সমাজতন্ত্রঃ একটি উদাহরণ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বই আছে, নাম ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ। পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া প্রমুখ দেশের জনগণ যখন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পুনরায় পুঁজিবাদের দিকে ফিরে যাচ্ছিল, সুনীল তখন ইউরোপ চষে বেড়াচ্ছিলেন। নিজের চোখে তিনি এসব প্রত্যক্ষ করেছেন। সুনীল সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ভাবতেন, কার্ল মার্ক্সের সমাজতন্ত্রই মানবজাতির সর্বোচ্চ স্বপ্ন। রাষ্ট্র সবকিছুর মালিক হবে, ব্যক্তিমালিকানার মতো পুঁজিবাদী লোভ থেকে বেরিয়ে মানুষ সমবায়ী হয়ে কাজ করবে, যার যা প্রয়োজন সে রাষ্ট্রের কাছ থেকে তা পাবে— এর থেকে ভালো সমাজব্যবস্থা আর কী হতে পারে! অথচ লেখক দেখলেন, মানুষ সমাজতন্ত্রকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে। জনরোষের মুখে বার্লিনকে দুভাগ করা দেয়ালটি মূহুর্তে মাটিতে ধ্বসে পড়েছে। চেতনার কী নির্মম অপমৃত্যু! লেখক ব্যাখ্যা দিলেন, মানুষের এই ঘৃণার পেছনের কারণ এই না যে সমাজতন্ত্র আদর্শ হিসেবে খারাপ ছিল। বরং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর শাসকরা যখন সমাজতন্ত্রকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার বানিয়ে মানুষের সব অধিকার ক্ষুণ্ণ করল, তখন মানুষ শুধু শাসককে নয়; পুরো আদর্শকেই ঘৃণা করতে লাগল।
সুনীলের ব্যাখ্যাটি যৌক্তিক। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বা এর বাইরেও যে কটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল, প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বৈরশাসকরা সমাজতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এত মানুষ হত্যা করেছে যে, সংখ্যাটি কোটি নয়; বরং কয়েক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ফলস্বরূপ, খুব হাকডাক দিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সমাজতন্ত্র আজ ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। কিউবা, ভেনিজুয়েলা বা উত্তর কোরিয়ার মতো হতদরিদ্র ও সর্বদা অশান্ত রাষ্ট্রগুলো ছাড়া আজ আর কোনো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বেঁচে নেই। চীনের চেয়ারম্যান মাও জেদং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য চীনের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। সে চীন আজ আমেরিকার চেয়ে বেশি পুঁজিবাদী। অথচ পুঁজিবাদী হওয়ার পরও কেবল মুখে সমাজতান্ত্রিক চেতনার কথা বলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আজও দেশটির সর্বময় ক্ষমতা বগলে নিয়ে বসে আছে। চীনে কারও কিছু বলার অধিকার নেই।
আমি মার্ক্স বা সমাজতন্ত্রের সমর্থক নই। আমার অসমর্থন কেবল এজন্য নয় যে, সমাজতন্ত্র একটি নাস্তিক্যবাদী জীবনদর্শন। এটি তো আছেই। সেইসাথে আরেকটি কারণ হলো, সমাজতন্ত্র হিউম্যান এজেন্সি তথা কর্মের ওপর মানুষের দায়দায়িত্বকে অস্বীকার করে এবং যাবতীয় খারাপের দায়কে শ্রেণিবৈষম্যের ওপর চাপিয়ে দায়মুক্তি নিতে চায়। বিষয়টি জটিল, তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলছি না। তাছাড়া প্রবন্ধের প্রতিপাদ্যও সমাজতন্ত্র নয়। এখানে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, কার্ল মার্ক্সের স্বপ্নের কমিউনিজম আর লেনিন-স্টালিন বা মাও জেদং-এর সমাজতন্ত্র এক নয়। মার্ক্স সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি আদর্শ হিসেবে। তার আদর্শের সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এর একটি প্রেক্ষাপট ছিল। শিল্পবিপ্লবের সময় ইউরোপে মজুররা যে নিদারুণ নিগ্রহের শিকার হয়েছিল, তাতে মার্ক্সের শ্রেণিবৈষম্যবিহীন সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু মার্ক্সের সেই আদর্শ যখন বাস্তবতার মুখ দেখল, অর্থাৎ পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো, তখন দেখা গেল আদর্শ ও বাস্তবতায় আকাশ-পাতাল তফাত। সাম্যবাদী আদর্শের গান গাওয়া সমাজতন্ত্র হয়ে উঠল পৃথিবীর কঠোরতম একনায়কতন্ত্র। মার্ক্সের আদর্শকে তার পরবর্তীরা মানুষের গলায় বেড়ির মতো আটকিয়ে দিল। কেবল কমিউনিস্ট নয় এই সন্দেহে তারা লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল।
