সাধারণতঃ বিজয়ীর ধর্ম বিজিতের উপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু আজ এখানে এমন এক বিজয়ী জাতির কথা বলব- যারা নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে বিজিতের ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা গ্রহণ করেছিল। মানব সভ্যতা বিধ্বংসী যালিম চেঙ্গিস খানের বংশধররা কীভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, এ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এখানে তুলে ধরছি।
চেঙ্গিস খান ও তৎপৌত্র হালাকু খান সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করা আবশ্যক। চেঙ্গিস খানের আমলে ভারত সীমান্ত থেকে বাগদাদের আব্বাসী খিলাফতের সীমান্ত পর্যন্ত বিশাল ভূ-ভাগের অধিপতি ছিলেন-মহা ক্ষমতাধর সুলতান আলাউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ খারিজমী। তার রাজ্যের সীমান্তবর্তী বাদশাহগণ মুহাম্মদ শাহকে ভীতির চোখে দেখতেন। মুহাম্মদ শাহের রাজ্যসীমা চেঙ্গিস খানের রাজত্বের সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এহেন ক্ষমতাধর মহা পরাক্রম সুলতানের সাথে সদ্ভাবের উদ্দেশ্যে চেঙ্গিস খান বাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ফলে-কারাকোরাম ও খারিজম সাম্রাজ্যের মাঝে অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতে থাকে। কথিত আছে-একবার কারাকোরাম থেকে আগত এক ব্যবসায়ী দলকে গুপ্তচর সন্দেহে মুহাম্মদ শাহের জনৈক গভর্নর বন্দী করে সুলতানকে তা অবহিত করেন। সুলতান এ সন্দেহজনক দলটিকে হত্যার আদেশ দেন। চেঙ্গিস খান এ ঘটনায় আপত্তি জানিয়ে সুলতানের কাছে এক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। সুলতান প্রতিনিধিদলের প্রধানকে হত্যার আদেশ দেন বলেও কথিত আছে। এরপর তাতারীরা চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মুসলমান সালতানাতের উপর প্রচন্ড হামলা চালায়। প্রথমে বুখারা ধ্বংস করে শহরের সকল অধিবাসীদের হত্যা করে। সমরকন্দেরও একই অবস্থা হয়। ইসলামী জগতের বিখ্যাত শহর হামদান, কজউইন, মেরো ও নিশাপুরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। উপরে উল্লেখিত মুসলমান সভ্যতার কেন্দ্রসমূহ যেভাবে ধ্বংস এবং মুসলিম অধিবাসীদের যেভাবে হত্যা করা হয়- মানবেতিহাসে এর নযীর কোথাও নেই। তাতারীদের কাছে হত্যার ব্যাপারে মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, কোনো তফাৎ ছিল না। যে শহর তারা দখল করেছে, মানুষকে করেছে নির্বিচারে হত্যা। মুসলিম মনীষীদের শত শত বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল অগণিত দুষ্প্রাপ্য ও মহামূল্যবান গ্রন্থরাজীর পাণ্ডুলিপি সব খড়কুটার মতো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সুলতান মুহাম্মদ শাহ খারিজমী তার বিশাল সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও রণকৌশলে ভুল করায় চরমভাবে পরাস্ত হয়ে পালিয়ে যান এবং কোন এক অখ্যাত স্থানে ইন্তিকাল করেন। তার পুত্র সুলতান জালালুদ্দীন আপ্রাণ চেষ্টা করেও সাম্রাজ্য রক্ষা করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত জঙ্গলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
