1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
ইসলামী শিক্ষা সংকোচন : একটি নসীহত ও উপলব্ধি
মো. মারুফ হোসাইন
  • ২ নভেম্বর, ২০২২

কোন রাষ্ট্রের প্রায় সকল জনগণের অধিকাংশ মূল্যবোধই যদি কোন নির্দিষ্ট ধর্মের শিক্ষার আলোকে আবর্তিত হয় তাহলে সে রাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তারে ইচ্ছুক  যেকোন শক্তি রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে সেই নির্দিষ্ট ধর্মের প্রভাব খর্ব করার দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকে। আর ধর্মীয় প্রভাব খর্ব করার অস্ত্র হিসাবে বহুকাল আগে থেকেই চলে আসছে ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ অথবা সংকোচনের পুরোনো পদ্ধতি। প্রাচীন মিশরীয় ফারাওদের সময়ে এ পদ্ধতির অস্তিত্ব যেমন পাওয়া যায় তেমনি পাওয়া যায় আধুনিক কিবা উত্তর আধুনিক এই সময়েও। বাংলাদেশের মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নানাভাবে নানাজন করছে বহুকাল ধরেই। এর অংশ হিসেবে অনেকবারই ইসলামী শিক্ষা সংকোচনের চেষ্টা হলেও সাফল্যের মুখ দেখেনি।

একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে এসে আমরা এখন এমন এক বিশৃঙ্খল বিশ্বব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করছি যেখানে রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সশস্ত্র যুদ্ধ যেমন আছে তেমনি সভ্যতার সাথে সভ্যতার সংঘাতও চলছে সমানতালে। এমন একটি সময় বাংলাদেশে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের নামে ধর্মীয় তথা ইসলামী শিক্ষা সংকোচনের যে নীতি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে ইসলামী শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলে অর্থাৎ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সোচ্চার প্রতিবাদ করছেন ন্যায়সংগত কারণেই। এ প্রতিবাদই উচ্চারিত হচ্ছিলো সেপ্টেম্বরে সিলেটে অনুষ্ঠিত তালামীযে ইসলামিয়ার বিভাগীয় সম্মেলনের প্রায় সকল বক্তার কণ্ঠে। লাইভে সবার বক্তব্য শুনছিলাম আর মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের বিষয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মুরশিদে বরহক আল্লামা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী কী নির্দেশনা দেন তা শুনার জন্য।

তিনি ইসলামী শিক্ষা সংকোচনের বিষয়ে সরাসরি দীর্ঘ বক্তব্য দেননি। শুধু সংক্ষেপে বলেছেন- “যদি কোন অপ্রত্যাশিত আক্রমণ আসে তাহলে টার্কির (তুরস্কের) দিকে নজর রাখবেন। কামাল পাশা যা চেয়েছিলো তা বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়নি, আন্ডারগ্রাউন্ডে পর্যন্ত দ্বীনি শিক্ষা চলেছে।” মাত্র এ দুটি বাক্যের মাধ্যমেই তিনি উপস্থিত হাজারো তালামীয কর্মী, ছাত্র-শিক্ষককে একটি পরিপূর্ণ নির্দেশনা দিয়ে গেলেন। তিনি আসলে কাকে তুরস্কের দিকে নজর রাখতে বলছেন তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। তুরস্কে ইসলামী শিক্ষা সংকোচন ও বিলোপের চেষ্টা ও পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ খুঁজে দেখে বুঝতে পারলাম তিনি এই ইস্যুতে তুরস্কের দিকে নজর রাখতে বলছেন সবাইকেই। যারা এমন নীতি গ্রহণ করছেন তাদেরকে যেন বলছেন তুরস্কের দিকে দেখো, তারা চেষ্টা করে পারেনি তোমরাও পারবে না। যারা সংকোচন নীতির প্রভাব নিয়ে চিন্তিত তাদের যেন অভয় দিয়ে যাচ্ছেন ভয় নেই, ইসলামী শিক্ষাকে দমানো যায় না। আবার তালামীয কর্মী অথবা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের দিকনির্দেশনাও দিচ্ছেন কিভাবে এ পরিস্থিতি থেকে উতরানো সম্ভব।

১৯২৩ সালে তুরস্কে প্রজাতন্ত্রের সূচনার পর থেকেই ইসলামী শিক্ষা সংকোচনের ধারা শুরু হয়। ১৯২৪ সালে  ৪৭৯টি মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই বছরে হাই স্কুল থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বিষয়ক কোর্সসমূহ বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট সমূহ থেকেও ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেওয়া হয়। ধর্মীয় শিক্ষার এ সংকোচন নীতি চলমান ছিলো ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। এ সময় যে শুধু মাদরাসাই বন্ধ হয়েছে তা নয়, বহু মসজিদকে জাদুঘরে পরিণত করা হয়, বহু খানকাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতো কিছুর পরও মানুষের হৃদয় থেকে ইসলামী শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা মুছে ফেলা যায়নি। মুসলিম শিশুরা এই কঠিন সময়েও ইসলামী বুনিয়াদী শিক্ষা  নিয়েছে পরিবার থেকে, তাসাওউফ শিখেছে সূফীদের দরবার থেকে। আমরা এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখতে পারি অতি সম্প্রতি ইন্তিকাল করা তুরস্ক তথা সারা দুনিয়ার তাসাওউফপন্থীদের প্রবাদ পুরুষ শাইখ মাহমুদ এফেন্দী (র.) এর জীবন থেকে।

