1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
হযরত হাসান ইবন আলী (রা.)
মারজান আহমদ চৌধুরী
  • ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

৩য় হিজরীর রামাদান মাসে আলী-ফাতিমা (রা.) দম্পতির ঘরে প্রথম সন্তান জন্ম নিলেন। ভালোবাসায় অভিভূত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাতির নাম রাখলেন হাসান। (সিয়ারু আলামিন নুবালা)
হাসান তাঁর পুরো জীবনজুড়ে যতটা না আলী-ফাতিমা (রা.) এর সন্তান ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে দাঁড়িয়েছেন, হাসান জায়নামাযে বসা। রুকু দিচ্ছেন, তো হাসান নানার কাপড় বেয়ে উঠতে ব্যস্ত। সিজদাহ দিচ্ছেন, তো হাসান নানার কাঁধে ঘোড়া চড়ছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদাহ দীর্ঘ করলেন। নামায শেষে বললেন, হাসান আমার কাঁধের উপর চড়ে বসেছিল। তার স্বাদ পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করলাম। এভাবেই কেটে গিয়েছিল বাল্যকাল।
সীরাত-সুরতে হাসান (রা.) ছিলেন নানার উপমা। আনাস (রা.) বলেছেন, হাসান ইবন আলীর চেয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কেউ ছিলনা। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৫৪২)
ফাতিমা (রা.) ছেলের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলতেন- ওহ বাবা! এ তো আলীর ছেলে নয়। এ তো তার নানার ছেলে! খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-

هذان ابناي وابنا ابنتي اللهم اني احبهما فاحبهما واحب من يحبهما

-এ দুটি আমার বাচ্চা এবং আমার কন্যার বাচ্চা। হে আল্লাহ! আমি এদেরকে ভালোবাসি, তুমিও এদেরকে ভালোবাসো। যে এদেরকে ভালোবাসে, তাকেও তুমি ভালোবাসো। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৭৩১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাতিদ্বয়কে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। বারা ইবন আযিব (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি হাসানকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাঁধের উপর দেখেছি। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন- اللهم إني أحبه فأحبه -হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালোবাসি। তুমিও তাকে ভালোবাসো। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৪২২)
ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসানকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। লোকজন হাসানকে বলত, কত উত্তম হাসানের বাহন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, কত উত্তম আমার কাঁধের আরোহী! (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)
একটু সময় নাতিদ্বয় চোখের আড়াল হলেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠত। আবূ হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বাজার থেকে এসে ফাতিমা (রা.) এর ঘরের আঙিনায় গেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডাক দিলেন- ও আমার বাচ্চারা! ও আমার বাচ্চারা! কেউ বাইরে আসছেনা দেখে তিনি আঙিনায় বসে পড়লেন। একটু পর হাসান বেরিয়ে আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে পরপর তিনবার বললেন- إني أحبه وأحب من يحبه -আমি একে ভালোবাসি। আর যে তাকে ভালোবাসে, আমি তাকেও ভালোবাসি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৪২১)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা (রা.) কে বলতেন, আমার বাচ্চাদেরকে ডাকো। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে নাক দিয়ে শুকতেন এবং বুকে চেপে ধরতেন। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৭৭২)
সাহাবায়ে কিরামের চোখে হাসান (রা.) এর অনুপম মর্যাদা ছিল। একবার আবূ বকর (রা.) আলী (রা.) এর সাথে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হাসান (রা.) কে দেখে আবূ বকর (রা.) তাঁকে কাঁধে নিয়ে বললেন-

