1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
এক বিপ্লবী নেতার শাহাদত ও আযাদীর সংগ্রামের ভবিষ্যৎ
মুহাম্মাদ বিন নূর
  • ২ আগস্ট, ২০২৪

গাযায় চলমানে ইসরায়েলি বর্বরতায় ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ প্রধান শত্রু হামাস এবং সবচেয়ে শক্তিধর শত্রু ইরান। “হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায়” ইরানের রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর দেড় মাসের মধ্যে ইরানের রাজধানী তেহরানেই শাহাদত বরণ করলেন হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান ইসমাইল হানিয়া। ইরানের নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে নতুন রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠক করেন হানিয়া। সে রাতেই তার মৃত্যু হয় ইসরায়েলের হাতে।
এতো  অল্প সময়ের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধ অক্ষের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার মৃত্যু নিছক কাকতালীয় কিনা বলা মুশকিল, কারণ ইরান তাদের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেনি, নিছকই দুর্ঘটনা বলে চালিয়েছে, যদিও অনেক বিশ্লেষকই তা মানতে নারাজ। তবে ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পিছনে ইসরায়েলের দায় মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত। ইসরায়েল ঠিক কীভাবে হানিয়াকে শহীদ করেছে, সেই বিবরণের চেয়ে বরং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই ঘটনার প্রভাব কী হতে পারে– সে বিষয়টি। তাই ইসমাইল হানিয়ার জীবন ও কর্ম আলোচনার বদলে সরাসরি তার শাহাদতের প্রভাব নিয়েই আলোচনা করা শ্রেয়।
কাতারে বসবাসরত ইসমাইল হানিয়া চলমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধবিরতি আলোচনায় ফিলিস্তিনীদের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র ছিলেন। প্রধানত ইসরায়েলের অযৌক্তিক গোয়ার্তুমির কারণে কোন ‍যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবে রূপায়িত না হলেও হানিয়া বিচক্ষণতার সাথে সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায়। ঠিক এই পরিস্থিতিতে তাকে শহীদ করার পিছনে ইসরায়েলের অনেকগুলো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যে কোন মূল্যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু গাযায় এতো দীর্ঘ সামরিক অভিযান পরিচালনা করেও তিনি সেই অর্থে কোন জয়ের নিশান তার স্বজাতির হাতে তুলে দিতে পারেননি। তাই তার দরকার যে কোন মূল্যে কোন সাফল্য অর্জন। যুদ্ধের ময়দানে আল কাসসাম ও অন্যান্য প্রতিরোধযোদ্ধাদের পরাস্ত করে সেই সাফল্য অর্জন ক্রমেই অসম্ভব থেকে অসম্ভবতর হয়ে উঠছে, তাই ময়দানের বাইরে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে সাফল্য দেখানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
তাছাড়া আলোচনার টেবিলে ইসমাইল হানিয়ার মনোবল ভেঙে দিতে এবারের যুদ্ধে ইসরায়েল তাঁর বোন, তিন ছেলেসহ বৃহৎ পরিবারের প্রায় ৬০ জন সদস্যকে শহীদ এবং আরো অনেককে আহত করে। তাতে ইসমাইল হানিয়ার অবস্থানে একটুও পরিবর্তন আসেনি, বরং তিনি গণমাধ্যমকে জানান যে হাজার হাজার ফিলিস্তিনীর চেয়ে আমার পরিবারের কারো জীবন অধিক মূল্যবান নয়, তাই এ কারণে প্রভাবিত হয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নই উঠে না। আলোচনার টেবিলে তার উপর নৃশংস চাপ প্রয়োগ শেষেই তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়া হলো।
