1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
আহলুল বাইতের মর্যাদা ও পরিচয়
মুহাম্মদ মঈন উদ্দিন
  • ৮ আগস্ট, ২০২২

আহলুল বাইত অর্থ পরিবারের সদস্যবৃন্দ। আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামীন, সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা, আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুণ্যবতী সহধর্মিনীগণ, তাঁর সন্তানাদি ও সম্ভ্রান্ত খান্দান ‘বনূ হাশিম’ যাদের উপর যাকাত গ্রহণ করা হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে তাঁরা এবং তাঁদের বংশধরগণই ‘আহলুল বাইতে রাসূল’ অথবা ‘আহলুল রাসূল’ নামে পরিচিত। আহলুল বাইত কারা এ সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের তিনটি মতের মধ্যে এ মতই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য।
এ মতের সমর্থনে যে সকল দলীল রয়েছে তার কয়েকটি সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
১. কুরআন কারীমে সূরা ‘আল-আহযাব’ এর ৩৩ নং আয়াতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহলুল বাইতকে সম্বোধন করে মহান আল্লাহ তাদেরকে সর্বপ্রকারের কলুষতা ও অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। এ আয়াত ‘আয়াতে তাত্বহীর’ নামে পরিচিত। উক্ত আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে দু’টি মত আছে। এক. এ আয়াত হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রা.) সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। দুই. এটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পুণ্যবতী সহধর্মিনীগণ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তারা সকলেই আহলুল বাইতের অন্তর্ভুক্ত।
২. মুসলিম শরীফে হযরত যায়িদ ইবন আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস রয়েছে, যা ‘হাদীসে খুম’ (حديث خم) নামে পরিচিত। এ হাদীসখানা বর্ণনা শেষে হযরত হুসাইন যিনি হযরত যায়িদ (রা.) কে হাদীস বর্ণনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর প্রশ্নের উত্তরে হযরত যায়িদ ইবন আরকাম (রা.) বলেছিলেন,

نساء من اهل بيته، ولكن اهل بيته من حرم الصدقة بعده- قال ومن هم؟ قال: هم ال على وال عقيل، وال جعفر وال عباس- قال: كل هؤلاء حرم الصدقة؟ قال: نعم-

-নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবিগণ তাঁর আহলুল বাইত, তবে প্রকৃত আহলুল বাইত হচ্ছেন তারা, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়াও যাদের উপর যাকাত হারাম করা হয়েছে। প্রশ্নকারী প্রশ্ন করলেন, তারা কারা? যায়িদ (রা.) উত্তরে বললেন, তারা হচ্ছেন- আলী (রা.) এর বংশধর, আকীল (রা.) এর বংশধর, জাফর (রা.) এর বংশধর এবং আব্বাস (রা.) এর বংশধর। প্রশ্নকারী আবার বললেন, এদের সবার উপরেই কি যাকাত গ্রহণ হারাম করা হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।
৩. মুসলিম শরীফে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

خرج النبى صلى الله عليه وسلم ذات غداة وعليه مرط مرحل من شعر اسود، فجاء الحسن رضى الله عنه فادخله معه، ثم جاء الحسين فادخله معه، ثم جاءت فاطمة رضى الله عنه فادخلها معه، ثم جاء على رضى الله عنه فادخله معه، ثم قال صلى الله عليه وسلم: انما يريد الله ليذهب عنكم الرجس اهل البيت ويطهركم تطهيرا-

-নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সকালে হুজরা শরীফ থেকে বের হলেন, তখন তাঁর পরিধানে ছিল কালো পশমের ডোরাদার একটি আলখাল্লা। ইতোমধ্যে হযরত হাসান (রা.) আসলেন, তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আলখাল্লার ভেতরে নিজের সাথে প্রবেশ করালেন। তারপর হযরত হুসাইন (রা.) আসলে তাঁকেও আলখাল্লার ভেতরে নিজের সাথে প্রবেশ করালেন। তারপর হযরত ফাতিমা (রা.) আসলে তাঁকেও তিনি নিজের সাথে আলখাল্লার ভেতরে প্রবেশ করালেন, তারপর হযরত আলী (রা.) আসলে তাঁকেও তিনি নিজের সাথে আলখাল্লার ভেতরে প্রবেশ করালেন, অতঃপর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করলেন,

