ভূমিকা
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বাদ।
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। এ দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও একে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠার জন্য সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন, বহু সাহাবায়ে কিরাম (রা.) নিজেদের জীবন কুরবান করেছেন। পরবর্তীতে এ ত্যাগ ও কুরবানীর ধারা প্রত্যেক যুগেই অব্যাহত ছিল। এ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে আউলিয়ায়ে কিরামের ত্যাগ ও কুরবানী নজীরবিহীন। নিকট অতীতে আমাদের সিলসিলাহর পূর্বপুরুষ হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) এর ভূমিকা এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। তিনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় সিপাহসালার ছিলেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও উপমহাদেশকে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে তিনি বালাকোট প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাঁর আন্দোলন-সংগ্রাম ও স্বাধীনতার স্পৃহা এতদঞ্চলের মানুষের চেতনায় পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে বীজ বপন করেছিল তার ফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগে এর প্রভাব লক্ষ্যণীয় ছিল। আমাদের পীর ও মুরশিদ হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) এর সিলসিলার অন্যতম বুযুর্গ ছিলেন। তিনি একই সাথে বৃটিশ উপনিবেশাধীন ভারত, স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ জীবন ইসলামের প্রকৃত আদর্শ প্রতিষ্ঠা, কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা বিস্তার ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষার স্বকীয়তা রক্ষার পাশাপাশি মুসলিম জনসাধারণের আত্মশুদ্ধির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথাগত রাজনীতিতে বিশেষ অংশগ্রহণ না করলেও ইসলাম ও মুসলমানের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে তিনি সবসময় সরব ছিলেন। তাঁর এ শিক্ষা অনুসরণে আমরাও বর্তমান পরিস্থিতিতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের নিকট ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছি।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ইতিহাসের নানা বাঁক অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, এদেশের মানুষ সময়ে সময়ে শোষণ, বঞ্চণা, নির্যাতন-নিপীড়ন ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব ইতিহাসের সে ধারারই অংশ। এ বিপ্লবে যেসকল মুসলিম শাহাদাত বরণ করেছেন আমরা তাদের মাগফিরাত কামনা করছি এবং সর্বস্তরের অংশীজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
জুলাই বিপ্লবের পর নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের সংস্কার ও উন্নয়নে নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সংবিধান সংস্কারের জন্য গঠন করেছে ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’। এ কমিশন দেশের সকল নাগরিকের নিকট থেকে সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রস্তাব আহ্বান করেছে। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) এর বিপ্লবী চেতনা উজ্জীবনের লক্ষ্যে গঠিত ‘বালাকোট চেতনা উজ্জীবন পরিষদ’ এর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরে যেসকল প্রস্তাব পেশ করেছি সেগুলো নিয়েই এ বুকলেট প্রকাশনা। প্রস্তাবসমূহ ইংরেজিতে প্রণয়ন করেছেন জার্মানির এরফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক প্রিয় ভাই মারজান আহমদ চৌধুরী। এর বাংলা অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আহমদ রায়হান ফারহী।
আমরা সংবিধান সংস্কার কমিশনের নিকট ১৯ দফা প্রস্তাব পেশ করেছি। সংবিধানের প্রস্তাবনায় “সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব” এর স্বীকৃতি প্রদানের কথা বলেছি। এটি অভূতপূর্ব কোনো বিষয় নয়। মৌরতানিয়া, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধানে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অনুযায়ী ¯্রষ্টার সার্বভৌমত্বের কথা বিভিন্ন পরিভাষায় প্রযুক্ত হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখার প্রস্তাবও আমরা করেছি। মালয়েশিয়া, তিউনিসিয়া, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড-এও এরূপ রাষ্ট্রধর্মের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পাশাপাশি ইসলামকে নৈতিক দিকনির্দেশনার ভিত্তি হিসেবে সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। তাছাড়া কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থি কোনো আইন প্রণয়ন না করা, আলিম-উলামা ও ইসলামী আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘ইসলামিক আইডোলজি কাউন্সিল’ গঠন করা, এলজিবিটিকিউ বা ট্রান্সজেন্ডারের মতো বিষয় অধিকার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত না করা, মুসলমানদের বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ও অন্যান্য পারিবারিক বিষয় পূর্ণরূপে ইসলামী নীতি অনুসারে পরিচালনার স্বীকৃতি, জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন, পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক ইসলামী শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি, ইসলামী অর্থনীতি ও শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন, সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থা প্রবর্তন, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা বিধানসহ ধর্মীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা এ ১৯ দফা’র মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব করেছি। প্রস্তাবসমূহ উল্লেখ করার সাথে সাথে এগুলোর ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য দেশের আইন, সংবিধান ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উদাহরণও আনা হয়েছে।
প্রস্তাবসমূহ সম্পাদনা ও চূড়ান্তকরণে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছেন বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান ও বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মাওলানা নোমান আহমদ। এছাড়া বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা আবু সালেহ মো. কুতবুল আলম, মাসিক পরওয়ানার সম্পাদক মাওলানা রেদওয়ান আহমদ চৌধুরীসহ আরো অনেকে। আল্লাহ সকলকে উত্তম জাযা দান করুন।
আহমদ হাসান চৌধুরী
