ঈমানের পরই নামাযের স্থান। নামাযকে বলা হয় ‘উম্মুল ইবাদাত’ তথা সকল ইবাদতের মূল। কেননা নামাযের মধ্যে ইসলামে স্বীকৃত সকল ইবাদতের নমুনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষ্য করা যায়। নামাযে রয়েছে শ্রেষ্ঠ ইবাদত তিলাওয়াতে কুরআন। রয়েছে তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ ও তাকবীর। তাছাড়া আরো রয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সালাত, সালাম ও সর্বশেষে রয়েছে তাওবা।
ইসলামের আমলযোগ্য প্রায় সকল বিষয়েই কিছু না কিছু মতবিরোধ উলামায়ে কিরাম ও ফুকাহায়ে ইযামের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তাই মূল ইবাদত নামাযের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। কুরআনে কারীমে নামায কায়িম করার নির্দেশ বারবার দেওয়া হয়েছে কিন্তু তা কিভাবে আদায় করতে হবে তা বিস্তারিতভাবে নেই। সুতরাং নামায আদায় করার পদ্ধতি পুরোটাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ থেকে আমরা পেয়েছি। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ اُصَلِّى -তোমরা আমাকে যেভাবে নামায আদায় করতে দেখ সেভাবেই নামায আদায় করো। এখন প্রশ্ন হতে পারে, নামাযের মাসাঈলে এতো ইখলিতলাফ বা মতবিরোধ কেন? প্রশ্নটার জবাব এক কথায়, কিংবা অতি সংক্ষেপে দেওয়া অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে আমরা এতটুকুই বলব যে, নামাযের আহকাম আরকান তথা ফরয, ওয়াজিবের ক্ষেত্রে তেমন একটা মতপার্থক্য নেই। তবে সুন্নাত ও মুস্তাহাব সম্পর্কে অনেক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ সকল মতপার্থক্যের মূল কারণ হচ্ছে রিওয়ায়াতের ভিন্নতা। কেননা মুহাদ্দিসীনে কিরাম যখন তাদের সংকলিত হাদীসগ্রন্থে হাদীস সংকলন করেছেন, তখন হাদীসের সনদ বা সূত্রকে প্রাধান্য দিয়ে এবং নিজস্ব শর্তাবলীকে সামনে রেখে তাদের কিতাবে হাদীস সংকলন করেছেন। হাদীসের প্রেক্ষাপট ও কোনটি পূর্বের এবং কোনটি পরের কোনটি নাসিখ কোনটি মানসূখ তার প্রতি লক্ষ্য না করে তাদের কিতাবে হাদীসসমূহ একত্রিত করেছেন। তাছাড়া এমনও অনেক সাহাবী রয়েছেন যারা কয়েকদিন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে থেকে নিজ দেশে চলে গেছেন কিংবা তিনি অনেক সাহাবীকে দ্বীনের দাঈ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করেছেন তারা নবীজির নামাযের পদ্ধতি বা ইসলামের অন্য কোনো বিষয় দেখেছেন বা জেনেছেন, কিন্তু তাদের চলে যাওয়ার পর উক্ত পদ্ধতি বা বিষয় পরিবর্তিত কিংবা রহিত হয়ে গেছে, তা তাদের জানা ছিল না। উক্ত পদ্ধতি ও বিষয় মুহাদ্দিসীনে কিরাম সনদের বিবেচনায় হাদীসের কিতাবে স্থান দিয়েছেন। পরবর্তীতে ফকীহ মুহাদ্দিসগণ ও আইম্মায়ে মুজতাহিদগণ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে যাচাই-বাছাই করে পরস্পর বিরোধী হাদীসগুলোর মধ্যে হয়তো সমন্বয় সাধন করেছেন না হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু হাদীসকে আমল থেকে বাদ দিয়েছেন, ফলে অনেক হাদীসই সহীহ হাদীসের কিতাবে বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও তা আমল করা সম্ভব হয়নি। তাই যে সমস্ত হাদীস আমলযোগ্য এগুলোকে সুন্নাহ বলা হয়। এখানে একটি কথা লক্ষ্যণীয় যে, সকল মুহাদ্দিস ফকীহ নন, তবে সকল ফকীহ মুহাদ্দিস। হাদীস গ্রহণ করা ও বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে সূত্র ও তথ্যগত ইখতিলাফ থাকার কারণে কোনো ফকীহ মুহাদ্দিস একটি হাদীসকে গ্রহণ করেছেন অপরজন সূক্ষ্ম কোনো কারণে তা পরিত্যাগ করেছেন, এতে গবেষণার দ্বার সুপ্রসন্ন হয়েছে এবং ঘুরে ফিরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকাংশ হাদীসকে আমলে আনার পথ সুগম হয়েছে। আর মুজতাহিদগণের উক্ত ইখতিলাফকেই বলা হয়েছে রাহমাত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে চার মাযহাবের অনুসারীদের দ্বারাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকাংশ হাদীসের উপর আমল হয়ে থাকে। আর তথাকথিত লা-মাযহাবী আহলে হাদীস নামধারীরা মূলত সহীহ হাদীসের দোহাই তুলে ইসলামী শরীআতের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দলীল হাদীসে নববীর বিশাল ভান্ডারকে অস্বীকার করছে।
আহলে হাদীস নামধারী সালাফী লা-মাযহাবীরা হাজারো বছর পূর্ব থেকে ইসলামের মুআমালাত মুআশারাত, ইবাদত বন্দেগী ও আকীদাসহ যাবতীয় সকল মীমাংসিত ইখতিলাফী বিষয়কে মিডিয়ার সহজলভ্যতার সুযোগে নতুন করে উসকে দিয়ে মুসলিম মিল্লাতকে এক নব্য ফিতনার মুখোমুখী দাঁড় করিয়েছে। যার পরিণতি ইতোমধ্যে অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে আজ স্থানে স্থানে, মসজিদে মসজিদে বিশেষ কিছু পূর্ব মীমাংসিত ফুরুঈ মাসআলাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, চ্যালেঞ্জবাজি, পরস্পরের মধ্যে কাঁদা ছুড়াছুড়ি, এমনকি একে অপরকে গালমন্দ ও নির্বোধ পথভ্রষ্ট প্রভৃতি কটুবাক্য ব্যবহার করছে। ফলে ইসলামের ক্ষতি ঠিকই হচ্ছে এবং ইসলাম বিদ্বেষীরা খুশি ও লাভবান হচ্ছে।
