1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
ছাত্রী জীবনে শালীনতা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
অধ্যাপিকা হাফিজা খাতুন
  • ৬ নভেম্বর, ২০২২

আজ থেকে চার পাঁচ দশক আগেও বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে মেয়েদের তেমন উশৃঙ্খল পদচারণা দেখা যায়নি। তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা ছিল সংখ্যায় কম। দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের আগমনের ব্যাপকতা লাভ করে স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের পর থেকে। বর্তমানে শতাব্দীর শেষ দশকে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা প্রায় সমসংখ্যায় এসে দাঁড়িয়েছে। আর সেই সাথে আধুনিকতাও আরো প্রসার লাভ করছে। যাকে এখন আর আধুনিকতা বলা যায়না, বলা যায় নগ্ন হওয়ার প্রতিযোগিতা।
কয়েক দশক পূর্বেও শহরের ছাত্রীদের মাঝে বিশেষ করে মুসলিম পরিবারে মেয়েদের ইসলামী অনুশাসনের বলয়ে চলতে দেখা গেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ও পুরুষকে পৃথকভাবে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। এ সময় শালীনতা একটা মুখ্য বিষয় ছিল। এ প্রসঙ্গে বলা যায় পঞ্চাশ ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কোনো মেয়ের সাথে কোনো ছেলেকে কথা বলতে দেখলে, ছেলেকে জরিমানা করা হতো। এমনকি কোনো মেধাবী ছেলেকে বিদেশে স্কলারশীপ দেওয়ার আগে খতিয়ে দেখা হতো তার ব্যক্তি স্বভাব-চরিত্রকে। অনেক মেধাবী ছেলের এমনও হয়েছে যে একটি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব ও কাছাকাছি সম্পর্ক থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিদেশে স্কলারশীপ দেননি। অথচ আজ এসব কাল্পনিক গল্প মনে হবে পাঠকদের কাছে। আমাদের এই প্রজন্মে কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা এই সব ঘটনা থেকে তুলনা করে অতি সহজে অনুমান করা যায়। সে সময় মেয়েদেরকে ছেলেদের মিছিল মিটিং এ দেখা গেছে বলে শোনা যায়নি। আর আজ মেয়েরাই মিছিলের সর্বাগ্রে থাকে। মনে হয় তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর ছেলেরা তাদের অনুসরণ করছে।
একথা সত্য, বাংলাদেশের সময় বদলেছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত। বিশ্ব আজ এগিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান আধুনিকতায়। আর সেই সাথে ধীরে ধীরে ছিটকে পড়ছে ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধি নিষেধের বলয় থেকে। এর প্রধান কারণ হলো ধর্মকে গভীর ও সঠিকভাবে অনুসরণ না করা। ইসলাম ধর্ম পথে না চলে মানব রচিত বিধানের পথে চলা।
এই শতকের শুরুতে রাশিয়া সমাজতন্ত্র কায়িম করে ধীরে ধীরে প্রায় দুই ডজন দেশকে তার তন্ত্রের আয়ত্বে এনে বিশৃঙ্খল ও বিভক্তির সৃষ্টি করে। পাশাপাশি চলতি শতকের শেষ দিকে বিশ্বে আবার জোয়ার আসে তথাকথিত মানব রচিত গণতান্ত্রিক ধারার। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই জোয়ারে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয় এবং বিনিময়ে তারা পায় তথাকথিত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধারা। আর এর নাম দেয় আধুনিকতা। ফলে নারীদের কাছে এই আধুনিকতাটি নগ্নতায় রূপ নেয়। তখনই শুরু হয় নগ্নতার প্রতিযোগিতা। শিক্ষাঙ্গনেই প্রথম এর প্রভাব জীবাণুর মত ছড়িয়ে পড়ে।
এতে ছাত্রীরা হারায় তাদের শালীনতা। বোরখা হারিয়ে যায় একসময়। তারপর আসে মাথায় বড় ওড়না। সেটাও সময়ের তালে পড়ে যায়। পোশাক ক্রমে ক্রমে কমতে থাকে। এখন মেয়েদের শরীরের এক বৃহৎ খোলা অংশে সূর্যের আলো পড়ে। ছেলেদের পাশাপাশি বসে গল্পগুজব চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
ঢাকা শহরের পার্কগুলোকে এখন আর পার্ক বলা যায়না। এগুলো পরিণত হয়েছে প্রেম নিকুঞ্জে। কপোত কপোতিদের দিনরজনীর আড্ডাখানা। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানে সময় কাটিয়ে যায়। আর তাদের সাথে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা তো আছেই। সহজ সরল ধর্মপরায়ণ পথচারীদের এখন নির্বিঘেœ এসব পার্কের পাশ দিয়ে পথচলা রীতিমত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পথচারীরা পথ চলতে হঠাৎ চোখ ফেলছে তাদের উপর। দেখা যাচ্ছে বেপরোয়াভাবে তারা গায়ে গা ঘেঁষে বসে বসে গল্প করছে, হাসছে, বাদাম চিবোচ্ছে; সে এক অশালীন বেহায়াপনার স্বপ্নকান্ড মনে হবে পথচারীর কাছে। এটা একদিক দিয়ে যেমন বিরক্তিকর অন্যদিক থেকে তেমনি লজ্জাকরও বটে।
দেশে প্রায় ডজনেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে ছাত্রীদের আসল রূপ চরিত্র বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়না। ঐতিহ্যবাহী নামধারী প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এখন ছেলেমেয়েদের দীর্ঘ সময়ের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। যা এক সময় ছিল কল্পনাতীত। বৃহৎ দুটি ছাত্রী নিবাসে (শামসুন্নাহার হল ও রোকেয়া হল) মেয়েদের একটি বড় অংশ অবস্থান করছে। একসময় তাদের সন্ধ্যার পরপরই হলের ভিতর ঢুকতে হতো। কিন্তু বর্তমানে রাত ৯টা পর্যন্ত তাদের হলের বাইরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ এর সূর্যাস্ত আইন বাতিলের দাবিতে মেয়েরা মিছিল মিটিং করে সে আইনকে শিথিল করে এটা করেছে। যুক্তি দেখিয়েছে মেয়েদের লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ার কথা, বাইরে নানা ধরনের কর্মব্যস্ততার কথা। কিন্তু তার সত্যতা অনেকখানিই অমূলক। অথচ সন্ধ্যার পর ৩০/৪০ জন ছাত্র-ছাত্রীর বেশি লাইব্রেরিতে অবস্থান করছেনা।
