1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর চরিত্র হননের জবাব
ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক
  • ১০ অক্টোবর, ২০২২

কিছু কিছু নিরপেক্ষ পাশ্চাত্য বিদ্বান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা করলেও ভ্যাটিকানসহ বিভিন্ন খ্রিষ্টীয় কেন্দ্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে সুবিচার করে নি। এ সিলসিলা আমরা সেই ক্রুসেডের যুদ্ধ থেকেই লক্ষ্য করছি। এরই ফলে পশ্চিমে বারবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ব্যঙ্গ করে পত্র-পত্রিকায় বানোয়াট ছবি ছাপানো হচ্ছে। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যে কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে এসেছে তাতে খ্রিষ্টীয় মহান ব্যক্তিদের নিয়ে মহান সব উক্তি এসেছে।
কুরআনে আছে, ‘আর স্মরণ কর সেই নারীকে (মেরি অর্থাৎ মারইয়ামকে) যে নিজের সতীত্ব রক্ষা করেছিল। তারপর তার মধ্যে আমি (আল্লাহ) আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম। আর তাকে ও তার পুত্র (যীশু অর্থাৎ ঈসা) কে জগদ্বাসীর জন্য এক আয়াত (নিদর্শন) করেছিলাম।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৯১)
‘যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়ামপুত্র ঈসা! স্মরণ কর তোমার ও তোমার জননীর উপর আমার অনুগ্রহ। আমি পবিত্র আত্মা (জিবরাইল অর্থাৎ হলি ঘোস্ট) দিয়ে তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম, আর তুমি দোলনায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতে…।’ (সূরা যুখরুফ, আয়াত-৬১)
‘যখন ফিরিশতারা বলেছিল, হে মারইয়াম! আল্লাহ তো তোমাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন, আর বিশ্বের নারীদের মধ্যে তোমাকে নির্বাচিত করেছেন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৪২)
আল কুরআনের এসব অমীয় বাণী থাকা সত্তেও কিছু খ্রিষ্টান পাদ্রী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যুলম করেছেন। ক্রুসেড ছাড়াও এর আরো একটা কারণ (যা এ যুগে লক্ষ্য করা যাচ্ছে) হলো, কিছু কিছু মুসলমান বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ (যাদের মুরতাদই বলতে হয়), যেমন কামাল রুশদী, ইরশাদ মানজি (কানাডীয় তথাকথিত মুসলমান মহিলা, যিনি লিখেছেন ইসলাম-বিদ্বেষী বই ‘দি ট্রাবল উইথ ইসলাম’) ইসলাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ‘নেগেটিভ’ কথাবার্তা বলায় ও লেখায়, পশ্চিমী মতলববাজরা লাই পেয়ে গেছে। কথায় বলে একে তো নাচুনি বুড়ি, তার উপরে ঢোলের বাড়ি। ফলে অখ্যাত জার্মান প্রফেসরের মতো কেউ কেউ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘ক্যারেকটার এসাসিনেসন’ এ নেমেছে। তারা মনে করে যে, ইসলামের নবীকে ‘আউট’ করতে পারলে, ইসলামই ‘আউট’ হবে, তখন খ্রিষ্টবাদ, পুঁজিবাদ, কম্যুনিজম ও নানা মতবাদের জন্য মুসলিম দুনিয়া তাদের নিকট নুয়ে পড়বে। আসলে খ্রিষ্টধর্ম পশ্চিম গোলার্ধ, আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো, এমনকি বৌদ্ধ-হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাতে আসর জমাতে পারলেও মুসলিম এলাকাতে এসে হোঁচট খেয়ে পড়ছে। তাই তারা মুসলমানদের অতি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘ক্যারেকটার এসাসিনেসন’ করে তাঁর অনুসারীদেরকে নতজানু করতে চায়। কমান্ডার নিহত তো সিপাহীও আর মাঠে থাকবে না।
