1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে দাঈর গুণাবলি : সমকালীন দাঈদের দৃষ্টি আকর্ষণ
ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ
  • ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ইসলাম চির শান্তি ও প্রগতির ধর্ম। মানুষকে ইসলামের কল্যাণের পথে আহ্বান করতে মহান আল্লাহ যুগে যুগে অনেক নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীতে ইসলামের প্রচারণা শুরু হয় হযরত আদম (আ.) এর মাধ্যমে। ইসলাম পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে। ইসলাম শুধু ধর্ম হিসেবেই আবির্ভূত হয়নি, বরং জীবন বিধান হিসেবেও অবতীর্ণ হয়েছে। ইসলাম একটি গতিশীল ধর্ম। কিয়ামত পর্যন্ত এ ধর্মের সৌন্দর্য ও উপযোগিতায় বিন্দুমাত্র হ্রাস ঘটবে না।
ইসলামে গোটা বিশ্ববাসীর উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিহিত। কোনো সৃষ্টিই ইসলামের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত নয়। মানবজাতি তখনই ইসলামের পূর্ণ কল্যাণ লাভে ধন্য হবে যখন সবাই ইসলামকে ধর্ম হিসেবে মেনে নিবে, এর আদেশ নিষেধ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রতিপালন করবে। এ জন্য ইসলামের দাওয়াত ও তা’লীম পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। কুরআন এবং হাদীসে এ ব্যপারে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীসে ইসলাম প্রচারের তাৎপর্য, ইসলাম প্রচারকের মর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে।
প্রতিটি মুসলিমই যে যার অবস্থানে থেকে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করবে। প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করবে। তবে কুরআনের নির্দেশনা হচ্ছে, প্রতিটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন কিছু বিশেষ ব্যক্তি থাকবেন, যারা গোটা জাতিকে সৎ পথের সন্ধান বাতলে দিবেন। মহান আল্লাহ আল কুরআনুল কারীমে বলেন, “তাদের প্রত্যেক দল থেকে একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানের অনুশীলন করতে পারে, এবং ফিরে আসার পর তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা অসদাচরণ থেকে বিরত হয়।” (সূরা তাওবাহ, আয়াত-১২২)
মহান আল্লাহ উপরে উল্লিখিত আয়াতে প্রতি সম্প্রদায় থেকে একটি অংশকে দ্বীনের দাঈ (ইসলামের পথে আহ্বানকারী বা ইসলাম প্রচার-প্রসারের মহান কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি) হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছেন। যেহেতু কওমের একটা অংশকে দাওয়াতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাই দ্বীনের গভীর জ্ঞান থাকা তাদের জন্য অপরিহার্য। উল্লিখিত আয়াতে সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্বীনের পাণ্ডিত্য অর্জনের পাশাপাশি চারিত্রিক কিছু গুণাবলি অর্জনও দাঈর জন্য জরুরী। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চারিত্রিক মাধুর্যতা অসংখ্য সাহাবীর ইসলাম গ্রহণের কারণ হিসেবে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে যারা ইসলামের আলো দিকদিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও সকলকেই মোহাচ্ছন্ন করত, যা ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও বিস্তৃতির অন্যতম কারণ।
বর্তমান সময়ে আমাদের দ্বীন প্রচারের অন্যতম মাধ্যম ওয়ায-মাহফিল বা ধর্মীয় সভা। সারা বছরই আমাদের দেশে বিভিন্ন নামে ছোট বড় ওয়ায-মাহফিল চলতেই থাকে। তা সত্ত্বেও সমাজের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে না। মানুষের অপরাধ প্রবণতা কমছে না। মানুষ ধর্মমুখী হওয়ার পরিবর্তে ক্রমেই ধর্ম বিমুখ হয়ে পড়ছে। অনেক বিশ্লেষকই এজন্য দাঈদের অযোগ্যতা, অসততা ও চারিত্রিক ত্রুটিকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে মনে করে থাকেন। যে কারণে দাঈদের যোগ্যতা ও গুণাবলি কী হওয়া উচিত এ বিষয়ে গবেষণা সময়ের দাবি। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে বাংলাদেশের সমকালীন প্রেক্ষাপটে দাঈদের গুণাবলি আলোচনা করা হয়েছে।

দাঈর গুণাবলি

১. ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শীতা
ধর্মীয় জ্ঞান অর্থাৎ কুরআন, হাদীস ও ফিকহের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ব্যতীত কারো পক্ষেই ইসলামকে স্বমহিমায় মানুষের সামনে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর সর্বপ্রথম অবতরণ করেন ‘ইকরা’ বা ‘পড়’। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ সকল দাঈকে এ বার্তাই দিয়েছেন যে, দাওয়াতের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নবীগণকেও মহান আল্লাহ প্রথমেই ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী করার পর দাওয়াতী দায়িত্ব পালনে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন, হযরত ইউসুফ (আ.) এর ব্যপারে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে,

