1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
ধর্মীয় বাস্তবতায় কোয়ান্টাম মেথড: কয়েকটি প্রশ্ন
আব্দুল্লাহ যোবায়ের
  • ৫ জুন, ২০২৩

বাংলাদেশে বেশ কয়েক দশক ধরে কোয়ান্টাম মেথড কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমবারে নাম শুনে যে কারুরই মনে হবে- সম্ভবত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো পদ্ধতির কথা হয়তো বলা হচ্ছে। কারণ কোয়ান্টাম ফিজিক্স, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ইত্যাদি পরিভাষা অত্যন্ত জনপ্রিয়। সমস্যা হলো, কোয়ান্টাম মেথড এর কোনোটিই নয়।

বাংলাদেশের মানুষকে দুটি জিনিসের নাম দিয়ে খুব সহজেই প্রভাবিত করা যায়। বলা উচিত দুটি জিনিসের নামে এদেশের মানুষ সহজেই প্রতারিত হতে পছন্দ করে। একটি হলো বিজ্ঞান এবং আরেকটি হলো ধর্ম। বিজ্ঞানের নামে এদেশে যত অপবিজ্ঞান চলে, ধর্মের নামেও বুজরুকি কম চলে না। যেমন সাত দিনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরবী বা ইংরেজি শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হস্তরেখা বিচার ইত্যাদি। কোয়ান্টাম মেথডও তথাকথিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধ্যানের আলোকে জীবনযাপনের কথা বলছে। তারা নিজেদের সায়েন্স অব লিভিং বা জীবনযাপনের বিজ্ঞান নাম দিয়েছে। বিজ্ঞানের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের জন্য তারা আলফা, বিটা, গামা, থেটা ইত্যাদির মতো গালভরা কিছু বৈজ্ঞানিক পরিভাষাও ব্যবহার করে। কিন্তু কেয়ান্টামে কি কোনো গবেষণা হয়? ধ্যান করাই কি বিজ্ঞান? প্রথম প্রশ্ন।

কোয়ান্টামের ধ্যান পদ্ধতি আসলে নতুন কিছু নয়। হিন্দু ও বৌদ্ধ যোগীদের (Yoga) নতুন সর্বধর্মবাদী একটি সংস্করণ হলো কোয়ান্টাম মেথড। জনৈক স্প্যানিশ উদ্যোক্তা হোসে সিলভা আমেরিকার টেক্সাস লরেডো শহরে আত্মনিয়ন্ত্রণের এক পদ্ধতি হিসেবে সিলভা মেথড চালু করেন।  এটি ছিল একান্তই তার নিজস্ব গবেষণার চূড়ান্ত ফল। হোঁজে সিলভার ভাষায় এটি পৃথিবীতে মানব বিবর্তনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

বাংলাদেশের এক প্রকৌশলী মাহী কাজী যুক্তরাজ্যে গিয়ে হোসে সিলভার সাথে পরিচিত হন এবং ১৯৯০ সালের শেষের দিকে দেশে ফিরে নিজেই সিলভা মেথড শেখানো শুরু করেন। সিলভা মেথড আদতে জটিল কিছু ছিল না। মন নিয়ন্ত্রণ করাই এখানে মূলকথা।

মাহী কাজীর প্রথম দিককার একটি কোর্সে জনৈক আব্দুল মান্নান শিকদারের পুত্র এ বি এম শহিদুল আলম শিকদার দুলু ভর্তি হয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করেন। এই দুলু শিকদার হলেন সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারের আপন চাচাতো ভাই।

কোর্সটি করার পর দুলু শিকদার নাম পালটে শহিদ আল বোখারী মহাজাতক হিসেবে আবির্ভূত হন। মাহী কাজী শুধু মন নিয়ন্ত্রণের কোর্স করিয়ে সুবিধা করতে পারেননি। সেজন্য মহাজাতক সিলভা মেথডের সবকিছু বাংলায় রূপান্তরিত করে নাম দেন কোয়ান্টাম মেথড। এরপর সিডি, ক্যাসেট, বই-পত্র ইত্যাদির মাধ্যমে এক যোগে প্রচারণা শুরু করেন। এরও আগে অর্থাৎ আশির দশকেই লোকজন তাকে জ্যোতিষী মহাজাতক হিসেবে চিনত। বাজারে মহাজাতকের পঞ্জিকা ও রাশিফলের অনেক কাটতি ছিল। তখন তিনি নিয়মিতভাবে দৈনিক ইত্তেফাক, মাসিক ঢাকা ডাইজেস্ট, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, মাসিক রহস্য পত্রিকা ইত্যাদিতে জ্যোতিষ শাস্ত্র ও কোয়ান্টাম মেথড নিয়ে লেখালেখি করতেন।

