1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
হজ্জের খরচ বৃদ্ধি : প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
হামিদ মাশহুর
  • ৬ এপ্রিল, ২০২৩

নির্দিষ্ট সংখ্যক হজ্জযাত্রীর কোটা পূর্ণ না হওয়ায় চতুর্থ দফা নিবন্ধনের সময় বাড়িয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। করোনা মহামারীর কারণে গত কয়েকবছর হজ্জ যাত্রার সুযোগ সীমিত থাকায় এবার বাংলাদেশ থেকে হজ্জযাত্রীর সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু চারবার মেয়াদ বাড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক পূণ্যার্থী জোগাড় হয়নি এখনো। বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক সংগতি কি তাহলে নিম্নমুখী? আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি তো ভিন্ন কথাই বলে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নিম্নমুখীতার এই সময়েও আমরা ‘সুসংহত অর্থনীতি’-এর অধিকারী বলে আমাদের কর্তাব্যক্তিরা আশ্বস্ত করেন। তাহলে এক লাখ সাতাশ হাজার হজ্জযাত্রী নিবন্ধনের জন্য সরকারকে কেন চারবার সময় বৃদ্ধি করতে হয়? এর জবাব পেতে বিগত বছরের হজ্জ যাত্রার খরচের সাথে এবারের খরচের তুলনা আমাদের দেখতে হবে; দেখতে হবে অন্যান্য দেশের হজ্জ প্যাকেজের সাথে আমাদের তুলনাও।

বাংলাদেশ থেকে ২০২৩ সালে হজের জন্য সরকারিভাবে হজ্জ প্যাকেজ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি খরচ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের দেওয়া তথ্যমতে গত বছরের তুলনায় টাকার অংকে হজ্জ প্যাকেজে বৃদ্ধি পেয়েছে দেড় লাখ থেকে ২ লাখ ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর ২০২০ সালের হজ্জ প্যাকেজের তুলনায় খরচ বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ! আমাদের নীতিনির্ধারকরা তিন বছরে দ্বিগুণ খরচ বৃদ্ধির দায় চাপাচ্ছেন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সৌদি আরবে খরচ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদির উপর। আমাদের সত্যবাদী কর্তাব্যক্তিদের ব্যাখ্যাতে বিশ্বাস রেখে হজ্জ্বের খরচ বৃদ্ধির জন্য এমবিএস, পুতিন, বাইডেনদের দায়ী করে স্বস্তিবোধ করতে পারতাম। কিন্তু আশেপাশের দেশসমূহ থেকে হজ্জের খরচ জানার পর এই স্বস্তিবোধটাই উধাও হয়ে গেছে।

আমাদের মিডিয়া যাদেরকে ‘দেউলিয়া রাষ্ট্র’ বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সে পাকিস্তান থেকে হজ্জের খরচ বাংলাদেশী মুদ্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার কিছু কম। আর ভারতে এ খরচ চার লাখ থেকেও কম হবে বলে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে। ইন্দোনেশিয়াতে এবার হজ্জের খরচ প্রায় সাড়ে তিন লাখ আর মালয়েশিয়াতে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। হজ্জ পালনে বাংলাদেশের মানুষ যে শুধু ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে বেশি খরচ করছেন তা নয়, বরং ছাড়িয়ে গেছেন সিঙ্গাপুরকেও। সেখানের হজ্জের সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছে ছয় লাখ ষাট হাজার টাকা। বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, কানাডা ইত্যাদি দেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে ক্ষমতাসীরা যে প্রায়ই দাবী করেন তা যে একেবারে ভিত্তিহীন নয় তা হজ্জের পরিসংখ্যানই বলে দিবে। পার্শ্ববর্তী এসব দেশে খরচ এতো কম হলেও বাংলাদেশে এতো বেশি কেন এর জবাবে দৈনিক ইত্তেফাককে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বলেছেন- তারা কিভাবে কম করছে আমাদের জানা নাই। মডার্ণ পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনে প্রতিটা দেশই নিজেদের সেবার মান বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য দেশের ‘বেস্ট এক্সাম্পল’ গুলো ভালো মত জেনে তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। আমাদের কর্তারাও সাঁতার শেখানো কিংবা খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণ নিতে সদলবলে বিদেশ সফর করেন। তবে হজ্জ যাত্রায় পাশের দেশগুলো থেকে দ্বিগুণ প্রাইস ট্যাগ বসিয়েও আমাদের মান্যবর আমলা মহোদয় সেসব বেস্ট এক্সাম্পল সম্পর্কে ‘জানি না’ বলায় অবাক হওয়ার কিছু নাই। ‘স্যার’ ডাকার দলীল হিসেবে ওসব দেশকে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায়, খরচাপাতিতে তো আমাদের উদাহরণ সব সময়ই আরবের শেখরা!