সহযোগী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সদস্য সচিব, বালাকোট-চেতনা উজ্জীবন পরিষদ
সংবিধান সংস্কার কমিশন সমীপে কিছু প্রস্তাব
বরাবর
মাননীয় চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ
সংবিধান সংস্কার কমিশন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
এই সংকটাপন্ন সময়ে সংবিধান সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগ্রহণের জন্য আমরা আপনাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আইনি অঙ্গনের বিশেষজ্ঞ হিসেবে সংবিধান, আইন ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আপনাদের অগাধ জ্ঞান রয়েছে। আপনাদের সদয় বিবেচনার জন্য আমরা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু সুপারিশ পেশ করছি। সেই সাথে প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে তুলে ধরছি, যার ভিত্তিতে এই প্রস্তাবগুলো তৈরি করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামি শরিয়তের বিধানসমূহ সমাজ ও রাষ্ট্রে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব কেবল একটি সম্পূর্ণ কাঠামোবদ্ধ ইসলামি শাসনব্যবস্থার ওপরই বর্তায়। যেহেতু এই কমিশন রাষ্ট্রের প্রচলিত কাঠামোর ভেতরে থেকে বিদ্যমান (সংস্কারাধীন) সংবিধান নিয়ে কাজ করছে, তাই আমরা এরই উপর ভিত্তি করে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কেবল সুনির্দিষ্ট কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি।
প্রস্তাব-১
আমরা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ অপসারণের প্রস্তাব করছি:
(ক) সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে, যেখানে এগুলোকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে;
(খ) সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে;
(গ) এই শব্দগুলোকে অধিকতর উপযুক্ত শব্দগুচ্ছের সাথে প্রতিস্থাপিত করা যেতে পারে। যেমন: ধর্মীয় সম্প্রীতি, সামাজিক সুবিচার, একটি ন্যায়ানুগ, ন্যায্য বা সমতাভিত্তিক সমাজ, অথবা এমন যে-কোনো শব্দাবলির সাথে যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিমালা ও ইনসাফ-ভিত্তিক সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বরাবরই ধর্ম ও ধর্মের সাথে রাজনীতির জটিল সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কে পরিপূর্ণ। দেশে প্রচলিত ও প্রভাবসম্পন্ন ন্যারেটিভ বা বয়ান অনুযায়ী, বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে কয়েকটি আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তন্মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা (সেক্যুলারিজম) ও সমাজতন্ত্র অন্যতম।১ ১৯৭২ সালের সংবিধানে চারটি ভাবাদর্শকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়; যথা- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যেগুলো পরবর্তীতে ‘মুজিববাদ’২ নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ ও রাজনীতিকেন্দ্রিক প্রভাবশালী ন্যারেটিভ বা বয়ানসমূহ ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন নীতি হিসেবে উপস্থাপন করেছে৩ এবং এটিকে বাংলার জনগণের ‘অন্তর্নিহিত চেতনা’৪ হিসেবে দাবি করেছে। পক্ষান্তরে, ইসলামকে (প্রায়শ ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নামে আখ্যায়িত করা হয়) ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর বিরোধী আদর্শ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। প্রচলিত বয়ান অনুযায়ী, ইসলাম কেবল ১৯৭০ দশকের শেষদিক ও ১৯৮০ দশকের সামরিক শাসনের সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে প্রবেশ করেছে।৫ এটি সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা মনে করি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা বাঙালি মুসলমানদের অন্তর্নিহিত চেতনা তো নয়ই; এটি কোনো নিরপেক্ষ বা সর্বজনীন আদর্শও নয়।
প্রথমত, নৃতাত্ত্বিক তালাল আসাদ উল্লেখ করেছেন যে, ‘সেক্যুলারিজম’-এর ধারণা ইউরোপীয় ইতিহাস দ্বারা প্রভাবিত, যা নির্দিষ্ট কিছু জীবনধারাকে ‘গ্রহণযোগ্য’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে এবং অন্যগুলোকে উপেক্ষা করে। কয়েক শতাব্দীব্যাপী ধর্মকেন্দ্রিক যুদ্ধগুলো চলার পর অবশেষে ইউরোপের লোকেরা যখন ধর্ম ও সমাজের মধ্যকার পার্থক্যকে গ্রহণ করে নিয়েছিল, কেবল তখনই সেখানে সেক্যুলারিজম একটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।৬ তবে, আমাদের ইতিহাসে ইউরোপের মতো রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে এমন কোনো সংঘাতের উদাহরণ নেই। দ্বিতীয়ত, সমাজবিজ্ঞানী হোসে ক্যাসানোভা বলেন যে, সেক্যুলারিজম আদর্শিকভাবে ধর্মকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করে তোলে এবং কেবল পশ্চিম ইউরোপ এটিকে আধুনিকতার একটি স্বাভাবিক উপজাত হিসেবে বিবেচনা করে। তবে, অ-পশ্চিমা সমাজগুলোতে প্রায়শ আধুনিকতার পাশাপাশি ধর্মীয় পুনর্জাগরণ পরিলক্ষিত হয়, যা আধুনিকতার সাথে ধর্মের বিরোধের পূর্বতন ধারণাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।৭ তৃতীয়ত, সেক্যুলারিজম ইসলামের সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক। দার্শনিক সাইয়্যেদ হোসেইন নাসর লিখেছেন যে, ইসলামে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যা ধর্মীয় পরিসীমার বাহিরে। ফলে, ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ অথবা আধ্যাত্মিক ও পার্থিব বিষয়াবলির মধ্যে পৃথককরণের কোনো সুযোগ নেই। প্রথমদিককার ইসলামি ভাষ্যগুলোতেও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বা ‘পার্থিব’ এর মতো কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই।৮
