1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
আফগানিস্তান: এখনই সব মার্কিন সেনা সরছে না, শান্তি কতদূর?
রহমান মোখলেস
  • ১ মে, ২০২১

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশেষে তাঁর পূর্বসূরি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের করা চুক্তি থেকে সরে আসলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তালেবানের চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী ১ মের আগে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ছিল। বাইডেন ১ মে দেশটি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু করবেন এবং আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের আগে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা সরিয়ে নেবেন। বাইডেন গত ১৪ এপ্রিল এক ঘোষণায় এ কথা বলেন।
এখন প্রায় ২৫০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে অবস্থান করছে। এছাড়া আছে ন্যাটোর বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের আরো প্রায় সাড়ে সাত হাজার সেনা। মার্কিন সূত্র থেকে ২৫০০ সেনার কথা বলা হলেও কোনো কোনো সূত্র মতে আসলে মার্কিন সেনা আছে সাড়ে তিন হাজার। ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে তালেবানের যে চুক্তি হয়, সেই চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র ১ মের আগেই তার সমস্ত বাহিনী প্রত্যাহারে সম্মত হয়। বিনিময়ে শান্তি চুক্তির শর্তানুসারে তালেবান সন্ত্রাস পরিহার করবে, মার্কিন সেনারা দেশে ফিরবে, তালেবান আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে এবং চুক্তির পর থেকে ১ মে পর্যন্ত মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা বন্ধ করবে। উভয় পক্ষেই চুক্তি বাস্তবায়নে জোরালো প্রতিশ্রুতি ছিল। ২০১১ সাল থেকেই শান্তি চুক্তিতে আসার ব্যাপারে কাতারের রাজধানী দোহায় বৈঠক করে আসছেন তালেবান নেতারা। উল্লেখ্য, তালেবান এখন দেশটির বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।

সময় নিয়ে প্রশ্ন ট্রাম্পের
সেনা প্রত্যাহারে বাইডেনের সময়সীমা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন যেন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা ফিরিয়ে আনার সময়সীমা ১১ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ না করেন। তার আগেই দেশটি থেকে সেনা সরিয়ে আনেন। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারকে চমৎকার একটি উদ্যোগ অভিহিত করে ট্রাম্প বলেন, তিনি ১৮ মাসের পরিকল্পনা নিয়ে ১ মের মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময় সীমা নির্ধারণ করেছিলেন। আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের তারিখ তাঁর নির্ধারিত সময়সীমার কাছাকাছি রাখার জন্য তিনি বর্তমান প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।

আফগান সরকারের প্রতিক্রিয়া
বাইডেনের ঘোষণার পরপরই আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি টুইট করে বলেছেন, ‘আমি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তাঁদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানাই। সেনা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মার্কিন অংশীদারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করব এবং চলমান শান্তি প্রচেষ্টায় আমরা মার্কিন ও ন্যাটো অংশীদারদের সঙ্গে তৎপরতা অব্যাহত রাখব।’

তালেবানের প্রতিক্রিয়া
এদিকে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে বাইডেনের সময়সূচি ঘোষণাকে প্রত্যাখান করেছে তালেবান। তালেবান বলেছে, সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে মার্কিন সরকার তাদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিল বাইডেন তা লজ্জাজনকভাবে লঙ্ঘন করেছে। গত ১৫ এপ্রিল কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মুখপাত্র মুহাম্মাদ নাঈম ওয়ারদাক ইরানের প্রেস টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ১ মের মধ্যে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার না হলে জোরপূর্বক তাদেরকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ওয়াশিংটন তার প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২০ সালে তালেবানের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল তার প্রতি তারা কোনো সম্মান দেখায়নি।
নাঈম ওয়ারদাক আরও বলেন, আফগান জনগন দখলদারদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত রয়েছে এবং গত বিশ বছর ধরে বিদেশি সামরিক আগ্রাসনের মুখে তারা নিজেদের রক্ষা করে চলেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য আমরা লড়াই করছি। জনগণকে রক্ষার জন্য স্বাধীন একটি সরকার চাই। ’
প্রেস টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তালেবান মুখপাত্র নাঈম ওয়ারদাক আরও বলেন, ‘আফগানিস্তানে সম্প্রতি যে সহিংসতা বেড়েছে তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। মার্কিন বোমাবর্ষণ আমাদের অভিযানের পরিধি বাড়াতে বাধ্য করেছে।’ আবার ক্ষোভ প্রকাশ করলেও কোনো কোনো তালেবানের নেতা বাইডেনের ঘোষণায় একদিকে নিজেদের বিজয় হিসেবেও দেখছে।
এদিকে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গত ২৪ এপ্রিল তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তালেবান তাতে অংশ নেবে না ঘোষণা দেওয়ার পর ২১ এপ্রিল বৈঠকটি স্থগিত করে তুরস্ক। এ সম্মেলনে জাতিসংঘসহ ২০টির বেশি দেশ অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এক টুইটে জানান, ‘আফগানিস্তানের মাটি থেকে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তালেবান এই নিয়ে আর কোনো বৈঠক বা সম্মেলনে অংশ নেবে না।’