انما يريد الله ليذهب عنكم الرجس اهل البيت ويطهركم تطهيرا-

-হে নবী পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে সমস্ত কলুষতা ও অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত:পবিত্র রাখতে।
৪. উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এ আয়াত (অর্থাৎ আয়াতে তাতহীর) আমার ঘরে অবতীর্ণ হয়। তখন আমার ঘরে হযরত ফাতিমা, আলী, হাসান ও হুসাইন (রা.) উপস্থিত ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সকলকে নিজের চাদর দিয়ে ঢেকে ফেললেন এবং বললেন, হে আল্লাহ, এরা হচ্ছে আমার আহলুল বাইত, তাদের থেকে সকল অপবিত্রতা দূর করে দাও এবং তাদেরকে পবিত্র ও নিষ্কলুষ বানিয়ে দাও। (আদ দুররুল মানসূর)
৫. হযরত সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন মুবাহালার আয়াত (সূরা আলে ইমরানের ৬১ নং আয়াত) অবতীর্ণ হয়, তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রা.) কে ডেকে নিয়ে আসেন এবং বলেন: اللهم هؤلاء اهل بيتى হে আল্লাহ, এরা হচ্ছে আমার আহলুল বাইত। (মুসলিম, তিরমিযী)
উল্লেখিত বর্ণনাসমূহ থেকে একথা স্পষ্ট হলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পুণ্যাত্মা বিবিগণ, সন্তান-সন্ততি এবং তাঁর পবিত্র খান্দানের লোকজনই হচ্ছেন আহলুল বাইতে রাসূল বা আহলুল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

আহলুল বাইত এর মর্যাদা
আহলুল বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তাদের নিসবাত বা সম্পর্ক। যেমন, তারা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিনী, অথবা খান্দান অথবা সন্তান।
‘ازواج مطهرات’ অর্থাৎ হুযূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূত:পবিত্র বিবিগণের মর্যাদার প্রমাণ হিসেবে এটুকুই যথেষ্ট যে, মহান আল্লাহ তাঁদেরকে ‘উম্মাহাতুল মু’মিনীন’ এর গৌরবান্বিত খেতাবে ভূষিত করেছেন, আল্লাহ পাক বলেছেন,

النبى اولى بالمؤمنين من انفسهم وازواجه امهاتهم

-নবী মুমিনদের জন্য তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ট এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা। (সূরা আহযাব, আয়াত-৬)
তাছাড়া আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

يانساء النبى لستن كاحد من النساء )الاية)

-হে নবী পত্নীগণ, তোমরা অন্য কোনো নারীদের মতো নও। (সূরা আহযাব, আয়াত-৩২)
একথা বলার অবকাশ রাখে না যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই তারা এ বিরল সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র নসব
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র নসব যে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন নসব তা মজবুত দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত। যেমন-

عن واثلة بن الاسقع رضى الله عنه قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: ان الله عز وجل اصطفى كنانة من ولد اسماعيل عليه السلام، واصطفى قريشا من كنانة، واصطفى من قريش بنى هاشم، واصطفانى من بنى هاشم- رواه مسلم رحمه الله-

-হযরত ওয়াসিলা ইবনুল আসকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই মহান ও মর্যাদাবান আল্লাহ ইসমাঈল (আ.) এর বংশধর থেকে বনু কিনানাকে চয়ন করেছেন, এবং কিনানা থেকে কুরাইশকে মনোনীত করেছেন এবং কুরাইশ থেকে বনু হাশিমকে আর বনু হাশিম থেকে আমাকে মনোনীত করেছেন। (মুসলিম শরীফ)
এ হাদীস থেকে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুবারক খান্দান বা বংশ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত খান্দান। কিয়ামত পর্যন্ত এ খান্দানের লোক পৃথিবীতে সেরা খান্দান হিসেবে থাকবেন।
কিয়ামতের দিন দুনিয়ার সব বংশগত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فاذا نفخ فى الصور فلا انساب بينهم يومئذ ولايتسائلون-

