন তাদের এক মহাশত্রুর মৃত্যুতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, পুরো মুসলিম উম্মাহর বিপরীতে তাদের এই অবস্থান মুসলিম বিশ্বের জায়োনিস্ট হিসেবে তাদের কুখ্যাতি আবারো সকলের সামনে স্পষ্ট করে তুলছে। জায়োনিস্ট ছাড়া আর কে ইয়াহইয়া সিনওয়ারের শাহাদাতে আনন্দিত হতে পারে!
সিনওয়ারের শাহাদাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছিল, কেবল সিনওয়ারের কারণেই যুদ্ধবিরতি হচ্ছে না, এখনই বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতিটা হয়ে যাবে, যদিও নেতানিয়াহুর বক্তব্যে ঠিক বিপরীত চিত্র ফুটে উঠে, এবং বাস্তবে কিছু্ হওয়ার কোন লক্ষণ অন্তত এখন অবধি দেখা যাচ্ছে না। হামাসের দিক থেকে সিনওয়ারের শাহাদাতের ঘোষণার সাথে সাথেই জানানো হয়েছিল, হামাস সিনওয়ারের রেখে যাওয়া পথেই থাকবে, তাঁর নীতিতে কোন ধরনের রদবদল আসবে না, এখন অবধি হামাসের কার্যক্রম থেকে তাদের এই ঘোষণার বাস্তবতা প্রমাণিত হচ্ছে।
ইসলামের ইতিহাস বলে, মুসলিম উম্মাহ কখনো কোন এক ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল না। মুতার যুদ্ধে তিনজন সেনাপ্রধানের শাহাদতের পরও মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হয়েছে, শেখ ইয়াসিন-রানতিসীদের শাহাদাতের পরও হামাস তাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে, একইভাবে হানিয়্যা-সিনওয়ারের শাহাদাতের পরও প্রতিরোধ যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে, আল্লাহর সাহায্যে চূড়ান্ত বিজয় আসবেই। সিনওয়ারের শাহাদাতের পর গাজার প্রতিরোধ যুদ্ধে তাই কোন পরিবর্তন আসেনি। তবে সিনওয়ার এই প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক হিসেবে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, আর ইসরায়েল নামক দখলদার রাষ্ট্রও যতদিন টিকে থাকবে, সিনওয়ারের নাম তাদের ভয়ের কারণ হয়ে থাকবে।
দখলদার বাহিনী সিনওয়ারের শেষ মুহূর্তের যে ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছে, তাতে আহত সিনওারকে একটি আরাম কেদারায় উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। ফিলিস্তিনী কবি তামীম আল বারগুসী সে দৃশ্য দেখে সিনওয়ারের শোকগাথার এক পর্যায়ে লিখেছেন-
“যেন খলীফার মতো বসে আছেন সিংহাসনে
অনুসারীরা তার বাইআত নিচ্ছে—আসমান ও যমীনে।”
সত্যিই তো, এতো এতো মুসলিম রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রপ্রধান, কিন্তু হাদীসে রাসূলের বর্ণনা মতে বাইতুল মাকদিসের আশেপাশে কিংবা আসকালানের মুজাহিদ-মুরাবিতদের কায়িদ তো এই আহত ইয়াহইয়া সিনওয়ারই, দখলদার ইসরায়েলের সহযোগী আরব-মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের পক্ষে সিনওয়ারের এই সিংসাহসনের সমকক্ষ হওয়ার সুযোগ কোথায়? সিনওয়ারের এই ভাঙা সিংহাসনই তাই মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে আবেগাপ্লুত করে, বিশাল বিশাল লকবধারী মুসলিম রাষ্ট্রনায়কদের কারোরই স্থান হয় না সেই আবেগাপ্লুত মানুষের হৃদয়ে। বারগুসী তার এই কবিতায় সিনওয়ারের লাঠিকে প্রতিরোধযোদ্ধাদের প্রতি সিনওয়ারের শেষ ওসীয়ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, প্রতিরোধযোদ্ধারা সেই ওসীয়ত পালনও করছেন, অচিরেই নদী থেকে সমুদ্র অবধি স্বাধীন ফিলিস্তীন কায়েমের মধ্য দিয়ে সে ওসীয়ত পূর্ণতা পাবে।