মূলত নেতানিয়াহুর এই মুহূর্তে একমাত্র চাওয়া হলো যুদ্ধকে প্রলম্বিত করা এবং সম্ভব হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো। সেই জায়গা থেকে ইসরায়েল বিভিন্নভাবে ইরানকে যুদ্ধে জড়ানোর উসকানি দিলেও ইরান কেবল বাগাড়ম্বরের বাইরে সত্যিকারের যুদ্ধে সরাসরি জড়াতে চাচ্ছে না। এদিকে ইরান নিজে থেকে সরাসরি যুদ্ধ শুরু না করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এর আগের কোন উসকানিতে কাজ না হওয়ায় তাই ইসরায়েল এবার সরাসরি ইরানের রাজধানীতে হামলা করে হামাসের প্রধান নেতাকে শহীদ করলো, যাতে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার আর কোন উপায়ই ইরানের হাতে না থাকে। আর একান্তই যদি ইরান যুদ্ধে নাও জড়ায়, তবু ইয়ামান, লেবানন, ইরাক এবং সিরিয়ায় ইরানের প্রক্সি যোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা বাড়বে ফলে অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। এ দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনে ইসরায়েল নিঃশর্ত সহযোগিতা করলেও নেতানিয়াহু তার এবং তার দলের উপর সন্তুষ্ট নয়। ফলে নেতানিয়াহুর চাওয়া— যে করেই হোক নভেম্বর অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মার্কিন নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে হবে। ইসরায়েলের ধারণা, তাতে আরো উগ্র মার্কিন সহায়তা লাভ সম্ভব হতে পারে এবং হামাসের সাথে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতিতে যাওয়া নাও লাগতে পারে।
এই গুপ্তহত্যার পর ইসরায়েলের তথা নেতানিয়াহু স্বল্পমেয়াদে কিছুটা ফায়দা হাসিল হতে পারে। বিশেষত ইসরায়েলের রাজপথে যারা তার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাদের একটা অংশ কিছুটা হলেও এই ঘটনায় উৎফুল্ল হবে, তার পাশে দাঁড়াবে এমনটাই তাঁর প্রত্যাশা। কিন্তু এর ফলে ইসরায়েলের রাজপথের মূল যে দাবি— বন্দিমুক্তি, তাতে কোন ইতিবাচক প্রভাব না পড়ার দরুণ এই উৎফুল্ল ভাব খুব দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে হয় না। ফলে এটি খুবই স্বল্পকালীন ফায়দা বটে। তবে কোন কোন বিশ্লেষক মনে করছেন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে যদি হামাসের সাথে চুক্তি করাই লাগে, সেক্ষেত্রে বন্দি বিনিময় চুক্তির আগে এরকম একটি “বিজয়” দেখিয়ে নেতানিয়াহু তার উগ্রবাদী সমর্থকদের সামনে মুখরক্ষা করতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ ‘হানিয়াকে হত্যা করেছি, এখন হামাসের সাথে চুক্তি করে বন্দিদের মুক্ত করছি’— এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে দেশের ভিতরের দুই শিবিরকেই হাতে রাখার চেষ্টা করতে পারেন নেতানিয়াহু। কিন্তু বাস্তবে এমন পরিস্থিতির চেয়ে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগই বেশি বলে মনে হচ্ছে।
