1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
হাদীসের আলোকে কারবালার প্রেক্ষাপট
মারজান আহমদ চৌধুরী
  • ৭ আগস্ট, ২০২২

এক.

যায়িদ ইবন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ খুম নামক কুপের পাশে খুতবা প্রদানকালে বলেছেন,

أَنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ فَخُذُوا بِكِتَابِ اللهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ فَحَثَّ عَلَى كِتَابِ اللهِ وَرَغَّبَ فِيهِ ثُمَّ قَالَ وَأَهْلُ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي. فَانْظُرُوا كَيْفَ تَخْلُفُونِي فِيهِمَا

-আমি তোমাদের জন্য দুটি ভারি (গুরুত্বপূর্ণ) বিষয় রেখে যাচ্ছি। প্রথমটি আল্লাহর কিতাব। এতে রয়েছে হিদায়াত ও নূর। তোমরা আল্লাহর কিতাবকে গ্রহণ করো এবং শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। অতঃপর তিনি আল্লাহর কিতাবের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতে লাগলেন। এরপর বললেন, এবং (দ্বিতীয়টি হলো) আমার আহলুল বাইত। আমি আমার আহলুল বাইতের ব্যাপারে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা (আল্লাহর ভয়) স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। তিনি এ কথাটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। অন্য রিওয়ায়াতে এসেছে, অতএব খেয়াল রাখবে, তোমরা তাদের সাথে কীরূপ আচরণ করো। (সহীহ মুসলিম, ২৪০৮; সুনান আত-তিরমিযী, ৩৭৮৮)

দুই.
আনাস (রা.) বলেছেন,

أُتِيَ عُبَيْدُ اللهِ بْنُ زِيَادٍ بِرَأْسِ الْحُسَيْنِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَجُعِلَ فِي طَسْتٍ فَجَعَلَ يَنْكُتُ وَقَالَ فِي حُسْنِهِ شَيْئًا‏ فَقَالَ أَنَسٌ كَانَ أَشْبَهَهُمْ بِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم

-উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের (কুফার গভর্নর) সামনে হুসাইন (রা.) এর কর্তিত মাথা একটি থালায় উপস্থাপন করা হলো। তখন ইবন যিয়াদ একটি ছড়ি দিয়ে হুসাইনের মাথায় খোঁচাখুঁচি করতে লাগল এবং (উপহাসের ভঙ্গিতে) তাঁর সৌন্দর্য নিয়ে কিছু কথা বলল। তখন আনাস বললেন, এই চেহারা (যাকে তুই অপমান করছিস) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর চেহারার সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। (সহীহ বুখারী, ৩৭৪৮)
উল্লিখিত দুটি ঘটনার মধ্যে ব্যবধান ৫০ বছর। ১০ম হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আহলুল বাইতের প্রতি উত্তম আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর ৬১ হিজরীতে এ উম্মতের কিছু লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার-পরিজনকে কারবালায় নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। কেন এ উম্মতকে ইয়াযীদের উত্থান এবং কারবালার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছিল, আমরা তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট (Historical Context) খুঁজতে চেষ্টা করেছি। এ নিবন্ধে হাদীসের সাথে মাকতাবাতুশ শামিলা প্রণীত হাদীস নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।

উম্মতের ইতিহাসের ৫টি যুগ
হুযাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

تَكُونُ النُّبُوَّةُ فِيكُمْ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ تَكُون ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا عَاضًّا فَيَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ الله ُأَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ مُلْكًا جَبْرِيّاً فَتَكُونُ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ تَكُونَ ثُمَّ يَرْفَعُهَا إِذَا شَاءَ أَنْ يَرْفَعَهَا ثُمَّ تَكُونُ خِلَافَةٌ عَلَى مِنْهَاجِ النُّبُوَّةِ

-তোমাদের মধ্যে নুবুওয়াত থাকবে যতদিন আল্লাহ চাইবেন, এরপর যখন আল্লাহ চাইবেন তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর হবে নুবুওয়াতের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাত। যতদিন আল্লাহ চাইবেন থাকবে, যখন আল্লাহ চাইবেন তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর হবে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা রাজতন্ত্র। যতদিন আল্লাহ চাইবেন থাকবে, যখন আল্লাহ চাইবেন তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর হবে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া রাজতন্ত্র। যতদিন আল্লাহ চাইবেন থাকবে, যখন আল্লাহ চাইবেন তা উঠিয়ে নেবেন। এরপর (পুনরায়) আসবে নুবুওয়াতের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাত। (মুসনাদে আহমাদ, ১৮৪০৬)
উল্লেখিত হাদীসের আলোকে উম্মতের ইতিহাসকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। (১) নুবুওয়াত তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগ। (২) খিলাফাত তথা খুলাফায়ে রাশিদীনের যুগ। (৩) দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা রাজতন্ত্র। যেমন- উমাইয়া, আব্বাসী, উসমানী (অটোমান) প্রমুখ। যেখানে শাসকরা মুসলিম ছিলেন সত্য, কিন্তু শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি সুন্নাতের ওপর কায়িম ছিল না। (৪) জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া রাজতন্ত্র। যেমন মুসলিম উম্মাহ’র ওপর ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, স্পেনিশ, ইটালিয়, ডাচ বা পর্তুগিজ সাম্রাজ্যবাদী শাসন। (৫) পুনরায় নুবুওয়াতের আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাত, তথা কিয়ামাতের পূর্বে ইমাম মাহদী ও সায়্যিদুনা মাসীহ আলাইহিস সালামের যুগ। ১১ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের মাধ্যমে নুবুওয়াত শেষ হয় এবং খিলাফাতের সূচনা হয়।

