1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
নবীজির দেহ মুবারাক: সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সাহাবীদের প্রশংসা
ইমাদ উদ্দীন
  • ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই এই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। দৈহিক গঠন এবং সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও তাই। আল্লাহর বাণীতে সে ঘোষণা হলো,

لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ

-আমি মানুষকে শ্রেষ্ঠ অবয়বে সৃষ্টি করেছি। -(সুরা ত্বীন : ০৪)
এ আয়াতের মর্মার্থ সম্পর্কে কুরআন মাজীদের প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ “তাফসীরে কাবীর”-এ ইমাম তাবারানী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৩৬০ হিজরী) বলেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ কাঠামোয় সবচেয়ে মানানসই সুন্দর অবয়ব।”
সৃষ্টির সেরা এই জাতির মাঝে সর্বোত্তম শ্রেণি হলেন আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলগণ। তারা জ্ঞানগরিমা,মর্যাদাসহ দৈহিক সৌন্দর্যেও সবার উর্ধ্বে। আবার শ্রেষ্ঠ এই শ্রেণির সবার উপরে আসন যার, তিনি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা ও সম্মানের শ্রেষ্ঠত্ব বিজ্ঞজনসহ আম জনতার কাছে স্পষ্ট। তবে দৈহিক সৌন্দর্যে অনন্যতার ক্ষেত্রে সাধারণ মনে মাঝেমধ্যেই সংশয় দেখা যায়। এর মূলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখনিঃসৃত মিরাজের একটি হাদীস, সেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইউসুফ (আ.) সম্পর্কে বলেন, “তিনি (ইউসুফ আ.) সৌন্দর্যের অর্ধেক লাভ করেছেন।”
কিন্তু মুহাদ্দীসগণের মতে, হাদীসটি ইউসুফ (আ.) সবেচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক করে না। তারা হাদীসের মূল আবেদন তুলে ধরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেকে মর্যাদার পাশাপাশি সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ সম্ভার প্রমাণ করেছেন। আমাদের আলোচনার কারণ হলো, হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা সকল নবীকেই সুন্দর আকৃতি এবং শ্রুতিমধুর কন্ঠের অধিকারী করে বানিয়েছেন।
মাকাসিদে শরীআহ ও আসরারুশ শরীআহ তথা শরঈ বিধানের উদ্দেশ্য ও গূঢ় রহস্য আলোচনার শাস্ত্রে আল্লাহ নবীদেরকে এই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার হিকমতের বড় একটি কারণ বলা হয়, যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া নিআমত সৃষ্টিগত সৌন্দর্য এবং মোহনীয় গলার স্বর মানুষের নিকট গুণ হিসেবে বিবেচিত, সেহেতু নবীগণকেও এই গুণে বিশেষত্ব দেওয়া হয়েছে।
এভাবে সৌন্দর্যের গুণে এগিয়ে থাকা নবী-রাসূলদের মাঝেও যে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনোহর রূপ মাধুরীতে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন— এখানে তা উপস্থাপন করাই উদ্দেশ্য। পাশাপাশি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসার নমুনাস্বরূপ এই সৌন্দর্যের আলোচনার রীতি যে নতুন নয়, বরং সাহাবীদের যুগ থেকেই চলমান— এ সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত কিছু বর্ণনা তুলে ধরব। ইনশাআল্লাহ!

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি
প্রথমে আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত মাখলুকের মাঝে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অনন্য হওয়া সংক্রান্ত আলোচনা করব। শুরুতে সে হাদীস তুলে ধরছি, যা থেকে সাধারণ দৃষ্টিতে সংশয় তৈরী হতে পারে। হাদীসটির মর্মার্থ সম্পর্কে সালাফের ব্যাখ্যাসহ সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অন্যান্য হাদীস ও সাহাবীদের বক্তব্য পেশ করছি-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠ মুজিযাসমূহের একটি মিরাজ। একরাত্রির স্বল্প সময়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস হয়ে সাত আসমান, জান্নাত-জাহান্নাম দর্শন এবং আল্লাহর দীদার লাভ করেন। বিস্ময়কর এ মুজিযার হাদীসে এসেছে, ভ্রমণকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইউসুফ (আ.) উভয়ের তৃতীয় আসমানে সাক্ষাত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইউসুফ (আ.) এর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে বলেন,