কোয়ান্টাম মেথড হোসে সিলভার মতো নিছক মন নিয়ন্ত্রণের কোনো মেথড হলে খুব একটা চিন্তার বিষয় ছিল না। কারণ মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে রোগীকে আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখানোর চেষ্টা করেন। এটিকেও তেমন কিছু ধরে নেয়া যেতো।

কিন্তু মহাজাতক যখন পবিত্র কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করেন, ধ্যানের আড়ালে হিন্দু ও বৌদ্ধ যোগীদের যোগ নিয়ে আসেন এবং ঈমান বিরোধী আকীদা-বিশ্বাস চর্চা আরম্ভ করেন, তখনই বিষয়টা মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথমত, মহাজাতক আকবরের মতো একটি সর্বধর্মসমন্বয়বাদী সংঘ গড়ে তুলেছেন। এর উদাহরণ হিসেবে তার রচিত কিছু বইয়ের নাম বলা যায়। যেমন গীতা কণিকা (হিন্দু ধর্ম), বাইবেল কণিকা, ধম্মপদ কণিকা (বৌদ্ধ ধর্ম), বেদ কণিকা ইত্যাদি।

একজন মুসলিমকে কোর্স করানোর নামে বেদ, বাইবেল আর ধম্মপদ পড়ানো কোনোভাবেই সঠিক কাজ হতে পারে না। এমনকি কোয়ান্টামের ধ্যানের বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্টিকর্তা বলা হয়, আল্লাহ বলা হয় না। মহাজাতক নিজেও প্রোমাস্টার কোর্সে ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে ব্রহ্মা ও আব্রাহাম সম্বোধন করে থাকেন।

দ্বিতীয়ত, জেনে শুনে কোনো জ্যোতিষীর কাছে যাওয়াটা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চাও হারাম। আর হালালকে হারাম মনে করাও কুফরি। মহাজাতক নিজে যেমন জ্যোতিষী ছিলেন, এখনও জোর গলায় তার পক্ষেই কথা বলেন। যেমন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে তিনি এ বিষয়ের একটি প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, ‘পবিত্র কুরআনের সূরা জিনের ২৬-২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘গাইব বা ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র তিনিই জানেন, যদি না তিনি কাউকে জানান, যেমন তিনি রাসূলদের জানিয়েছেন।’ অর্থাৎ জানার পথ খোলা আছে। তিনি যে কাউকে ইচ্ছা ভবিষ্যৎ জানাতে পারেন, যে কাউকে ইচ্ছা গাইব জানাতে পারেন, এটা তার ইখতিয়ারে। আর এটা আল্লাহর একটি আশ্বাসই যে, যে যা জানতে চায়, আল্লাহ সেই বিষয়ে তাকে জ্ঞান দান করেন।

আসলে জ্যোতিষী নিয়ে আমাদের সমাজে অনেকের মধ্যে যে বিরূপ মনোভাব তার মূলে আছে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ আমাদের এখানে অতীতে জ্যোতিষচর্চা করতেন মূলত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা। অতএব জ্যোতিষ-বিজ্ঞান চর্চা করলে সে মুসলমান থাকবে না। সেইসাথে কুরআন-হাদীসের পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যার মাধ্যমে কট্টরপন্থী একশ্রেণির আলিম এ বিষয়টিকে ধর্মীয় নিষেধের বেড়াজালে বন্দি করে ফেলেন। তারা গণকের ভাগ্য গণনার সাথে জ্যোতিষ বিজ্ঞানকে একাকার করে ফেলেন।’