খুলাফায়ে রাশিদীনের সময়কাল
সাফিনা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الْخِلاَفَةُ فِي أُمَّتِي ثَلاَثُونَ سَنَةً ثُمَّ مُلْكٌ بَعْدَ ذَلِكَ

-আমার উম্মতের মধ্যে খিলাফাত থাকবে ৩০ বছর। এরপর হবে রাজতন্ত্র। (সুনান আত-তিরমিযী, ২২২৬)
খুলাফায়ে রাশিদীনের খিলাফাতকাল ছিল ৩০ বছর। তন্মধ্যে আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) (১১-১৩ হি.) উমর (রা.) (১৩-২৩ হি.) উসমান (রা.) (২৩-৩৫ হি.) এবং আলী (রা.) (৩৫-৪০ হি.)। আলী (রা.) এর শাহাদাতের পর হাসান ইবন আলী (রা.) (৪০-৪১ হি.) আরও ৬ মাস দায়িত্ব পালন করার পর খিলাফাতে রাশিদার ৩০ বছর সমাপ্ত হয়। এরপর শুরু হয় রাজতন্ত্র। প্রশ্ন জাগে, নববী আদর্শ ও খিলাফাতে রাশিদার পথপরিক্রমা ত্যাগ করে এ উম্মত কীভাবে রাজতন্ত্রের ঘেরাটোপে পতিত হলো?

শাসনব্যবস্থায় পট পরিবর্তনের আভাস
৩য় খলীফা উসমান (রা.) এর খিলাফাতকালে কতিপয় প্রাদেশিক গভর্নরের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছিল। তন্মধ্যে কুফার গভর্নর ওয়ালিদ ইবন উকবা ও মিশরের গভর্নর আবদুল্লাহ ইবন সা’দ ইবন আবিস সারাহ উল্লেখযোগ্য। খলীফা নিজ গোত্র বনু উমাইয়ার লোকজনকে বিশ্বাস করে যেসব দায়িত্ব দিয়েছিলেন, দু’একজন ছাড়া বাকিরা সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি। কতিপয় সাহাবী খলীফার কিছু সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। খলীফা চেষ্টা করেছিলেন বিষয়গুলোকে সমাধান করতে। কিন্তু কিছু বিপথগামী লোক এসব অভিযোগ সামনে এনে খলীফার বিরুদ্ধে প্রচারণা করতে শুরু করে। ইরাক ও মিশরের কয়েকশ লোক মদীনায় এসে খলীফার বাসভবন ঘেরাও করে (সুনান আত-তিরিমিযী, ৩৭০৩) এবং খলীফার পদত্যাগ দাবি করে। খলীফা তাতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এমনটি করতে বারণ করেছিলেন। আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

يَا عُثْمَانُ إِنَّهُ لَعَلَّ اللهَ يُقَمِّصُكَ قَمِيصًا فَإِنْ أَرَادُوكَ عَلَى خَلْعِهِ فَلاَ تَخْلَعْهُ لَهُمْ

-হে উসমান, আল্লাহ তোমাকে একটি জামা পরাবেন। যদি তারা এটি খুলে নিতে চায়, তাহলে তুমি তাদের জন্য সেটি খুলে দেবে না। (সুনান আত-তিরমিযী, ৩৭০৫)
সাহাবীরা এসব বিপথগামীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করলেও খলীফা নিজের সুরক্ষায় মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাত ঘটানোর অনুমতি দেননি। এক সময় বিদ্রোহীরা খলীফার ঘরে প্রবেশ করে এবং নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করে (বিদায়াহ, ৭ম খন্ড)। উসমান (রা.) এর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে উম্মতের ঐক্য চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যায়।
বিপর্যয়ের বহিঃপ্রকাশ
উসমান (রা.) এর শাহাদাতের পর চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আলী ইবন আবি তালিব (রা.) উম্মাহ’র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সবার মধ্যে তখন উসমান (রা.) এর নির্মম শাহাদাত নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল। আলী (রা.) চেয়েছিলেন প্রাথমিক বিশৃঙ্খলা স্তিমিত করে উসমান হত্যার বিচার করবেন। কিন্তু উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা.) এ ব্যাপারে খলীফাকে চাপ দিতে থাকেন। তাঁর সাথে যুক্ত হন প্রসিদ্ধ সাহাবী তালহা (রা.) এবং যুবাইর (রা.)। তাঁরা মদীনা ছেড়ে বসরায় চলে যান এবং উসমান হত্যার বিচার দাবি করেন। (সহীহ বুখারী, ৭১০০)
ওদিকে সিরিয়ার গভর্নর মুআবিয়া (রা.) আলী (রা.) এর হাতে বাইআত দেননি। তার ওপর তিনি উসমান হত্যার বিষয়টি নিয়ে চরম উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। আলী (রা.) বিষয়টি সমাধা করার জন্য সিরিয়ায় রওয়ানা করেছিলেন। পথিমধ্যে আয়িশা (রা.) এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সাথে আলী (রা.) এর বাহিনীর সাক্ষাৎ ঘটে। দু’দল আলোচনার মাধ্যমে উসমান হত্যার বিচারের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছালেও কতিপয় মুনাফিকের ষড়যন্ত্রে জনতার মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েক হাজার মুসলমান প্রাণ হারান। তালহা (রা.) এবং যুবাইর (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করার পর আলী (রা.) আয়িশা (রা.) কে সসম্মানে বসরায় পাঠিয়ে দেন। এ যুদ্ধের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন (মুসনাদে আহমাদ, ২৪২৯৯)। না চাইতেও এমন একটি বিপর্যয় আসবে, কেউ ভাবতেই পারেনি। আয়িশা (রা.) উষ্ট্রীর যুদ্ধে তাঁর পদক্ষেপের জন্য আমৃত্যু আফসোস করেছেন। (মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবা, ৩৭৭৭২)