هُوَ قَدْ أُعْطِيَ شَطْرَ الْحُسْن

-“তাঁকে (ইউসুফ আ.) সৌন্দর্যের অর্ধেক দান করা হয়েছে।”
হাদীসের মর্মার্থ নিয়ে নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসগণের ব্যাখ্যা নিম্নরূপ-
আল্লামা ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৫৯৭ হিজরী) তাঁর রচিত অনবদ্য গ্রন্থ ‘কাশফুল মুশকিল মিন হাদীসিস সাহীহাইন’ এ বলেন,
ইবন কুতাইবা (র.) বলেন, ইউসুফ (আ.) কে অর্ধেক পরিমাণ সৌন্দর্য দেওয়ার অর্থ হলো- আল্লাহ তাআলা সৌন্দর্যের একটি চুড়ান্ত সীমারেখা তথা মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন। তা থেকে সৃষ্টির মধ্যে যাকে যেমন ইচ্ছা প্রদান করেন। হোক ফিরিশতা বা জান্নাতের হুর। আল্লাহ ইউসুফ (আ.) কে সেই মাপকাঠি অনুযায়ী অর্ধেক প্রদান করেছেন। কাজেই তিনি অনেক সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। তবে বিষয়টি মানুষের ধারণা মত এমন নয় যে, ইউসুফ (আ.) কে মোট সৌন্দর্যের অর্ধেক দেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তী অর্ধেক সমস্ত মানুষকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল জাওযিয়্যাহ (র.) (৭৫১ হিজরী) হাদীসের ব্যাখ্যায় “বাদাইউল ফাওয়াইদ”-এ বলেন, ইউসুফ (আ.) সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য ‘তাকে সৌন্দর্যের অর্ধেক দেওয়া হয়েছে’ এ ব্যাপারে একদল বলেন, ইউসুফ (আ.) কে সৌন্দর্যের সেই অর্ধেক দেওয়া হয়েছে, যা দেওয়া হয়েছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্য সৌন্দর্যের মাপকাঠির চুড়ায় পৌঁছেছিলো আর ইউসুফ (আ.) এর সৌন্দর্য সেই মাপকাঠির অর্ধেক পৌঁছেছে।
শেষে আরও বলেন, আনাস (রা.) এর হাদীসটি এ বিষয় (ইউসুফ আ. অর্ধেক পরিমাণ সৌন্দর্য লাভ করা) অগ্রাহ্য করে না, তবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৈহিক সৌন্দর্য এবং কণ্ঠ উভয় দিক থেকে শ্রেষ্ঠ— তা প্রমাণ করছে।
আল্লামা ইবন হাজার আসকালানী (র.) (৮৫২ হি.) বুখারী শরীফের সমাদৃত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বলেন, হাদীসের বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয়,ইউসুফ (আ.) ছিলেন সুন্দরতম মানুষ। কিন্তু ইমাম তিরমিযী আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা সকল নবীকেই সুন্দর আকৃতি এবং মায়াবি কণ্ঠের অধিকারী করে বানিয়েছেন। আর তোমাদের নবী (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী। এ হাদীসের ভিত্তিতে বলা যায়, মিরাজের হাদীসটির আবেদনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শামিল নন। তাছাড়া ব্যক্তির এই বাণী, ‘বক্তা তার সকল সম্বোধনের অন্তর্ভূক্ত হয় না’— উল্লেখিত ব্যাখ্যাকে আরও জোরালো করে।

