ধর্মীয় ও মানবিক কারণে বাংলাদেশের জনগণ সব সময়ই ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেন। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশও ফিলিস্তিনের পক্ষেই সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছিল। শুধু রাষ্ট্রীয় সমর্থন কিংবা জনগণের আবেগ ও ভালোবাসাই নয়, বাংলাদেশের বহু বীরযোদ্ধা ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণও করেছিলেন।
ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগ্রামে অবদান রাখা বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করতে হলে প্রথমেই চলে আসে ১৯৬৭ সালের বিখ্যাত আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। তখনো বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে উঠেনি, তবে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীতে ছিলেন বহু বাঙালি কর্মকর্তা। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ইরাক ও জর্ডানের সশস্ত্র বাহিনীকে সহযোগিতা করতে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সেই সুবাদে বাঙালি সামরিক ব্যক্তিত্বও সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তেমনই এক বীর যোদ্ধা ছিলেন তদানন্তীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বাঙালি ফাইটার পাইলট কিংবদন্তি আকাশযোদ্ধা সাইফুল আজম। ছয়দিনের সেই আরব ইসরায়েল যুদ্ধে ইরাক ও জর্ডানের হয়ে তিনি একাই ৪টি ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত করেন। প্রথম মিশনে জর্ডানের বিমানবাহিনীর হকার হান্টার যুদ্ধ বিমানে করে ভূপাতিত করেন ইসরায়েলি দুটি যুদ্ধ বিমান, পরের দিন আরেক মিশনে ইরাকি বিমান ঘাঁটি থেকে ভূপাতিত করেন আরো দুটি ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমান। মাত্র দুটি মিশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার রেকর্ড তার আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে চাকরি করে অবসরে চলে যান, তারপর রাজনীতিতে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০২০ সালে এই কিংবদন্তি আকাশযোদ্ধার ইন্তেকাল হয়।
স্বাধীনতার পরও ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত থাকে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ফিলিস্তিনে মেডিকেল টিম পাঠিয়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেই সময়কার বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে যা ছিল বিস্ময়কর। তারই ধারাবাহিকতায় আশির দশকে একদল স্বেচ্ছাসেবী বাংলাদেশ থেকে ফিলিস্তিনে গিয়েছিলেন সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে।
১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত মার্কিন কংগ্রেস লাইব্রেরির প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে রিপোর্ট করে যে “৮,০০০ বাংলাদেশি যুবক প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে লড়াই করেছে”। মূলত সে বছর ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তবে এসকল স্বেচ্ছাসেবী আরো আগে ফিলিস্তিনের সংগ্রামে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী লেবাননে পাড়ি জমিয়েছিলেন বলে জানা যায়। মূলত ১৯৮০ সাল থেকেই এসকল স্বেচ্ছাসেবীদের যাত্রা শুরু হয়; পাকিস্তান, ব্যাংকক, দুবাই, সিরিয়া হয়ে তারা পৌছান লেবাননে – সে সময়ের ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে। পরবর্তীতে লেবাননে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী নিয়োগের পর থেকে বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবীরা ফিরে আসতে শুরু করেন, এবং তাদের নতুন করে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে লেবানন যাত্রাও বন্ধ হতে থাকে।
বিপুল সংখ্যক এই তরুণদের মধ্যে অনেকের যেমন লক্ষ্য ছিল আল আকসাকে রক্ষা করা; তেমনি আরো অনেকের লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের সর্বশেষ উপনিবেশকে ধ্বংস করা। তবে আদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও তাদের সকলের লড়াই ছিল মযলুম ফিলিস্তিনিদের পক্ষে, বর্বর ইসরায়েলের বিপক্ষে।
পিএলওর সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশী সেই সকল বীরদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দুঃখজনকভাবে হারিয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস কিংবা ফিলিস্তিনি দূতাবাস কেউই তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সূত্রে তাদের সম্পর্কে খানিকটা তথ্য জানা যায়। মাতৃভূমি থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে ন্যায়ের পক্ষে লড়তে যাওয়া এই যোদ্ধাদের মধ্য থেকে ৪৭৬জন ইসরায়েলিদের হাতে বন্দি হয়ে অমানবিক নির্যাতনও সহ্য করেছিলেন বলে জানা যায়। যারা ফিরে এসেছিলেন, তাদের বেশিরভাগই এখন আর জীবিত নেই, কেউ হয়তো বার্ধক্যে ভুগছেন। কিন্তু তাদের বিস্মৃত ইতিহাস ন্যায়ের পক্ষে বাংলাদেশিদের শিরদাড়া সোজা করে দাঁড়ানোর নজির হয়ে থাকবে চিরকাল।