সিরিয়াবাসীর বিদ্রোহ
সিরিয়ার অদূরবর্তী সিফফিনে পৌঁছে আলী (রা.) মুআবিয়া (রা.) কে পরিস্থিতি বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি খলীফার কথা গ্রহণ করেননি।
৭ই সফর, ৩৭ হিজরী সনে মুআবিয়া (রা.) এর বাহিনী আলী (রা.) এর বাহিনীর ওপর হামলা করে। ৫ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অন্তত ৬০-৬৫ হাজার মুসলমান প্রাণ হারান। আলী (রা.) এর দল বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছালেও সিরিয়াবাসী একটি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে পরাজয় বাঁচিয়ে দেয়। (বিদায়াহ, ৭ম খণ্ড)
খলীফার বিরুদ্ধে সিরিয়াবাসীর বিরুদ্ধাচরণ ও অস্ত্রধারণের কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আলী (রা.) ছিলেন মুসলিম উম্মাহ’র ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত খলীফা। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ إِلاَّ أَنْ يُؤْمَرَ بِمَعْصِيَةٍ فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَة

-প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে, পাপকাজের নির্দেশ ব্যতীত (বৈধ) আমিরের হুকুম শোনা ও মান্য করা, চাই সে পছন্দ করুক বা না করুক। যদি আমির (শাসক) পাপকাজের নির্দেশ দেয়, তাহলে তার কথা শোনা ও মানার প্রয়োজন নেই। (সহীহ মুসলিম, ১৮৩৯)

সিফফিনে উপস্থিত দুই বাহিনীর মধ্যকার পার্থক্য
আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

                                                                                                                                   وَيْحَ عَمَّارٍ تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ يَدْعُوهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ وَيَدْعُونَهُ إِلَى النَّارِ

-আফসোস আম্মারের জন্য! একটি বিদ্রোহী দল তাকে হত্যা করবে। সে তাদেরকে জান্নাতের দিকে আহবান করবে, (অথচ) তারা তাকে জাহান্নামের দিকে আহবান করবে। (সহীহ বুখারী, ৪৪৭)
সিফফিনের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় সাহাবী আম্মার ইবন ইয়াসির (রা.) ছিলেন আলী (রা.) এর দলে। মুআবিয়া (রা.) এর দল (হাদীসের ভাষায় বিদ্রোহী দল) তাঁকে হত্যা করেছিল। (মুসনাদে আহমাদ, ১৬৭৪৪)

হাসান-মুআবিয়ার সমঝোতা
৪০ হিজরীর রামাদান মাসে আলী (রা.) বিপথগামী খারিজী আবদুল্লাহ ইবন মুলজিমের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এরপর মুসলমানরা হাসান (রা.) এর হাতে খিলাফাতের বাইআত দেন। সাথে সাথে মুআবিয়া (রা.) নিজেকে খলীফা দাবি করেন। আবার যুদ্ধের দামামা বাজে। কিন্তু হাসান (রা.) উম্মতের মধ্যে পুনরায় রক্তপাত ঘটানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। তাই দুজনের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়। ইমাম আসকালানী (ফাতহুল বারী, সহীহ বুখারীর ৭১০৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যায়) বলেছেন, সেই সমঝোতা চুক্তির শর্ত ছিল ৪টি। (১) মুআবিয়া (রা.) কুরআন-সুন্নাহ ও খুলাফায়ে রাশিদীনের অনুসরণে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। (২) মুআবিয়া (রা.) নিজের পক্ষ থেকে কাউকে পরবর্তী খলীফা মনোনীত করবেন না। বরং সেটি উম্মতের পরামর্শের ভিত্তিতে নির্ণীত হবে। (৩) আলী (রা.) এর সাথে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদেরকে কোনোরূপ যুলুম করা যাবে না। (৪) আহলুল বাইতের জন্য কুরআনে বর্ণিত খুমুস (গণিমতের এক পঞ্চমাংশ) বহাল থাকবে। মুআবিয়া (রা.) শর্ত পূরণ করার অঙ্গীকার করেন এবং হাসান (রা.) খিলাফাতের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। সমাপ্ত হয় নববী আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাতের ৩০ বছর। আবূ বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসানের ব্যাপারে বলেছেন,

                                                                                                                          إِنَّ ابْنِي هَذَا سَيِّدٌ وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ.
-নিশ্চয়ই আমার এ বাচ্চা নেতা। সম্ভবত আল্লাহ তার মাধ্যমে মুসলমানদের দুটি বড় দলের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করাবেন। (সহীহ বুখারী, ২৭০৪ ও ৭১০৯)