কিছু খ্রিষ্টান ভাই আমাদের মনে এভাবে আঘাত দিলেও, আমরা তাদের নবীকে (বা যাকে তারা গড বলে) ‘হিটব্যাক’ করতে পারছি না, শুধু আমরা চোখের পানিতে ভাসছি। যীশু অর্থাৎ হযরত ঈসা (আ.) ও তাঁর পুণ্যবতী মা মাদার মেরি অর্থাৎ হযরত মারইয়াম (আ.) আমাদেরও খুবই প্রিয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যুদ্ধবাজ বলা হলে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের বিশেষ করে ‘জুশুয়া’ পরিচ্ছেদ পড়–ন। সেখানে বাইবেলের যুদ্ধনীতি হলো, শ্বাসবিশিষ্ট কোনো কিছুকে বাঁচতে দেওয়া হবে না। যীশুকে ‘নন-ভায়োলেন্ট’ বলা হলেও, যীশু গ্রেফতারের আগে শিষ্যদের বলেন, ‘যার তলোয়ার নেই, সে যেন তার আলখিল্লা বেঁচে তলোয়ার কেনে’ (লুক : ২২ : ৩৬)। আর যীশু যখন ভবিষ্যতে দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আসবেন তিনি সাদা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করবেন।
কিছু খ্রিষ্টান লেখক ও পাদ্রী অপবাদ দিয়েছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভন্ড নবী (নাউযুবিল্লাহ)। তিনি নাকি বাইবেল থেকে চুরি করেছেন কুরআন। আধুনিক গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন যে, বাইবেলের অবৈজ্ঞানিক লাইনগুলো কুরআনে নেই। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসব বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রমাণ করার কোনো সুযোগ ছিল না। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো সম্পূর্ণ নিরক্ষর ছিলেন। সেলের ইংরেজি তরজমা করা কুরআনের ব্যাখ্যায় ও পাদ্রী ই এম হুয়েরীর ‘এ কমপ্রিহেনসিভ কমেন্টারি অন দি কুরআন’ (তিন খন্ড) বইয়ে বারবার বলা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইমসটার’ (ভন্ড); তিনি নাকি নিজেকে নবী বলে কপটতা, ভান (প্রিটেন্ড) করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। ড. মরিস বুকাইলি প্রমাণ করেছেন যে, বাইবেলে রয়েছে অজস্র ভুল ও অবৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত¡, অথচ কুরআনে একটাও নেই। তাহলে কপটতা কোথায়? একটা বিষয় আর কুরআন মাজীদের রচয়িতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নন; স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো হাত নেই এতে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মূল বাইবেল তথা ইঞ্জিল শরীফে কোনো ভুল নেই যেহেতু এটি আসমানী কিতাব। গবেষকদের কাছে বাইবেলের এ ভুল মূলত: বাইবেল বিকৃত করার কারণে ধরা পড়েছে।
কিছু কিছু খ্রিষ্টান লেখক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বৈবাহিক ও যৌনজীবন নিয়ে সম্পূর্ণ অনৈতিক ও ভিত্তিহীন অপবাদ দেয়। উল্লেখ্য যে, ইসলামের বৈবাহিক-যৌন বিষয় খ্রিষ্টানদের মতো নয়। আধুনিক খ্রিষ্টানরা বিয়ে, বিধবা বিবাহ, তালাক, বহুবিবাহ সবকিছুকে নিরুৎসাহিত করে। রোমান ক্যাথলিক পাদ্রীরা বিয়েকে খারাপভাবে দেখে। অথচ বাইবেলে উল্লেখিত প্রায় প্রত্যেক নবী বিয়ে করেছেন, কখনো কখনো একের অধিক। তাঁদেরও অনেকের বর-কনের অনেক তফাৎ ছিল বয়সে। ৮৬ বছর বয়সে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর প্রথম স্ত্রী হযরত হাজিরা পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কে প্রসব করেন (বাইবেল, আদিপুস্তক ১৬ : ১৬)। হযরত হাজিরার বয়স হযরত ইবরাহীম (আ.) এর চেয়ে বহু কম ছিল। হযরত ইবরাহীম (আ.) এর তিন জন স্ত্রী ছিলেন। হযরত দাউদ (আ.), তাঁর পুত্র হযরত সুলাইমান (আ.) এর একের অধিক স্ত্রী ছিল। হযরত ঈসা (আ.) বিবাহ করতে পারেন নি। কারণ তিনি সে সময় পাননি। স্বজাতি কাফির-মুশরিকদের ষড়যন্ত্র মুকাবিলায় তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়িশাকে বাল্য বয়সে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা ছিল সর্বমোট ১২। তবে তিনি ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছরের বিধবা মহিলা হযরত খাদিজা (রা.) কে বিয়ে করে তাঁর সঙ্গে ঘর-সংসার করলে তাঁর ৫০ বছর বয়সে স্ত্রী বিয়োগ হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খাদিজার সন্তানদের দেখার জন্য এ সময় তাঁর চেয়ে বড় হযরত সাওদাকে বিয়ে করলেন।
এদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অতি প্রিয় ব্যক্তি হযরত আবূ বকর কোনো না কোনোভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক চাইছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে অমত করলেও হযরত আবূ বকরের অতি পীড়াপীড়িতে হযরত আয়িশাকে তাঁর বালিকা অবস্থায় বিবাহ করেন, তবে হযরত আয়িশা সাবালিকা হলে পরে স্বামীর ঘরে যান। এতদিন তিনি তাঁর পিতার ঘরেই থাকেন। উল্লেখ্য যে, একমাত্র হযরত আয়িশা ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সব স্ত্রীই বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা ছিলেন। বদরের যুদ্ধের শহীদ হযরত উবাইদাহর বিধবা স্ত্রী হযরত যাইনাব বিনতে খুযাইমাকে তাঁর ৬০ বছর বয়সে মানবিক কারণে তিনি বিবাহ করেন। পালকপুত্র সম্পর্কে কুপ্রথা, কুসংস্কার বন্ধে আল্লাহর নির্দেশে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ফুফাতো বোন হযরত যাইনাব বিনতে জাহাশকে বিবাহ করেন। ইতিপূর্বে যাকে বিবাহ করেছিলেন তাঁর পালকপুত্র যাইদ।
উহুদ যুদ্ধের শহীদ হযরত আব্দুল্লাহ বিন আবদুল আসাদের বিধবা স্ত্রী উম্মে সালামাকে তাঁর চার ইয়াতীম বাচ্চার দায়িত্ব গ্রহণসহ মানবিক কারণে বিবাহ করেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আবিসিনিয়াগামী মুহাজির হযরত উবাইদুল্লাহ বিন জাহাশের বিধবা স্ত্রী এবং মক্কার দলপতি আবূ সুফিয়ানের কন্যা হযরত উম্মে হাবীবাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবাহ একটা উঁচুস্তরের হিকমত ছিল। একজন প্রধান শত্রæ এতে মিত্রে পরিণত হলো। হযরত জুয়াইরিয়া ছিলেন মুসতালিক গোত্রপতির কন্যা, তেমনিভাবে হযরত সাফিয়া ইয়াহুদী বনী নযীর ও কুরাইযা গোত্রের নেতার কন্যা। রাজনৈতিক কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুজনকে বিবাহ করেন। হযরত মারিয়া কিবতি মিশর অধিপতির মেয়ে ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিবাহ না করতে চাইলে, হযরত মারিয়া দেশে ফিরে যেতে চান, তা হতো কূটনৈতিক বিপর্যয়। অতঃপর রাজনৈতিক পররাষ্ট্রনৈতিক কারণে তিনি তাঁকে বিবাহ করেন। সর্বশেষ বার নম্বর পত্নী হলেন বৃদ্ধা বিধবা হযরত মাইমুনা।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বেশিরভাগ বিবাহ হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরী থেকে অষ্টম হিজরী পর্যন্ত অর্থাৎ মক্কা বিজয় পর্যন্ত, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তুমুল যুদ্ধবিগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। এই বিবাহগুলো তাঁর প্রাথমিক জীবনে, যখন তিনি যুবক ছিলেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন তখন হয়নি। আসলে সামাজিক, মানবিক, রাজনৈতিক, পররাষ্ট্রনৈতিক ও নানা কারণে যেমন- তাবলীগ, দ্বীনি শিক্ষা প্রচার ইত্যাদির কারণে তাঁকে এসব বিয়ে করতে হয়। কুলাঙ্গার সালমান রুশদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাড়ি নিয়েও কটুক্তি করেছে। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাড়ি ছিল একটা একাডেমিক যেখানে ছিল দুইটা শাখার একটা পুরুষদের, অন্যটা মহিলাদের। মহিলাদের শাখার প্রকৃত প্রধান ছিলেন হযরত আয়িশা (রা.)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের পরেও এই দ্বীনী একাডেমি চালু ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের বহু বৈশিষ্ট্য আমরা নবী-পত্নীদের নিকট থেকে পেয়েছি, যা হাদীসের কিতাবগুলোতে বিস্তারিত এসেছে। হযরত আয়িশা (রা.) কে বাল্য বয়সে বিবাহ করায় কোনো কোনো পশ্চিমী বুদ্ধিজীবী বাল্যবিবাহ রোধের চিন্তায় সমালোচনা করে থাকেন। অথচ হযরত আয়িশার বিবাহ বাল্য বয়সে হলেও তিনি পিতার ঘরেই ছিলেন। সাবালিকা হলে স্বামীর ঘরে যান। হযরত আয়িশা কোনোদিন আফসোস করেন নি তাঁর স্বামীর বয়স নিয়ে। বরং একবার মিথ্যা প্রচারণায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে তালাক দেওয়ার চিন্তা করলে, তিনি (হযরত আয়িশা) তা শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালে বিদূষী হযরত আয়িশা স্বামী বিরহে কবিতা লেখেন যা ছিল কতকটা এ রকম-