পরিতাপের বিষয় নামাযের একটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেই তারা একে নবীজির সালাত কিংবা হাদীস ও সুন্নাহসম্মত নামায বলে আখ্যায়িত করছে, আর অপরাপর পদ্ধতিগুলোকে হাদীস-সুন্নাহ বিরোধী মনে করছে। এমনকি তাদের উগ্রপন্থীরা অন্য পদ্ধতিগুলোকে বাতিলই বলে থাকে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় সাহাবা-তাবিঈন, মুহাদ্দিসীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন তথা সালফে সালিহীন যুগে যুগে যে পদ্ধতিতে নামায আদায় করেছেন তাঁদের নামায কি সুন্নাহবিরোধী ছিল? কারণ তাঁদের নামাযের পদ্ধতিগুলো তো উক্ত মনীষীদের নামাযের সাথে পরিপূর্ণভাবে মিলে না। তাহলে পরোক্ষভাবে এ কথাই সাব্যস্ত হচ্ছে যে, সাহাবা-তাবিঈন ও তাদের পরবর্তীদের নামায খিলাফে সুন্নাহ বা খিলাফে হাদীস ছিল। এমনকি লা-মাযহাবীরা যাদের লিখিত হাদীসের কিতাব থেকে দলীল নিয়ে নবীজির সালাত বা সহীহ হাদীসসম্মত সালাতের বিশেষ পদ্ধতি নির্ণয় করেছেন তাদের নামাযও সুন্নাহ বিরোধী ছিল? (نعوذ بالله من ذالك)
তাই উক্ত নিবন্ধে ধারাবাহিকভাবে এমন কয়েকটি বিষয় আলোচনা করার ইচ্ছা পোষণ করছি যেগুলোকে কেন্দ্র করে আজ মসজিদে-মসজিদে, মহল্লায়-মহল্লায় ফিতনা দেখা দিয়েছে। যারা তাদের বক্তব্য-বিবৃতি, বই-পুস্তক, লিফলেট পড়ে সালাফ ও খালাফসহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের হক্কানী উলামায়ে কিরামের প্রতি কুধারণা পোষণ করছেন এবং বাজার থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত হাদীসের বিভিন্ন কিতাব পড়ে নিজেকে স্বঘোষিত মুহাদ্দিস বা আহলে হাদীস ভাবা শুরু করেছেন, আশা করি তারা উক্ত নিবন্ধে আলোচিত বিষয়গুলো উদার মনমানসিকতা নিয়ে পাঠ করলে সঠিক বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন।
রাফয়ে ইয়াদাইন
রাফয়ে ইয়াদাইন অর্থ উভয় হাত উত্তোলন করা। নামায শুরু করতে যে তাকবীর উচ্চারণ করা হয় তাকে আকবীরে তাহরীমা বলা হয়। যা ফরয এবং উক্ত তাকবীর বলার সময় উভয় হাত উত্তোলন করা সর্বসম্মতিক্রমে সুন্নাত। তবে হাত কিভাবে ও কতটুকু পর্যন্ত ওঠাতে হবে এ ব্যাপারে উলামা, মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ের সকল দলীল আদিল্লা বিশ্লেষণপূর্বক আলোচনা করতে হলে পৃথক শিরোনামের প্রয়োজন। বিধায় এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু হাত ওঠানো দিয়েই আলোচনা শুরু করছি। তাকবীরে তাহরীমা ব্যতিত রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু থেকে ওঠার সময় হস্তদ্বয় ওঠানো সুন্নাত কি না এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসীন ও ফুকাহায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। প্রথমেই চার মাযহাবের ইমামগণ ও তাঁদের অনুসারীদের মতামতসমূহ ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হলো। যেহেতু এ প্রসঙ্গে রিওয়ায়াতের ভিন্নতা রয়েছে তাই চার ইমামের দুজনের মতে তা সুন্নাত এবং দুজনের মতে জায়িয তবে সুন্নাত নয় বরং মাকরূহ বা অপছন্দনীয়।
আহনাফের অভিমত
হানাফী মাযহাবের প্রামাণ্য কিতাব রাদ্দুল মুহতার যা ফাতাওয়ায়ে শামী নামে সুপ্রসিদ্ধ, উক্ত কিতাবের প্রথম খন্ড ৩৭৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-
لا يرفع عند التكبيرات الانتقالات خلافا للشافعى واحمد فيكره عندنا ولا تفسد الصلوة
-নামাযের এক রোকন থেকে অন্য রোকনে যেতে যে তাকবীর বলা হয়, সেই তাকবীরের সময় হাত উত্তোলন করা যাবে না। ইমাম শাফিঈ (র.) ও ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র.) বিপরীত মত পোষণ করে থাকেন। তবে হাত ওঠানোর কারণে নামায ফাসিদ হবে না।
শাফিঈদের অভিমত
كتاب الفقه على المذاهب الاربعة এর প্রথম খন্ড ২৫০নং পৃষ্ঠায় শাফিঈ মাযহাবের বক্তব্য নিম্নরূপ উল্লেখ রয়েছে।
الاكمل فى السنة هو رفع اليدين عند تكبيرة الاحرام والركوع والرفع منه وعند القيام من التشهد الاول
-পরিপূর্ণ সুন্নাত হচ্ছে তাকবীরে তাহরীমার সময় রুকুতে যাওয়ার সময় রুকু হতে ওঠতে ও প্রথম তাশাহহুদ শেষে দাঁড়ানোর সময় উভয় হাত উত্তোলন করা।
তবে প্রথম তাশাহহুদ শেষে দাঁড়ানোর সময় অর্থাৎ তৃতীয রাকাতের জন্য ওঠার সময় হাত উত্তোলন না করার অভিমতও শাফিঈ মাযহাবের কোনো কোনো কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
মালিকী মাযহাবের অভিমত
كتاب الفقه على المذاهب الاربعة এর প্রথম খন্ড ২৫০নং পৃষ্ঠায় মালিকী মাযহাবের অভিমত উল্লেখ করা হয়েছে নিম্নরূপ-
رفع اليدين حذو المنكبين عند تكبيرة الاحرام مندوب وفيما عدا ذالك مكروه
-তাকবীরে তাহরীমার সময়ে কাঁধ বরাবর হস্তদ্বয় উত্তোলন করা মুস্তাহাব। উক্ত স্থান ব্যতীত হাত ওঠানো মাকরূহ।
হাম্বলী মাযহাবের অভিমত
كتاب الفقه على المذاهب الاربعة এর প্রথম খন্ড ২৫০নং পৃষ্ঠায় হাম্বলী মাযহাবের অভিমত নিম্নরূপ উল্লেখ করা হয়েছে-
يسن للرجل والمرأة رفع اليدين الى حذو المنكبين عند تكبيرة الاحرام والركوع والرفع منه.