বনু উমাইয়ার শাসনের নৈতিক মূল্যায়ন
বনু উমাইয়ার রাজতন্ত্র শুরু হয় মুআবিয়া (রা.) এর মাধ্যমে। মুআবিয়া (রা.) একজন সাহাবী ছিলেন। তাঁর ঈমান, আমল, দ্বীনদারী নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। কিন্তু এটিও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কেবল উমর ইবন আবদুল আযীয (র.) ব্যতীত বনু উমাইয়ার পুরো শাসনামলে বহু অনভিপ্রেত এবং নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো-
এক. আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রা.) কাবা শরীফের পাশে বসা ছিলেন। তাবিঈ আবদুর রাহমান তাঁকে বললেন, আপনার চাচাতো ভাই (বনু উমাইয়ার প্রথম শাসক) আমাদেরকে বলেন, আমরা যেন পরস্পরের সম্পদ গ্রাস করি এবং হানাহানি করি। অথচ আল্লাহ এমনটি করতে নিষেধ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, أَطِعْهُ فِي طَاعَةِ اللهِ وَاعْصِهِ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ -তোমরা আল্লাহর আনুগত্যের অধীনে তার আনুগত্য করবে। এবং আল্লাহর অবাধ্যতার ব্যাপারে তার অবাধ্যতা করবে। (সুনান আবু দাউদ, ৪২৪৮)
দুই. সাঈদ ইবন জুবাইর বলেছেন,
كُنْتُ مَعَ ابْنِ عَبَّاسٍ بِعَرَفَاتٍ فَقَالَ مَا لِي لاَ أَسْمَعُ النَّاسَ يُلَبُّونَ قُلْتُ يَخَافُونَ مِنْ مُعَاوِيَةَ فَخَرَجَ ابْنُ عَبَّاسٍ مِنْ فُسْطَاطِهِ فَقَالَ لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ فَإِنَّهُمْ قَدْ تَرَكُوا السُّنَّةَ مِنْ     بُغْضِ عَلِيٍّ.
-আমি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) এর সাথে আরাফাতের ময়দানে ছিলাম। তিনি বললেন, আমি মানুষজনকে তালবিয়া পাঠ করতে শুনছি না কেন? আমি বললাম, মুআবিয়ার ভয়ে। তখন ইবন আব্বাস (রাগান্বিত অবস্থায়) তাবু থেকে বের হলেন এবং ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ পাঠ করতে শুরু করলেন। বললেন, এরা আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতকে বাদ দিয়েছে। (সুনান নাসায়ী, ৩০০৬)
তিন. সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) কে মুআবিয়া (রা.) জিজ্ঞেস করলেন,
مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسُبَّ أَبَا التُّرَابِ فَقَالَ أَمَّا مَا ذَكَرْتُ ثَلاَثًا قَالَهُنَّ لَهُ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَلَنْ أَسُبَّهُ
-কোন বিষয়টি তোমাকে আবূ তুরাব (আলী রা.) এর প্রতি গালাগাল করা থেকে বিরত রাখছে? সা’দ বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ব্যাপারে এমন তিনটি বিষয় বলেছেন, যতদিন আমি এগুলো স্মরণ রাখব ততদিন আমি আলীর ব্যাপারে মন্দ কথা বলব না। (সহীহ মুসলিম, ২৪০৪)
চার. সাঈদ ইবন যায়িদ (রা.) কুফার গভর্নরের কাছে উপস্থিত হলেন। তখন জনৈক ব্যক্তি সেখানে এসে (কাউকে উদ্দেশ্য করে) অকথ্য ভাষায় গালাগাল শুরু করতে লাগল। সাঈদ ইবন যায়েদ জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তি কাকে গালাগাল করছে? তারা জবাব দিল, আলীকে! সাঈদ ইবন যায়িদ (রা.) (চমকে ওঠে) কুফার গভর্নরকে বললেন,

                                                                                                              أَلاَ أَرَى أَصْحَابَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُسَبُّونَ عِنْدَكَ ثُمَّ لاَ تُنْكِرُ وَلاَ تُغَيِّرُ

-আমি এসব কী দেখছি! তোমার সামনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীদেরকে গালাগাল করা হচ্ছে, অথচ তুমি এসব বন্ধ করছ না কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিচ্ছ না? (সুনান আবূ দাউদ, ৪৬৫০)
পাঁচ. হুজর ইবন আদী (রা.) একজন বীর সাহাবী ছিলেন। কেবল আলী (রা.) এর প্রতি ভালোবাসা পোষণ এবং উমাইয়া গভর্নরদের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করার কারণে উমাইয়া শাসনামলে তাঁকে দামেস্কের পাশে আযরা নামক গ্রামে নিয়ে শিকলবদ্ধ অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডের সংবাদ পেয়ে আয়িশা (রা.) চরম রাগান্বিত হয়েছিলেন এবং মুআবিয়া (রা.) কে ডেকে এনে কৈফিয়ত তলব করেছিলেন। ইমাম হাকিম সংকলিত আল-মুসতাদরাক কিতাবে এ সংক্রান্ত পুরো ঘটনাপ্রবাহ বর্ণিত আছে। উপরিউক্ত প্রত্যেকটি ঘটনা বনু উমাইয়ার শাসনামলের একেবারে শুরুর দিকে, ইয়াযীদ ক্ষমতায় বসার আগেই সংঘটিত হয়েছে।

ইয়াযীদের মনোনয়ন
মুআবিয়া (রা.) তাঁর পুত্র ইয়াযীদকে পরবর্তী খলীফা মনোনীত করতে চাইলেন। তাঁর পত্র পেয়ে হিজাযের গভর্নর মারওয়ান খুতবায় এ কথা শুনিয়ে দিলেন, যেন মানুষ ইয়াযীদের হাতে বাইআত প্রদান করে। তখন আবদুর রহমান ইবন আবূ বকর (রা.) বললেন, এটি (ইচ্ছামতো খলীফা মনোনয়ন) আবূ বকর ও উমরের সুন্নাত নয়। বরং এটি রোম ও পারস্য সম্রাটদের প্রথা। তখন মারওয়ান তাঁকে আটক করতে উদ্যত হলেও আটক করতে সক্ষম হলেন না। (সহীহ বুখারী, ৪৮২৭; ফাতহুল বারী, তাফসীর অধ্যায়)