-অতঃপর যখন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে, সেদিন তাদের পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত-১০১)
সেদিন একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হবে না।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,كل سبب ونسب منقطع يوم القيامة الا سببى ونسبى -কিয়ামতের দিন সমস্ত সবব ও নসব অর্থাৎ বৈবাহিক সম্পর্কিত আত্মীয়তা এবং জন্মগত আত্মীয়তা ছিন্ন হয়ে যাবে একমাত্র আমার সবব ও নসব ব্যতীত।
উক্ত হাদীসখানা ইমাম তাবারানী (র.) তাঁর মু’জামে কাবীরে হযরত ইবন আব্বাস (রা.) থেকে, ইমাম তাবারানী মু’জামে কাবীরে অন্য স্থানে ইমাম হাকিম (র.) মুসতাদরাকে, ইমাম বায়হাকী (র.) তাঁর সূনানে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে, ইমাম আহমদ (র.) তাঁর মুসনাদে হযরত মিসওয়ার ইবন মাখরিমা (রা.) এবং হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। হাদীসের ইমামগণ অত্র হাদীসখানাকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
অতএব উক্ত হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, কিয়ামতের বিপদসংকূল দিনেও একমাত্র আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দুনিয়ার বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক অক্ষুন্ন থাকবে।

আয়াতে তাতহীর
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুরআন কারীমের সূরা আল আহযাব এর ৩৩ নং আয়াত ‘আয়াতে তাতহীর’ নামে পরিচিত। মহান আল্লাহ এ আয়াতে তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ‘আহলুল বাইত’ কে সর্বপ্রকার অপবিত্রতা থেকে দূরে রাখার ঘোষণা দিয়ে তাঁদের শানকে সুউচ্চ করেছেন। যা দুনিয়াতে তাঁদের উচ্চ মর্যাদার অন্যতম প্রতীক।

নামাযে আহলুল বাইতের উপর দুরূদ পাঠ
আহলুল বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসীম মর্যাদার অন্যতম দলীল হচ্ছে, তাঁদের উপর দুরূদ পাঠ করাকে আল্লাহ তাআলা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত নামাযের অন্তর্ভূক্ত করে দিয়েছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফসহ আরো অন্যান্য হাদীস গ্রন্থসমূহে হযরত কা’ব ইবন উজরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قيل يا رسول الله: اما السلام عليك فقد عرفناه فكيف الصلاة؟ قال: قولوا اللهم صل على محمد وعلى ال محمد كما صليت على ال ابراهيم انك حميد مجيد- اللهم بارك على محمد وعلى ال محمد كما باركت على ال ابراهيم انك حميد مجيد-

আহলুল বাইতের বিশেষ সদস্যবর্গ
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “আয়াতে তাতহীর” অবতীর্ণ হওয়ার পরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী, ফাতিমা, ইমাম হাসান ও হুসাইন (রা.) কে নিজের একান্ত কাছে টেনে নিয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে আরয করেছেন, হে আল্লাহ! এরা হচ্ছে আমার আহলুল বাইত। মুবাহালার আয়াত নাযিল হওয়ার পরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার আপনজনকে সাথে নিয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে আরয করলেন, হে আল্লাহ! এরা হচ্ছে আমার আহলুল বাইত।
এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আহলুল বাইতের মধ্যে উপরোক্ত চারজন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সুতরাং তাঁদের সম্পর্কে শুধুমাত্র উদাহরণ হিসেবে কয়েকখানা হাদীস পাঠকদের সম্মুখে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
হযরত আলী (রা.) সম্পর্কে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসংখ্য হাদীসের মধ্যে একখানা হাদীস হচ্ছে-