-তাকবীরে তাহরীমা, রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠার সময় নর-নারী সকলের জন্যই কাঁধ পর্যন্ত উভয় হাত উত্তোলন করা সুন্নাত।
ইমাম চতুষ্টয়ের বক্তব্যের খুলাসা
এক. তাকবীরে তাহরীমার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন বা হাত ওঠানো সর্বসম্মতিক্রমে সুন্নাত।
দুই. তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্যান্য স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন করলে সর্বসম্মতিক্রমে নামায ফাসিদ হবে না।
তিন. ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মালিক (র.) এর মতে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্যান্য স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন করা সুন্নাত নয়, জায়িয। তবে মাকরূহ বা অপছন্দনীয়।
চার. ইমাম শাফিঈ (র.) ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র.) এর মতে তাকবীরে তাহরীমার মতোই রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন সুন্নাত।
তবে তথাকথিত আহলে হাদীস লা-মাযহাবীরা নামাযে ফরয, ওয়াজিব কিংবা সুন্নাত মুস্তাহাব এগুলোর পৃথক হুকুম রয়েছে তা মানতে নারাজ। বরং তাদের মতে নামাযের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবগুলো কাজই একই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত।
এখন মূল আলোচনার বিষয় হলো রুকুতে যেতে ও রুকু থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করা ও না করা নিয়ে। সুতরাং এ সংক্রান্ত দলীল আদিল্লার বিশ্লেষণমূলক আলোচনা নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করা হলো।
রাফয়ে ইয়াদাইন করা সংক্রান্ত দলীল
নামাযে তাকবীরে তাহরীমা, রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করা সংক্রান্ত রিওয়ায়াত একাধিক। তন্মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণিত হাদীসটি সিহাহ সিত্তাহ’র অন্তর্ভুক্ত একাধিক কিতাবসহ হাদীস শাস্ত্রের প্রায় সকল সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে শব্দগত কিছু পার্থক্যসহ উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে বর্ণিত সর্বাধিক শক্তিশালী দলীল হিসেবে তা পরিগণিত হয়। হাদীসটি নিম্নরূপ-
عن الزهرى قال اخبرنى سالم بن عَبْدِ اللهِ بْنِ عمر ان عَبْدِ اللهِ بْنِ عمر قَالَ رَأَيْتُ النبيَّ ﷺ افْتَتَحَ التَّكْبِيرَ في الصَّلاةِ، فَرَفَعَ يَدَيْهِ حِينَ يُكَبِّرُ حتّى يَجْعَلَهُما حَذْوَ مَنْكِبَيْهِ، وإذا كَبَّرَ لِلرُّكُوعِ فَعَلَ مِثْلَهُ، وإذا قالَ: سَمِعَ اللهُ لِمَن حَمِدَهُ، فَعَلَ مِثْلَهُ، وقالَ: رَبَّنا ولَكَ الحَمْدُ، ولا يَفْعَلُ ذلكَ حِينَ يَسْجُدُ، ولا حِينَ يَرْفَعُ رَأْسَهُ مِنَ السُّجُودِ.
-যুহরী থেকে বর্ণিত, আমার নিকট আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) এর ছেলে সালিম বর্ণনা করেছেন, আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাকবীর দ্বারা নামায শুরু করতে দেখেছি। তখন তিনি তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় কাঁধ পর্যন্ত উভয় হাত উত্তোলন করলেন এবং যখন سَمِعَ اللهُ لِمَن حَمِدَهُ বললেন তখনও অনুরূপ করলেন, অতঃপর رَبَّنا ولَكَ الحَمْدُ বললেন। তবে তিনি সিজদায় যেতে ও সিজদা থেকে মাথা উত্তোলন করতে রাফয়ে ইয়াদাইন করেননি। (বুখারী ১ম খন্ড, পৃ. ১০২; মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ. ১৬৮; আবূ দাউদ ১ম খন্ড, পৃ. ১০৪)
রাফয়ে ইয়াদইন না করা সংক্রান্ত দলীল
তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া নামাযের অন্য কোথাও রাফয়ে ইয়াদাইন নেই এ মর্মে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যাও একাধিক। তবে এ সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বর্ণনা হিসেবে গণ্য করা হয় হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদীসটি যা সিহাহ সিত্তাহ’র অন্তর্ভুক্ত একাধিক কিতাবসহ প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থসমূহে বিভিন্ন সহীহ সূত্রে শাব্দিক কিছু পার্থক্য সহকারে বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি নিম্নরূপ:
عن علقمة قال قال عبد الله بن مسعود ألا أُصلِّي بكم صلاةَ رسولِ اللهِ ﷺ؟ فصلّى فلم يرفَعْ يدَيْهِ إلّا في أوَّلِ مرَّةٍ. قال ابو عيسى حديث ابن مسعود حديث حسن. (الترمذى)
-হযরত আলকামা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) একদা সাহাবায়ে কিরামের মজলিসে ঘোষণা করলেন, আমি কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেরূপ নামায আদায় করেছেন সেরূপ নামায আদায় করে দেখাব না? অতঃপর তিনি নামায আদায় করলেন। তখন তিনি প্রথম তাকবীর অর্থাৎ তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্য কোথাও রাফয়ে ইয়াদাইন করলেন না। (তিরমিযী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৯; আবূ দাউদ ১ম খন্ড, পৃ. ১০৯; শারহু মাআনিল আসার (তাহাবী) ১ম খন্ড, পৃ. ১৬২; জামিউল মাসানিদ ১ম খন্ড, পৃ. ৩৫৫)
উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করে ইমাম তিরমিযী (র.) বলেছেন, হাদীসটি হাসান। জাহিরীদের ইমাম ইবন হাযম তার লিখিত المحلى (আল মুহাল্লা) নামক গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডে ৮৮নং পৃষ্ঠায় উক্ত হাদীসকে সহীহ বলেছেন। তাছাড়া সমকালীন একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা আহমদ শাকির ترمذى محقق এর ২য় খন্ডের ৪১নং পৃষ্ঠায় উক্ত হাদীস সম্পর্কে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেন,
هذا الحديث صححه ابن حزم وغيره من الحفاظ، وهو حديث صحيح وما قالوا فى تعليله ليس بعلة.