অন্যদিকে, বাংলার ইতিহাস গঠনে ইসলাম অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। ১৩শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলায় মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে, এই অঞ্চলে সুফি-সাধক ও মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে ইসলামের আগমন ঘটে।৯ তাদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা ও পরবর্তীতে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় একটি সমৃদ্ধ মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠে।১০ উনিশ শতকে ফরায়েজি আন্দোলন, তরিকা-ই-মুহাম্মাদিয়া, খেলাফত আন্দোলন১১ ও পরবর্তীতে বিংশ শতকের শুরুর দিকে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে একটি শক্তিশালী মুসলিম চেতনা বিকশিত হয়। ফরায়েজি আন্দোলন এমন সব অঞ্চলে তীব্র হয়ে ওঠে, যেখানে মুসলিম কৃষকরা হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশদের দ্বারা নিপীড়িত ছিল।১২ অপরদিকে, সৈয়দ আহমদ শহিদ বেরলভি (র.) এর নেতৃত্বাধীন তাসাউফচর্চা ও ব্রিটিশবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য প্রসিদ্ধ তরিকা-ই-মুহাম্মাদিয়া বাংলায় উল্লেখযোগ্য সমর্থন লাভ করে। ১৮২০ সালে এই অঞ্চলের দশ হাজারেরও বেশি মুসলমান সৈয়দ আহমদের সাথে কলকাতায় মিলিত হন।১৩ সৈয়দ তিতুমীরের ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ, নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরীর বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও কারামত আলী জৌনপুরীর শান্তিপূর্ণ দাওয়াতি কার্যক্রম তরিকা-ই-মুহাম্মাদিয়াকে একটি বহুমুখী আন্দোলনে রূপান্তরিত করে। অধ্যাপক আইরা লাপিডাসের মতে, ১৮৩১ সালে বালাকোটে শহীদ হওয়া সৈয়দ আহমদের এই আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলাসহ উপমহাদেশের অন্যান্য মুসলিম সংস্কার আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।১৪ পরবর্তীতে, বাংলার শত শত আলেম খেলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।১৫ ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালি নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সুতরাং, এটি সহজেই বলা যায় যে, ঔপনিবেশিক যুগে ইসলাম কেবল একটি সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং এটি মুসলমানদেরকে একটি পরিচয় ও প্রতিরোধের হাতিয়ার প্রদান করেছিল।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি ভাবাদর্শের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বের ইঙ্গিত ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ৭ দফা ঘোষণা,১৬ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৪২ দফা কর্মসূচি,১৭ কিংবা যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনি ইশতেহারে এমন কিছুই ছিল না যা ইসলামি আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারে বলা হয়েছিল: “কোরান ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ করে কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।”১৮
পাকিস্তান আমলে ধর্মনিরপেক্ষতা কখনো আওয়ামী লীগের আদর্শগত আলোচনায় গুরুত্ব পায়নি। দলটির কোনো রাজনৈতিক প্রচারণায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়নি।১৯ শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলন, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি, আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ইশতেহার, কিংবা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রÑ কোনোটাতেই ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রের উল্লেখ ছিল না।২০ অতএব, এটি স্পষ্ট যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার জন্য ছিল না; বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সামরিক রাষ্ট্র (garrison state) পাকিস্তানের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এজন্য আলাদা হয়নি যে, এটি একটি ইসলামি রাষ্ট্র ছিল; বরং তারা আলাদা হয়েছিল কারণ পাকিস্তান তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ইসলামি নীতিতে পরিচালিত হচ্ছিল না, উলটো এখানে একটি ঔপনিবেশিক ও দমনমূলক শাসনব্যবস্থা বিরাজমান ছিল।
তবুও, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় হঠাৎ করেই ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে ‘মূলনীতি’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ‘অনুপ্রেরণা’ বলে দাবি করা হয়। কিন্তু, এই দাবি যে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা বিবেচনা করা হয়নি।২১ যদিও শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে ‘ধর্মহীনতা’ নয় বলে যুক্তি দেখিয়েছিলেন২২ এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেনও দাবি করেছিলেন যে, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় অপব্যবহার রোধ করার জন্য তারা বাধ্য হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করেছিলেন;২৩ তবুও সময়ে সময়ে বাংলাদেশে ‘আগ্রাসী ধর্মনিরপেক্ষীকরণ’২৪, এমনকি ‘রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ডি-ইসলামাইজেশন’ লক্ষ করা গেছে, যেটিকে প্রফেসর হাতেম বাজিয়ানের ভাষায় ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামবিদ্বেষ (ইসলামোফোবিয়া)’-এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।২৫ এ ধরনের কার্যক্রম সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে কখনোই উৎসাহিত করতে পারেনি; বরং রাষ্ট্রযন্ত্রকে একটি দমনমূলক শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে, মুসলমানদের ঐতিহাসিক আকাক্সক্ষাগুলোকে ধ্বংস করেছে এবং দেশের বিশাল একটি অংশকে তাদের নিজ ভূখ-েই পরবাসী বানিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা নিঃসন্দেহে একটি উড়ে এসে জুড়ে বসা ধারণা,২৬ যদিও এই প্রস্তাবে এর বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের বক্তব্যের সাথে একমত; তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা এই দেশের সামাজিক চেতনা ও ইতিহাসকে প্রতিফলিত করেনি; বরং এটি ছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনে গ্রহণ করা একটি ছলপূর্ণ কৌশল।”২৭
একইভাবে, সমাজতন্ত্র একটি বিশ্বব্যাপী ব্যর্থ মতাদর্শ। বাংলার মুসলমানদের সাথে এটির কোনো ঐতিহাসিক যোগসূত্র নেই। বাংলাদেশি মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন নেই, উপরন্তু শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বা একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির সমাজতন্ত্রেরও দরকার নেই। ইসলাম স্বভাবতই সাম্যের কথা বলে এবং ইসলামের এই বৈশিষ্ট্যই ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।২৮ ইসলামি শরিয়াহর আদর্শাবলি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ধর্মীয় সহনশীলতা, শোষণ দূরীকরণ ও একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সামাজিক ন্যায়বিচারব্যবস্থাকে লালন করে এবং ইতিহাস জুড়ে সমৃদ্ধিশালী মুসলিম সভ্যতাগুলো এই আদর্শাবলির বাস্তব রূপায়ণ দেখিয়েছে।
প্রস্তাব-২
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় “সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব” আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। এক্ষেত্রে মৌরিতানিয়া, পাকিস্তান, আয়ারল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর উদাহরণ উদ্ধৃত করা যেতে পারে, যেগুলোর সংবিধানে ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্ব বা দিকনির্দেশনার স্বীকৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রস্তাব-৩