قُلْ هٰذِهِ سَبِيْلِيْ أَدْعُوْا إِلَى اللهِ- عَلٰى بَصِيْرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِيْ-

-বলুন, এটাই আমার পথ, আল্লাহর পথে আহ্বান জানাচ্ছি, আমি ও আমার অনুসারীরা, স্পষ্ট জ্ঞানের মাধ্যমে। (সূরা ইউসুফ, আয়াত-১০৮)
বর্তমান সময়ের দাঈদের একটা বড় অংশের মাঝেই ধর্মীয় জ্ঞানের অপরিপক্কতা বেশ লক্ষণীয়। যে কারণে অনেক আলোচকই ভুল ও খ-িতভাবে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। অজ্ঞতার কারণে অনেক আলোচককে ভুল ফাতওয়া প্রদান করতেও দেখা যায়। যা সামগ্রিকভাবে অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২. চারিত্রিক মাধুর্যতা
মানুষের চরিত্রের দুটি দিক, ভালো ও মন্দ। একজন দাঈর জন্য চরিত্রের ভালো দিকগুলো অনুশীলন করা অপরিহার্য। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাঈ। তাঁর চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন, “আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত” (সূরা কলম, আয়াত-৪)। এ পৃথিবীতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবির্ভাবের অন্যতম কারণ মানুষকে উত্তম চরিত্রের শিক্ষা দেওয়া। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি” (আস-সুনান আল-কুবরা লিল বায়হাকী, হাদীস নং ৮৯৪৯)। উত্তম চরিত্র অবলম্বনের গুরুত্ব বুঝাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের মাঝে সে ব্যক্তিই উত্তম যার চরিত্র সর্বোৎকৃষ্ট।” (বুখারী, হাদীস নং ৩৫৫৯)

৩. ধৈর্য ও অবিচলতা
যেকোনো কাজে সাফল্য লাভের অন্যতম শর্ত ধৈর্য ও অবিচলতা। প্রত্যেক দাঈর জন্য ধৈর্যশীল হওয়া অপরিহার্য। কোনো কওমই এক বাক্যে তাওহীদের মূলনীতি গ্রহণ করেনি। বরং বিরোধিতা করেছে। ইসলামের পক্ষে দাওয়াত দানকারীকে নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। দাওয়াতী কাজে বিপদাপদ আসা নতুন কোনো বিষয় নয়। নূহ (আ.) থেকেই শুরু হয়েছে এর ইতিহাস। সালিহ (আ.), ইবরাহীম (আ.), মূসা (আ.), শুআয়ব (আ.), ইলিয়াস (আ.), ঈসা (আ.) এবং শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলেই যুলম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ধৈর্যধারণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে সে সকল নবীগণের ধৈর্যের ইতিহাস বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন: “তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবেÑযদিও এখনও তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুরূপ অবস্থা আসেনি ? অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল এবং তাঁর সঙ্গে ঈমান আনয়নকারীগণ বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ জেনে রাখ! অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য নিকটে।” (সূরা বাকারা, আয়াত-২১৪)
বর্তমান যুগের দাঈদেরও নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদেরও নবী-রাসূলগণের ন্যায় ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে। তবেই প্রকৃত দ্বীন প্রচারে সাফল্য আসবে।

৪. ত্যাগের মানসিকতা
ইসলামের প্রচার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ত্যাগ ও কুরবানী ছাড়া এ কাজে সফল হওয়া যায় না। নবীগণের (আ.) জীবনীতে আমরা এর উদাহরণ পাই। পবিত্র কুরআনে নূহ (আ.) এর কাহিনী বর্ণনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “তিনি (নূহ) বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার সম্প্রদায়কে দিবারাত্রি আহ্বান করেছি। কিন্তু আমার আহ্বান তাদের পলায়ন প্রবণতাই বৃদ্ধি করেছে।” (সূরা নূহ, আয়াত-৫) এ আয়াতগুলোই প্রমাণ করে হযরত নূহ (আ.) ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাস ত্যাগ করে দিন-রাত মানুষের কাছে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করেছেন।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াতী জীবনও ছিল অনেক ত্যাগ ও কুরবানীর। ভোগ-বিলাসের লেশ মাত্রও ছিল না তাঁর দাওয়াতী জীবনে। ভোগ নয় ত্যাগই ছিল তাঁর জীবনের মহান আদর্শ। মক্কায় তাঁর দাওয়াতী মিশনকে থামিয়ে দেয়ার জন্য যখন কাফিরদের সকল কৌশল ব্যর্থ হয়েছিল তখন মক্কার কুরাইশরা অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে তাঁকে ফিরাতে চেষ্টা করল। রাসূল (সা.) পরিষ্কার করে তাদের জানিয়ে দিলেন, “চাচাজান, আল্লাহর শপথ! যদি এরা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় তবুও শাশ^ত এ মহা সত্য প্রচার সংক্রান্ত আমার কর্তব্য থেকে এক মুহূর্তের জন্যও আমি বিচ্যুত হব না। এ মহামহিম কার্যে হয় আল্লাহ আমাকে জয়যুক্ত করবেন, না হয় আমি ধ্বংস হয়ে যাব। কিন্তু আমি কখনই এ কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হব না।” (সফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃ. ১২১)

৫. তাকওয়া ও ইখ্লাস
দাওয়াতী কাজে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাকওয়া ও ইখলাস। ইসলামে এ বিষয় দুটি এতটাই গুরুত্ব বহন করে যে, এগুলো ব্যতীত মানুষের কোনো ভাল কাজই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে কবূল হয় না। সহীহ বুখারীতে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিয়ত অনুযায়ী সমস্ত কাজের ফলাফল হবে। প্রত্যেকেই যে উদ্দেশ্যে কাজ করবে সে তাই পাবে।” (বুখারী, হাদীস নং ০১)
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, “তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল দ্বীনকে কেবল তারই জন্য নিবেদিত করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়িম করতে ও যাকাত দিতে, এটাই সঠিক দ্বীন।” (সূরা বায়্যিনাহ, আয়াত-৫)
উপরে উল্লিখিত হাদীস ও আয়াতসমূহে একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সকল কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বস্তুত ইখলাস ও জাগতিক স্বার্থ তথা ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ কিংবা অন্য কোনো স্বার্থ পরিহার ব্যতীত যতই দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করা হোক না কেন, এতে সফল্য আসার সম্ভাবনা নেই। আর বর্তমানে অগ্রিম টাকা নিয়ে, দর কষাকষি করে অধিক অর্থ উপার্জনের যে মহোৎসব চলছে এর দ্বারা টাকা পয়সা রোজগার এবং আলীশান জীবন যাপন ছাড়া প্রকৃত ইসলাম প্রচারের কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

৬. পরমত সহিষ্ণুতা ও আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মু’মিনদের গুণাবলি বর্ণনা করে বলেন, “যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৩৪) অসহিষ্ণুতা সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তি বিনষ্টের অন্যতম প্রধান কারণ। একটা সমাজে নানা ধর্ম, চিন্তা ও মতের মানুষের বসবাস। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ধর্ম, চিন্তা ও মতকে সঠিক ও সর্বোত্তম বলে মনে করে। এক্ষেত্রে সকল দাঈর কর্তব্য ভিন্ন মত বা ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভতিশীল থাকা। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে ইসলাম প্রচারে বিরোধিতা করা হলেও সহিষ্ণু আচরণ করা।

৭. বিনয় ও নম্রতা
সচ্চরিত্রভূক্ত বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি বিনয় ও নম্রতা। ইসলাম মানুষকে বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের সকল ক্ষেত্রেই বিনয় অবলম্বন করতেন। দাওয়াতের অন্যতম কৌশল দাওয়াতী কার্যক্রমে বিনয় অবলম্বন করা। কুরআনের একাধিক আয়াতে বিনয় অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লহ বলেন,

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّواْ مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِيْنَ

-(হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের প্রতি কোমলহৃদয় হয়েছিলেন। তা না হয়ে আপনি যদি তাদের প্রতি রূঢ় ও কঠোর হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার আশপাশ হতে সরে পড়তো। কাজেই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। (পরামর্শ শেষে) আপনি কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হলে আল্লাহর উপর ভরসা করুন। যারা (আল্লাহর উপর) ভরসা রাখে, আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৫৯)

৮. মার্জিত শব্দ ব্যবহার করা
দাওয়াতের ক্ষেত্রে দাঈর ভাষাগত বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে দাঈর উচিত মাতৃভাষায় মার্জিত শব্দে সুস্পষ্ট ও সহজভাবে দ্বীনের দাওয়াত উপস্থাপন করা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধীরে-সুস্থে উপদেশ দিতেন। এতই ধীরে যে, ইচ্ছে করলে কেউ তাঁর প্রতিটি কথা গণনা করতে পারতেন (সহীহ বুখারী)। কুরআনে বক্তৃতা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। হযরত লুকমান (আ) তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়েছেন,

وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ

-কথা বল নিচুস্বরে। জেনে রেখ, নিশ্চয় গাধার কণ্ঠই সবচেয়ে অপ্রিয়। (সূরা লুকমান, আয়াত-১৯)

৯. অশ্লীল, অশোভন ও অনর্থক কথা থেকে বিরত থাকা
দাওয়াতের ক্ষেত্রে অশোভন, অপ্রাসঙ্গিক ও অনর্থক কথা বর্জন জরুরী। অপ্রাসঙ্গিক, অনর্থক কথার কারণে অনেক সময়ই মূল বক্তব্য হারিয়ে যায়। শ্রোতা এতে করে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। যে কারণে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনর্থক কথা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আলী (যাইনুল আবেদীন) ইবনুল হুসাইন (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

اِنَّ مِنْ حُسْنِ اِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكَهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ

-কোনো ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো অর্থহীন কথা বা কাজ ত্যাগ করা। (তিরমিযী, হাদীস নং ২৩১৮)
বর্তমান সময়ের অনেক আলোচককে বক্তব্যের মাঝে অশ্লীল বাক্য, সিনেমার গান ও ডায়লগ ইত্যাদি ব্যবহার করতে দেখে যায়। কেউ কেউ যৌন ইঙ্গিতমূলক গল্প-কৌতুকও বলে থাকেন। এর কোনোটাই ইসলাম সমর্থন করে না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপদাতা, অশ্লীলভাষী ও গালাগালকারী হয় না। (তিরমিযী, হাদীস নং ২০৪৩)

১০. ব্যক্তি জীবনে ধর্ম পালনে অভ্যস্ত হওয়া
ইসলামের পূর্ণ অনুসরণ থাকতে হবে দাঈর নিজের ব্যক্তি জীবনে। তারা তাদের জীবন পরিচালনা করবেন কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ মোতাবেক। দাঈগণ তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সকল সৎ গুণের অনুশীলন করবেন এবং অন্যায় আচরণ থেকে দূরে থাকবেন। দাঈগণ লোক দেখানো বা সামাজিকতার জন্য দ্বীন পালন করতে পারে না। ইসলামের বিধি-বিধান পালন করাকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য বানাতে হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতে কথা ও কাজে মিল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, “তোমরা কি মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দাও এবং তোমাদের নিজেদের ক্ষেত্রে ভুলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর। তাহলে কি তোমরা বুঝো না?” (সূরা বাকারা, আয়াত-৪৪)

১১. বোধগম্যতার জন্য শ্রোতাদের অবস্থা বিবেচনা করা
দাঈ নিজের পা-িত্য বা গভীরতা প্রকাশের জন্য সবার কাছে একই রকম প্রচার চালাবে না। বরং মানুষের গ্রহণ করার ক্ষমতা বিবেচনা করবেন। যারা জ্ঞানী তাদের নিকট দার্শনিক তত্ত্ব বা জ্ঞান আলোচনা করবেন। পক্ষান্তরে, কম শিক্ষিতদের সামনে তুলনামূলক সহজ বিষয়, সহজভাবে আলোচনা করবেন। হযরত আয়িশা (রা.) বলেছেন ;

امر رسول الله صلى الله عليه وسلمَ ان ننزل الناس منازلهم-

-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন, আমরা যেন মানুষকে যথাযথ মর্যাদার স্থানে রাখি। (ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমা)
এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, দাওয়াহ গ্রহণে আগ্রহী তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ লোককে দাওয়াহ গ্রহণে অনাগ্রহী তুলনামূলক বেশি গুরুত্বপূর্ণ লোককে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বরং আগ্রহী লোকই বেশি গুরুত্ব পাবে। তাকে কোনোক্রমেই অবজ্ঞা বা অবহেলা করা যাবে না। কাজেই ব্যক্তির অবস্থান ও যোগ্যতা অনুসারে তার উপযুক্ত ভাষা ও পদ্ধতিতে তার নিকট দাওয়াহ উপস্থাপন করতে হবে।

১২. সততা অবলম্বন এবং বানোয়াট বক্তব্য পরিহার করা
দাঈ বিশ্বস্ত হবেন। যে কোনো তথ্য ও লেনদেনে মানুষ তার ওপর আস্থা রাখবে। তিনি তার ব্যক্তি জীবনে যেমনিভাবে সততা অবলম্বন করবেন, অনুরূপভাবে দাওয়াতের ক্ষেত্রেও সততা অবলম্বন করবেন। মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য বা নিজ দলের প্রচারণার স্বার্থে বানোয়াট কোনো বক্তৃতা প্রদান করবে না। মহান আল্লাহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সততা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا

-হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। (সূরা আহযাব, আয়াত-৭০)
হাদীস বর্ণনা, কুরআনের তাফসীর করা, ফিকহী মাসআলা আলোচনাসহ সকল ক্ষেত্রেই সততা অবলম্বন করতে হবে। কুরআন-হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা করা যাবে না, বরং সাহাবী, তাবিঈ বিখ্যাত ইমাম ও পূর্ববর্তী পণ্ডিতগণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বর্তমান সময়ের উপযোগী করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।

১৩. গীবত চর্চা না করা
ইসলামী শরীআতে গীবত বা পরনিন্দা করা অবৈধ। আল্লাহ বলেছেন,

وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ

-আর তোমরা একে অন্যের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে ভালোবাসবে? বস্তুত তোমরা নিজেরাই তা অপছন্দ করে থাকো। (সূরা হুজরাত, আয়াত-১২)
গীবত করাকে আল-কুরআনে নিজ মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং গীবত খুবই অপছন্দনীয় কাজ। সুস্থ বিবেকবান কোনো মানুষেই এরূপ কাজ পছন্দ করতে পারে না। আল্লাহ তাআলাও গীবত করা পছন্দ করেন না।
পবিত্র হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের গিবতের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গীবত ব্যভিচারের চাইতেও মারাত্মক। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! গীবত কিভাবে ব্যভিচারের চাইতেও মারাত্মক অপরাধ হয়? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোনো ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তাওবা করলে আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করে দেন। কিন্তু গীবতকারীকে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ মাফ করেন না যতক্ষণ না যার গীবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি মাফ করবে। (বায়হাকী)

১৫. আত্মসমালোচনা
চরিত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে আত্মসমালোচনা একটি কার্যকর উপায়। মানুষকে সঠিক পথ ও সংশোধনের রাস্তা দেখাতে আত্মসমালোচনার ভূমিকা অনন্য। আত্মসমালোচনা করলে নিজের ভুল ধরা পড়ে এবং পরবর্তী সময় সে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক কাজটি করতে পারে। যে ব্যক্তি নিজের দোষ-ত্রুটি, অন্যায় নিজে বিচার করে, সে কখনো আত্মপ্রীতি ও আত্মম্ভরিতার শিকার হতে পারে না। নিজের গুনাহের কথা যে চিন্তা ও হিসাব করে সে ব্যক্তি সহজে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে পারে। আত্মসমালোচনার গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ- وَاتَّقُوا اللهَ- إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُون

-হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। প্রত্যেকেই চিন্তা করে দেখুক, আগামীকালের জন্য সে কী (পুণ্য কাজ) অগ্রিম পাঠিয়েছে। (সূরা হাশর, আয়াত-১৮)
সমকালীন দাঈদের মধ্যে আত্মসমালোচনার প্রবণতা নেই বললেই চলে। বরং অধিকাংশকেই পরনিন্দা চর্চা করতে দেখা যায়। এর ফলে দাঈদের চারিত্রিক ত্রুটি দূর হচ্ছে না। ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, দাঈদের পরনিন্দার প্রবণতায় ভয়াবহ সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে এবং কলহে রুপ নিচ্ছে দাঈদের পারস্পরিক বিদ্বেষ।

উপসংহার
ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি কাজ দ্বীনের দাওয়াত। এটি বান্দার প্রতি মহান আল্লাহ প্রদত্ত একটি দায়িত্বও বটে। যে দায়িত্ব যুগে যুগে নবী রাসূলগণ এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দগণ নিঃস্বার্থভাবে পালন করে এসেছেন। দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে নানা কারণেই সৎ, দক্ষ ও যোগ্য দাঈ সৃষ্টি হচ্ছে না। অনেকেই দাওয়াতী কার্যক্রমকে লাভজনক পেশা হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন। যে কারণে ইসলামের মর্মবাণী সাধারণ মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারছে না। এ অবস্থায় দাঈদের আবশ্যক কর্তব্য তাদের জ্ঞানগত অযোগ্যতা দূরীকরণে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। নিজেদর লোভ-লালসাসহ অন্যান্য চারিত্রিক ত্রুটি সংশোধন করা। এর পাশাপাশি দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে নবীজী (সা.), সাহাবী, তাবিঈসহ ওলী-আউলিয়ার নীতি আদর্শ অনুশীলন করা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের জন্য আদর্শ দাঈ হিসেবে কবুল করুন। আমীন।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ফেইসবুকে আমরা...