এখানে কি তিনি নিজেকে আল্লাহর রাসূলগণের সমকক্ষ দাবি করলেন? নাকি জ্যোতিষীদেরকে রাসূলগণের কাতারে নিয়ে গেলেন? অথচ মহানবী e বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্যোতিষীর কাছে গেল, অতঃপর তার কাছে কোনো কিছু জানতে চাইল, ৪০ দিন পর্যন্ত তার তাওবা কবূল হবে না। আর যদি সে তার কথা বিশ্বাস করে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে (আত তারগিব ওয়াত তারহিব)। হাজার হাজার কোয়ান্টাম-রোগীদের কী অবস্থা আল্লাহই ভালো জানেন।

তৃতীয়ত, কোয়ান্টামের কোয়ান্টাম টেক্সটবুক বইয়ে বলা হয়েছে, ‘কথিত আছে অলৌকিক শক্তিবলে ঋষিরা ইসম বা মন্ত্র উচ্চারণ করতেন আর যাদুর মত সব ঘটনা ঘটে যেত। যে কোন ঋষিরা মন্ত্র উচ্চারণের আগে বছরের পর বছর ইসম বা মন্ত্র জপ করতেন বা যিকর করতেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আল্লাহ, ইয়াহু, ইয়া হক, ওম ইত্যাদি…..।’ লক্ষ্যণীয় এখানে কিভাবে আল্লাহু শব্দের সাথে হিন্দুদের ওম-কে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া তাদের কোয়ান্টাম ভঙ্গিও সরাসরি বৌদ্ধ ধর্মের অনুশীলন। কোয়ান্টাম টেক্সট বইয়ে বলা হয়েছে, ‘আপনি মহামতি বৌদ্ধসহ প্রাচীন ঋষিদের যে ভাস্কর্য দেখতে পান,তার বেশিরভাগই অভয়মুদ্রা করে সিদ্ধাসনে বসা। আর এই অভয়মুদ্রার আধুনিক নামই কোয়ান্টা ভঙ্গি।’ অভয়মুদ্রা হলো বুড়ো আঙুল আর তর্জনীকে গোল করে ধরে অন্য আঙুলগুলোকে সমান করে রাখা। মহাজাতক এরপর এটিকে ইসলামাইজ করার জন্য হাস্যকর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন- ‘কোয়ান্টা ভঙ্গি করে হাত সামনে এনে খেয়াল করলে দেখবেন হাতে আরবী আলিফ, লাম ও হে অর্থ্যাৎ আল্লাহু হয়ে আছে। সুতরাং কোয়ান্টা ভঙ্গি করার সাথে সাথে আপনি প্রকারান্তরে স্রষ্টাকে স্মরণ করছেন।’

বৌদ্ধ ধর্মের মুদ্রা দিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে- ইসলাম কি এতই অপূর্ণাঙ্গ? ইসলাম তো পরিপূর্ণ জীবনবিধান।

চতুর্থত, কোয়ান্টামের ধ্যানের মাধ্যমে মনছবি দেখা, অন্তর্গুরুর সন্ধান করা, কমান্ড সেন্টার, অটোসাজেশান ইত্যাদি সবই নানাভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। কোনটা সরাসরি শিরক, কোনোটা ভিন্ন ধর্মের অনুসরণ আর কোনোটা অবান্তর কাজ।

পঞ্চমত, এ প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছিলাম, বিজ্ঞান আর ধর্মের নামে এদেশে কাউকে প্রতারিত করা খুবই সহজ। কোয়ান্টাম মেথড ইদানিং তাদের ধ্যানের নাম দিয়েছে মুরাকাবা। অথচ মুরাকাবা সালফে সালিহীনের যুগ থেকে ব্যবহৃত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তাসাওউফী পরিভাষা। সার্বক্ষণিক আল্লাহ আমাকে দেখছেন এবং আমিও আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করে আছি তথা ইহসানই মুরাকাবার মূলকথা। মুরাকাবা হয় একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য। কোনো অন্তুর্গুরুর সন্ধানে নয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, ইদানিং মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন মুরাকাবার নাম দিয়ে কর্মশালা পরিচালনা করছে। অসংখ্য তরুণ-তরুণী তাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের জাগতিক ক্যারিয়ারের পাশাপাশি ঈমানী জিন্দেগীও বরবাদ করে ফেলেছে। সামনের দিনগুলোকে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আরও বেশি ধর্মীয় পরিভাষা ব্যবহার করবে বলে আমার বিশ্বাস। তাদের প্রতিহত করা ও তাদের বিভ্রান্তি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা কর্তব্য।

ফেইসবুকে আমরা...