আল্লামা কাস্তালানী (র.) (৯২৩ হি.) বলেন,‘জেনে রাখো! নিশ্চয়ই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে ঈমানের পূর্ণতা এ বিশ্বাস রাখায় যে, আল্লাহ তাআলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন মনোহর রূপমাধুরী দিয়েছেন, যার সমমান পূর্বাপর কোনো মানব দেহে প্রকাশিত হয়নি। তাঁর পবিত্র দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সেই শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি বহন করে। নিজ চারিত্রিক মাহাত্ম্য নবীজির পবিত্র আত্মার নিশ্চয়তা দেয়।’
আল্লামা মুল্লা আলী কারী (র.) মিশকাতের শরাহ মিরকাতুল মাফাতীহে বলেন, অনেক নির্ভরযোগ্য মুতাআখখিরীন হাফিযে হাদীস শাইখ বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইউসুফ (আ.) এর থেকেও বেশি সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। তবে আল্লাহ সে সৌন্দর্যের বেশিরভাগ জ্যোতিই সাহাবীদের থেকে গোপন রেখেছেন। যদি সাহাবীদের নিকট সে জ্যোতির সবটুকু প্রকাশিত হতো, তাহলে তারা নবীজিকে দেখতে সক্ষম হতেন না। কতিপয় বিদগ্ধ আলিম এমনই বলেছেন। অন্যদিকে ইউসুফ (আ.) এর সৌন্দর্যের সবটুকুই ছিলো প্রকাশিত।
সুতরাং, হাদীসের ব্যাখ্যা থেকে এর মর্মার্থ এটিই বুঝা যায়,ইউসুফ (আ.) সৌন্দর্যের অর্ধেক সংক্রান্ত হাদীসের অর্থ এই নয় যে, সমস্ত সুন্দরের অর্ধেক উনাকে দেওয়া হয়ে গেছে আর বাকি অর্ধেক সবাইকে ভাগ করা হয়েছে; যার ভিতরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অন্তর্ভুক্ত। বরং সৌন্দর্যের পরিমাপ বা বণ্টনের হিসাব পূর্ণতার অনুপাতে হয়ে থাকে। আর ইউসুফ (আ.) এর লাভ করা সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য হল সৌন্দর্যের পূর্ণতার মাপকাঠির অর্ধেক। অন্যদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৌন্দর্যের মাপকাঠি অনুযায়ী পূর্ণতা পেয়েছিলেন। তাছাড়া উলামায়ে কিরামের বক্তব্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্য অন্য কারোর মাঝে প্রকাশিত না হওয়ার ব্যাখায় আমরা বলতে পারি, সকল সৃষ্টির তুলনায় সৌন্দর্যের পূর্ণতার যে সন্নিবেশ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে হয়েছে, এর সমমান সৌন্দর্য আর কেউই লাভ করেননি। না সার্বিক দিক থেকে, না কোনো একটি শাখায়।

সাহাবী কর্তৃক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৈহিক সৌন্দর্যের প্রশংসা
ইসলামের মূল আবেদন অনুধাবন ও তার অনুসরণে অগ্রগণ্য সাহাবীরা রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও ভালোবাসাকে নিজের জীবনের উপর প্রাধাণ্য দিতেন। নবীজির দর্শন লাভের তৃষ্ণা সাহাবীদের কখনও শেষ হতো না। সব কামনা কি ফুরিয়ে যায়? এটা তো সেই অমিয় সুধা, যার আবেদন কখনো ফুরাবার নয়। এ টান থেকেই সাহাবীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়কেও প্রাণাধিক ভালোবাসতেন; জীবনের সাথে জড়িত প্রতিটি বিষয় খুঁজে খুঁজে এর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতেন। ছোটো বা কম সংস্পর্শ পাওয়া সাহাবী এবং তাবিঈদের কাছে তা বর্ণনা করতেন। তিনি দৈহিক আকৃতিতে কেমন, তাঁর পবিত্র দেহ মুবারকের কোন অঙ্গ কীরূপ ছিল, পরম আবেগ নিয়ে প্রতিটির পূর্ণাঙ্গরূপ বর্ণনা করতেন। এই অবয়বকে অনন্য বলে স্বীকৃতি দিতেন। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শারীরিক অবয়ব শরীআতের অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা এমন করেছেন তাযীমে শিয়ারিল্লাহ হিসেবে। এমনকি জান্নাতী যুবকদের সরদার হাসান ইবনু আলী (রা.) এর বর্ণনায় সাহাবীদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক গঠনের সাথে নিজেদের মিল খোঁজার আকাংখা ফুটে ওঠে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমষ্টিগত বৈশিষ্ট্য, শ্রেষ্ঠত্ব এবং ব্যবহার্য ও আচরণগত দিক নিয়ে সাহাবীদের বর্ণনা ইতিহাস, জীবনী এবং হাদীসগ্রন্থগুলোতে গুরুত্বের সাথে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রতিটি হাদীসগ্রন্থে শামাইলের উপর আলাদা অধ্যায় সংকলিত হয়েছে। স্বতন্ত্র কিতাবও রচিত হয়েছে। শামাইলের প্রসিদ্ধ কিছু কিতাব হলো, ইমাম তিরমিযী (র.) কর্তৃক সংকলিত আশ-শামাইলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ, আল্লামা ইউসুফ নাবহানী (র.) কর্তৃক রচিত ওয়াসায়িলুল উসূল ইলা শামাইলির রাসূল, আল্লামা আব্দুল্লাহ সিরাজুদ্দীন হালাবি (র.) কর্তৃক রচিত সায়্যিদুনা মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শামাইলুহুল হামিদাহ ওয়া খিসালুহুল মাজীদাহ ইত্যাদি।
উল্লেখিত ইমাম তিরমিযী রচিত শামাইলের স্বতন্ত্র কিতাবটির ব্যাখ্যা করেছেন জগদ্বিখ্যাত অসংখ্য মুহাদ্দিস। শুধু এই কিতাবটির ব্যাখ্যাগ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক হবে।
নিম্নে সাহাবী কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মুবারকের প্রশংসায় কয়েকটি বর্ণনা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।