আমরা প্রস্তাব করছি যে, ইসলামকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক:
(ক) সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘নৈতিক দিকনির্দেশনার ভিত্তি’ হিসেবে;
(খ) সংবিধানের প্রথম ভাগে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসেবে; এক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, তিউনিসিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও আইসল্যান্ডের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে, যেগুলোর সংবিধান একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রধর্মকে স্বীকৃতি দেয়;
(গ) হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য স্বাধীনভাবে পালন ও সংরক্ষণের অধিকার রক্ষার শর্তে।
প্রস্তাব-৪
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হোক, যাতে উল্লেখ করা হবে যে, কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না।
প্রস্তাবসমূহের প্রেক্ষাপট
আমাদের উপরিউক্ত তিনটি প্রস্তাবের (২, ৩ ও ৪) প্রেক্ষাপট হিসেবে আমরা ইসলামি শরিয়াহ ও এর মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যাবলির ওপর ভিত্তি করে একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছি। শরিয়াহকে অনেকেই অজ্ঞতাবশত কেবল কতিপয় ইসলামি দ-বিধির একটি সংকলন মনে করেন। কিন্তু শরিয়াহ কেবল কতিপয় দ-বিধির নাম নয়; বরং এটি পুরো ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বাস (আকাইদ), ইবাদতের বিধানাবলি (আহকাম) ও নৈতিক নির্দেশনা (আখলাক)। ইসলামি বিদ্বানরা শরিয়াহকে “আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সকল বিধান দিয়েছেন” বলে সংজ্ঞায়িত করেন২৯ এবং এটিকে মুক্তির (নাজাত) পথ হিসেবে দেখেন, যেমনটা ১৩শ শতাব্দীর ফিকহশাস্ত্রবিদ আল-কুরতুবি উল্লেখ করেছেন।৩০ শরিয়াহর মৌলিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ১৩শ শতকের আরেকজন ফকিহ ইবনুল কাইয়্যিম লিখেছেন:
“নিঃসন্দেহে, শরিয়াহ উভয় জগতে আল্লাহর বান্দাদের জন্য প্রজ্ঞা ও কল্যাণের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর পুরো কাঠামো ন্যায়বিচার, দয়া, কল্যাণ ও প্রজ্ঞার ওপর গঠিত হয়েছে। যে-কোনো বিষয় যা ইনসাফের পরিবর্তে জুলুম, দয়ার পরিবর্তে নিষ্ঠুরতা, জনকল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ ও প্রজ্ঞার পরিবর্তে নির্বুদ্ধিতা বয়ে আনে, তা শরিয়াহর অন্তর্ভুক্ত নয়, যদি কোনো ব্যাখ্যার মাধ্যমেও তা অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়।”৩১
শরিয়াহকে মোটাদাগে বোঝার একটি কার্যকরী উপায় হচ্ছে মাকাসিদ তথা উদ্দেশ্যগুলোকে বোঝা। মাকাসিদের সংজ্ঞা হচ্ছে, “যা আইনপ্রণেতার উদ্দেশ্য পূরণ করে।” মাকাসিদে শরিয়াহ এমন একটি শাস্ত্র, যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) আইনপ্রণয়নের অন্তর্নিহিত অভিপ্রায়গুলোকে ব্যাখ্যা করা হয়।৩২ শরিয়াহর উদ্দেশ্যগুলোকে ফকিহগণ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে- অপরিহার্যতা (আদ-দারুরিয়্যাত), প্রয়োজনীয়তা (আল-হাজিয়্যাত) ও সৌন্দর্যপ্রবণতা (তাহ্সিনিয়্যাত)। অপরিহার্যতার ক্ষেত্রে, ইসলামি শরিয়াহর পাঁচটি প্রধান মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যাবলি রয়েছে: দ্বীন সংরক্ষণ, জীবন রক্ষা, বংশ সংরক্ষণ, বুদ্ধির সুরক্ষা ও সম্পদের হেফাজত।৩৩
মাকাসিদ ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে শরিয়াহর বিধানগুলো লক্ষ করলে এগুলোর অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞা উপলব্ধি করা যাবে।
টেবিল-১:
মাকাসিদ ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী শরিয়াহর বিধানসমূহের শ্রেণিবিন্যাস-
শরিয়াহর মাকাসিদ ও এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলি ইসলামি আইনশাস্ত্রবিদদের ইজতিহাদের ক্ষেত্রে কুরআন, হাদিস ও ইজমার আলোকে এমন কিছু নীতি তৈরি করতে উৎসাহী করেছে, যেগুলোকে ইসলামি আইনজ্ঞরা ফিকহী বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে মূলনীতি হিসেবে ব্যবহার করেন। তন্মেধ্যে রয়েছে, ইসতিহসানÑ যা ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞকে কুরআন-হাদিসে সরাসরি উল্লেখ নেই এমন বিষয়াবলির ক্ষেত্রে নিজ বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সর্বাধিক উপযুক্ত সমাধানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এখতিয়ার প্রদান করে; মাসলাহা মুরসালাহÑ যা আইনপ্রণয়নের ক্ষেত্রে জনকল্যাণ ও সুবিচারের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়; এবং উরফÑ যা আইনপ্রণয়নের সময় কোনো নির্দিষ্ট সমাজের রীতিনীতি ও প্রথাগুলোকে গুরুত্ব দিতে বলে। সংক্ষেপে, শরিয়াহ ও এর ফিকহি নীতিমালার (উসুল) কোনো বিধান ন্যায়বিচার, দয়া, সামষ্টিক কল্যাণ ও প্রজ্ঞার পরিসীমাকে লঙ্ঘন করে না। কোনো অজ্ঞ বা উগ্রপন্থি ব্যক্তি শরিয়াহর মাকাসিদ ও এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলির পরিপন্থীভাবে যতই কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা করুক না কেন, কোনো আস্থাভাজন ইসলামি প-িত এমন ব্যাখ্যাকে সমর্থন করবেন না। এ কারণেই ইসলামি প-িতদের মধ্যে কেউই আইএস বা এরকম কোনো গোষ্ঠীর কর্মকা-কে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেন না। শরিয়াহ কিছু অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করেছে সত্য, কেননা এটি ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে জনকল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং সমাজকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