এত বড় পরিসরে না হলেও আদর্শ বনাম বাস্তবতার মধ্যকার ফারাক সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকটভাবে দেখা যায়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই ফারাক দেখা দিয়েছিল মার্ক্সের আদর্শ বনাম সমাজতান্ত্রিক শাসকদের কর্মকাণ্ডে। বাংলাদেশে এটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম মুক্তিযুদ্ধপন্থী শাসকদের কর্মকাণ্ডে।
রাজনীতিতে বয়ানের গুরুত্ব
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামীলীগ গত পনের বছর ধরে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ধরে রেখেছে। দীর্ঘ শাসনামলে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তবে সেসব আপাতত বাদ দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার পেছনে আওয়ামীলীগ সরকারের বয়ান নিয়ে আজ আলাপ করব৷ এখানে বয়ান বলতে ওয়ায মাহফিলের ‘বয়ান’ মনে করবেন না। এই বয়ান ভিন্ন বিষয়।
একজন বা কয়েকজন ব্যক্তি একটি দেশের জনগণকে কীভাবে শাসন করে? জবাব হচ্ছে, ন্যারেটিভ তৈরির মাধ্যমে। ন্যারেটিভ হচ্ছে ঘটনার বিবরণ। বাংলা ভাষায় একে ‘বয়ান’ বলা হয়। একটি ঘটনার নানারকম বিবরণ থাকে। যেমন, কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন— এটি একটি ঘটনা। কেউ এই ঘটনার বিবরণ দেয় এভাবে, কলম্বাস একজন দুঃসাহসী স্বপ্নবান নাবিক, যিনি ইউরোপীয়দের জন্য আটলান্টিক মহাসাগরের ওই পাড়ে একটি নতুন দেশ খুঁজে পেয়েছেন। আবার কেউ বলে, কলম্বাস একজন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী, যিনি আমেরিকার আদিবাসীদের হত্যা করে তাদের দেশকে জবরদখল করেছেন। এই যে একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ, তার প্রত্যেকটিই ন্যারেটিভ বা বয়ান। যে ন্যারেটিভ বেশিরভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, সেটি হয়ে যাবে মাস্টার ন্যারেটিভ বা ‘মহান বয়ান’। যে বিবরণ এর বিপরীতে দাঁড়াবে সেটি হবে কাউন্টার ন্যারেটিভ বা ‘পাল্টা বয়ান’। আবার যদি একদিন কাউন্টার ন্যারেটিভকে মানুষ গ্রহণ করে নেয়, তাহলে সেটি হয়ে যাবে মাস্টার ন্যারেটিভ।
মাস্টার ন্যারেটিভ বা মহান বয়ান হচ্ছে এমন বিবরণ, যাতে ইতিহাসের ঘটনাবলী, অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটমান বিষয়কে নিজের সুবিধামত ব্যাখ্যা বা পুনঃনির্মাণ করে এর মাধ্যমে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও রীতিনীতিকে বৈধ করা হয়। মহান বয়ান মানে এই না যে, বয়ানটি খুব মহান। হতে পারে বয়ানটি অনেকাংশে মিথ্যা। আসল বিষয় হচ্ছে, বয়ানটি যারা দিচ্ছে, তারা শক্তিশালী কিনা এবং মানুষ এই বয়ান গিলছে কিনা। যদি এ দুটি বিষয় নিশ্চিত হয়, তবে একটি বয়ান ‘মহান বয়ান’ হয়ে উঠে। আর কিছু লাগে না। যেমন, কারবালার ঘটনা নিয়ে সুন্নী ও শিআদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ আছে। ইরান শিআ মতাদর্শী, তাই ইরানে শিআ বিবরণটি মাস্টার ন্যারেটিভ। সৌদি, মিশর বা পাকিস্তান সুন্নী মতাদর্শী, তাই এসব দেশে সুন্নী বিবরণটি মাস্টার ন্যারেটিভ। এখানে সত্য কোনটি, সেটি পরের বিষয়। মানুষ ওই নির্দিষ্ট বয়ান বিশ্বাস করছে কিনা, তা-ই রাজনীতিতে মূখ্য। মহান বয়ানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে ইতিহাস বলার ক্ষেত্রে কেবল একটি দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরবে, একই ধারার ঘটনাকে সামনে আনবে এবং শুধু এক ব্যক্তি বা একটি দলের অবদানকে সর্বেসর্বা বানিয়ে দেবে। ফরাসী দার্শনিক লিওটার্ড এধরণের ন্যারেটিভকে বলেছেন মেটা ন্যারেটিভ।