খলীফা মনোনয়নের ব্যাপারে উমর (রা.) এর ফাতওয়া
ইয়াযীদের মনোনয়ন মুসলিম উম্মাহ’র পছন্দে বা পরামর্শে হয়নি। মুআবিয়া (রা.) নিজের জীবদ্দশায় নিজেই পুত্রের নাম ঘোষণা করে প্রাদেশিক গভর্নরদের মাধ্যমে ইয়াযীদের পক্ষে বাইআত গ্রহণ করিয়ে ছিলেন, যদিও তখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রসিদ্ধ সাহাবী জীবিত ছিলেন। ৬০ হিজরীর রজব মাসে মুআবিয়া (রা.) ইন্তিকাল করার পর ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় ইয়াযীদের হাতে। তবে এ ধরণের ইচ্ছেমতো মনোনয়ন ও জোরপূর্বক বাইআত গ্রহণ করা খিলাফাতের আদর্শের বিপরীত। আমিরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেছেন, فَمَنْ بَايَعَ رَجُلاً عَلَى غَيْرِ مَشُورَةٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ فَلاَ يُتَابَعُ هُوَ وَلاَ الَّذِي بَايَعَهُ تَغِرَّةً أَنْ يُقْتَلاَ‏ -যে ব্যক্তি মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতিরেকে কাউকে বাইআত প্রদান করবে, তাহলে যে বাইআত দিল আর যার হাতে দেওয়া হলো, কারও অনুসরণ করা যাবে না। কেননা দুজনেরই নিহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। (সহীহ বুখারী, ৬৮৩০)
ইয়াযীদের দুঃশাসনের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইঙ্গিত
এক. আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

                                                                                                                                                                      هَلاَكُ أُمَّتِي عَلَى يَدَىْ غِلْمَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ -কুরাইশ বংশের তরুণদের হাতে আমার উম্মতের বিনাশ হবে। (সহীহ বুখারী, ৩৬০৫)
দুই. আবূ হুরাইরা (রা.) বলেছেন,

                                                                                حَفِظْتُ مِنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وِعَاءَيْنِ فَأَمَّا أَحَدُهُمَا فَبَثَثْتُهُ وَأَمَّا الآخَرُ فَلَوْ بَثَثْتُهُ قُطِعَ هَذَا الْبُلْعُومُ‏

-আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছ থেকে দু’ধরণের জ্ঞান অর্জন করেছি। তন্মধ্যে আমি এক ধরণের জ্ঞান প্রচার করি। অন্য ধরণের জ্ঞান যদি প্রচার করতে যাই, তাহলে আমার গলা কেটে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, ১২০)
ইমাম আসকালানী (ফাতহুল বারী, সহীহ বুখারীর ১২০ নং হাদীসের ব্যাখ্যায়) বলেছেন, এখানে আবূ হুরাইরা (রা.) অত্যাচারী শাসকদের নাম, অবস্থা ও সময়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, কিন্তু স্পষ্ট করে বলেননি। আবূ হুরাইরা (রা.) বলতেন, ‘৬০ হিজরী ও বালকদের শাসন থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই।’ আল্লাহ তাঁর দুআ কবূল করেছিলেন। ৬০ হিজরীতে ইয়াযীদের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর আগেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।

বনু উমাইয়ার শাসনের প্রতি সাহাবীর মূল্যায়ন
এক. সাঈদ বর্ণনা করেছেন,

                                                                                            فَقُلْتُ لَهُ إِنَّ بَنِي أُمَيَّةَ يَزْعُمُونَ أَنَّ الْخِلاَفَةَ فِيهِمْ ‏قَالَ كَذَبُوا بَنُو الزَّرْقَاءِ بَلْ هُمْ مُلُوكٌ مِنْ شَرِّ الْمُلُوكِ

-আমি সাফিনা (রা.) কে বললাম, বনু উমাইয়ার লোকেরা মনে করে খিলাফাত তাদের মধ্যে বিদ্যমান। তখন সাফিনা (রা.) বললেন, নীল চক্ষুবিশিষ্ট (বনু উমাইয়া) লোকেরা মিথ্যা কথা বলছে। বরং তারা তো নিকৃষ্ট রাজতন্ত্রের মধ্যে একটি রাজতন্ত্র। (সুনান আত-তিরমিযী, ২২২৬)

ইয়াযীদের শাসনামলে সাহাবীদেরকে অপমান
এক. আবূ বারযাহ (রা.) কুফায় নিযুক্ত ইয়াযীদের গভর্নর ইবন যিয়াদের কাছে আসলেন। ইবন যিয়াদ তাঁকে দেখিয়ে বলল,
إِنَّ مُحَمَّدِيَّكُمْ هَذَا الدَّحْدَاحُ فَفَهِمَهَا الشَّيْخُ فَقَالَ مَا كُنْتُ أَحْسِبُ أَنِّي أَبْقَى فِي قَوْمٍ يُعَيِّرُونِي بِصُحْبَةِ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم
-তোমাদের এই মুহাম্মাদী তো খাটো এবং মোটা। আবূ বারযাহ (রা.) এই তাচ্ছিল্য বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, আমি কোনোদিন ভাবিনি যে আমাকে এমন একটি দলের মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে, যারা আমাকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী হওয়ার কারণে অপমান করবে। (সুনান আবূ দাউদ, ৪৭৪৯)
দুই. আইদ ইবন আমর (রা.) কে কুফার গভর্নর ইবন যিয়াদ বলেছিল,
فَإِنَّمَا أَنْتَ مِنْ نُخَالَةِ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم ‏فَقَالَ وَهَلْ كَانَتْ لَهُمْ نُخَالَةٌ إِنَّمَا كَانَتِ النُّخَالَةُ بَعْدَهُمْ وَفِي غَيْرِهِمْ
-তুমি সাহাবীদের মধ্যকার এক খড়কুটো/আবর্জনা। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, সাহাবীদের মধ্যে কি কেউ খড়কুটো ছিলেন? বরং খড়কুটো হচ্ছে তাঁদের পরবর্তীরা, অর্থাৎ তোমরা। (সহীহ মুসলিম, ১৮৩০)
ইয়াযীদের হাতে বাইআত না দেওয়ার কারণ
ক্ষমতায় আরোহন করে ইয়াযীদ হুসাইন ইবন আলী (রা.) এর বাইআত নেয়ার জন্য জোরাজুরি করতে শুরু করেন। কিন্তু হুসাইন (রা.) ইয়াযীদের হাতে বাইআত দেননি। সম্ভবত এর কারণ ছিল-
১. ব্যক্তি হিসেবে ইয়াযীদ ফাসিক ছিলেন। খলীফা হওয়ার নৈতিক যোগ্যতা তার মধ্যে ছিল না। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৪র্থ খন্ড)
২. মুআবিয়া (রা.) স্বীয় পুত্রকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছেন। এটি হাসান (রা.) এর সাথে কৃত চুক্তির লঙ্গন। তাছাড়া ইয়াযীদের মনোনয়ন পদ্ধতি ছিল খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের বিপরীত।
৩. নববী আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফাত পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। এটি না করে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা রাজতন্ত্রকে স্বীকার করে নেয়া দুর্বল ঈমানের লক্ষণ। হুসাইন (রা.) দুর্বল ঈমানের অধিকারী ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