عن ابى ايوب الانصارى رضى الله عنه قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: من كنت مولاهفعلى مولاه- اللهم وال من والاه وعاد من عاداه- مسند احمد، البزار، مجمع الزوائد-

-হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, আমি যার মাওলা (আপনজন ও অভিভাবক) আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ! তাঁর সাথে যে বন্ধুত্ব রাখে তুমি তার সাথে বন্ধুত্ব রাখো, আর যে তাঁর সাথে শত্রুতা পোষণ করে, তুমি তার সাথে শত্রুতা পোষণ করো।
ইমাম ইবন হাজার আল হাইসামী (রা.) এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। সাহাবায়ে কিরামের এক জামাআত কর্তৃক হাদীসখানা আরোও বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
২. হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী (রা.) এর উদ্দেশ্যে বলেন-

انت منى بمنزلة هارون من موسى الا انه لا نبى بعدى-

-আমার দৃষ্টিকোণ থেকে তোমার অবস্থান এমন, যেমন হারুন (আ.) এর গুরুত্ব মুসা (আ.) এর নিকট ছিল। তবে তফাৎ হচ্ছে এখানে যে, আমার পরে আর কোন নবী আসবেন না।
হযরত ফাতিমা (রা.), হাসান ও হুাসাইন (রা.) এর ফদীলত সম্পর্কে বর্ণিত অগণিত হাদীসের মধ্যে একখানা হচ্ছে, ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেন-

عن حذيفة رضـ الله عنه ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: ان هذا ملك لم ينزل الى الارض قبل هذه الليلة، استأذن ربه بان يسلم على وبشرنى بان فاطمة سيدة نساء اهل الجنة وان الحسن والحسين سيدا شباب اهل الجنة-

-হযরত হুযাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইনি হচ্ছেন একজন ফিরিশতা, যিনি অদ্যকার রাত্রির পূর্বে আর কখনো পৃথিবীতে অবতরণ করেননি। তিনি তাঁর রবের অনুমতি নিয়ে আমাকে সালাম দেওয়ার জন্য এবং এ সুসংবাদ দেওয়ার জন্য এসেছেন যে, ফাতিমা হচ্ছেন বেহেশতের রমণীদের সরদার এবং হাসান-হুসাইন হচ্ছেন বেহেশতের যুবকদের সরদার।
বুখারী শরীফে হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তিম শয্যায় শায়িত অবস্থায় হযরত ফাতিমা (রা.) কে একান্ত কাছে নিয়ে বলেছেন, اما ترضين ان تكونى سيدة نساء اهل الجنة- او نساء المؤمنين -তুমি কি এ কথার উপর খুশি নও যে, তুমি হবে জান্নাতের নারীদের সরদার, অথবা মুমিন নারীদের সরদার।
এতদ্ব্যতীত হযরত হাসান-হুসাইন (রা.) এর ফদীলত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহের অন্যতম হচ্ছে- তিরমিযী শরীফে হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

من احبهما فقد احبنى ومن ابغضهما فقد ابغضننى يعنى حسنا وحسينا-

-যে এদের দুজনকে (হাসান-হুসাইনকে) ভালোবাসলো, সে আমাকে ভালোবাসলো, আর যে এদের সাথে শত্রুতা পোষণ করলো, সে আমার সাথে শত্রুতা পোষণ করলো।
অন্য আরেক হাদীসে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اللهم انى احبهما فاحبهما واحب من يحبهما -হে আল্লাহ! আমি এ দুজনকে ভালোবাসি, অতএব তুমিও তাদেরকে ভালোবাসো। আর যে তাদেরকে ভালোবাসে, তাকেও তুমি ভালোবাসো।
শুধুমাত্র উদাহরণ হিসেবেই এ কয়েকখানা হাদীস এখানে আলোচনা করা হলো। হাদীস শরীফের বিভিন্ন কিতাবে এ সম্পর্কিত আরো অনেক নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণিত রয়েছে, যা থেকে আহলুল বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে উল্লিখিত চারজন মহান ব্যক্তিত্বের স্বতন্ত্র ফদীলত, বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার প্রমাণ পাওয়া যায়।