চেঙ্গিস খানের পর তার পৌত্র হালাকু খান ইসলামী দুনিয়ার দারুল খিলাফত, সে কালের দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ নগরী, শিক্ষা ও সভ্যতার কেন্দ্র বাগদাদে আক্রমণ চালিয়ে নগরীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। হালাকু খানের সময়ে বাগদাদের খলীফা ছিলেন মুতাসিম বিল্লাহ। তিনি ইবন আলকমী নামক কুখ্যাত চরমপন্থী শিআকে উযীর নিযুক্ত করেছিলেন। শিআ সম্প্রদায়ের লোকেরা সুন্নী মুসলমানদের পরম শত্রু হিসেবে মনে করে থাকে। আলকমীও সুন্নী মুসলমানের খিলাফত ধ্বংস করার সবরকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এ গাদ্দার হালাকু খানের কাছে পত্র লিখে বাগদাদ আক্রমণের আহবান জানায়। অন্যদিকে নাসিরুদ্দীন তুসী নামক এক কুখ্যাত শিআ হালাকু খানের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেও হালাকু খানকে যথাসাধ্য বাগদাদ আক্রমণে প্ররোচিত করতে থাকে। বাগদাদ ধ্বংসের ব্যাপারে উযীর আলকমী ও নাসিরুদ্দীন তুসী উভয়ের ভূমিকার কথা সকল ঐতিহাসিক স্বীকার করেন। এমনকি ইরানী জনৈক শিআ কর্তৃক লিখিত ‘আখবার ও আসারে খাযা নাসিরুদ্দীন তুসী’ নামক বইতেও বাগদাদ ধ্বংসের ব্যাপারে নাসিরুদ্দীন তুসীকে দায়ী করা হয়েছে।
বাগদাদ ধ্বংস এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। এর সামান্য নমুনা পাঠক সমক্ষে উপস্থাপন করছি। ইবন কাসীর (র.) ‘বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ কিতাবে লিখেছেন- বাগদাদে চল্লিশ দিন একাধারে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। চল্লিশ দিন পর পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এ শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। রাস্তায়-বাজারে সবখানে লাশের উপর লাশ পড়ে টিলার মতো দেখাচ্ছিল। তারপর বৃষ্টির পানি পড়ে এসব লাশ পচে গলে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়ায়। ফলে শহরের আবহাওয়া দূষিত হয়ে মহামারী দেখা দেয়। দূষিত বায়ু ও মহামারীতে বহু লোক মারা যায়। হত্যা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ এ তিনের সমন্বয়ে বাগদাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। আল্লামা তাজুদ্দীন সুবুকী (র.) এর বর্ণনায়-হালাকু খান বাগদাদের খলীফা মুতাসিম বিল্লাহকে এক তাবুতে রাখে। উযীর ইবন আলকমী শহরের উলামা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে এ মর্মে আহবান করে যে, খলীফা ও হালাকু খানের সন্ধিপত্রে তারা সাক্ষ্য দিবেন। এসব লোক উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে তাদের সবাইকে হত্যা করে ফেলা হয়। এভাবে একদল একদল করে আনা হয় ও হত্যা করা হয়। তারপর খলীফার বিশেষ অমাত্য ও পরিষদবর্গের লোকদের ডেকে এনে সবাইকে হত্যা করা হয়। খলীফা তখনও জীবিত ছিলেন। খলীফার রক্তপাতে অনিষ্টের আশংকা ভেবে হালাকু কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু নাসিরুদ্দীন তুসী (শিআ) বললো কোন অসুবিধা নেই। খলীফার রক্তপাত না করে অন্যভাবে তাকে হত্যা করা যাবে। অতঃপর খলীফাকে বিছানা দিয়ে লেপ্টে ধরে লাথি ও ঘুসি মেরে হত্যা করা হয়। (ইন্না লিল্লাহি….. রাজিঊন)
তাতারীরা শুভ অশুভ গণনায় খুব বিশ্বাস করতো। হালাকু খানের দরবারে হুসামুদ্দীন নামক এক গণক ছিলেন। বাগদাদ আক্রমণের শুভ অশুভ সম্বন্ধে হালাকু উক্ত গণককে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন-এ সময়ে বাগদাদ আক্রমণ করা অশুভ। যখনই কোনো বাদশাহ খিলাফত ধ্বংসের কাজে হস্তক্ষেপ করেন তখনই বিপদগ্রস্ত হন। যদি আপনি বাগদাদ আক্রমণ করেন, তবে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে। ঝড়-তুফান ও ভূমিকম্পে দুনিয়ার একাংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি বাদশাহ সনকু খান (তাতারী সম্রাট) মারা যাবেন। হালাকু খান এতদশ্রবণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সম্ভবতঃ উক্ত মুসলমান গণক ব্যক্তি বাগদাদের অধিবাসীদের প্রাণ রক্ষার্থে উক্ত গণনার অবতারণা করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। নাসিরুদ্দীন তুসী (শিআ) হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের পক্ষে অনেক যুক্তি দিল। সে বললো যুদ্ধে অনেক সাহাবা শহীদ হয়েছেন, কিন্তু এতে যমীনে কোনো ফাসাদ সৃষ্টি হয়নি। যদি আব্বাসীয়দের কোন বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয় তবে এর উত্তর হচ্ছে- আব্বাসীয় খলীফা মামুনের আদেশে আমীনকে হত্যা করা হয়েছে। মুতাওয়াক্কিল তাঁর দেহরক্ষীদের হাতে নিহত হন।
মুনতাসির এবং মুতাদ্দিদকেও হত্যা করা হয়েছে। এতে তো কোন ভূমিকম্প বা তুফান হয়নি। মোটকথা শেষ পর্যন্ত নাসিরুদ্দীন তুসীর কথাই হালাকুর মনোপুত হলো। আব্বাসী খলীফা মুতাসিম বিল্লাহকে হত্যার ব্যাপারে তার মনে আর কোনো দ্বিধা রইল না। হালাকু খান বাগদাদের নিহত মানুষের লাশ গণনা করার আদেশ দিলে এর সংখ্যা দাঁড়ায় আঠার লক্ষ। পঁচিশ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে আঠার লক্ষ কতল হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক নিহতের সংখ্যা এরচেয়ে কিছু কম বলে বর্ণনা করেছেন। বাগদাদের পর তাতারীদের হাতে হলব ও দামেস্ক বিধ্বস্ত হয়।
দামেস্কের খ্রিষ্টান অধিবাসীরা তাতারীদের স্বাগত জানায় ও মুসলমানদের ধ্বংস দৃশ্যে অত্যন্ত খুশি হয়। এ সুযোগে মুসলমানদের পবিত্র মসজিদে খ্রিষ্টানরা মদ ছিটায় ও উল্লাস করে। অতঃপর তাতারীরা মিশর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মিশরের সুলতান মালিক মুজাফফর সাইফুদ্দীন ভাবলেন এবার মিশরের পালা। যদি তাতারীরা মিশর আক্রমণ করে তবে দেশ রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং আগেভাগে অগ্রসর হয়ে সিরিয়ায় পৌঁছে তাতারীদের উপর হামলা করা উচিৎ। ২৫ শে রামাদান ৬৫৮ হিজরী আইনে জালূত নামক স্থানে মিশরীয় বাহিনীর সাথে তাতারীদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মিশরীয় বাহিনী জয়লাভ করে। ইতিহাসে আইনে জালূতের যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অজেয় তাতারী বাহিনী এই যুদ্ধে প্রথম মুসলিম বাহিনীর হাতে পরাজয়বরণ করে। আইনে জালূতের যুদ্ধের পর মালিক জাহির বাইবার্স কয়েকবার তাতারীদের পরাস্ত করেন এবং তাদেরকে বিতাড়িত করেন।
উপরোল্লিখিত ঘটনায় এ কথা প্রমাণিত হয় যে, একমাত্র মিশরীয় সুলতানের রাজত্ব ছাড়া এবং ভারতের মুসলিম রাজত্ব ছাড়া কারাকোরাম থেকে মিশর সীমান্ত পর্যন্ত বিশাল ভূ-ভাগ তাতারীদের দখলে চলে গিয়েছিল। তারা তখন বিজয়ী। ধর্মের ব্যাপারে তাদের উপর জোর-জবরদস্তি করার ক্ষমতা মুসলমানদের ছিলো না। কিন্তু আল্লাহর অপূর্ব মহিমায় তাতারীরা ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করতে আরম্ভ করল।
মনে রাখা আবশ্যক যে, তাতারীরা মুসলমান ছাড়া অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদার ছিল। তাদের সব আক্রোশ ছিল মুসলমানদের উপর। দামেস্ক বিজয়ের সময় তথাকার খ্রিষ্টানরা তাতারীদের স্বাগত জানায়। মুসলিম নিধন দেখে উল্লাস প্রকাশ করে। এদিকে মুসলমানরা তখন বিপর্যস্ত, পরাজিত তাতারীদের চোখে একান্ত হেয়। এহেন অবস্থায় তাদের মাঝে ইসলামের প্রসার এক অস্বাভাবিক ঘটনা। মোটকথা তখনকার অবস্থা ইসলামের প্রসারের ক্ষেত্রে মোটেই অনুকূল ছিলো না।