                                                                                                                                                     حُسَيْنٌ مِنِّي وَأَنَا مِنْ حُسَيْنٍ أَحَبَّ اللهُ مَنْ أَحَبَّ حُسَيْنًا -হুসাইন আমার থেকে এবং আমি হুসাইন থেকে। যে হুসাইনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। (সুনান আত-তিরমিযী, ৩৭৭৫)
প্রশ্ন আসতে পারে যে, ইয়াযীদ যেহেতু ক্ষমতায় বসেই গেছেন, তারপর হুসাইন (রা.) এর বাইআত নেয়ার জন্য এত জোরাজুরি কেন করেছিলেন? এমন তো নয় যে, হুসাইন (রা.) বাইআত না দিলে ইয়াযীদ ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। জবাব হলো, অন্য সবার বাইআত আর হুসাইন (রা.) এর বাইআত এক বিষয় নয়। হুসাইন (রা.) যদি ইয়াযীদের হাতে বাইআত দিয়ে দিতেন, তাহলে মনে হতো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবার ইয়াযীদকে স্বীকার করে নিয়েছেন। অনেকে বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) প্রমুখ সাহাবীরা যখন ইয়াযীদের হাতে বাইআত দিয়েছিলেন, তখন হুসাইন (রা.) কেন দেননি? জবাব হচ্ছে, ওই সকল সাহাবীরা তখন রাজনৈতিক হিকমাত দেখেছিলেন, আর হুসাইন (রা.) দেখেছিলেন খিলাফাতে রাশিদার সুন্নাত। হুসাইন (রা.) জানতেন যে, দ্বীন কেবল মসজিদে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান, যাতে ইবাদত-বন্দেগী যেমন রয়েছে, অর্থব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনাও তেমন রয়েছে। যদি রাষ্ট্র পরিচালনার ভার একজন অযোগ্য ফাসিক ব্যক্তির হাতে চলে যায়, তাহলে দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা খন্ডিত হবে এবং উম্মতের বিনাশ চলে আসবে। তাই ইয়াযীদের শাসনকে মেনে না নিয়ে বরং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই তাঁর কাছে যথোপযুক্ত মনে হয়েছিল। এ প্রতিবাদ হুসাইন (রা.) নিজের জন্য করেননি, করেছিলেন উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য। আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ
-তোমাদের মধ্যে কেউ অন্যায় হতে দেখলে সে যেন হাত (শক্তি) দিয়ে সেটি রুখে দেয়। এতে সক্ষম না হলে জবান দিয়ে, এতেও সক্ষম না হলে অন্তর দিয়ে। আর অন্তর দিয়ে ঘৃণা করা দুর্বল ঈমানের লক্ষণ। (সহীহ মুসলিম, ৪৯)
ইরাকের কুফা শহরের অধিবাসীরা ইয়াযীদের হাতে বাইআত না দিয়ে হুসাইন (রা.) এর কাছে পত্র প্রেরণ করেছিল। আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কুফায় আগমন করার জন্য। অবস্থা বুঝতে পেরে ইয়াযীদ কুফার তৎকালীন গভর্নরকে অপসারণ করে হিংস্র-বর্বর ইবন যিয়াদকে কুফার দায়িত্ব প্রদান করে। এই ইবন যিয়াদ ছিল কারবালা যুদ্ধের নীলনকশা প্রণয়নকারী। যেহেতু যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, তাই আমরা পূর্বাপর ঘটনাবলি এখানে বিস্তারিত উল্লেখ করছি না।

হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের ভবিষ্যদ্বাণী
আবদুল্লাহ ইবন নুজায়-এর পিতা বর্ণনা করেছেন, একবার সফরকালে তাঁরা নিনওয়া নামক স্থান অতিক্রম করছিলেন। তখন আলী (রা.) চিৎকার দিয়ে বললেন, হে আবূ আবদিল্লাহ (হুসাইন) ফোরাতের তীরে ধৈর্য ধারণ করো। বর্ণনাকারী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? আলী (রা.) বললেন,
دَخَلْتُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ وَعَيْنَاهُ تَفِيضَانِ قُلْتُ يَا نَبِيَّ اللهِ أَغْضَبَكَ أَحَدٌ مَا شَأْنُ عَيْنَيْكَ تَفِيضَانِ قَالَ بَلْ قَامَ مِنْ عِنْدِي جِبْرِيلُ قَبْلُ فَحَدَّثَنِي أَنَّ الْحُسَيْنَ يُقْتَلُ بِشَطِّ الْفُرَاتِ قَالَ فَقَالَ هَلْ لَكَ إِلَى أَنْ أُشِمَّكَ مِنْ تُرْبَتِهِ قَالَ قُلْتُ نَعَمْ فَمَدَّ يَدَهُ فَقَبَضَ قَبْضَةً مِنْ تُرَابٍ فَأَعْطَانِيهَا فَلَمْ أَمْلِكْ عَيْنَيَّ أَنْ فَاضَتَا‏.
-আমি একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘরে প্রবেশ করে দেখি তাঁর চোখ পানিতে ভেজা। জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর নবী, কেউ কি আপনাকে অখুশি করেছে? আপনার চোখ ভেজা কেন? তিনি বললেন, কিছুক্ষণ আগে জিবরাঈল এসেছিলেন। বলে গেলেন, (আমার নাতি) হুসাইন ফোরাতের তীরে শহীদ হবে। জিবরাঈল আমাকে বললেন, আপনি কি ওই মাটির ঘ্রাণ শুঁকতে চান? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি হাত বাড়িয়ে কিছু মাটি এনে আমার হাতে দিলেন। ফলে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। (আবূ ইয়ালা, ৩৬৩; তাবরানী, ২৮১১)

হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের সংবাদ
কুফাবাসীর আমন্ত্রণে মক্কা থেকে কুফায় যাওয়ার পথে ইয়াযীদের প্রেরিত সেনাবাহিনী হুসাইন (রা.) এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের পথ আটকে দেয়। তাঁকে ইয়াযীদের পক্ষে বাইআত দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু হুসাইন (রা.) এমনটি করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলাফলস্বরূপ ৬১ হিজরীর ১০ই মুহাররাম ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে আমর ইবন সাদ ও শিমর ইবন যুল জাওশানের নেতৃত্বাধীন ৮ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর সাথে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন নবী-দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) এবং আহলুল বাইতের আরও ১৮ জন সদস্যসহ মোট ৭২ জন পুরুষ (বিদায়াহ, ৮ম খন্ড)। অসুস্থ অবস্থায় তাবুতে অবস্থান করার কারণে আলী ইবন হুসাইন যাইনুল আবিদীন (রা.) এ হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যান।
অনেকে বলে থাকেন, হুসাইন (রা.) এর হত্যাকান্ড ইয়াযীদের হাত ছিল না। বরং ইবন যিয়াদ একাই এ হত্যাকান্ডের আদেশ দিয়েছিল। অথচ হুসাইন (রা.) এর ওপর আক্রমণকারী বাহিনীটি মূলত রাজধানী দামেস্ক থেকে তুরস্কের দায়লাম অঞ্চলে যুদ্ধ করার জন্য যাচ্ছিল। ইয়াযীদের সরাসরি নির্দেশ ব্যতীত ইবন যিয়াদের পক্ষে এত বড় বাহিনীকে পথ পরিবর্তন করে অন্যত্র যুদ্ধে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশে চলে, প্রাদেশিক গভর্নরের আদেশে নয়। অতএব কারবালার ঘটনায় ইয়াযীদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করা নেহায়েত মূর্খতা।
হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের সংবাদ মক্কায় আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) এবং মদীনায় উম্মে সালামাহ (রা.) এর কাছে পৌঁছে দেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইবন আব্বাস (রা.) বলেছেন,
رأيتُ النبيَّ صلَّى الله عليه وسلَّم في المنام بنِصْف النهار أشعثَ أغْبَرَ معه قارورةٌ فيها دمٌ يلتقطُه قال قلت يا رسول الله ما هذا قال دمُ الحسين وأصحابه لَم أزَلْ أتتبَّعُه منذُ اليومِ. قال عمَّار فحَفِظْنا ذلك اليوم فوجَدْناه قُتِلَ ذلك اليوم
-আমি এক দুপুরবেলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে স্বপ্নে দেখলাম। তাঁর চুল অবিন্যস্ত, চেহারা ছিল ধুলোমাখা। হাতে এক শিশি রক্ত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার হাতে কী? তিনি জবাব দিলেন, হুসাইন ও তার সাথিদের রক্ত। আমি আজ সারাদিন এগুলো সংগ্রহ করছি। বর্ণনাকারী বলেছেন, আমরা ওই দিনটি মনে রেখেছি এবং জানতে পেরেছি যে, ওই দিনেই হুসাইনকে শহীদ করা হয়েছিল। (মুসনাদে আহমাদ, ২১৬৫)
উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামাহ (রা.) বলেছেন,
رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم تَعْنِي فِي الْمَنَامِ وَعَلَى رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ التُّرَابُ فَقُلْتُ مَا لَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ‏شَهِدْتُ قَتْلَ الْحُسَيْنِ آنِفًا
-আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে স্বপ্নে দেখলাম। তাঁর মাথা ও দাড়ি মুবারকে মাটি লেগে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার কী হয়েছে? তিনি বললেন, এইমাত্র দেখে আসলাম হুসাইনকে হত্যা করা হয়েছে। (সুনান আত-তিরমিযী, ৩৭৭১)

কারবালার ঘটনায় সাহাবা-তাবিঈদের প্রতিক্রিয়া
এক. শাহার ইবন হাউশাব বলেছেন, হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের কথা জানতে পেরে উম্মে সালামাহ (রা.) চিৎকার দিয়ে বলেন,                                                                                                                                                                            قَتَلُوهُ قَتَلَهُمُ اللهُ غَرُّوهُ وَذَلُّوهُ لَعَنَهُمُ اللهُ -ওরা তাঁকে হত্যা করেছে, আল্লাহ ওদেরকে ধ্বংস করুন। ওরা তাঁকে ধোকা দিয়েছে এবং অপদস্থ করেছে, ওদের প্রতি আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক। (মুসনাদে আহমাদ, ২৬৫৫০)
দুই. একবার ইরাকের কিছু লোক আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) এর কাছে মাছি মারা বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল। তিনি জবাব দিলেন,