আহলুল বাইতের মুহাব্বাত
কারো সাথে কারো সম্পর্ক কেবলমাত্র দুই ধরনেরই হতে পারে। আর তা হচ্ছে, মহব্বত অথবা আদাওত। অর্থাৎ ভালোবাসা অথবা শত্রুতা। তবে এ দুই সম্পর্কের সমন্বয়ে আরোও এক প্রকার সম্পর্ক রয়েছে যার নাম হচ্ছে ‘নিফাক’ বা মুনাফিকী, যা ঈমানের পরিপন্থী বিধায় ঈমানদারদের জন্য মোটেও কাম্য নয়। অতএব সহজ কথা হচ্ছে, আহলুল বাইতের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক আছে এবং থাকবে, তা হচ্ছে খাঁটি ও নির্ভেজাল মহব্বত বা ভালোবাসা। কেননা হাদীস শরীফে রয়েছে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

احبوا الله تعالى لما يغذوكم من نعمة واحبونى بحب الله واحبوا اهل بيتى بحبى- رواه الترمذى فى سننه والبخارى فى التاريخ الكبير، وصححه الحاكم والذهبى والسيوطى وغيرهم رحمهم الله.

-তোমরা আল্লাহকে মহব্বত কর যেহেতু তিনি তোমাদেরকে সকল প্রকারের নিআমত দান করেন, আর আমাকে মহব্বত কর আল্লাহর মহব্বতের কারণে এবং আমার আহলুল বাইতকে মহব্বত কর আমার সাথে তোমাদের মহব্বতের কারণে।
অতএব অত্র হাদীসের আলোকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসা যেমন ফরয ও ঈমানের দাবি তেমনি আহলুল বাইতের প্রতি ভালোবাসাও ফরয এবং ঈমানের দাবি হিসেবে সাব্যস্ত হলো।
অন্য এক হাদীসে রয়েছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্বাস (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,

والذى نفس محمد صلى الله عليه وسلم بيده او قال والذى نفسى بيده لايدخل قلب رجل الايمان حتى يحبكم لله عز وجل ورسوله- رواه الامام احمد رحمه الله فى فضائل الصحابة-

-সেই সত্তার শপথ করে বলছি যার হাতে আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রাণ রয়েছে, কোন মানুষের অন্তরে ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তোমাদেরকে (আহলুল বাইতকে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কারণে ভালো না বাসবে। (ফাযাইলে সাহাবা, ইমাম আহমাদ র.)
উক্ত হাদীস থেকে প্রমাণিত হলো যে, মুুখে ঈমানের দাবি থাকা সত্ত্বেও অন্তরে আহলুল বাইতে রাসূলের মহব্বত প্রবেশ না করা পর্যন্ত ঈমান বাইরে অর্থাৎ মুখেই থাকবে, ভিতরে প্রবেশ করবে না।
প্রকাশ থাকে যে, আহলুল বাইতের সাথে ভালোবাসা যেহেতু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে ভালোবাসার কারণেই। সেহেতু এ ভালোবাসা হতে হবে ভক্তি ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা। অর্থাৎ তাঁদেরকে অন্তর দিয়ে মহব্বত করার পাশাপাশি সব সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন, কথায় ও কাজে তাদের সাথে কোনো প্রকার বেয়াদবী না হয়ে যায়। সাহাবায়ে কিরাম ও সালফে সালিহীন এভাবেই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহলুল বাইতকে ভালোবাসতেন। এ সম্পর্কিত ভূরিভূরি প্রমাণের মধ্যে নিম্নে শুধু একটি উদাহরণ বর্ণনা করছি-

عن عمار بن ابى عمار ان زيد بن ثابت ركب يوما فاخذ ابن عباس بركابه، فقال: تنح يا ابن عم رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقال: هكذا امرنا ان نفعل بعلمائنا وكبرائنا فقال زيد: ارنى يدك، فاخرج يده فقبلها فقال: هكذا امرنا ان نفعل باهل بيت رسولنا صلى الله عليه وسلم- رواه ابن سعد فى الطبقات