মিশরের মেয়েরা হযরত ইউসুফের সৌন্দর্য দর্শনে
তাদের আঙ্গুল কেটেছিল
তারা যদি আমার প্রেমিকের চরিত্র মাধুর্য দেখত,
তাহলে তারা তাদের হৃদয় কেটে ফেলত।
কোনো বালিকাবধূ তাঁর পৌঢ় স্বামীর বিরহে কখনো কি এমন কবিতা লিখেছেন? কেন বাল্যবিবাহ নিয়ে এতো টানাটানি? বাল্যবিবাহ নিয়ে ইসলাম যা বলে, তাই খাঁটি। প্রয়োজন থাকলে হবে, না থাকলে হবে না। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রামিনী সারাহ পলিনের নাবালিকা মেয়েকে বিবাহ করতে না দেওয়ায় সে বিবাহের আগেই মা হলো। পাশ্চাত্যের কেউ কেউ বলে, বিনা বিবাহে মা হওয়া ভালো, তবু বাল্য বিবাহ চলবে না। বালিকা মাতা চলবে, বালিকাবধূ চলবে না। অথচ ইসলামের বালিকাবধূ সাবালিকা হলে তার বিবাহ বাতিল করতে পারে প্রয়োজনে, তবে বাল্য বয়সে বিবাহ বাতিল হবে না। কারণ, বালিকার মঙ্গল চিন্তা করেই বাবা-মা বা অভিভাবক এই বিয়ে করে দিয়েছেন। সম্রাট আকবর, মহাত্মা গান্ধী, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- সবারই বালিকাবধূ ছিল। ইসলাম বা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হেয় প্রতিপন্ন করতেই বালিকাবধূ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়। অথচ ‘গ্যাং রেপ’, ধর্ষণের পর হত্যা, নারীদের ধরে নিয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োগ, ইন্ডিয়া ও চীনে নারী-ভ্রুণ হত্যা- এগুলো নিয়ে ইসলাম বিরোধীরা তেমন কিছু বলে না। ইসলামে বিবাহ সহজ কিন্তু ব্যভিচার কঠিন। ব্যভিচারের শাস্তি প্রাণতন্ড।
ইসলাম নারীকে সঠিক মর্যাদা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও নেপালে হিনউদ রাজাদের মৃত্যুতে রাজার একের বেশি বিধবা রাণীকে জ্বলন্ত চিতায় পোড়ানো হতো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবে কন্যাশিশু হত্যাপ্রথা চিরতরে দমন করেন। এক পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবী মন্তব্য করেছেন যে, নবীর বাণী- বেহেশত মায়ের পায়ের নিচে- এ বাণী আমি কোনোদিন ভুলবো না, এ এক মহান বাণী।
খ্রিষ্টীয় নারী ও যৌন নীতিতে রয়েছে স্ববিরোধিতা। যৌনতাকে খারাপ মনে করে রোমান ক্যাথলিক পাদ্রীরা বিয়ে করে না, তবে তারা প্রায়ই সমকামী। ইসলাম বাস্তববাদী, যুক্তিগ্রাহ্য ধর্মীয় মতবাদ। ইসলাম মধ্যমপন্থার ধর্ম, বাড়াবাড়ির ধর্ম নয়। একশ্রেণির তথাকথিত ধার্মিকদের বৈরাগ্য ইসলামে নেই, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের যৌন উন্মত্ততাও নেই। ইসলাম মানুষকে স্বাভাবিক, ভালো মানুষ হিসেবে চায়। বিভ্রান্ত ও ছোট মনের কিছু পাশ্চাত্যবাসী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অযথা সমালোচনা করলেও পাশ্চাত্যের বেশ কিছু জ্ঞানী ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসায় উচ্ছসিত। ফরাসি ইতিহাসবিদ আলফ্রেড দে লা মার্টিন তার ‘হিস্টরি অব টার্কি’ বইয়ে লিখেন, ‘উদ্দেশ্যের মহত্ত¡, উপায়-উপকরণের স্বল্পতা এবং বিস্ময়কর সফলতা যদি এই তিনটি বিষয়ই মানব প্রতিভার মানদন্ড হয়, তাহলে ইতিহাসের জন্য কোন মহামানবকে এনে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তুলনা করবে, এমন সাহস কার আছে? দার্শনিক, বক্তা, ধর্মপ্রচারক, যোদ্ধা, আইন রচয়িতা, ভাবের বিজয়কর্তা, যুক্তিপূর্ণ মতবাদের ও প্রতিমাবিহীন ধর্ম পদ্ধতির পুণ:সংস্থাপনকারী, কুড়িটি পার্থিব সাম্রাজ্যের এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, দেখ এই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। মানুষের মহত্তের যতগুলো মাপকাঠি আছে তা দিয়ে মাপলে কোন লোক তাঁর চেয়ে মহত্তর হতে পারে?’