যা ভাবছে বর্তমান মার্কিন প্রশাসন
বর্তমান মার্কিন প্রশাসন ১ মে থেকে শুরু করে আগামী ১১ সেপ্টম্বরের মধ্যেই তাদের সব সেনা প্রত্যাহার করতে চায়। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, প্রেসিডেন্টের লক্ষ্য খুবই পরিষ্কার। আমাদের সৈন্যদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে হবে ঠিক, তবে অন্যদিকে আফগানিস্তান যেন আবার সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়স্থল না হয়ে ওঠে তাও নিশ্চিত করতে হবে। ব্লিংকেন বলেন, সব সেনা প্রত্যাহারের আগে আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। সে জন্য যৌথ বাহিনী কাজ চালিয়ে যাবে। যেখানে তালেবান সহিংতা পরিহার করে রাজনৈতিক ধারায় ফিরবে।
অপরদিকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ট্রাম্প প্রশাসনের মতো তাড়াহুড়া না করে ধীরে ধীরে সৈন্য প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। সিআইএ মনে করে, পরিস্থিতি বিবেচনা করেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যহার করতে হবে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে চাপ ছিল। ‘অমূলক’ এ ব্যয় বহুল যুদ্ধ চালানো এবং আফগানে অবস্থান করার এখন আর কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন মার্কিন বিশ্লেষকরা। এর আগে বারবার সময়সূচি নির্ধারণ করেও বারাক ওবামা কিংবা ট্রাম্পের সময়ে সব সেনা প্রত্যাহার সম্ভব হয়নি।
আফগানিস্তান যুদ্ধে গত ২০ বছরে প্রাণ গেছে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনার। হতাহত হয়েছে লাখো আফগান নাগরিক। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১১ সালে আফগানিস্তানে সর্বোচ্চ ১ লাখ মার্কিন সেনা সদস্য ছিল। পরে বিভিন্ন সময়ে তা কমানো হয়েছে। আর এবার পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি। আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের পর কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তার জন্য যত সংখ্যক সেনা প্রয়োজন, ঠিক তত সংখ্যক মার্কিন সেনাই আফগানিস্তানে থাকবে।
এদিকে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য ২০০২ সাল থেকে ১৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তার মধ্যে ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহায়তা দিতে। যুদ্ধে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যু মার্কিন জনগণকে ক্ষুব্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজপথে যুদ্ধ বিরোধী মিছিল সমাবেশ হয়েছে।

কী ভাবছে ন্যাটো
আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সেনাদেরও সরিয়ে নেওয়া হবে একই সময়ে। ন্যাটো জোট ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, ন্যাটো আফগানিস্তান থেকে ১ মে সব সৈন্য সরাচ্ছে না। ন্যাটোর মতে, তালেবান চুক্তির সমস্ত বিষয় মেনে চলছে না। কাজেই আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সৈন্য সরানোর মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। ১ মে নয়, ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তারাও আফগানিস্তান থেকে তাদের সব সেনা সরাবে।
সম্প্রতি ন্যাটোর প্রধান জ্যাঁ স্টলটেনবার্গ ব্রাসেলসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আফগানিস্তানে শান্তি স্থাপনের জন্য এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করেছে ন্যাটো। সে কারণেই সেখানে যৌথ বাহিনীর সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। গত দুই দশকে লাখ লাখ অর্থ খরচা হয়েছে। এখন যদি দ্রুত সেনা ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে মিশন সফল হবে না। পরিশ্রম সব বিফলে যাবে। আর এ জন্যই এত দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহার সম্ভব নয়। তার আগে দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। দেশে যাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, সে বিষয়েও তারা আগ্রহ দেখাবে। গত ডিসেম্বরেও কাবুলে বড়সড় বিস্ফোরণ ঘটায় তালেবান। যেখানে মৃত্যু হয় ডেপুটি গভর্নরের। এখনই সেনা সরিয়ে নিলে জঙ্গি আক্রমণ আরো বেড়ে যাবে। এদিকে জোটের শরীক জার্মানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা ৪ জুলাইয়ের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নেবে।