-আম্মার ইবন আবি আম্মার (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন হযরত যায়িদ ইবন সাবিত (রা.) উটের উপর আরোহন করলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) উটের রিকাব (আরোহীর পা রাখার জায়গা) ধারণ করলেন। তখন যায়িদ (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূলের চাচাতো ভাই, আপনি সরে যান। তখন ইবন আব্বাস (রা.) বললেন, ‘আমাদের আলিম ও বড়দের সাথে এ ধরণের (সম্মানজনক) ব্যবহার করতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে।” তখন যায়িদ (রা.) বললেন, আমাকে আপনার হাত দেখান। ইবন আব্বাস (রা.) তাঁর হাত বের করার পর যায়িদ (রা.) তাতে চুম্বন করে বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহলুল বাইত এর সাথে এ ধরণের ব্যবহার করতে আমাদের আদেশ করা হয়েছে।’ (ইবন সা’দ (র.) তাঁর ‘আত-তাবাকাত’ এর মধ্যে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন)
তাছাড়া হাফিয ইবন হাজার আসকালানী (র.) বুখারী শরীফের শরাহ ‘ফাতহুল বারী’ তে দস্তবুসী ও কদমবুসীর বৈধতার অন্যতম দলীল হিসেবে একথাটি এভাবে উল্লেখ করেছেন,

وقبل زيد بن ثابت يد ابن عباس حين اخذ ابن عباس بركابه-

-ইবন আব্বাস (রা.) যায়িদ ইবন সাবিত (রা.) এর রিকাব ধারণ করলে তিনি [যায়িদ (রা.)] ইবন আব্বাস (রা.) এর হাতে চুম্বন করেন।

ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে অনুসরণ করা
এ মর্মে বর্ণিত অনেক হাদীস থেকে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত হাদীসখানা পাঠকের সম্মুখে পেশ করা হলো-

عن جابر بن عبد الله رضى الله عنهما قال: رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم فى حجته يوم عرفة وهو على ناقته قصواء يخطب فسمعته يقول: يايها الناس انى تركت فيكم ما ان اخذتم به لن تضلوا- كتاب الله وعترتى اهل بيتى- رواه الترمذى

-জাবির ইবন আবদিল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমি তার বিদায় হজ্জে আরাফার দিন তার কাসওয়া নামক উষ্ট্রীতে আরোহিত অবস্থায় বক্তৃতা দিতে দেখেছি এবং তাকে বলতে শুনেছি, হে লোকসকল! নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আমি এমন জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা তা ধারণ বা অনুসরণ করলে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহ তাআলার কিতাব (আল কুরআন) এবং আমার ইতরাত অর্থাৎ আমার আহলুল বাইত। (তিরমিযী, বাবু মানাকিবি আহলি বাইতিন নাবিয়্যি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
হাদীসে আল্লাহর কিতাবকে ধারণ করা মানে হচ্ছে কুরআন শরীফের আদেশ নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলা। আর আহলুল বাইতকে আকড়ে থাকা মানে হচ্ছে; তাঁদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার সম্পর্ক রাখা এবং ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে তাঁদেরকে অনুসরণ করা।

পরিশেষে মহামহিম আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি যেন তিনি তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহলুল বাইত এর মহব্বত আমাদের অন্তরের অন্ত:স্তলে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য বদ্ধমূল করে দেন, যাতে করে রোজ হাশরে আমরা আহলুল বাইতের সঙ্গী হয়ে আল্লাহর হাবীবের লিওয়ায়ে হামদ এর নীচে সমবেত হতে পারি এবং আহলুল বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী লা-মাযহাবী, খারিজী, ওয়াহাবী ও ইয়াযীদপ্রেমী মুনাফিকদের হামলা থেকে মহান আল্লাহ যেন তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সরলপ্রাণ উম্মতের ঈমান, আকীদা, আমল ও আখলাক হিফাযত করেন। আমীন।

ফেইসবুকে আমরা...