রাজনীতিতে বয়ান তৈরি করা এবং মানুষের কাছে তা বিকানো খুব জরুরি। প্লেটো বলেছিলেন, Those who tell the stories rule society অর্থাৎ, যারা গল্প বলে তারাই সমাজকে শাসন করে। কথাটি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় শাসনপ্রক্রিয়ার সাথে গল্প বা বয়ান কীভাবে জড়িত। বয়ান নির্মাণ করা ছাড়া কেউ শাসন করতে পারে না, সেটি সমাজতন্ত্রে হোক, গণতন্ত্রে হোক কিংবা সামরিক শাসনে হোক।
মুক্তিযুদ্ধের মহান বয়ান
প্রতিটি জাতির কাছে নিজের অস্তিত্ব ও আদর্শ সংক্রান্ত কিছু গল্প থাকে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এ ধরণের গল্প হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আবার যেহেতু দেশের সিংহভাগ জনগণ মুসলমান, তাই ইসলামও এ দেশের মানুষের কাছে একটি বড় গল্প। বাংলাদেশের যে কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক আলাপে মুক্তিযুদ্ধ আসবে, ইসলাম আসবে। মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম ছাড়াও দেশের রাজনীতিতে উন্নয়ন, সুশাসন ইত্যাদির গল্প আছে। এসব গল্প যে সুন্দর করে বলবে, সে-ই দেশ শাসন করবে৷ প্লেটোর কথাটি স্মরণ করুন, যারা গল্প বলে তারাই সমাজকে শাসন করে।
যখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প আসে, তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামীলীগের চেয়ে স্বস্তিকর অবস্থান আর কার আছে? আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাই রাজনীতিতে বয়ান তৈরির ক্ষেত্রে তারা মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে প্রাধান্য দিয়েছে। তারা সেতু-ফ্লাইওভার বানিয়ে উন্নয়নের গল্প শুনিয়েছে। মডেল মসজিদ বানিয়ে ধার্মিকতার গল্পও শুনিয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন ও ধার্মিকতার গল্প তো অন্যান্য দলও শুনাতে পারে। যে গল্পটি আওয়ামীলীগের মতো এতটা যুৎসই করে কেউ শুনাতে পারবে না, সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তাই আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে তারা তাদের রাজনীতির মূল বয়ান তো বানিয়েছে-ই; সেইসাথে এটিকে পুরো দেশের রাজনীতির মূল বয়ান হিসেবেও হাযির করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপনি চাইলেও মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেন না। আপনাকে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আপনার অবস্থান পরিস্কার করতেই হবে। বলা যায় এটি আওয়ামীলীগের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, মাস্টারস্ট্রোক।
মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে মানুষ যখন রাজনীতির সবচেয়ে বড় গল্প এবং মূল চেতনা হিসেবে কবূল করে নিল, তখন আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত অন্যান্য বিবরণকে খারিজ করে কেবল তার নিজস্ব বিবরণ জাতিকে শুনানো শুরু করল। ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের গল্প থেকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবদান বাদ পড়ল। এমনকি জেনারেল ওসমানী ও কাদের সিদ্দিকীর মতো ব্যক্তির নামও মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা থেকে ধীরে ধীরে ফুটনোটে চলে গেল। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজ নিজ তাগিদে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে এসব কথা খুব গৌণ। যুদ্ধশেষে মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা সাধারণ জনগণের হাত থেকে হাতছাড়া হয়ে গেছে। আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যে বয়ান তৈরি হয়েছে তা এক ব্যক্তি ও একটি দলের মালিকানাধীন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী, সেটি আজ একটি দলই ঠিক করে দেয়। বেচারা বাঙালি জাতি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বিষয়টি কবূল করে নিয়েছে। ফলে দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে আওয়ামীলীগের তৈরি করা ন্যারেটিভ হয়ে উঠেছে মাস্টার ন্যারেটিভ, মহান বয়ান।
এক্ষেত্রে দেশের আরেক বৃহৎ দল বিএনপি পড়েছে ব্যাপক বিড়ম্বনায়। একেতো মুক্তিযুদ্ধে দল হিসেবে বিএনপির অবদান নেই। বিএনপির জন্মই হয়েছে যুদ্ধের প্রায় এক দশক পর। তার ওপর তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল জামায়াতের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে রাজনীতি করছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে বিএনপি খুব একটা যুৎসই অবস্থানে নেই। যদিও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দলটিতে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বা এখনও আছেন, তবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়াটা এখানে মোটেও বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের যে বয়ান আওয়ামীলীগ হাযির করেছে, সেই বয়ানের ভেতর আপনি ‘ফিট’ হতে পারছেন কিনা। ফিট হতে পারলে মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুহম্মদ জাফর ইকবাল হয়ে যান মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। আবার ফিট হতে না পারায় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান ‘পাকিস্তানের ধুসর’ হয়ে থেকে যান।
মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে মাস্টার ন্যারেটিভ বানানোর পর আওয়ামীলীগ ‘বুশ-ডকট্রিন’ প্রয়োগ করছে। বুশ ডকট্রিন হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের মনোভাব। বুশ বলেছিলেন, হয় তুমি আমাদের পক্ষে, নয়তো তুমি টেরোরিস্ট। ধীরে ধীরে আওয়ামীলীগ একই সুরে বলতে শুরু করে, হয় তুমি আমাদের পক্ষে, নয়তো তুমি রাজাকার। একাডেমিক ভাষায় আমরা একে বলি ডাইকোটমি বা দ্বান্দ্বিকতা। হয় এটি, নইলে ওটি। মুক্তিযুদ্ধের গল্প, যা ইতিমধ্যে দেশের রাজনীতিতে মূল বয়ান হয়ে গেছে, সেটিকে আওয়ামীলীগ আরও একধাপ এগিয়ে ডাইকোটমিতে নিয়ে যায়। এর ফলে এতদিন ধরে তারা রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে আসছে। কেউ সরকারের বিপক্ষে কথা বললেই সে হয়ে গেছে রাজাকার, খুব সিম্পল।
কিন্তু এবারের ছাত্র আন্দোলনে এই ডাইকোটমি তো ভেঙ্গেছে-ই, সেইসাথে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে আওয়ামীলীগের মাস্টার ন্যারেটিভ মারাত্মকভাবে ধাক্কা খেয়েছে। এই ধাক্কার সূচনা অবশ্য ২০১৭-১৮ সালেই হয়ে গিয়েছিল, যখন মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে স্পষ্ট ভাষায় রাজাকার বলেছিলেন। প্রতিবাদে কিছু শিক্ষার্থী নিজেদেরকে রাজাকার বলে গলায় প্লেকার্ড ঝুলিয়ে হেঁটেছে। এবারের আন্দোলনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একই সুরে, ভিন্ন শব্দে মতিয়ার কথাটি পুনঃব্যক্ত করেছেন৷ তাতেই গর্জে উঠেছে ছাত্র সমাজ। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লোগান উঠেছে “আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার” বলে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ছাত্ররা এখন মুক্তিযুদ্ধের মাস্টার ন্যারেটিভের ভেতর ফিট হওয়াকে পাত্তা দিচ্ছে না। এটি ভালো হয়েছে কি খারাপ, সে আলাপে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু আওয়ামীলীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে ধাক্কা খেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এটিই সম্ভবত ২০২৪ সালের রক্তঝরা ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে বড় পরিচায়ক হয়ে থাকবে।