                                                                                                                 أَهْلُ الْعِرَاقِ يَسْأَلُونَ عَنِ الذُّبَابِ وَقَدْ قَتَلُوا ابْنَ ابْنَةِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم -ইরাকবাসী মাছির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে। অথচ তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দৌহিত্রকে হত্যা করেছে। (সহীহ বুখারী, ৩৭৫৩)
তিন. ইমাম ইবরাহিম নাখয়ী (ইমাম আবূ হানীফার উস্তায) বলেছেন,
لَوْ كُنْتُ فِيمَنْ قَتَلَ الْحُسَيْنَ بْنَ عَلِيٍّ ثُمَّ غُفِرَ لِي ثُمَّ أُدْخِلْتُ الْجَنَّةَ اسْتَحْيَيْتُ أَنْ أَمُرَّ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيَنْظُرَ فِي وَجْهِي
-যদি আমি হুসাইন (রা.) এর হত্যাকান্ডে জড়িত থাকতাম, এরপর ক্ষমা পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতাম, তবুও আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুখ দেখাতে লজ্জাবোধ করতাম। (তাবরানী, ২৮২৯)

ইয়াযীদ বাহিনীর মক্কা-মদীনা আক্রমণ
কারবালা যুদ্ধের পর মদীনার অধিবাসীরা ইয়াযীদের বাইআত ত্যাগ করেন। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ইয়াযীদ মুসলিম ইবন উকবার নেতৃত্বে ১১ হাজার সৈন্য মদীনায় প্রেরণ করেন। মদীনার অদূরবর্তী হাররা নামক প্রান্তরে ইয়াযীদের বাহিনী ও বনু উমাইয়ার লোকজনের সাথে মদীনাবাসীর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় এবং মদীনাবাসী পরাজিত হন। এরপর ইয়াযীদের নির্দেশনা অনুযায়ী তার সৈন্যরা তিনদিন মদীনা শরীফে হত্যাকান্ড ও লুটতরাজ চালায়। এতে হাজারো সাহাবা-তাবিয়ীন শহীদ হন। আবূ যর গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হত্যাযজ্ঞের দিকে ইঙ্গিত করে তাঁকে বলেছেন,
كَيْفَ أَنْتَ وَقَتْلًا يُصِيبُ النَّاسَ حَتَّى تُغْرَقَ حِجَارَةُ الزَّيْتِ بِالدَّمِ قُلْتُ مَا خَارَ اللهُ لِي وَرَسُولُهُ قَالَ الْحَقْ بِمَنْ أَنْتَ مِنْهُ
-তোমার অবস্থা কী হবে, যখন ব্যাপক গণহত্যা চলবে, এমনকি হিজারাতুয যাইত রক্তে প্লাবিত হবে। আবূ যর বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমার জন্য যা পছন্দ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যাদের সাথে আছ, তাদের অর্থাৎ মদীনাবাসীর দলে যুক্ত থাকবে। (সুনান ইবন মাজাহ, ৩৯৫৮)
মদীনা শরীফে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
الْمَدِينَةُ حَرَمٌ مِنْ كَذَا إِلَى كَذَا لاَ يُقْطَعُ شَجَرُهَا وَلاَ يُحْدَثُ فِيهَا حَدَثٌ مَنْ أَحْدَثَ حَدَثًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
-মদীনা এখান থেকে ওখান পর্যন্ত হারাম। এখানে বৃক্ষরাজি কর্তন করা যাবে না এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। যে ব্যক্তি মদীনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, তার ওপর আল্লাহর, আল্লাহর ফিরিশতাদের এবং সমগ্র মানবজাতির লা’নত। (সহীহ বুখারী, ১৮৬৭)
এরপর ইয়াযীদের বাহিনী মক্কা শরীফে আক্রমণ করে এবং আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের (রা.) ও তাঁর সাথিদের ওপর মিনজানিক বা পাথরগোলা দিয়ে হামলা করে। ওই হামলায় কাবা শরীফ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (ফাতহুল বারী)
ইয়াযীদের ৩ বছরের শাসনামলের প্রথম বছর কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়, দ্বিতীয় বছর মদীনায় এবং তৃতীয় বছর মক্কায় হামলা চালানো হয়। ইয়াযীদের কৃতকর্মকে মূল্যায়ন করে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল, ইবনুল জাওযী, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, শামসুদ্দীন যাহবী, সাদউদ্দীন তাফতাযানী, মাহমুদ আলূসী, শাওকানী, আবদুল হাই লকনভী প্রমুখ ভিন্ন ভিন্ন যুগের সুপ্রসিদ্ধ আলিম-উলামা ইয়াযীদকে লা’নতের পাত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন।
শেষকথা
কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি সমালোচনার তীর ধার্য করা উদ্দেশ্য ছিল না। ইতিহাসের গভীর গিরিখাতে প্রবেশ করে সত্য তালাশ করার পেছনে আমাদের একমাত্র অভিপ্রায় হচ্ছে আহলুল বাইতের প্রতি বনু উমাইয়ার নিদারুণ অত্যাচারের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবহিত হওয়া। নিবন্ধে উল্লেখিত হাদীসসমূহ এবং উলামায়ে কিরামের বিশ্লেষণকে সামনে রাখলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, কারবালার নির্মম ঘটনা হঠাৎ করে সংঘটিত হয়নি। এটি ছিল দীর্ঘদিনের উত্তরোত্তর অবনতির পরিণাম। উসমান (রা.) এর শাহাদাতের পর থেকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, গৌত্রিক রেষারেষি, খিলাফাত ভেঙ্গে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা রাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন এবং সে রাজতন্ত্রের দূষিত উপজাত হিসেবে উদিত হওয়া ইয়াযীদ ও ইবন যিয়াদের মতো লোকদের কারণেই সংঘটিত হয়েছিল কারবালার যুদ্ধ, মদীনা ও মক্কা আক্রমণ। প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি সব সময়ই কারবালার মতো ঘটনার জন্ম দেয়।

ফেইসবুকে আমরা...