সে আমলা না জানলেও পাশের দেশগুলো কিভাবে হজ্জের খরচ কমাচ্ছে এটা খুব জটিল কোন হিসাব নয়। বছরের অন্যান্য সময় ঢাকা থেকে জেদ্দার আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়া এক লাখের কম হলেও হজ্জ মৌসুম উপলক্ষে তা দুই লাখ টাকা করা হয়েছে। সারা বছর লোকসান গুণা বিমান বাংলাদেশ হজ্জের মওসুমকে ব্যবসার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে লুফে নেয়। হজ্জ ফ্লাইটে বিমান বাংলাদেশকে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়ায় বিমান ভাড়ায় এমন অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বেশি বেশি এয়ারলাইন্সকে সুযোগ দিয়ে পরিপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বাজার তৈরি করতে পারলে বিমান ভাড়া কমতো নিঃসন্দেহে। কিন্তু বৈশ্বিক এয়ারলাইন্সগুলার সাথে সারা বছর ব্যবসায় গোল খাওয়া বিমানকে হজ্জযাত্রীদের পকেট কেটে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। গত বছর বিমান ভাড়া এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ৬ বছরের হজ্জের বিমান ভাড়া ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। হজ্জকে সামনে রেখে আমাদের সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমানের এহেন ভাড়া বৃদ্ধির মাধ্যমে সারা বছরের লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার প্রবণতা কী কারণে সরকারের ধর্মব্যবসা বলে গণ্য করা যাবে না তা উৎসুক মানুষ জানতে চাইতেই পারেন। অবশ্য এ প্রবণতাকে রামাদান মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতার সাথেও তুলনা করা যায়। সারাবিশ্বে রামাদান, হজ্জ, ঈদ ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতা থাকলেও এদেশে চলে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। ধর্মীয় উপলক্ষকে কেন্দ্র করে রমরমা ব্যবসা করা সরকার, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবীদ কাউকেই ধর্মব্যবসায়ী বলা যাবে না, এ ট্যাগ শুধু তখনই ব্যবহার করা যাবে যখন হজ্জের খরচ কমানোর জন্য কোন আলিমের নেতৃত্বে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ আন্দোলনে নামবে।

হজ্জের খরচ কমানোর আরো একটি সহজ উপায় সরকার কর্তৃক ভর্তুকি প্রদান। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ নানা রাষ্ট্র তাদের হজ্জযাত্রীদের খরচে বড় ধরনের সরকারি ভর্তুকি প্রদান করে। বহুকাল ভারতেও এরকম ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকলেও ২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদীর উগ্রহিন্দুত্ববাদী সরকার তা বন্ধ করে দেয়। নানামুখী চাপের মুখে এ বছর ভারত সরকার প্রত্যেক হাজীর জন্য এক লাখ রুপী ভর্তুকি দিবে বলে নানা গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ভর্তুকির মাধ্যমে হজ্জযাত্রীদের খরচ কমানোর দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এ ব্যবস্থা নতুন কিছু নয়। উসমানী, মুঘলসহ আরো নানা সাম্রাজ্যেও এ চর্চা ছিলো।

শুধু হজ্জ যাত্রাই নয় যেকোন ধরণের তীর্থযাত্রায়ই নানা রাষ্ট্র ভর্তুকি প্রদান করে। এসব ভর্তুকিতে হজ্জযাত্রীদের খরচ লাঘব কতটুক হয় তা মুখ্য নয়, মূল বিষয় হলো এর মাধ্যমে এই পূণ্যক্ষণে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তার জনগণকে শুভেচ্ছা জানানো; জনগণের আবেগ, অনুভূতি, বিশ্বাসের সাথে রাষ্ট্রের একাত্মতা প্রকাশ। ইসলামের খিদমতে নিযুত সংখ্যক কাজ করার দাবিদার আমাদের রাজনৈতিক মহলের কোন অংশ থেকে কখনো হজ্জযাত্রায় ভর্তুকি দেওয়ার দাবি উঠেছিলো কী না আমার জানা নাই। তবে ভর্তুকির পরিমাণ যে প্রায় শুন্য তা মোটামুটি নিশ্চিত। অসংখ্য মেগা প্রজেক্টে হাজার কোটি টাকার ছড়াছড়ির মাঝে এদেশের পনেরো কোটি মুসলমানের বিশ্বাসকে সম্মান করে হজ্জের জন্য অল্প কিছু ভর্তুকি দিলে সরকারি তহবিল খালি হয়ে যেতো না, রিজার্ভ এক অংকে নেমে আসতো না। কিন্তু আমাদের সরকারি কর্তৃপক্ষ জনগণের এই অনুভূতিকে সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তিলে তিলে টাকা জমিয়ে হজ্জে যাওয়ার স্বপ্নে অগ্রীম নিবন্ধন করা হাজারো মধ্যবিত্তকে শেষ মুহূর্তে এসে ভাঙা হৃদয়ে নিবন্ধন প্রত্যাহার করতে হয়েছে।