আফগানিস্তান সংকটের শুরু যখন থেকে
কখন থেকে এই আফগান সংকটের শুরু তা খুব সংক্ষেপে একটু জেনে নেওয়া যাক। গত চার দশক ধরে চলছে আফগান সংকট। যুক্তরাষ্ট্রকে মুকাবিলায় নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃষ্টি ছিল মধ্য এশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে আরব সাগরে পৌঁছা। তার আগে আফগানিস্তান দখল এবং সেখানে কমিউনিস্ট শাসনের প্রতিষ্ঠা। এ জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তান একটি অভ্যুত্থান ঘটায়। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপিএ) ক্ষমতায় আসে। এই অভ্যুত্থান তথা বিপ্লবে মুহাম্মদ দাউদ খানের সরকার উৎখাত হয়। আর ১৯৭৯ সালেই আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে সোভিয়েত বাহিনী। এদিকে দাউদের পর নূর মুহাম্মদ তারাকি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হন। তারপর আসে হাফিজউল্লাহ আমিন। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে আরো একটি অভ্যুত্থানের নাটক। হাফিজউল্লাহ আমিনকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসে সোভিয়েতপন্থী বাবরাক কারমাল। ১৯৮৬ সালে কারমালকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে মুহাম্মদ নজিবউল্লাহ। এদিকে আফগানিস্তান থেকে কমিউনিস্ট শাসন ও সোভিয়েতপন্থী সরকার হটাতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন মুজাহিদ বাহিনী। মার্কিন উদ্যোগে ও অস্ত্রে প্রতিষ্ঠা হয় আল-কায়েদা। এ সময় সংঘাতে লাখ লাখ আফগান উদ্বাস্তু হয়ে পাকিস্তান আসে। পাকিস্তানের আফগান উদ্বাস্তু শিবিরে গঠিত হয় আফগান ছাত্রভিত্তিক সংগঠন তালেবান। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশ করলে সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীও যুদ্ধের সূচনা করে। মুজাহিদ বাহিনী ও আল-কায়েদার হামলার তীব্রতায় ১৯৮৮ সালের ১৫ মে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
এদিকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটলে ১৯৯২ সালের এপ্রিলে পতন ঘটে নজিবউল্লাহ সরকারের। এ সময় নজিবউল্লাহকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সোভিয়েতের বিদায়ে আবদুর রশিদ দোস্তামের মুজাহিদ বাহিনী ও আফগান সরকারের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। এদিকে আফগানিস্তানে দ্রুত উত্থান ঘটে তালেবানের। এক পর্যায়ে আল-কায়েদার সমর্থনে ক্ষমতা দখল করে তালেবান।

আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার প্রবেশ
তালেবান ক্ষমতায় আসার পরই আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেরও বিরোধ শুরু হয়ে যায়। এরই এক পর্যায়ে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে নিইউয়র্কে মার্কিন টুইন টাওয়ারে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র এ জন্য দায়ী করে আল-কায়েদাকে। এ ঘটনার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সামিল হয় মিত্র ন্যাটো জোটও। তারা দ্রুত আফগানিস্তানে ‘আল-কায়েদার পৃষ্ঠপোষক’ তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। তালেবান হঠিয়ে এরপর আফগানিস্তানে আসে একের পর এক মার্কিন সমর্থিত সরকার। এরই সর্বশেষ পর্যায় তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমানে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি সরকার এখন ক্ষমতায়। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আফগান যুদ্ধ দ্বিতীয় দীর্ঘতম যুদ্ধ। তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এতদিন স্থায়ী হয়নি।
এদিকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তান পরিস্থিতি যাতে অস্থির না হয়ে উঠে, তার জন্য গোপনে কাজ করছে বাইডেন প্রশাসন। তুরস্কের সহযোগিতায় তালেবানের সাথে আফগান সরকারের একটি সমঝোতার চেষ্টা চলছে। এপ্রিল মাসের শেষে এ নিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে একটি বৈঠকের কথা রয়েছে।

আফগান সরকার-তালেবান শান্তি আলোচনা
আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যেও শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছিল, তবে এতদিনেও তারা চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে আসতে পারেনি। কাতারের রাজধানী দোহায় ট্রাম্প আমলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আফগান সরকার এবং তালেবান প্রতিনিধিদের মধ্যে এ শান্তি আলোচনা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে তিন পৃষ্ঠার একটি চুক্তিতে দুই পক্ষ সম্মত হলেও পরে তা আর রক্ষা হয়নি। চুক্তিতে তালেবান আফগানিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাবে না এবং অস্ত্র পরিহার করবে এমন শর্ত ছিল। বিনিময়ে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং বন্দি তালেবান সদস্যদের মুক্তি দেওয়ার শর্ত ছিল। শর্ত অনুযায়ী অনেক তালেবান বন্দিকে মুক্তিও দেয় আফগানিস্তানের আশরাফ গণি সরকার।
কিন্তু এই আলোচনা চলার মধ্যেই তালেবানের হামলা অব্যাহত থাকায় এবং আলোচনার বিষয়গুলো নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় এ নিয়ে তারা কোনো চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি।