সর্বশ্রেষ্ঠ মুখশ্রী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মানব
হযরত ইসহাক (র.) বর্ণনা করেন, তিনি বারা ইবনে আযিব (রা.) কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠত্ব বলতে শুনেছেন,

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحْسَنَ النَّاسِ وَجْهًا، وَأَحْسَنَهُمْ خُلُقًا، لَيْسَ بِالطَّوِيلِ الذَّاهِبِ، وَلَا بِالْقَصِيرِ

-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুশ্রী চেহারা এবং সুন্দর সৃষ্টি উভয় দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। তিনি খুব বেশি লম্বা ছিলেন না বা খুব খাটো ছিলেন না।

চেহারায় যেন সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হতো
ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে নেওয়া সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী আবূ হুরাইরা (রা.) বলেন,
مَا رَأَيْتُ شَيْئًا أَحْسَنَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَأَنَّ الشَّمْسَ تَجْرِي فِي وَجْهِهِ
-আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাইতে বেশি সুন্দর কোনো কিছুই দেখিনি। মনে হতো তাঁর চেহারায় সূর্য বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

রেশম অধিক মসৃণ দেহ এবং সুগন্ধিময় ঘাম মুবারক
সাহাবীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্যের আধারে হারিয়ে যেতেন। আনাস (রা.) খিদমতে দশ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা করে বলেন,

لاَ مَسِسْتُ خَزًّا قَطُّ وَلاَ حَرِيرًا وَلاَ شَيْئًا كَانَ أَلْيَنَ مِنْ كَفِّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ شَمَمْتُ مِسْكًا قَطُّ وَلاَ عِطْرًا كَانَ أَطْيَبَ مِنْ عَرَقِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ‏.‏

-আমি রেশম এবং পশম মিশিয়ে বানানো কাপড় নিজ হাতে ছুয়ে দেখেছি এবং খাঁটি রেশমী কাপড়ও ছুয়েছি কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতের চেয়ে অধিক নরম ও মসৃণ কোন কিছু স্পর্শ করিনি। আমি মৃগনাভির ঘ্রাণ গ্রহণ করেছি এবং আতরের ঘ্রাণও শুকে দেখেছি,কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীরের ঘামের চেয়ে অধিক সুঘ্রাণ কিছুতেই পাইনি।

পূর্ণিমা চাঁদের চেয়েও মোহনীয় চেহারা মুবারক
উম্মতের মুখে উচ্চারিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌন্দর্য বর্ণনায় চাঁদের থেকে আকর্ষণীয় বলাটা বাড়াবাড়ি নয়। সাহাবী জাবির ইবন সামুরা (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণিমা চাঁদের থেকেও মোহনীয় বলেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার বয়ানে বলেন,

رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي لَيْلَةٍ إِضْحِيَانٍ، وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ حَمْرَاءُ، فَجَعَلْتُ أَنْظُرُ إِلَيْهِ وَإِلَى الْقَمَرِ، فَلَهُوَ عِنْدِي أَحْسَنُ مِنَ الْقَمَرِ