এদেশে সরকারি অনুদান, বরাদ্দ, ভর্তুকি বড় আজব রঙের। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের হরেক রকমের পূজায়, খিষ্টানদের বড়দিনে, উপজাতিদের সাংগ্রাই, বিজু, বৈসুক, সোহরাইতে সরকারি বরাদ্দের ছড়াছড়ি আমাদের প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে। সংখ্যালঘুদের এমন কোন উৎসব নাই যে উৎসবে একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বরাদ্দ পৌছে দেওয়া হয় না। সংখ্যালঘুদের অধিকার সচেতন সরকার এসব বরাদ্দ দিতেই পারে। আমার কেবল জানতে মন চায় বছরে দুইবার আমি যেই ঈদগাহে নামায পড়তে দাঁড়াই সে ঈদগাহ মাঠ পরিস্কারে ‘আমার’ সরকার কেন কোনদিন এসে পাশে দাঁড়ায় না! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশ সরকারের মতো ভাগ্যবান সরকার দুনিয়ায় কমই আছে। এখানে নব্বই ভাগ জনতার ধর্ম, আবেগ, বিশ্বাস সংরক্ষণে সরকারকে ‘প্রায় কিছু না করেই’ ফাঁকা বুলির মাধ্যমেই জনগণকে ভুলিয়ে রাখা যায়। এদেশের সবুজ প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ মসজিদের এক শতাংশও সরকার করে দেয়নি, মানুষ করেছে। ইমাম, মুআযযিনদের খরচও যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষ চালাচ্ছে। হাজারো লাখো ইয়াতীমকেও সাধারণ মানুষই লালন পালন করছে। কোটি কোটি মুসলিম শিশুর অতি আবশ্যক দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা ও কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষাতেও নেই সরকারের উল্লেখযোগ্য প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা। এগুলোও শিশুদের বাবা-মা নিজ উদ্যোগে মক্তবে, দারুল কিরাতের মাধ্যমে শিক্ষা দেন। এতো কিছু না পাওয়ার গল্প আমরা ভুলে যাই মডেল মসজিদের ছবি দেখে। আমরা তাই সরকার বাহাদুরের প্রতি শ্রদ্ধায় বিগলিত হই; আমাদের উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের নির্ধারিত ‘সুলভ’ দ্রব্যমূল্য পরিশোধ করে অসাম্প্রদায়িক পেটুকদের উদরপূর্তি করি; আমাদের হজ্জ যাত্রায় বিমান বাংলাদেশের পকেটভর্তি করি।

হারামাইনে লাব্বাইক বলার জন্য বেকারার এদেশের সাধারণ মুসলমানের সাধ্যের মধ্যে হজ্জের খরচ রাখতে সকল সচেতন মহলের সোচ্চার ভূমিকা কাম্য। পাশের দেশগুলো থেকে দ্বিগুণ কেন আমরা খরচ করব এর সঠিক জবাব সরকারের কাছ থেকে আদায় করা অত্যন্ত জরুরি। এটা কি নিছকই মূল্যবৃদ্ধি আর অতি মুনাফার প্রবণতা থেকেই হচ্ছে, না কি কোন বিশেষ মহল এদেশের মুসলমানদের হজ্জযাত্রার রাশ টেনে ধরতে পরিকল্পিতভাবে বছর বছর খরচ বৃদ্ধি করছে তাও খতিয়ে দেখার বিষয়। প্রতিনিয়ত খরচবৃদ্ধি চলতে থাকলে অতি শীঘ্রই হজ্জ উচ্চ মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

হজ্জের খরচ কমানোর দাবি চারিদিক থেকে উচ্চারিত হলেও সরকারের কাছে তা খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। তবে কিছুদিন আগে খরচ ১১ হাজার টাকা কমেছে শুনে ভেবেছিলাম সরকার মনে হয় বিমান ভাড়া কমিয়েছে অথবা ভর্তুকি দিয়েছে। এমাউন্টটা এতো অল্প দেখে কষ্টও পেয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো এই এগারো হাজার আসলে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে খরচ কমানোর কোন উদ্যোগ না, বরং সৌদি আরব সরকার কোন এক খাতে কিছুটা কমিয়েছে, ঠিক সেটাই সারা বিশ্বের হাজীদের মতো আমাদের জন্যও কমেছে। আর এই খবরই টুইস্টেড করে আমাদের দেশপ্রেমিক ফেইসবুক এক্টিভিস্টদের সে কী আহ্লাদ! এতদ্দর্শনে আমি বলি- মরিতে চাহিনা এই সুন্দর বঙে, তোষামোদের রং-সং দেখিবার চাই।

ফেইসবুকে আমরা...