ইসমাইল হানিয়ার শাহাদতের ফলে তাই নেতানিয়াহু স্বল্পমেয়াদে ফায়দা ভোগ করলেও দীর্ঘমেয়াদে ইসরায়েলের অস্তিত্ব সংকটকে আরো প্রকট করে তুলবে। অবরুদ্ধ গাযা উপত্যকার প্রতিরোধযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যেখানে ইসরায়েলি বাহিনীকে রীতিমতো পর্যুদস্ত হতে হচ্ছে, এখনো কোন একটি অঞ্চল থেকেও হামাসযোদ্ধাদের হটানো সম্ভব হয়নি, সেখানে ইরানের রাজধানীতে হামলার ফলে যদি ইরানের সব কয়টি প্রক্সি শক্তি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে তবে ইসরায়েলের পক্ষে মার্কিন সহায়তা নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
ফিলিস্তিনিরা নিঃসন্দেহে এই সময়ে তাদের অন্যতম প্রধান নেতাকে হারিয়েছে, যা তাদের জন্য প্রচণ্ড বেদনার বিষয়। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথ চলায় এ ঘটনা তাদের জন্য অনুপ্রেরণার আরেক উৎস ছাড়া আর কিছুই হবে না। হামাস বা এ ধরনের যে কোন সংগঠনের নেতৃত্ব সব সময়ই ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারানোর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন, ইসমাইল হানিয়ার মতো নেতা যে যেকোন সময় শহীদ হতে পারেন এ বিষয়ে হামাসের সর্বস্তরে মানসিক প্রস্তুতি ছিল। এর আগেও হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমদ ইয়াসিন থেকে শুরু করে বহু শীর্ষ নেতা শহীদ হয়েছেন, তাতে শোক বিহ্বল হয়ে তাদের সংগ্রাম থেমে যায়নি, বরং আপন গতিতে এগিয়ে গেছে। এসকল প্রতিরোধ আন্দোলন যেহেতু কোন ব্যক্তিনির্ভর আন্দোলন নয়, ফলে কোন এক শীর্ষনেতার মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণের পূর্ণ প্রস্তুতি তাদের আগে থেকেই গ্রহণ করা থাকে।  এর আগে আল কাসসামের কমান্ডার ইন চীফ গুপ্তঘাতকের হাতে শহীদ হলে তারচেয়েও কঠোর কমান্ডার মুহাম্মাদ আদ-দ্বাইফের উত্থান ঘটে, ফিলিস্তিনের সিংহখ্যাত আব্দুল আজিজ রানতিসি শহীদ হলে সামনে আসেন কিংবদন্তি ইয়াহইয়া আস-সিনওয়ার যাদের নেতৃত্বে আল আকসার তুফানে আজ ইসরায়েলিদের ঘুম হারাম হয়ে পড়ছে। ফলে ইসমাইল হানিয়ার শাহাদতের সৃষ্ট নেতৃত্বশূন্যতা যে খুবই সাময়িক, দীর্ঘমেয়াদে স্বাধীনতার সংগ্রামে এর কোন নেতিবাচক প্রভাবই পড়বে না, তা মোটামুটি নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়। উপরন্তু ইসরায়েলের দালালিতে লিপ্ত অনেকে যে হামাসের রাজনৈতিক শাখার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অবান্তর অভিযোগ উত্থাপন করেন যে তারা বিলাসবহুল নিরাপদ জীবন যাপন করে ফিলিস্তিনীদের জীবনের ঝুঁকিতে ফেলছেন, শহীদ ইসমাইল হানিয়ার শাহাদত এসকল দালালদের গালেও শক্ত চপোটাঘাত হয়ে থাকলো বৈকি।
সর্বোপরি আযাদীর জন্যে যে লড়াই, তার শিকড় এতোটাই গভীরে থাকে যে কোন ব্যক্তি তা সে যত গুরুত্বপূর্ণই হোন না কেন, তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির চেয়ে বরং মানুষের মুক্তির বাসনাই সেই লড়াইকে এগিয়ে নিতে মূল চালিকা শক্তির ভূমিকা পালন করে। ফিলিস্তিনীদের মধ্যে সেই চূড়ান্ত বাসনার উপস্থিতি কার না চোখে পড়ে। আর তাই সাগর থেকে নদী অবধি আযাদি অর্জিত হবেই, আল্লাহর সাহায্য আসবেই, কারণ আল্লাহ তার ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। তিনি তার বান্দাদের এই প্রচেষ্টাকে বিফল করবেন না। ইসমাইল হানিয়ার শাহাদত তাই দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামে কোন নেতিবাচক প্রভাব তো ফেলবেই না, বরং প্রেরণার উৎস হয়ে অমর থাকবে।

ফেইসবুকে আমরা...