শরিয়াহ প্রথমে ব্যক্তির ইসলাহ তথা শুদ্ধির ওপর জোর দেয়, কারণ ব্যক্তি হলো সমাজের মূল ভিত্তি। এরপর পারিবারিক বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয় এবং তারপর সামাজিক ও শাসনব্যবস্থার বিষয়গুলো নিয়ে নির্দেশনা প্রদান করে। পাশাপাশি দুনিয়াবি বিষয়াদির ক্ষেত্রে নিজ জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও সুস্থ বিবেক-বিবেচনা প্রয়োগের অনুমতি প্রদান করে। আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন এবং এসব বিষয় পরিচালনার জন্য জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিছক জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে সাহাবিদের অভিজ্ঞতালব্ধ কোনো কোনো কাজকে অনুমোদন দিয়েছেন এবং বলেছেন, “তোমরা তোমাদের জাগতিক বিষয় সম্পর্কে অধিকতর অবগত।”৩৪ তবে এটিও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জাগতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে নিজস্ব বিবেক প্রয়োগে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যেন এটি শরিয়াহর কোনো মূলনীতির খেলাফ না হয়। উপরন্তু যেসব বিষয়ে জনসাধারণের সম্পৃক্ততা আছে সেসব বিষয়ে শরিয়াহর প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা তো রয়েছেই। উদাহরণস্বরূপ, শাসনব্যবস্থার মতো জনদায়িত্ব পালনের জন্য কুরআন শুরা বা পরামর্শমূলক পদ্ধতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।৩৫ একইভাবে, শরিয়াহ Presumption of innocence তথা কোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বলে বিবেচনা করাকে বিচারব্যবস্থার মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশ হচ্ছে- সাক্ষ্যপ্রমাণের ভার অভিযোগকারীর ওপর; অভিযুক্তের ওপর নয়।৩৬ অনুরূপভাবে, আর্থিক বিষয়াবলির ক্ষেত্রে ইসলাম সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে যেন সম্পদ কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়।৩৭ শরিয়াহ সংখ্যালঘুদের ধর্ম ও সংস্কৃতি পালন,৩৮ নিরাপদ জীবনযাপন৩৯ ও আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ সুরক্ষা বিধান করেছে। সীরাতে এর অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়।
শরিয়াহ দয়া ও সুবিচারের মূল্যবোধকে ধারণ করার পাশাপাশি মুসলমানদের ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে বহুবার সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই দ্বীন খুব সহজ-সরল। কেউ দ্বীনের ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করলে সে অবশ্যই পরাভূত হবে।”৪০, “তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকো”৪১ এবং “সীমালঙ্ঘনকারীরা ধ্বংস হোক”৪২। অতএব, বোঝা যায় যে, শরিয়াহ কেবল ইসলামি দ-বিধির একটি সংকলন নয়; বরং এটি এমন একটি সর্বাঙ্গীণ ব্যবস্থা, যা ব্যক্তিসংশ্লিষ্ট বিষয়াবলির পাশাপাশি শাসনপদ্ধতি, বিচার, অর্থনীতি ও আইন প্রণয়নসহ সামষ্টিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও নির্দেশনা প্রদান করে। আমরা স্বীকার করি, ইসলামি শরিয়াহ’র কিছু দ-বিধি হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি রাষ্ট্র ছাড়া কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, যেমনটি প্রফেসর ওয়েল হাল্লাক উল্লেখ করেছেন।৪৩ তবে, যেখানে একটি মুসলিম-প্রধান সমাজ রয়েছে, সেখানে ইসলাম নৈতিক ও আইনি দিকনির্দেশনার সর্বোচ্চ উৎস হিসেবে হাজির হবেই। লেখক শাদি হামিদ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, অন্যান্য ধর্ম যেখানে সেক্যুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সহজেই মানিয়ে নেয়, ইসলামের পক্ষে সেটি সম্ভব নয়। কারণ ইসলাম একইভাবে একটি ধর্ম ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল এবং এ বিষয়টি ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষীকরণের বিরোধী করে তোলে।৪৪
সুতরাং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্র, যেখানে মানুষ গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ, সে রাষ্ট্রের সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামি শরিয়াহর মূল্যবোধকে সহজেই অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যদি এসব মূল্যবোধকে উপরিউক্ত মাকাসিদ ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করা হয়। ইসলামি শরিয়াহর মূল্যবোধকে সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জীবন, মর্যাদা, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা, সামাজিক সংহতি ও অগ্রগতির জন্য একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে, যা ধর্মনিরপেক্ষতা (যেটি ধর্মীয় সম্প্রীতির সীমা ছাড়িয়ে লাইসিটে তথা ফরাসি সেক্যুলারিজম ও কামালবাদ পর্যন্ত যাওয়ার প্রবণতা রাখে), সমাজতন্ত্র ও বিত্তশালীদের তোষণকারী পুঁজিবাদের মতো অস্পষ্ট, লোভাতুর ও জোড়াতালি দেওয়া মতাদর্শের চেয়ে বহুগুণ উৎকৃষ্ট প্রমাণিত হবে।
পূর্বোক্ত প্রেক্ষাপটের সাথে প্রাসঙ্গিক আরও কিছু প্রস্তাব
প্রস্তাব ৫:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে একটি ‘ইসলামিক আইডোলজি কাউন্সিল’ (ইসলামি মতাদর্শ পরিষদ) গঠন করা হোক, যেটি মিশরের আল-আজহারের পরামর্শবিষয়ক ভূমিকা, মালয়েশিয়ার জাতীয় ফতওয়া কাউন্সিল ও পাকিস্তানের ইসলামিক আইডোলজি কাউন্সিলের মতো সফল মডেলসমূহ থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারে। উক্ত কাউন্সিল জাতীয় সংসদ কর্তৃক নিযুক্ত প্রথিতযশা আলেম ও ইসলামি আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত হবে, যেন এতে বহুমুখী প্রতিনিধিত্ব ও বিশেষজ্ঞতা নিশ্চিত হয়। এই কাউন্সিলের প্রধান দায়িত্বগুলো হবে:
(ক) শরিয়াহ ব্যাখ্যা করা: শাসন ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামি নীতিমালার ওপর কর্তৃত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান;
(খ) আইন মূল্যায়ন করা: বিদ্যমান ও প্রস্তাবিত আইনসমূহ পর্যালোচনা করে সেগুলোকে শরিয়াহর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা;
(গ) সরকার ও বিচারবিভাগকে পরামর্শ প্রদান: আইনগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করে শরিয়াহর অনুবর্তিতা (compliance) নিশ্চিত করা।
প্রস্তাব ৬:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে LGBTQ+ কার্যক্রমকে মৌলিক বা অন্য কোনো অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়। অধিকন্তু;
(ক) ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি সংবিধান বা সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে লিঙ্গ পরিচয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়।
(খ) বিকৃত যৌনাঙ্গ বা অস্পষ্ট যৌন বৈশিষ্ট্যযুক্ত ব্যক্তিদের ‘ইন্টারসেক্স’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা উচিত এবং তাদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি মূলধারার সমাজে অঙ্গীভূত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
প্রস্তাব ৭:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, মুসলমানদের বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ও অন্যান্য পারিবারিক বিষয় পূর্ণরূপে ইসলামি নীতিমালা অনুসারে পরিচালিত হওয়ার অধিকারকে সংবিধানে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। সাথে এই বিষয়টিও থাকবে যে, অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা পারিবারিক ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয় তাদের নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতি অনুসারে পরিচালনার অধিকার লাভ করবে।