মঞ্চে আবার রাশিয়া
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার নিয়ে টালবাহানার মাঝে মঞ্চে আবার এসে হাজির হয় রাশিয়া। শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে হঠাৎ করেই তৎপর হয়ে ওঠে রাশিয়া। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন যুদ্ধ-পরবর্তী আফগানিস্তানে তার দেশের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে, সে ব্যাপারে উদ্যোগী হন। কাতারের রাজধানী দোহায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি নিয়ে অচলাবস্থার মাঝে রাশিয়া মস্কোতে গত ১৮ মার্চ আফগান সরকার, তালেবান ও অন্য নেতাদের নিয়ে শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান এই বৈঠকে তাদের প্রতিনিধি পাঠায়।
রাশিয়ার দেওয়া শান্তি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। ৪১ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করতে হবে।
এদিকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার পাশাপাশি মস্কো, বেইজিং ও তেহরানের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে তালেবান। তালেবান নেতারা একাধিকবার মস্কো, তেহরান ও বেইজিং সফর করেছেন।

শান্তি কতদূর?
সিএনএনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে আফগান যুদ্ধ শেষ হবে না। এই পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। দেশটি আরও অস্থিতিশীল হতে পারে। এই অস্থিতিশীলতা আঞ্চলিক পর্যায়েও ছড়াতে পারে। সিএনএনের মতে আফগানিস্তানে এখন আল-কায়েদাও বেশ তৎপর। এছাড়া এই যুদ্ধের মধ্যেই আফগানিস্তানে আইএসেরও উত্থান ঘটেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আফগান যুদ্ধের অবসান এবং এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের সকল পক্ষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসা উচিৎ। গত চার দশক ধরে আফগানিস্তানে যে রক্ত ঝরছে তার অবসান হওয়া উচিৎ। তালেবান আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, আগামী ১ মের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার না হলে তারা আবারও বিদেশি সৈন্যদের ওপর হামলা শুরু করবে।
আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরাও। দেশটিতে শেষ পর্যন্ত শান্তি ফিরবে তো? তবে তার আগে যত দ্রুত সম্ভব দেশটি থেকে মার্কিন ও ন্যাটো জোটসহ সব বিদেশি সেনার চলে যাওয়া উচিৎ। এছাড়া এখনই বর্তমান আফগান সরকার ও তালেবান এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে একটি কার্যকর চুক্তি ও সমঝোতা হতে হবে। বাইডেন ক্ষমতায় এসেই বলেছিলেন, আফগানিস্তান থেকে দ্রুততার সাথে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে। তা হলে আর বিলম্ব কেন? ১ মে কে সামনে রেখেই যুক্তরাষ্ট্র, আফগান সরকার ও তালেবান এই ত্রিমুখী বৈঠকের মাধ্যমে সংকটের শান্তিপূর্ণ ফয়সালা হতে পারত। কারণ যত বিলম্ব হবে, আফগানিস্তানে তত রক্ত ঝরবে। আর তালেবানকেও এগিয়ে আসতে হবে সদিচ্ছা নিয়ে। পরিহার করতে হবে কঠোর রক্ষণশীল মনোভাব। তাদেরকে সশস্ত্র পন্থা বাদ দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে আসতে হবে। এটাই শান্তির রাস্তা। তালেবানকে এই পথেই আসতে হবে। গত ২০ বছরের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। যুদ্ধের মাধ্যমে কখনই শান্তি সম্ভব নয়। ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আফগানিস্তান বৃহৎ শক্তি ও আন্তর্জাতিক মোড়লদের কাছে সবসময়ই ছিল লোভনীয়। তাই সাবেক সোভিয়েত সেনারা চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তান যেভাবে মার্কিন ঘূর্ণি চক্রে পড়েছিল এবার মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার পর আবার সেই চক্রের মুখে দেশটি যেন না পড়ে। অনেক রক্ত ঝরেছে, আর নয়। আর যুদ্ধ নয়, শান্তি ফিরে আসুক। কিন্তু সেই শান্তি এখন কত দূর?

ফেইসবুকে আমরা...