সময়ের জিজ্ঞাসা
এবার প্রশ্ন হলো, ধাক্কা খাওয়ার পরও কি আওয়ামীলীগ প্রণীত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশের রাজনীতির মাস্টার ন্যারেটিভ হয়ে থেকে যাবে? নাকি এখন দেশের রাজনীতিতে অন্য কোনো বয়ান আসবে? যদি আসে, সেটি কে নিয়ে আসবে? আওয়ামীলীগ নাকি বিএনপি? এটিও প্রশ্ন যে, মুক্তিযুদ্ধের গল্প বা চেতনা ব্যতীত বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে কি আর কোনো শক্তিশালী গল্প আছে, যা দিয়ে বয়ান তৈরি করা সম্ভব? উন্নয়ন নিয়ে কি এরকম শক্ত বয়ান তৈরি করা সম্ভব? আওয়ামীলীগ অবশ্য উন্নয়নকে বয়ান হিসেবে হাযির করার চেষ্টা বহুদিন ধরে করছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে আওয়ামীলীগকে উন্নয়নের সরকার হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। ওদিকে বিএনপি আওয়ামীলীগের পাতানো নির্বাচনের অভিযোগ দিয়ে এর মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারকে তাদের রাজনৈতিক বয়ান হিসেবে হাযির করে। যেন বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ‘ডুবে যাওয়া’ গণতন্ত্র আবার ভেসে উঠবে!
তবে এসব ছাপিয়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু ইসলাম ইতিমধ্যে দেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ‘গল্প’, তাহলে ইসলাম নিয়ে কি এ দেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বয়ান তৈরি করা সম্ভব? আলিম-উলামা কি সেটি করতে চেষ্টা করেছেন? ইসলামকে এ
দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিরসনের হাতিয়ার হিসেবে কি হাযির করাতে পেরেছেন? জবাব সম্ভবত না-বাচকই হবে। আজও ইসলামপন্থীরা এ দেশের রাজনীতির মূলস্রোতে ইসলামকে ইন্ট্রোডিউস করাতে পারেননি। এতটা ইসলামপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও দেশের মানুষের কাছে ইসলাম এখনও ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে মসজিদ ও কতিপয় দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে। দেশের ইসলামপন্থীরা যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে এক ধরণের অস্বস্তিকর শীতনিদ্রায় চলে যান। তারা কেবল সেসব ইস্যু নিয়েই মাঠে আসেন, যে ইস্যুটি তাদের রিলিজিয়াস ফ্রেইমওয়ার্কের ভেতর ফিট হয়। অন্যথায় তারা নীরব থাকেন। আবার নির্বাচন এলে তারা বিভিন্ন দলের জন্য ভোট-ব্যাংক হিসেবে হাযির হন। দেশের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা ও গুরুত্ব এতটুকুই। অস্বস্তিকর হলেও এটিই তেতো সত্য।
দেশে এখন মাস্টার ন্যারেটিভের শূন্যতা দেখা দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম জাফর ইকবালীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এখন আর পাত্তা দিচ্ছে না। ক্ষমতায় যারা ছিল, তারাই আছে, কিন্তু তাদের ক্ষমতায় থাকার পেছনের যৌক্তিকতা মারাত্মকভাবে ধাক্কা খেয়েছে৷ এবার কি আলিম-উলামা এগিয়ে আসতে পারেন না? কোনো সেক্যুলার দলের ভেতরে নিজেদেরকে হারিয়ে না ফেলে তারা কি ইসলামকে দেশের শান্তি, স্থিতি, সুশাসন ও উন্নয়নের শক্তিশালী বয়ান হিসেবে হাযির করাতে পারেন না? তারা কি এই চেষ্টাও করবেন না? জানি না, করবেন কিনা। কিন্তু এতটুকু জানি যে, যদি তারা এই সুযোগ কাজে না লাগান, তাহলে আগামী কয়েক দশকেও ইসলামপন্থীরা দেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হতে পারবেন না। ইসলামপন্থীদের রাজনীতি দেশের মূলস্রোত থেকে দূরে, ‘দ্বিতীয় শ্রেণির রাজনীতি’ হয়েই থেকে যাবে।