প্রস্তাব ৮:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হোক, যেটি নিশ্চিত করে যে, পারিবারিক আইন ও জনসাধারণের নৈতিকতার বিষয়ে বিচারিক সিদ্ধান্তগুলো (Judicial decisions) ইসলামি আইনি নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
প্রস্তাব ৯:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে জাতীয় শিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠিত হোক, যার সদস্যবৃন্দ সংসদ কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। এই কমিশন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও তা তদারকির দায়িত্বে থাকবে। এ কমিশনে সুনির্দিষ্ট সংখ্যক আলেম-উলামা সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন, যারা শিক্ষাব্যবস্থায় শরিয়াহর নীতি-আদর্শের বিপরীত কোনো বিষয় যাতে অন্তর্ভুক্ত না হয় তা নিশ্চিত করবেন। ইসলাম সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মতামত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে।
প্রস্তাব ১০:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির অগ্রগতিকে সহজতর করার জন্য নি¤œলিখিত পদক্ষেপগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হোক:
(ক) নৈতিকতা ও নৈতিক বিকাশের নীতিমালার সাথে সমঞ্জসতা নিশ্চিত করে মুসলমানদের জন্য জাতীয় পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক ইসলামিক স্টাডিজ এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তাদের নিজ নিজ ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাধ্যতামূলক বিধান অন্তর্ভুক্ত করা।
(খ) বিবাহকে একটি মৌলিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমর্থন ও উৎসাহিত করার বিধান রাখা, যা পারিবারিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করবে।
(গ) শিশু ও পরিবার কল্যাণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা, যার মধ্যে থাকবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অসহায় পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তার সুযোগ।
(ঘ) জনসমক্ষে অশালীনতা ও অনৈতিক আচরণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যা সমাজে শালীনতাবোধ ও নৈতিক আচরণের সংস্কৃতি গড়ে তুলবে।
প্রস্তাব ১১:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানের ৭৭নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ন্যায়পালের কার্যালয় (দিওয়ান আল-মুহতাসিব) সক্রিয় ও প্রাতিষ্ঠানিক করা হোক। সংসদ কর্তৃক নিযুক্ত একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে এই কার্যালয়টির কার্যনির্বাহ করা উচিত, যার মধ্যে রয়েছে জনসাধারণের অভিযোগ সমাধান, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও ইসলামি বিধিবিধান অনুযায়ী ন্যায়বিচার বলবৎ করা।
প্রস্তাব ১২:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে ইসলামি অর্থনীতি ও শ্রম অধিকার বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত বিধান সংযুক্ত করা হোক। এই বিধানগুলোতে নি¤œলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে:
(ক) সুদমুক্ত ব্যাংকিং: বাংলাদেশের জন্য একটি স্বচ্ছ ও ভোক্তাবান্ধব সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য একটি সর্বাঙ্গীণ কাঠামো প্রণয়ন। এই কাঠামো নি¤েœাক্ত সফল মডেলসমূহ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে:
১) মালয়েশিয়া: Shariah Advisory Council শরিয়াহর নীতিমালা মেনে চলা নিশ্চিত করে এবং সুকুক (ইসলামি বন্ড) প্রচলিত বন্ডের শরিয়াহসম্মত বিকল্প প্রদান করে।
২) সুদান: সম্পূর্ণ ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেখানে মুদারাবা, মুশারাকা, মুরাবাহা ও ইজারা-এর মতো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
৩) পাকিস্তান: প্রতিষ্ঠানগুলো স্টেট ব্যাংকের Shariah Advisory Board-এর তত্ত্বাবধানে Shariah Governance Framework মেনে চলে।
৪) বাহরাইন: শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগকে সমর্থন করে। বাহরাইনভিত্তিক AAOIFI ইসলামি আর্থিক মানদ- প্রতিষ্ঠায় বৈশ্বিকভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
(খ) সামাজিক সুবিচার ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য ন্যায়সংগত সম্পদ বিতরণের নীতিমালা তৈরি;
(গ) দরিদ্র বিমোচন, সামাজিক কল্যাণে সহায়তা এবং যাকাত সংগ্রহ ও পরিচালনার জন্য একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ যাকাত বোর্ড স্থাপন;
(ঘ) জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা রক্ষার জন্য মদ ও নেশাজাত দ্রব্যের বিক্রি ও ব্যবহার প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ;
(ঙ) ভোক্তাদের সুরক্ষা ও বাজার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সিন্ডিকেট, মজুদদার ও কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ;
(চ) শ্রমিকদের মর্যাদা ও ন্যায়সংগত বেতন কাঠামো নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের জন্য ন্যায্য ও সময়োপযোগী মজুরি প্রদানের বিধান করা।
প্রস্তাব ১৩:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কোনো ধর্মকে লক্ষ্য করে উদ্দেশ্যমূলক উসকানি বা বৈরিতার কাজ নিরুৎসাহিত করার জন্য স্পষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হোক। সেই সাথে এই সুরক্ষাগুলো যাতে যুক্তিসম্মত আলোচনা বা অ্যাকাডেমিক অনুসন্ধান দমন করার জন্য অপব্যবহৃত না হয় তা নিশ্চিত করা উচিত। এমন বিধান বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সম্প্রীতি প্রচারের জন্য সহায়ক হবে।
প্রস্তাব ১৪:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে এমন আইনি বাধ্যবাধকতামূলক বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হোক, যা রাষ্ট্রে বসবাসরত ব্যক্তিদের গুমের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করবে এবং অন্যায্য গ্রেফতার বা আটক প্রতিরোধে সুরক্ষাগুলোকে শক্তিশালী করবে। পাশাপাশি, আমরা সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্তমানে অন্তর্ভুক্ত না থাকা মৌলিক অধিকারগুলো যুক্ত করার সুপারিশ করছি। যেমন: ভোটাধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার, ভোক্তা সুরক্ষার অধিকার ইত্যাদি।