প্রফেসর আরনল্ড বলেন, অবশেষে ইসলাম তার অতীত শান-শওকত নিয়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে উঠল। মুসলমান মনীষীগণ এ বর্বর জাতিকে যারা মুসলমানদের উপর কোনো যুলমই বাকী রাখেনি- তাদেরকেও মুসলমান করে ফেললো, এ কাজটি ছিল মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। কারণ দুটি ধর্মের লোক (বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান) এ ব্যাপারে সক্রিয় ছিল, যাতে তাতারদের নিজ ধর্মে বিশ্বাসী করে তোলে। ইসলামের জন্য এ সময় বৌদ্ধ ও খ্রিষ্ট ধর্মের মুকাবিলা করে মুঘলদের (তাতারীদের) এ উভয় ধর্ম থেকে বাঁচিয়ে ইসলামে দীক্ষা দেওয়া এমন কাজ ছিলো যাতে উত্তীর্ণ হওয়া অসম্ভব মনে করা হতো। মুঘলদের (তাতারী) এ প্রলয়ংকারী ধ্বংসে মুসলমানরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যান্য ধর্মের প্রতি মুঘলরা ছিল উদার, ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ছিল অত্যন্ত বেশি। চেঙ্গিস খান হুকুম দিয়েছিল-যে সমস্ত মুসলমান শরীআত মুতাবিক পশু জবাই করবে তাদেরকে হত্যা করা হবে। কুবলাই খানের রাজত্বকালে উক্ত হুকুমটি নতুনভাবে আবার জারী করা হয়। ফলে অসংখ্য মুসলমান এ অপরাধে নিহত হন। কিউক খানের আমলে (১২৪৬-১২৪৮খ্রি.) দু’জন খ্রিষ্টান উযীরের হাতে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা ছিল। এ সময় মুসলমানদের উপর চরম নির্যাতন চালানো হয়। আরগুণ খান (১২৮৪-১২৯১খ্রি.) এর আমলেও মুসলমানদের উপর নির্যাতন চলে। এতসবের পরও এ বর্বর জাতি সেই মুসলমানদের ধর্ম গ্রহণ করল; অথচ তাদের তারা পদানত করেছিল।
যেসব নিবেদিত প্রাণ মুসলমান ও মহান ব্যক্তির দ্বারা এ দুর্ধর্ষ যালিম কওম ইসলাম গ্রহণ করে, এদের মধ্যে কম লোকের নামই দুনিয়াবাসী জানে। তবে এদের কাছে শুধু মুসলমানই নয়; সমস্ত মানব জাতিই ঋণী।
তাতারীদের প্রথম যে বাদশাহ মুসলমান হয়েছিলেন তাঁর নাম বোরকা খান। তিনি চেঙ্গিস খানের পৌত্র ও জুজী খানের পুত্র। চেঙ্গিস বংশের দ্বিতীয় শাখা ইলখানী বংশে প্রথম মুসলমান হয়েছিলেন তাগুদার। তিনি হালাকু খানের পৌত্র। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় আহমদ। তিনি শাইখ কামালুদ্দীন আব্দুর রহমান রাফিযীকে উযীর নিযুক্ত করেছিলেন। আহমদ খানের ইসলাম গ্রহণে তার ভাই আরগুণ খান অতিশয় রুষ্ট হয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ফলে আহমদ খান মাত্র তিন বৎসর রাজত্বের পর বন্দী হয়ে ৬৮৩ হিজরীতে শাহাদাতবরণ করেন। বাল্যকালে তাগুদারকে (আহমদ) খ্রিষ্ট ধর্ম মুতাবেক শিক্ষা দেওয়া হয়, কিন্তু বড় হয়ে তাগুদার ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইলখানী বংশের সপ্তম বাদশাহ গাজান খান ইসলাম গ্রহণ করেন। গাজান খানের শিক্ষা-দীক্ষা বৌদ্ধ ধর্মানুসারে দেওয়া হয়। ফলে প্রথমদিকে গাজান খান অনেক বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন। তিনি বৌদ্ধ শাস্ত্রীদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে অন্যান্য ধর্মমত সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে থাকেন এবং একপর্যায়ে আমীর তুজুন (র.) এর হাতে সত্য ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন।