-ইবন হাযম ও অন্যান্য হাফিযে হাদীসগণ উক্ত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সুতরাং হাদীসটি সহীহ। যারা উক্ত হাদীসের কিছু ত্রুটি উল্লেখ করেছেন সেগুলো আদৌ কোনো ত্রুটি হিসেবে পরিগণিত নয়।
সুতরাং বর্তমান সময়ের তথাকথিত আহলে হাদীস লা-মাযহাবীরা তাদের চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী সাধারণ মানুষকে এ কথা বলে বিভ্রান্ত করতে চায় যে রাফয়ে ইয়াদাইন না করা সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসসমূহের সবগুলোই দঈফ তথা দুর্বল। তাদের এ সকল বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য আদৌ সত্য নয়। বরং তা ধোঁকা বৈ কিছুই নয়।
মতবিরোধের ভিত্তি জায়িয-নাজায়িয নিয়ে নয়; উত্তম ও অনুত্তম নিয়ে
রিওয়ায়াতের ভিন্নতা হেতু নামাযের অনেক ক্ষেত্রেই ইমামগণ নিজস্ব ইজতিহাদ অনুযায়ী কোনো একটি বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়ে মত প্রকাশ করেছেন ও আমল করেছেন। উদাহরণস্বরূপ নামায শুরু করতে তাকবীর আগে বলতে হবে নাকি হাত আগে ওঠাতে হবে? এ ব্যাপারে বিপরীতমুখী সহীহ বর্ণনা থাকায় কেউ তাকবীর আগে বলেন এবং হাত পরে ওঠান, আবার কেউ কেউ আগে হাত ওঠান এবং পরে তাকবীর বলেন, কারণ উভয় পদ্ধতিই সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে কাওমাতে رَبَّنا لَكَ الحَمْدُ ও বলা যায় আবার ‘ওয়াও’ যুক্ত করে رَبَّنا ولَكَ الحَمْدُ এবং اَللّٰهُمَّ رَبَّنا ولَكَ الحَمْدُ ও বলা যায়। সবই সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত এবং সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
কিছু মতবিরোধ এমনও রয়েছে যেখানে দুটো বিষয়ই অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। তবে বিভিন্ন সুক্ষ্ম আলামতের ভিত্তিতে কোনো ফকীহ একটিকে উত্তম ও প্রাধান্য দিয়ে থাকেন এবং অপরটিকে অনুত্তম তবে বৈধ ও শরীআতে তা অনুমোদিত বলে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। আর নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইনের মাসআলাটি শেষোক্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (র.) তার রচিত زاد المعاد গ্রন্থে ফজরের নামাযে কুনুত পড়া প্রসঙ্গে লিখেন-
وهذا من الاختلاف المباح الذى لا يعنف فيه فاعله ولا من تركه وهذا كرفع اليدين فى الصلاة وتركه- وكالخلاف فى انواع الشهدات وانواع الاذان والاقامة وانواع الشك من الافراد والقران والتمتع.
-তা এমন সব মতবিরোধের অন্তর্ভুক্ত, যাতে কার্যসম্পাদনকারী কিংবা পরিত্যাগকারী কাউকেই নিন্দা ও ভর্ৎসনা করা যাবে না। এটা নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন করা বা না করা, তাশাহহুদ পাঠের বিভিন্নতা, আযান-ইকামাতের বিভিন্ন পদ্ধতি ও হজ্জের বিভিন্ন প্রকার তথা ইফরাদ, কিরান ও তামাত্তো প্রভৃতি বিষয়ের মতবিরোধের ন্যায়।
আমলে মুতাওয়ারাস
নামায এমন একটি ইবাদত যা শুধু মাসআলা পড়ে শিখা যায় না। তা সঠিকভাবে আদায় করতে হলে বাস্তব প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। আর সাহাবায়ে কিরাম এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায দেখে। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ ও প্রজ্ঞাবান যারা ছিলেন তারাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে সম্মুখ সারিতে বসতেন এবং নামাযে তাঁর ঠিক পেছনে দাঁড়াতেন। আর এমনটি করার নির্দেশও দিয়েছিলেন খোদ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- لِيَلِيَنِّي منكُم أولوا الأحلامِ والنُّهى -তোমাদের মধ্যে বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাবান যারা তারা যেন আমার নিকটে দাঁড়ায়। (শারহু মাআনিল আসার (তাহাবী) খন্ড- ১, পৃ. ১৬৩)
আর এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, সাহাবীদের মধ্যে একাধারে ফকীহ ও মুহাদ্দিস যে কয়জন ছিলেন তন্মধ্যে অন্যতম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.)। যিনি স্বদেশে ও সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদিম ছিলেন। তাঁর উপাধি ছিল صاحب النعلين والوسادة والمطهرة ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাদুকাদ্বয়, বালিশ এবং উযূর পানির পাত্র বহনকারী’। এমনকি তিনি নবী পরিবারের এতই ঘনিষ্ট ছিলেন যে, হযরত আবূ মূসা আশআরী (রা.) বলেন, আমরা দীর্ঘদিন যাবত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) ও তাঁর মাতাকে আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত মনে করতাম কেননা নবীর গৃহে তাদের যাতায়াত ছিল অনেক বেশি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) নবীজির কতটুকু কাছের লোক ছিলেন নিম্নোক্ত বর্ণনায় লক্ষ্য করুন-
عَن المغيرة قال قلت لابراهيم حديث وائل انه رأى النبى صلى الله عليه وسلم يَرفَعُ يَدَيه إذا افتَتحَ الصلاةَ، وإذا ركَع، وإذا رفَع رأسَهُ منَ الركوعِ فقال ان كان وائل رأه مرة يفعل ذالك فقد رأه عبد الله خمسين مرة لا يفعل ذالك. (شرح معانى الاثار)