প্রস্তাব ১৫:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করা হোক এবং ফ্রান্স, পর্তুগাল ও ফিনল্যান্ডের মডেলগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি সেমি-প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হোক। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নির্বাহী ক্ষমতা বিভাজিত হবে, যা সুষম শাসন (balanced governance), বর্ধিত জবাবদিহিতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। রাষ্ট্রপতি পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা তত্ত্বাবধান করতে পারেন এবং প্রধানমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ শাসন ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলির ওপর মনোযোগ দিতে পারেন। দুটি দপ্তরের মধ্যে সংঘাত প্রতিরোধে দায়িত্বের স্পষ্ট বিভাজন ও ক্ষমতার ভারসাম্য (checks and balances) নিশ্চিত করা আবশ্যক।
প্রস্তাব ১৬:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধান ক্ষমতার পৃথক্করণ ও বিকেন্দ্রীকরণের নীতিগুলোকে শক্তিশালী করুক, যাতে ভারসাম্যপূর্ণ শাসন ও বর্ধিত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। এটি অর্জনের জন্য নি¤œলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:
(ক) নির্বাহী, আইনসভা ও বিচারবিভাগের ভূমিকা ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা, যাতে দায়িত্বের অধিক্রমণ (overlaps) প্রতিরোধ ও ক্ষমতার ভারসাম্য (checks and balances) নিশ্চিত হয়।
(খ) স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৃহত্তর প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করা, যাতে তারা জনসংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোকে কার্যকরভাবে সমাধান করতে পারে এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনকে উৎসাহিত করতে পারে।
(গ) সরকারের প্রতিটি শাখার কার্যক্রম নিরীক্ষণের জন্য স্বাধীন নজরদারি সংস্থা গঠন করা, যাতে কোনো একক প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধ করা যায়।
প্রস্তাব ১৭:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানে জাতীয় নির্বাচনের সময় একটি তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হোক। এ সরকারের সীমিত ক্ষমতা থাকবে এবং এটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে কেবল নির্বাচনি প্রক্রিয়া পরিচালনা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সাংবিধানিক নীতিমালা সমুন্নত রাখার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে। এর গঠন, ক্ষমতা ও মেয়াদ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত থাকবে। পদ্ধতিটি সফল আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মডেল থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে, যেমন: পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, নেপালের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যবহার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ইতালি ও গ্রিসে টেকনোক্র্যাটিক বা তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের নিয়োগ। তবে, এই কাঠামো বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও আইনি প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গঠন করা উচিত, যাতে তা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও নির্বাচনের সময় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।
প্রস্তাব ১৮:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধানের কাঠামো এমনভাবে গঠন করা হোক, যাতে সংবিধান সংশোধনে স্বেচ্ছাচার প্রতিরোধ করা যায় এবং ভবিষ্যতে কোনো সরকার এটিকে স্বৈরাচারী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারে। এটি অর্জন করা যেতে পারে নি¤œলিখিত উপায়গুলোর মাধ্যমে:
(ক) মৌলিক অধিকার, শাসন কাঠামো বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করে এমন সাংবিধানিক সংশোধনীর জন্য গণভোট বাধ্যতামূলক করা।
(খ) সব ধরনের সাংবিধানিক সংশোধনীর জন্য সংসদে সুপারমেজরিটি ভোটের প্রয়োজনীয়তা আরোপ করা।
(গ) প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোকে বিচারিক পর্যালোচনার (judicial review) আওতায় আনা, যাতে সেগুলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর (basic structure) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
এই পদ্ধতিগুলো সুইজারল্যান্ডের গণভোট ব্যবস্থা ও জার্মানির Protection for Fundamental Principles এর মতো সংবিধান পরিচালনার উৎকৃষ্ট চর্চাগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে, যা সংবিধানের অখ-তা রক্ষা করবে।
প্রস্তাব ১৯:
আমরা প্রস্তাব করছি যে, সংবিধান আন্তর্জাতিক শান্তি, সংহতি ও ন্যায়বিচারের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি আরও জোরদার করবে এবং এটি নিশ্চিত করবে যে, বাংলাদেশের কোনো সরকার:
(ক) দমনমূলক বা বর্ণবাদী কোনো রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকবে।
(খ) স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য মানবজাতির অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করে ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
(গ) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সাথে ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
এই সুপারিশগুলো বিশেষভাবে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত, যেগুলো ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ আন্তরিকভাবে এই প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করবেন।
মহান আল্লাহ তা’আলার কাছে আমরা সকলের সাফল্য কামনা করছি।
গ্রন্থনা: মারজান আহমদ চৌধুরী, পিএইচডি গবেষক, এরফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি; বাংলা অনুবাদ: আহমাদ রায়হান ফারহী, এলএলএম (অধ্যয়নরত), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সম্পাদনা: আহমদ হাসান চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান, মুহাদ্দিস, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসা; প্রকাশনায়: বালাকোট-চেতনা উজ্জীবন পরিষদ, খিলগাঁও, ঢাকা-১২১৯।
তথ্যপঞ্জি
1. Riaz, A. (2004). God Willing: The Politics of Islamism in Bangladesh. Rowman & Littlefield, Lanham, MD.
2. Huq, A. F. (1973). Constitution-Making in Bangladesh, Pacific Affairs, 46, 59-76.
3. Riaz, A. (2021). More Than Meets the Eye: The Narratives of Secularism and Islam in Bangladesh. In Ghosts from the Past? 105-122. Routledge, London.