بأبي شبيه بالنبي ليس شبيه بعلي وعلي يضحك

ওহ বাবা! এ তো নবীর সাদৃশ্য। আলীর সাদৃশ্য নয়! রাবী বলেন, এ কথা শুনে আলী (রা.) হাসলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৫৪০)
উমর (রা.) বাইতুল মাল থেকে হাসান (রা.) কে বদরী সাহাবীদের সমান ৫ হাজার দিরহাম ভাতা দিতেন। যদিও বদর যুদ্ধের সময় হাসান (রা.) এর জন্মই হয়নি। উসমান (রা.) খারিজীদের দ্বারা গৃহবন্দী থাকাকালীন হাসান (রা.) গলায় খোলা তরবারি ঝুলিয়ে খলীফার পাহারায় রত ছিলেন। উসমান (রা.) এর মনে আশঙ্কা লেগেই থাকত, না জানি আমাকে বাঁচাতে গিয়ে হাসানের কিছু হয়ে যায়। শাহাদাতের দিন তিনি জোর করে হাসান (রা.) কে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও মূল আক্রমণের আগে হাতাহাতির দরুণ হাসান (রা.) গুরুতর আহত হয়েছিলেন। আলী (রা.) হাসান-হুসাইনকে খুব সম্মান করতেন। তিনি বলতেন, এ দুজন আমার নবীর সন্তান। একদা আলী (রা.) হাসান (রা.) কে বললেন, তুমি বক্তৃতা দাও, আমি শুনব। হাসান (রা.) জবাব দিলেন, বাবা! আপনার সামনে আমার লজ্জা লাগে। আলী (রা.) আড়ালে চলে গিয়ে বললেন, নাও সরে গেলাম, এবার বলো। হাসান (রা.) তখন অত্যন্ত সারগর্ভ একটি বক্তৃতা দিলেন। হাসান-হুসাইন (রা.) যখন বাহনে চড়তেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বরকতের জন্য বাহনের লাগাম ধরে রাখতেন। আল্লামা ইবন কাসীর বর্ণনা করেছেন, হাসান-হুসাইন (রা.) যখন বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করতেন, সাহাবীরা তখন মায়াভরা চোখে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল বর্ণনা করেছেন, আবূ হুরাইরা (রা.) হাসান (রা.) কে বলতেন, বাবা তোমার সে স্থানটি দেখাও যেখানে আমার নবী e চুমু দিতেন। হাসান (রা.) জামা উপরে উঠাতেন। আবূ হুরাইরা হাসান (রা.) তাঁর পেটে চুমু দিতেন। (মুসনাদ আহমদ)
হাসান (রা.) অধিক যিকর করতেন এবং রাসূলুল্লাহ e এর স্ত্রীদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। মানুষ তাঁকে হাদিয়া-তুহফা দিত। তিনি যা গ্রহণ করতেন, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দান করে দিতেন। একবার এক হাবশী গোলামকে দেখলেন, সে নিজে এক লুকমা খাবার খাচ্ছে আর পাশে থাকা কুকুরের মুখে এক লুকমা দিচ্ছে। এ বদান্যতা দেখে তিনি ঐ গোলামের মালিকের কাছে গিয়ে গোলামকে ক্রয় করে, তাকে আযাদ করে দিলেন। মুআবিয়া (রা.) প্রতিবছর হাসান (রা.) এর জন্য ভাতা ও উপঢৌকন পাঠাতেন। ইমাম বুখারী বলেছেন, হাসান (রা.) পায়ে হেটে হজ্জে যেতেন। তিনি অন্তত ২০ বার হজ্জ করেছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
মানুষ হাসান (রা.) এর সাথে আত্মীয়তা করাকে বরকতময় মনে করত। যেভাবে পূর্ববর্তী খলীফাগণ আলী (রা.) এর পরিবারে বিয়ে দেওয়া-নেয়াকে বরকতময় মনে করতেন। আমাদের বিশ্বাস, আহলে বাইতের সাথে আত্মীয়তা করার জন্য মানুষের নিদারুণ আগ্রহই ছিল হাসান (রা.) এর অধিক বিয়ে ও তালাকের একমাত্র কারণ।
৪১ হিজরী একটি চুক্তির মাধ্যমে নিজে খিলাফতের মসনদ থেকে নেমে পড়েন নবী দৌহিত্র হাসান ইবন আলী (রা.)। তার ৭ মাসের খিলাফতের মাধ্যমে খুলাফায়ে রাশিদীনের ৩০ বছরের খিলাফতের সমাপ্তি হয়। উম্মতের দুই পক্ষের মধ্যে রক্তপাত রুখতেই তার এই ত্যাগ। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন-

ابني هذا سيِّد، ولعلَّ اللهَ أن يُصلحَ به بين فئتين من المسلمين

-আমার এ সন্তান হচ্ছে নেতা। আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে বিবাদমান দু’দল মুসলিম বাহিনীর মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দিবেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৭৪৬)
প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী, হাসান (রা.) কে বিষপান করানো হয়েছিল। কিছু ঐতিহাসিক এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। হাসান (রা.) তাঁর চিকিৎসককে বলেছিলেন, আমাকে অনেকবার বিষপান করানো হয়েছে। কিন্তু এবারের বিষ সবচেয়ে কঠিন। হুসাইন (রা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে আপনাকে বিষপান করিয়েছে? হাসান (রা.) বললেন, তুমি কি তাকে হত্যা করবে? ছেড়ে দাও! আমি ধারণার বর্শবর্তী হয়ে কারো রক্ত ঝরাতে চাইনা। আমরা সবাই একদিন আল্লাহর সামনে গিয়ে দাঁড়াব। হাসান (রা.) কে বিষপান করানোর কারণ হিসেবে কেউ বলেছেন, তাঁর জনৈকা স্ত্রী ভেবেছিলেন হাসান (রা.) তাকে তালাক দেবেন। তাই তিনি তাঁকে বিষপান করিয়ে দেন। একটি মত এমন রয়েছে যে, ইয়াযীদের পক্ষ থেকে তাঁর ঐ স্ত্রীকে প্ররোচনা দেওয়া হয়েছিল। (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ)
কোন মতটি বিশুদ্ধ, আল্লাহই ভাল জানেন। বিষের প্রকোপে প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে ৪৯ হিজরির ৫ই রবিউল আউয়াল ৪৬-৪৭ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদরের নাতি, ইমাম আবূ মুহাম্মদ হাসান ইবন আলী (রা.)। আয়িশা (রা.) এর অনুমতিক্রমে তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাশে দাফন করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু মদীনার গভর্নর মারওয়ান ও উমাইয়া আমির-উমরাগণ হিংসাবশত প্রচণ্ড বাধা সৃষ্টি করে। এতে হুসাইন (রা.) প্রচণ্ড রেগে যান। সাহাবী সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস, আব্দুল্লাহ ইবন উমর, আবূ হুরাইরা, জাবির (রা.) প্রমুখ হুসাইন (রা.) কে শান্ত করেন। অবশেষে জান্নাতুল বাকীতে ফাতিমা (রা.) এর কবরের পাশেই সমাহিত হন জান্নাতী পুরুষদের শিরতাজ ইমাম হাসান (রা.)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- الحسن والحسين سيدا شباب اهل الجنة -হাসান ও হুসাইন জান্নাতী যুবকদের সর্দার। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৭৬৮)

ফেইসবুকে আমরা...