-হযরত মুগীরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবরাহীম নাখঈকে বললাম, ওয়াইল ইবন হুজর (রা.) এর হাদীস যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাকবীরে তাহরীমা, রুকুতে যেতে এবং রুকু থেকে ওঠতে রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেছেন, তখন তিনি (ইবরাহীম নাখঈ) বললেন, ওয়াইল (রা.) যদি একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেন তাহলে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) পঞ্চাশ বার তা না করতে দেখেছেন। (শারহু মাআনিল আসার, খন্ড ১, পৃ. ১৬২)
সেই ইবন মাসউদ (রা.) নবীজির সালাত কেমন ছিল তা প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে শুধুমাত্র তাকবীরে তাহরীমায় রাফয়ে ইয়াদাইন করলেন, অন্য কোথাও তা করলেন না। তাছাড়া ইমাম মালিক (র.) যিনি মদীনা শরীফের বাসিন্দা হয়েও রাফয়ে ইয়াদাইন করেননি। বরং তাঁর মাযহাব অনুযায়ী তা মাকরূহ। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে যে, ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মদীনা শরীফের বাসিন্দা খুলাফায়ে রাশিদীনের মধ্যে হযরত উমর (রা.) ও হযরত আলী (রা.)সহ অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরাম রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না, যা আমলে মুতাওয়ারাস অর্থাৎ সাহাবা, তাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের ধারাবাহিক আমলে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কথাটির স্বীকৃতি আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (র.) এর নিম্নোক্ত বক্তব্যেও পাওয়া যায়।
وقد كان فى سائر البلاد تاركون وكثير من التاركين فى المدينة فى عهد مالك (رح) وعليه بنى مختاره. (نيل الفرقدين)
-সকল শহরেই রাফয়ে ইয়াদাইন পরিত্যাগকারী লোক ছিলেন। এমনকি মদীনায়ও ইমাম মালিক (র.) এর যুগে হাত না ওঠানোর পক্ষের লোক অধিক থাকায় তিনি তাঁর মতের ভিত্তি এর উপরই রাখেন। (নায়লুল ফারকাদাইন, পৃ.২২)
ইসলামী শিক্ষার আরেক প্রাণকেন্দ্র হলো কুফা নগরী, যেখানে প্রায় পাঁচশত সাহাবায়ে কিরাম অবস্থান করতেন। কারও মতে প্রায় দেড় হাজার সাহাবায়ে কিরাম তথায় বসবাস করতেন। তন্মধ্যে বদরের যুদ্ধ ও বাইআতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবায়ে কিরামও ছিলেন। তাদের কেউই তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্য কোথাও রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না। যেমন ইমাম মুহাম্মদ ইবন নাসর আল মারওয়াযী (র.) তদীয় التعليق الممجد নামক গ্রন্থের ১ম খন্ড ৯১নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
لا نعلم مصرا من الامصار يتركوا باجماعهم رفع اليدين عند الخفض والرفع فى الصلاة الا اهل الكوفة.
-কুফাবাসী ব্যতীত আমরা অন্য এমন কোনো শহর সম্পর্কে অবগত নই যে, উক্ত শহরের পুরো বাসিন্দাই রুকুতে যাওয়ার ও রুকু থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন ছেড়ে দিতেন। সুতরাং এটা প্রমাণিত হলো যে, কুফা শহরে বসবাসকারী সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন ও তাদের পরবর্তীদের মধ্যে কেউই রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না। আর মদীনা শরীফসহ অন্যান্য শহরের বাসিন্দাদের মধ্যেও উক্ত আমলের (রাফয়ে ইয়াদাইন না করার) আধিক্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং আহনাফ ও মালিকী মাযহাবের অনুসারীরা উক্ত আমলে মুতাওয়ারাস এর সূত্র ধরে ও নিম্নোক্ত দলীলাদির ভিত্তিতে তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্যান্য স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন মানসূখ বা রহিত হওয়ার অভিমত পোষণ করে থাকেন।
রাফয়ে ইয়াদাইন রহিত হওয়ার প্রথম দলীল
এ প্রসঙ্গে সহীহ মুসলিম শরীফের باب الامر بالسكون فى الصلوة (নামাযে স্থিরতা রক্ষা করার নির্দেশ সংক্রান্ত অধ্যায়ে) হযরত জাবির ইবন সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত পরপর দুটো হাদীস বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। হাদীস দুটো নিম্নোক্ত পেশ করা হলো,
عن جابر بن سمرة قال خرج علينا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال ما لِي أراكم رافِعِي أيديِكُم كأنَّها أذنابُ خيلٍ شُمْسٍ، اسكُنُوا في الصلاةِ. (مسلم)
-হযরত জাবির ইবন সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা আমাদের নিকট বের হয়ে আসলেন (এমতাবস্থায় আমরা নামাযে ছিলাম) এবং বললেন, কি হলো! আমি তোমাদেরকে উদ্ভ্রান্ত ঘোড়ার লেজ নাড়ানোর মতো হাত নাড়তে দেখছি? নামাযে স্থিরতা অবলম্বন করো। (সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ. ১৮১)
عن جابر بن سمرة قَالَ كُنّا إذَا صَلَّيْنا مع رَسولِ اللهِ ﷺ قُلْنا: السَّلامُ علَيْكُم ورَحْمَةُ اللهِ السَّلامُ علَيْكُم ورَحْمَةُ اللهِ، وأَشارَ بيَدِهِ إلى الجانِبَيْنِ، فَقالَ رَسولُ اللهِ ﷺ: عَلامَ تُومِئُونَ بأَيْدِيكُمْ كَأنَّها أذْنابُ خَيْلٍ شُمْسٍ؟ إنَّما يَكْفِي أحَدَكُمْ أنْ يَضَعَ يَدَهُ على فَخِذِهِ ثُمَّ يُسَلِّمُ على أخِيهِ مَن على يَمِينِهِ، وشِمالِهِ.