4. Khatun, S. (2010). Examining the Discourses of Political Islam in Bangladesh. Anthropology Journal, 10(1), 69-82.
5. Ahamed, E., & Nazneen, D. R. J. A. (1990). Islam in Bangladesh: Revivalism or Power Politics? Asian Survey, 795-808.
6. Asad, T. (2003) Formations of the Secular: Christianity, Islam, Modernity. Stanford University Press, Stanford, CA.
7. Casanova, J. (2009). The Secular and Secularisms. Social Research: An International Quarterly, 76(4), 1049-1066.
8. Nasr, S. H. (2002). Islam: Religion, History, and Civilization. Harper One, New York.
9. Khan, M. M. (2013). The Muslim Heritage of Bengal: The Lives, Thoughts and Achievements of Great Muslim Scholars, Writers and Reformers of Bangladesh and West Bengal. Kube Publishing Ltd, Leicestershire.
10. Khan, Z. R. (1985). Islam and Bengali Nationalism. Asian Survey, 25(8), 834-851.
11. Riaz, A. (2009). Interactions of ‘transnational’ and ‘local’ Islam in Bangladesh in transnational Islam. In South and Southeast Asia: Movements, Networks, and Conflict Dynamics. The National Bureau of Asian Research, Seattle, WA, 79– 100.
12. https://en.banglapedia.org/index.php/Faraizi_Movement. Retrieved on November 17, 2024
13. https://en.banglapedia.org/index.php/Tariqah-i-Muhammadiya. Retrieved on November 17, 2024.
14. Lapidus, I. (1997). Islamic Revival and Modernity: The Contemporary Movements and the Historical Paradigms. Journal of the Economic and Social History of the Orient, 40(4), 444-460, Brill, Leiden.
15. Shah, M. (2001). The Bengal Muslims and the world of Islam: Pan-Islamic trends in colonial Bengal as reflected in the press. In Understanding the Bengal Muslims. Oxford University Press, Noida, 86–112.
16. Afzal, M. R. (1976). Political Parties in Pakistan, 1947–1958. National Commission on Historical and Cultural Research, Islamabad.
17. Islam, M. N., Islam, M. S., Islam, M. N., & Islam, M. S. (2020). Piety and Politics: Secularization and Islamization in Bangladesh. Islam and Democracy in South Asia: The Case of Bangladesh, 167-214.
18. Ahad, O. (2012). Jatio Rajniti: 1945 Theke 75. Bangladesh Co-operative Book Society, Dhaka.
19. Hakim, M. A. (1998). The Use of Islam as a Political Legitimization Tool: The Bangladesh Experience, 1972–1990. Asian Journal of Political Science, 6(2), 98-117.
20.হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.). (১৯৮২). বাাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, তৃতীয় খ-, পৃ. ৪-৭, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা।
21. Hossain, A. A. (2015). Contested National Identity and Political Crisis in Bangladesh: Historical Analysis of the Dynamics of Bangladeshi Society and Politics. Asian Journal of Political Science, 23(3), 366-396.
22. O’Connell, J. T. (1976). Dilemmas of Secularism in Bangladesh, Journal of Asian and African Studies, 11, 64-81.
23. Islam, M. N., & Islam, M. S. (2018). Islam, Politics and Secularism in Bangladesh: Contesting the Dominant Narratives. Social Sciences, 7(3), 37.
24. Fahim, M. A. A. I. (2022). Inventing Islam(ism): De-Islamization under Secular Authoritarianism in Bangladesh. ReOrient, 7(2), 158-181.
25. Bazian, H. (2018) Religion-Building and Foreign Policy. In Bayrakli, E. and Hafez, F. (eds). Islamophobia in Muslim Majority Societies, 21–44, Routledge, London.
26. Hasan, M. (2017). The Diverse Roots of the ‘Secular’ in East Pakistan (1947–71) and the Crisis of ‘Secularism’ in Contemporary Bangladesh. History and Sociology of South Asia, 11(2), 156-173.
27. Maniruzzaman, T. (1990). Bangladesh Politics: Secular and Islamic Trends. Religion, Nationalism and Politics in Bangladesh, 63-93.
28. Arnold, T. W. (1913). The Preaching of Islam: A History of the Propagation of the Muslim Faith. Constable & Company Ltd, London.
29. Zaidan, A. K. (2005). Al-Madkhal li Diraasah al Shariah al Islamiah. Al-Resalah Publishers, Beirut.
30. Al-Qurtubi, Abu Abdullah. (2006). Al-Jami’ li Ahkam al-Quran, vol. 8, p. 39, Al-Resalah Publishers, Beirut.
31. Ibn Qayyim, Muhammad ibn Abu Bakr, (1996). I’laam al-Mouwaqi’in ‘an Rabb il-‘Alamin, vol. 3, Dar al-Kutub al Ilmiyah, Beirut.
32. Auda, J. (2008). Maqasid al-Shariah: An Introductory Guide. International Institute of Islamic Thought (IIIT), Herndon, VA.
33. Al-Ghazali, Abu Hamid, (2018). al-Mustafa min Ilm al Usul. Dar ul Tuqafah, Doha.
34. Muslim ibn Hajjaj, Sahih, The Book of Virtues, Hadith no: 2363.
35. Quran, 42:38
36. Al-Bayhaqi, al-Sunan al-Kubra, The Book of Accusation and Evidences, Hadith no: 21201.
37. Quran, 59:7
38. Quran, 2:256
39. Quran, 60:8
40. Al-Bukhari, Muhammad ibn Ismail, Sahih, The Book of Faith, Hadith no: 39.
41. An-Nasa’i, Ahmad ibn Shu’ayb, al-Sunan al-Sughra, The Book of Hajj, Hadith no: 3057.
42. Abu Dawud, Sulaiman ibn Ash’ath, Sunan, The Book of Sunnah, Hadith no: 4608.
43. Hallaq, W. B. (2012). The Impossible State: Islam, Politics, and Modernity’s Moral Predicament. Columbia University Press, NY.
44. Hamid, S. (2016). Islamic exceptionalism: How the struggle over Islam is reshaping the world. St. Martin’s Press, NY