কাশগড়ের বাদশাহ তুঘলক তৈমুর মুসলমান হওয়া সম্বন্ধে বর্ণিত আছে, একবার বুখারা থেকে এক বুযুর্গ শাইখ জালালুদ্দীন (র.) একদল ভক্তসহ সফরে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে তুঘলক তৈমুরের সংরক্ষিত শিকারের স্থান দিয়ে যাচ্ছিলেন, তৈমুরের সেনারা এ কারণে তাঁদের সকলকে বন্দী করে বাদশাহর দরবারে হাযির করে। তুঘলক তৈমুর অত্যন্ত গোস্বা ভরে শাইখ জালালুদ্দীন (র.)কে জিজ্ঞেস করেন- আমার সংরক্ষিত শিকারের ভূমিতে তোমরা কেন প্রবেশ করেছো? শাইখ উত্তর দিলেন আমরা বিদেশি মানুষ। আমাদের জানা ছিলো না যে এ ভূমি দিয়ে চলা নিষিদ্ধ। কথাবার্তায় বাদশাহ যখন জানতে পারলেন, এরা ইরানী। তখন বললেন, ইরানীদের চেয়ে কুকুরই উত্তম। শাইখ অত্যন্ত শান্তভাবে জবাব দিলেন তা সত্য, যদি আমরা সত্যধর্মের অনুসারী না হতাম তবে কুকুরের চেয়ে অধম ছিলাম। এ কথাটি তৈমুরের মনে খুব দাগ কাটল। তিনি রক্ষীদের আদেশ দিলেন এ বন্দীকে আমি শিকার থেকে ফেরার পর আমার কাছে হাযির করবে। বাদশাহ শিকার থেকে ফিরে আসলে শাইখ জালালুদ্দীন (র.) কে তাঁর দরবারে পেশ করা হলো। বাদশাহ তৈমুর প্রশ্ন করলেন তুমি আগে যে কথাটি বলেছিলে, এখন তার ব্যাখ্যা দাও। সত্য ধর্ম বলতে তুমি কী বুঝাতে চাও? শাইখ জালালুদ্দীন (র.) ইসলাম সম্বন্ধে এমন হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য পেশ করলেন যা শুনে পাষাণ হৃদয় তাতারী বাদশাহ তৈমুর অভিভূত হলেন। সত্যের আলোকে যাদের অন্তর উদ্ভাসিত এদের কথা মানুষের মরমে না পৌঁছে পারে না। সিদ্ধ পুরুষ জালালুদ্দীন (র.) এর কথা বাদশাহর হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করল। তিনি বললেন, এখন আমার ইসলাম গ্রহণ করার কথা প্রকাশ হলে প্রজাদের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। অতিসত্বর আমি আমার পিতার স্থলাভিষিক্ত হব। তখন আপনি আমাকে সাক্ষাৎ দিবেন। অনেকদিন পরের কথা। শাইখ জালালুদ্দীন (র.) তার জন্মভূমিতে এসে ভীষণ অসুখে পতিত হন। মৃত্যুর সময়, নিকটবর্তী হলে পুত্র রাশিদুদ্দীনকে বলেন তুঘলক তৈমুর একদিন বড় বাদশাহ হবে, তখন তুমি তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বলবে আমার সাথে তার কী ওয়াদা ছিল। পিতার ইন্তিকালের পর রাশিদুদ্দীন ওসীয়ত মুতাবিক বাদশাহর ছাউনিতে পৌঁছে অনেক চেষ্টা করে বাদশাহর সাক্ষাৎ লাভে ব্যর্থ হন। অবশেষে তিনি একদিন ফজরের সময় তৈমুরের তাবুর পাশে আযান দেন। আযান শুনে সিপাহীরা তাকে ধরে রাজদরবারে নিয়ে গেল। রাশিদুদ্দীন নিঃশঙ্কচিত্তে তৈমুরের কাছে পিতার খবর পৌঁছালেন। তুঘলক তৈমুর তৎক্ষণাৎ কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন।
আরনল্ড বলেন- সমস্ত মুঘল (তাতারী) সাম্রাজ্যের সবখানেই এমন মুসলমান ছিল- যারা বিধর্মীকে সংগোপনে মুসলমান করে ফেলতো। উকতাই খানের আমলে ইরানের গভর্নর কিরখিজ- যিনি প্রথমে বৌদ্ধ হয়েছিলেন পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। মোটকথা, কয়েক বৎসরের মধ্যে তাতারীদের সকলে ইসলাম গ্রহণ করে। যারা মুসলিম নিধন ও মুসলিম সভ্যতার উৎখাতকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তারা শতাব্দীর মধ্যে মুসলমান হয়ে যাওয়ায় এ কথা প্রমাণিত হলো যে, ইসলাম নিজ দুশমনকেও নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে একান্ত আপন করে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। যারা একদিন ধরাপৃষ্ঠ হতে ইসলামের নামকে মুছে ফেলতে হয়েছিল বদ্ধপরিকর তাদের বংশ থেকেই বড় বড় মুসলমান বাদশাহ, ফকীহ, আলিম ও মুজাহিদ পয়দা হলো। আল্লামা ইকবাল যথার্থই বলেছিলেন- ভূতখানা থেকে বেরিয়ে এলো কাবার প্রহরী।