-হযরত জাবির ইবন সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায পড়তাম তখন উভয় দিকে সালাম ফিরানোর সময় কেউ কেউ হাত তুলে ইশারা করতেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ঘোষণা করলেন, তোমাদের কি হলো! তোমরা উদ্ভ্রান্ত ঘোড়ার লেজ নাড়ানোর মতো হাত নাড়ছো? তোমাদের কারও জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, হাত উরুর উপর রাখবে ও তার ডান বামের ভাইদেরকে সালাম দিবে। (সহীহ মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃ. ১৮১)
মুসলিম শরীফের উক্ত দুটো রিওয়ায়াত একই শিরোনামে একই বর্ণনাকারী হতে পরপর বর্ণিত হয়েছে বলে ইমাম নববীসহ কেউ কেউ রিওয়ায়াত দুটোকে একই রিওয়ায়াত মনে করেছেন। মূলত রিওয়ায়াত দুটো ভিন্ন। প্রথম রিওয়ায়াত তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত সকল প্রকারের হাত ওঠানোকেই পরিস্কারভাবে ইঙ্গিত করছে, পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বর্ণনা সালামের সময়কার হাত উত্তোলনকে রহিতকরণ নির্দেশ করছে। কারণ প্রথম বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্পষ্ট নির্দেশ- اسكنوا فى الصلوة -নামাযে স্থিরতা রক্ষা করো। আর নামাযে স্থিরতার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রাফয়ে ইয়াদাইন, যা উক্ত রিওয়ায়াত দুটো প্রমাণ করে।
রহিত হওয়ার দ্বিতীয় দলীল
নামাযে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়াও রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইনের প্রবক্তারা উক্ত স্থানগুলো ব্যতীত নামাযের অন্যান্য স্থানের রাফয়ে ইয়াদাইন রহিত হওয়া সর্বসম্মতিক্রমে মেনে নিয়েছেন। কারণ উক্ত স্থানগুলো ছাড়া আরও বিভিন্ন স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন ছিল মর্মে একাধিক রিওয়ায়াত সিহাহ সিত্তাহসহ হাদীসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলীতে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত পাওয়া যায়। কিন্তু কেউই উক্ত স্থানসমূহে রাফয়ে ইয়াদাইন করেন না। উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত রিওয়ায়াতগুলো গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠ করুন।
এক. প্রত্যেক তাকবীরে হাত ওঠাতেন-
عن عبدالله بن عباس أن رسولَ الله ﷺ يرفَعُ يديه عند كلِّ تكبيرةٍ.
-হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে প্রতিটি তাকবীরে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। (ইবন মাজাহ, পৃ. ৬২)
দুই. ফরয নামাযের প্রতিটি তাকবীরে হাত ওঠাতেন-
عن عبد الله بن عبيد بن عمير عن ابيه عن جده عمير بن حبيب قال كان رسول الله ﷺ يرفَعُ يديه مع كلِّ تكبيرةٍ في الصلاة المكتوبةِ.
-হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উবাইদ ইবন উমাইর তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর দাদা উমাইর ইবন খুবাইব থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরয নামাযের প্রতিটি তাকবীরে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। (ইবন মাজাহ, পৃ. ৬২)
উক্ত হাদীস প্রমাণ করে ফরয নামায ব্যতীত অন্যান্য নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না।
তিন. সাজদায় যেতে ও সাজদা থেকে মাথা ওঠানোর সময়ও-
عن مالك بن الحويرث أنَّهُ رأى النَّبيَّ ﷺ رفعَ يدَيهِ في صلاتِهِ، وإذا رَكَعَ وإذا رفعَ رأسَهُ منَ الرُّكوعِ وإذا سجدَ، وإذا رفعَ رأسَهُ منَ السُّجودِ.
-হযরত মালিক ইবন হুয়াইরিস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নামায আরম্ভ করতে, রুকুতে যেতে, রুকু থেকে মাথা মুবারক তুলতে, সাজদায় যেতে ও সাজদা থেকে মাথা উত্তোলন করতে রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেছেন। (নাসাঈ, ১ম খÐ, পৃ. ১৬৫)
চার. দুরাকআতের মধ্যখানে-
عن عبد الله ابنِ عمرَ أنه ﷺ كان يرفعُ يديهِ إذا دخل في الصلاةِ، وإذا ركع، وإذا قال: سمِع اللهُ لمَنْ حمِدَه، وإذا سجد بين الركعتينِ.
-হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের শুরুতে, রুকুতে যেতে سَمِعَ اللهُ لِمَن حَمِدَهُ বলে রুকু থেকে ওঠতে সিজদায় যেতে এবং দুরাকআতের মধ্যখানে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। (আল মুহাল্লা, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ২৯৭)
পাঁচ. তৃতীয় রাকআতের শুরুতে-
عن نافع اَنَّ ابْنَ عُمَرَ كانَ إذا دَخَلَ في الصَّلاةِ كَبَّرَ ورَفَعَ يَدَيْهِ، وإذا رَكَعَ رَفَعَ يَدَيْهِ، وإذا قالَ: سَمِعَ اللهُ لِمَن حَمِدَهُ، رَفَعَ يَدَيْهِ، وإذا قامَ مِنَ الرَّكْعَتَيْنِ رَفَعَ يَدَيْهِ.