অপরদিকে মেয়েদের হলগেটদ্বয়ের সামনে থেকে শুরু করে ডাস, অডিটোরিয়াম এবং চত্বরে রাত দশটা পর্যন্ত শতশত ছেলেমেয়েদের ভীড় লেগে থাকছে। রাত একটু বাড়লেই দেখা যায় হল সংলগ্ন রাস্তার পাশে অন্ধকারে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়েরা গায়ে গা ঘেঁষে বসে আছে। একে অপরের প্রতি বেপরোয়া আচরণ করছে। সাধারণ ভদ্রলোকের পক্ষে তখন রাস্তা দিয়ে রিকশায় কিংবা হেঁটে চলা রীতিমত লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। মতিহার চত্বর যেন এক প্রমোদ আর আড্ডা চত্বরে পরিণত হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বৃহৎ অংশ মেতে আছে এই আড্ডায়, ছাত্রীদের পোশাকে চালচলনে তারা যেমন নগ্ন, তাদের পদচারণাও তেমনি আধুনিক।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত কুষ্টিয়ার এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নামেমাত্র ইসলামী ফ্যাকালটি রয়েছে, এর ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার, আর বাকী সব অন্যান্য বিষয়ের ছাত্র। নামেমাত্র ইসলামী কয়েকটি বিষয় পড়ানো হচ্ছে এখানে। ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা অনেকটা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। শরীআহ ফ্যাকালটিতে মেয়েদের মধ্যে কিছুটা শালীনতাসুলভ পোশাক থাকলেও অন্যান্য ফ্যাকালটির অবস্থা অত্যন্ত করুণ। যা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একান্ত কাম্য নয়।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে ছেলে ও মেয়েদের পাশাপাশি এবং একই বেঞ্চের এই শিক্ষা ব্যবস্থাটি যতটা না প্রভাব বিস্তার করছে তার চেয়ে বেশি বিস্তার করছে আধুনিকতার নামে অপসংস্কৃতি আর নগ্নতার জোয়ার। এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়েগুলো বাইরের পরিবেশে মিশে তাদের নৈতিক সুন্দরতম চরিত্রটাকে হারাচ্ছে। ইসলামী আইন অনুশাসন থেকে তারা দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় পা দিয়ে তারা নিজেদেরকেই নিজেদের যোগ্য অভিভাবক মনে করছে। কোনো উপদেশ আর পিতামাতা বা বড়দের অভিভাবকত্ব তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছেনা।
বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত। আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। দেশের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি জনসংখ্যা মুসলমান। অথচ তারপরেও বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যায়, আমরা কতটা নীচে নেমে গেছি। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে আজ মেয়েদের যে অবস্থা বিরাজ করছে আমাদের মধ্যে তাও নেই। আর অন্যান্য ইসলামী দেশগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম।
যে দেশে ইসলামকে ঘটাকরে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়। ইসলামের নামে রাষ্ট্রের বড় বড় দলগুলোর নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা বিবৃতি দেন, সেদেশে মেয়েদের নৈতিকতা, পর্দাশীলতা কিভাবে এতটা অবনতির দিকে দিন দিন ধাবিত হচ্ছে তা অতি সহজেই অনুমেয়। মূলতঃ আমাদের দেশে ইসলামের নাম করে কিছু ধ্বজাধারী মুখোশ পরিধানকারী লোক রয়েছে তারা এটাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা যুগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া একশ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহল রয়েছে তারা মৌলবাদ মৌলবাদ বলে ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের সমালোচনা করছে। ইসলাম আধুনিকতার অন্তরায়, তারা ইসলাম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা বলছে ইসলাম নারীদের সঠিক মূল্যায়ন করেনি, এ যুগে ইসলাম আকার্যকর। ইত্যাদি নানা ধরনের কথা তারা বলছে। এতে উৎসাহ পাচ্ছে এ প্রজন্মের নারীরা এবং শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রীরা। এ কারণে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলো আজ এতো নগ্নতা বেহায়াপনা আর অশালীনতায় ভরে যাচ্ছে। এর প্রভাবে সুন্দর গোলাপের মত ছেলেরা তাদের নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা ক্রমশঃ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নারী তাদের কাছে পড়াশোনার পাশাপাশি একটা আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পাসে, করিডোরে, আবাসিক হলে নারী নিয়ে আলোচনা একটি অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোর অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো অবস্থা বিরাজ করবে। ফলে নানা ধরণের অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হবে। নতুন নতুন জটিল রোগের আবির্ভাব ঘটবে। ইসলামী অনুশাসন আর পর্দা ও শালীনতার কোনো নিয়ম থাকবেনা। আমাদের পারিবারিক জীবনে নেমে আসবে চরম বিশৃঙ্খলা। আমরা হবো মুসলিম নামধারী অশালীন অনৈতিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ এক ধর্মচ্যুত পথভ্রষ্ট পতিত জাতি।

ফেইসবুকে আমরা...