একজন খ্রিষ্টান মনীষী এমন মহান মন্তব্য করলেও কিছু মুসলমান হতভাগা এ মহামানবের আদর্শকে ভ্রুকুটি করে অন্যসব বাতিল, মিথ্যা মতবাদের কারণে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনী পাঠ করলে দেখা যায় ভালো ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও, তিনি অল্প বয়সে ইয়াতীম হয়ে যান। চৌদ্দ (মতান্তরে পনের বা বিশ) বছর বয়সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচাদের সঙ্গে ফুজ্জার যুদ্ধে নামমাত্র অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু তিনি কাউকে আঘাত করেন নি। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে তিনি স্বল্প পরিচিত শান্তি সংগঠন ‘হিলফুল ফুযুল’ কে শক্তিশালী করেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি ধনাঢ্য বিধবা মহিলা ব্যবসায়ী হযরত খাদিজার ব্যবসা দেখাশোনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গুণের জন্য তাঁর নাম এ সময় হয় ‘আল-আমীন’- বিশ্বস্ত। এ মহিলাই তার প্রথম স্ত্রী হন। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি চিন্তাশীল হয়ে হেরা পর্বতের গুহায় ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। দেশবাসীর প্রবল বিরোধীতায় তিনি ৫৩ বছর বয়সে তাঁর শহর মক্কা ছেড়ে মদীনাতে গেলেন, মদীনা সনদের মাধ্যমে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, যা পরবর্তীতে শুধু মক্কা নয়, রোমান ও পারসিকদের সফল প্রতিদ্ব›দ্বীতে পরিণত হলো। তিনি সমগ্র আরব ও আরববাসীকে সম্পূর্ণরূপে সমৃদ্ধির দিকে বদলে দেন। তিনি শুধু ইসলাম ধর্মই নয়, মানবীয় যা কিছু ভালো, তা প্রতিষ্ঠিত করলেন। মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুকন্যার অধিকার, দাস-দাসীর অধিকার, বিধর্মীদের অধিকার, বন্দীর অধিকার, হতদরিদ্রদের অধিকার, সঠিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিকনীতি, পররাষ্ট্রনীতি সবই প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর অবদানে শিশুকন্যা হত্যা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। বর্ণবাদ, মাদক নিষিদ্ধ হলো। যুদ্ধে নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ধর্মীয় ব্যক্তিগণের হত্যা নিষিদ্ধ হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সমগ্র আরবের শাসক। অথচ তাঁর ঘরে দিনের পর দিন চুলা জ্বলতো না। তাঁর প্রাসাদ ছিল জীর্ণ কুটির। ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে তিনি অর্থনীতি ও রাজনীতিকে সমান গুরুত্ব দেন। ধনীর সম্পদে গরীবের হক নির্দিষ্ট করেন। ধনীর সম্পদে শতকরা আড়াই ভাগ অংশ গরীবের হক বলে সিদ্ধান্ত হলো রোজ কিয়ামত পর্যন্ত। যুদ্ধ তিনি করেছেন, তবে তা কখনই হিটলার, চেঙ্গিসের মতো নয়। তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত বহু পরের সালাহুদ্দীন আইয়ুবীকে তো পাশ্চাত্য চেনে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতো লক্ষ সালাহুদ্দীনের সমাহার ছিলেন। সুতরাং এ নবীর চরিত্র হননের অপচেষ্টা করলেও পশ্চিমারা কি সফল হবে? অবশ্যই না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুমহান মর্যাদা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিবেকবান ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের অন্তরে প্রোথিত আছে, থাকবেও অনন্তকাল।

ফেইসবুকে আমরা...