-হযরত নাফে স্বীয় পিতা হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, তিনি নামাযের শুরুতে তাকবীর বলতেন ও রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। অনুরূপ রুকুতে যেতে, রুকু থেকে ওঠে এবং তৃতীয় রাকআতের জন্য যখন দাঁড়াতেন রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। (বুখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ১০২)
উল্লেখ্য যে, উক্ত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) বর্ণিত হাদীসই হচ্ছে রাফয়ে ইয়াদাইনের প্রবক্তাদের মূল দলীল। যার উপর ভিত্তি করে তারা রুকুতে যেতে ও রুকু থেকে ওঠতে রাফয়ে ইয়াদাইন করে থাকেন। অথচ বর্ণনাকারী নিজেই তৃতীয় রাকআতের শুরুতেও রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন মর্মে সহীহ বুখারীতে একই পৃষ্ঠায় বর্ণিত হাদীসে পাওয়া গেল। কিন্তু রাফয়ে ইয়াদাইনের প্রবক্তারা তা আমল করেন না।
উপরোক্ত বর্ণনাগুলোর আলোকে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, নামাযের প্রায় সর্বত্রই যেখানে তাকবীর আছে সেখানে হাত উত্তোলন ও ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অর্থাৎ শুরুতে তা বহাল রেখে বাকী জায়গাগুলোয় নামাযের سكونة তথা স্থিরতা রক্ষার জন্য রহিত করা হয়েছে। যেহেতু তাকবীরে তাহরীমা, রুকুতে যাওয়া ও রুকূ থেকে ওঠা এ তিন স্থান ছাড়া অন্যান্য স্থানের রাফয়ে ইয়াদাইন মানসূখ বা রহিত হওয়া ইমাম শাফিঈ (র.), ইমাম আহমদ (র.) ও গায়র মুকাল্লিদ লা-মাযহাবীরাও মেনে নিয়েছেন। সুতরাং দুস্থানে অর্থাৎ রুকূতে যেতে ও রুকূ থেকে ওঠতে রাফয়ে ইয়াদাইন বাকী থাকল কোন যুক্তিতে?
রহিত হওয়ার তৃতীয় দলীল
আমরা নামাযের মাসাঈল সংক্রান্ত হাদীসগুলো আলোচনা করলে দেখতে পাই প্রথমদিকে নামাযে অনেক কিছুই বৈধ ছিল। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেমন- প্রথমদিকে নামাযে কারও সাথে কথাবার্তা বলা, কাউকে সালাম দেওয়া এবং সালামের জবাব দেওয়াও জায়িয ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। নিম্ন বর্ণিত হাদীসগুলো লক্ষ্য করুন।
এক.
عن زيد بن أرقم قال كان أحَدُنا يكَلِّمُ الرَّجُلَ إلى جنبِه في الصَّلاةِ، فنزلت }وَقُومُوا لِلَّهِ قانِتِينَ{ فأُمِرْنا بالسُّكوتِ ونُهِينا عن الكلامِ.
-হযরত যায়দ ইবন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রথমদিকে নামাযে আমাদের মধ্যে কেউ তার পার্শ্ববর্তী লোকের সাথে (প্রয়োজনে) কথা বলত। তখন অবতীর্ণ হলো, وَقُومُوا لِلّٰهِ قانِتِينَ -তোমরা নামাযে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ধীরস্থিরভাবে দাঁড়াও। তখন থেকে আমাদেরকে নামাযে নিশ্চুপ থাকার নির্দেশ দেওয়া হলো এবং কথাবার্তা বলতে নিষেধ করা হলো। (আবূ দাউদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১৩৭)
দুই. নামাযে সালাম দেওয়া ও সালামের জবাব দেওয়া বৈধ ছিল। যেমন-
عن عبد الله بن مسعود كُنّا نُسَلِّمُ على النبيِّ ﷺ وهو في الصَّلاةِ، فَيَرُدُّ عَلَيْنا، فَلَمّا رَجَعْنا مِن عِندِ النَّجاشِيِّ سَلَّمْنا عليه، فَلَمْ يَرُدَّ عَلَيْنا، وقالَ: إنَّ في الصَّلاةِ شُغْلًا.
-হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা নামাযে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দিতাম এবং তিনি জবাবও দিতেন। অতঃপর আমরা যখন আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশীর দরবার থেকে প্রত্যাবর্তন করে তাকে (নামাযে) সালাম দিলাম। কিন্তু তিনি জবাব দিলেন না। বরং তিনি বললেন, নিশ্চয় নামাযে রয়েছে নিমগ্নতা (যা সালামের জবাব দেওয়ার পরিপন্থি)। (বুখারী, খন্ড ১, পৃ. ১৬০; আবূ দাউদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১৩৩)
তিন.
عن عبد الله بن عمر أتى رَسولُ اللهِ ﷺ مَسجدَ قباءَ يصلِّي فيهِ، فَجاءتْ رجالٌ منَ الأنصارِ يسلِّمونَ عليهِ، فسألتُ صُهَيْبًا، وَكانَ معَهُ: كيفَ كانَ رسولُ اللَّهِ ﷺ يردُّ عليهِم؟ قالَ: كانَ يشيرُ بيدِهِ.
-হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে কুবায় নামায আদায়ের জন্য আগমন করলেন। তথায় একদল আনসার আসলেন এবং তাঁকে (নামাযে) সালাম দিলেন। বর্ণনাকারী (হযরত ইবন উমর রা.) বলেন, আমি সুহাইব (রা.) কে জিজ্ঞেস করলাম যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন যে তিনি কিভাবে সালামের জবাব দিতেন। উত্তরে বললেন, হাত দ্বারা ইশারা করে। (ইবন মাজাহ, পৃ. ৭২)
উক্ত রিওয়ায়াতসমূহ নামাযে ধারাবাহিক কিছু পরিবর্তনের বাস্তব উদাহরণ। সুতরাং তাকবীরে তাহরীমা ব্যতীত অন্যান্য স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন রহিত হওয়া অনুরূপই একটি পরিবর্তন মাত্র।
রহিত হওয়ার চতুর্থ দলীল
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে রাফয়ে ইয়াদাইন প্রমাণে সর্বাধিক শক্তিশালী রিওয়ায়াতের রাবী হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.)। কিন্তু তাঁর থেকে রাফয়ে ইয়াদাইন না করার আমলও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাছাড়া বুখারীতে পরপর বর্ণিত দুটো হদীস যা ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে দ্বিতীয় বর্ণনায় তৃতীয় রাকাআতের শুরুতেও রাফয়ে ইয়াদাইন করার কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু রাফয়ে ইয়াদাইনের প্রবক্তারা তা আমল করেন না। এতে প্রমাণিত হলো তৃতীয় রাকাআতের শুরুতে রাফয়ে ইয়াদাইন রহিত হওয়া তারাও মেনে নিয়েছেন। সুতরাং রাবী আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) এর রাফয়ে ইয়াদাইন ছেড়ে দেওয়ার হাদীস প্রমাণ করে তা পূর্বে ছিল পরে আর থাকেনি। রিওয়ায়াতটি নিম্নোক্ত পেশ করা হলো,
عن مجاهد قال صلَّيتُ خلفَ ابنِ عمرَ فلم يكن يرفعُ يديهِ إلّا في التَّكبيرةِ الأولى منَ الصَّلاةِ.
-হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) এর প্রখ্যাত শিষ্য হযরত মুজাহিদ (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) এর পিছনে নামায আদায় করলাম। তিনি প্রথম তাকবীর ব্যতীত নামাযের অন্য কোথাও হাত উত্তোলন করলেন না। (শারহু মাআনিল আসার (তাহাবী), ১ম খন্ড, পৃ. ১৬৩; মুসসান্নাফ ইবন আবি শাইবা, ১ম খন্ড, পৃ. ২৩৭)
আল জাওহারুন নাকী গ্রন্থের তৃতীয় খন্ড ৪৭নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে هذا سند صحيح -উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ।
ইমাম তাহাবী (র.) এর যৌক্তিক পর্যালোচনা
ইমাম আবূ জাফর আত তাহাবী (র.) তার রচিত শারহু মাআনিল আসার যাকে সংক্ষেপে ‘তাহাবী শরীফ’ বলা হয় উক্ত গ্রন্থে রাফয়ে ইয়াদাইন এর মাসআলায় উভয় পক্ষের দলীলসমূহ উল্লেখ করে পরিশেষে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ একটি মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। তাঁর যৌক্তিক মন্তব্যটি লক্ষ্য করুন-
قال ابو جعفر وقد رأينا تكبيرة الافتتاح من صلب الصلوة لا تجزى الصلوة الا باصالتها رأينا التكبيرة بين السجدتين ليست كذالك لانه لو تركها تارك لم تفسد عليه صلاته وراينا تكبيرة الركوع وتكبيرة النهوض ليستا من صلب الصلوة لانه لو تركها تارك لم تفسد عليه صلاته وهما من سننها فلما كانتا من سنن الصلوة كما ان التكبيرة بين السجدتين من سنن الصلوة كانتا كهى ان لا رفع فيهما كما لا رفع فيها.
-ইমাম আবূ জাফর আত তাহাবী (র.) বলেন, এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, তাকবীরে তাহরীমা হচ্ছে নামাযের রুকন যা সঠিকভাবে আদায়ের সাথে নামাযের বিশুদ্ধতার সম্পর্ক রয়েছে। পক্ষান্তরে দুই সিজদার মধ্যখানে তাকবীর বলা অনুরূপ নয়। কেননা যদি কেউ তা ত্যাগ করে নামায ফাসিদ হবে না। এমনিভাবে আমরা দেখতে পাই রুকূতে যাওয়া ও রুকূ থেকে ওঠার সময়ের তাকবীর নামাযের কোনো রুকন নয়। কেননা কেউ তা ত্যাগ করলে নামায ফাসিদ হবে না। বরং দুই সিজদার মধ্যখানের তাকবীরের ন্যায় তাও নামাযের সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যেহেতু দুই সিজদার মধ্যখানের তাকবীরে কারও মতে, হাত উত্তোলন বা রাফয়ে ইয়াদাইন নেই, তাই রুকূতে যাওয়া ও রুকূ থেকে ওঠার তাকবীরেও রাফয়ে ইয়াদাইন না থাকাই যুক্তিযুক্ত। (শারহু মাআনিল আসার (তাহাবী), ১ম খন্ড, পৃ. ১৬৪)
খুলাসা
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত বিষয়গুলোর সার-সংক্ষেপ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
এক. রাফয়ে ইয়াদাইন করা ও না করা উভয় বিষয়েই সহীহ হাদীস হাদীসের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে।
দুই. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বর্ণিত সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায হলো কেবলমাত্র নামাযের শুরুতে রাফয়ে ইয়াদাইন, অন্যত্র নয়।
তিন. সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির ইবন সামুরা (রা.) বর্ণিত হাদীস প্রমাণ করে বারবার হাত উত্তোলন করা নামাযের স্থিরতার পরিপন্থি, তাই তা করা থেকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারণ করেছেন।
চার. পবিত্র কুরআনের আয়াত- وَقُوْمُوْا لِلّٰهِ قَانِتِيْنَ ও প্রমাণ করে অধিক নড়াচড়া নামাযে একাগ্রতার পরিপন্থি।
পাঁচ. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) বর্ণিত সকল রিওয়ায়াত সামনে রাখলে প্রমাণিত হয় যে, রাফয়ে ইয়াদাইনের আমল নামাযের প্রথমদিকে ছিল, পরবর্তীতে তা রহিত হয়ে যায়।
ছয়. কোনো সহীহ হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ আমল ছিল রাফয়ে ইয়াদাইন করা। তবে বায়হাকীতে বর্ণিত রিওয়ায়াত فما زالت تلك صلاته حتى لقى الله -নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের শেষ পর্যন্ত নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন মর্মে বর্ণিত হাদীসটি অত্যন্ত দঈফ যা সহীহ হাদীসসমূহের মুকাবিলায় দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন প্রসিদ্ধ লা-মাযহাবী সালাফী আলিম মাওলানা আতাউল্লাহ হানীফ আত তালীকাতুস সালাফিয়া গ্রন্থের ১০৪নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,وحديث البيهقى ما زالت الخ ضعيف جدا -বায়হাকীর হাদীস ما زالت الخ অত্যন্ত দুর্বল।