-আমি একবার পূর্ণিমা রাত্রির স্নিগ্ধ আলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লাল চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। তখন আমি একবার তাঁর দিকে ও একবার চাঁদের দিকে তাকাতে থাকলাম। মনে হলো তিনি যেন পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে অধিকতর মোহনীয়।

চেহারা যেনো কুরআন কারীমের মুক্তোঝরা নূর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীর্ঘদিনের খাদিম ও প্রিয় সাহাবী আনাস ইবন মালিক (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পূর্বে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। তখন জামাআতে শরীক হতে পারতেন না। মসজিদে নববীতে আবু বকর (রা.) এর ইমামতিতে সাহাবীরা নামায পড়তেন। আনাস (রা.) বলেন,

إِذَا كَانَ يَوْمُ الاِثْنَيْنِ وَهُمْ صُفُوفٌ فِي الصَّلاَةِ، فَكَشَفَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم سِتْرَ الْحُجْرَةِ يَنْظُرُ إِلَيْنَا، وَهْوَ قَائِمٌ كَأَنَّ وَجْهَهُ وَرَقَةُ مُصْحَفٍ، ثُمَّ تَبَسَّمَ يَضْحَكُ، فَهَمَمْنَا أَنْ نَفْتَتِنَ مِنَ الْفَرَحِ بِرُؤْيَةِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، فَنَكَصَ أَبُو بَكْرٍ عَلَى عَقِبَيْهِ لِيَصِلَ الصَّفَّ، وَظَنَّ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم خَارِجٌ إِلَى الصَّلاَةِ، فَأَشَارَ إِلَيْنَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَنْ أَتِمُّوا صَلاَتَكُمْ، وَأَرْخَى السِّتْرَ، فَتُوُفِّيَ مِنْ يَوْمِهِ‏.

-লোকেরা সোমবারে সালাতের জন্য কাতারে দাঁড়াল,তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুজরার পর্দা উঠিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন,তখন মনে হলো তাঁর চেহারা যেন কুরআনে করীমের পৃষ্ঠা (এর ন্যায় নূর ঝলমল করছিল)। তিনি মুচকি হাসলেন। আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেয়ে খুশিতে প্রায় আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম এবং আবূ বকর (রা.) নবীজিকে কাতারে দাঁড়ানোর জন্য পিছনে সরে জায়গা করে দিচ্ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হয়তো নামাযের জন্য বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ইশারায় জানালেন যে, তোমরা নামায পূর্ণ করে নাও। অতঃপর তিনি পর্দা ছেড়ে দিলেন। সে দিনই তিনি ইন্তিকাল করেন।

কোনো চোখ নবীর চেয়ে সুন্দর কিছু দেখে নাই
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সভাকবি, শাইরুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসসান ইবন সাবিত (রা.) কবিতার ভাষায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৈহিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা করে বলেন,

وَأَحسَنُ مِنكَ لَم تَرَ قَطُّ عَيني
وَأَجمَلُ مِنكَ لَم تَلِدِ النِساءُ
خُلِقتَ مُبَرَّءً مِن كُلِّ عَيبٍ
كَأَنَّكَ قَد خُلِقتَ كَما تَشاءُ

-‘চোখ মোর দেখে নাই আপনার চেয়ে সুন্দর কিছু
কোনো মা জন্ম দেয় নি আপনার চেয়ে সুশ্রী শিশু।
আপনি সৃজিত হয়েছেন নিষ্পাপ-ত্রুটিহীন সাকারে
যেন চেয়েছেন যেমন আপনার মাবুদের দ্বারে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে মর্যাদাবান এবং সবচেয়ে সৌন্দর্যের অধিকারী করে বানিয়েছেন। আমাদের জন্য আবশ্যক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আণিত শরীআত পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রাণাধিক ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসার আলামত হিসেবে উচিত সাহাবীদের মতো তাঁর দেহ মুবারাক সম্পর্কেও জানা,আলোচনা করা। এটা চুড়ান্ত ভালোবাসা ও আনুগত্যের অন্যতম এক নিদর্শন। আল্লাহ যেন আমাদেরকে তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণ, মুহব্বত, সম্মান যথাযথভাবে প্রদান করার তাওফীক দেন। আমীন!

 

ফেইসবুকে আমরা...