মাহমুদ এফেন্দী (র.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেক্যুলার তুরস্কে ১৯২৯ সালে। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ যেসময় ছিলো সবচেয়ে কঠিন, সে সময়ে তিনি তার শৈশব কাটিয়েছেন। কিন্তু বাবা মায়ের সচেতনতার ফলে নানা প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে তিনি অল্প বয়সেই হিফয সম্পন্ন করেন, ইলমে হাদীস, ফিকহে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি বিখ্যাত সূফী শাইখ আলী হায়দার এফেন্দী নকশবন্দী (র.) এর কাছে বাইআত হয়ে তাসাউফ চর্চায় মনযোগী হন। শুধু মাহমুদ এফেন্দীই নন, তুরস্কের প্রথম ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট নাজিমুদ্দিন এরবাকানের শৈশব-কৈশোরও কেটেছে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের সময়েই। তবু তিনিও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা পেয়েছেন পরিবার থেকে, মক্তব থেকে। তুরস্কের দিকে তাকানোর কথা বলে ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী আমাদের দেশের নীতি প্রণেতাদের এই বার্তাই দিয়েছেন যে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষা সংকোচিত করার মাধ্যমে  ইসলামী ঐতিহ্য সচেতন প্রজন্ম তৈরিতে বাধার সৃষ্টি করা যাবে না। বরং এমন কঠিন অবস্থাই মাহমুদ এফেন্দীর মত জগদ্বিখ্যাত আলিমের জন্ম দেয়; এরবাকান, এরদোয়ানের মতো মুসলিম নেতার জন্ম দেয়।

তুরস্কের দিকে তাকাতে বলার আরো একটি কারণ সম্ভবত বাংলাদেশে যারা তাসাউফের খিদমতে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন তাদেরকে দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। তুরস্ক যখন ইসলাম বিদ্বেষীদের দখলে ছিলো তখন শুধু মসজিদ, মাদরাসা বন্ধতেই তারা নিজেদের আটকে রাখেনি, বরং খানকাহগুলোতেও আঘাত করেছিলো, কারণ তারা জানতো খানকাহগুলোতে ইসলামের যে সুমহান আদর্শ প্রচার হয় তা বন্ধ করতে না পারলে মাদরাসা বন্ধ করে লাভ হবে না। এমন কোন আঘাত যে কোনকালেই বাংলাদেশের সূফীদের খানকাহে আসবে না এমন নিশ্চিত হয়ে ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নেই। খানকাহসমূহ বন্ধের নানা পায়তারা সত্ত্বেও তুরস্কে ইসলামী শিক্ষার বুনিয়াদ টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন সূফীরাই। তারা তাদের মজলিস, যিকরে মানুষকে তাযকিয়ার পথে ডেকেছেন, দ্বীনি ইলমের উপকারিতা বুঝিয়েছেন, তাহযীব-তামাদ্দুন শিখিয়েছেন, সর্বোপরি তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যদাতা মুসলমানরা যে স্বতন্ত্র্য ঐতিহ্যের ধারক এই বোধ মানুষের অন্তরে সদা জাগ্রত রাখার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষা সংকোচনের ভূত চাপলে এদেশের তাসাওউফপন্থীদেরও একইভাবে কাজ করে যেতে হবে।

তালামীযের সম্মেলনে প্রধান অতিথির নসীহত থেকে তালামীয কর্মীরা তথা বাংলাদেশী মুসলিম তরুণরা আরো একটি নির্দেশনা পেতে পারেন। তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের নামে ধর্মহীনতার চর্চার বিরুদ্ধে যারা সীসাঢালা প্রাচীরের মতো দাড়িয়েছিলেন, যারা যুগের পর যুগ একনিষ্ঠভাবে উম্মাহর ঐক্যের জন্য কাজ করেছিলেন তাদের প্রায় সবাই ই তরুণ ছিলেন। মূলত সূফীদের সংস্পর্শ ধন্য নিবেদিতপ্রাণ তরুণদের পরিশ্রমেই সেদেশে ইসলামী মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা সম্ভব হয়েছে। আমাদের মুসলিম তরুণদের তাই প্রস্তুত থাকতে হবে দ্বীনের জন্য, দ্বীনি শিক্ষা কায়েম রাখার জন্য নিজের সময়, সম্পদ, পরিশ্রম কুরবান করার জন্য। আর তা এককভাবে করলে হবে না, করতে হবে সংঘবদ্ধভাবে,  উপযুক্ত নেতার নেতৃত্বে, সঠিক রাহবারের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী। তালামীয কর্মীরা ভাগ্যবান এর কোনটাই তাদের কাছে অনুপস্থিত নয়।

ফুলতলী ছাহেব (র.) যুগের পর যুগ এদেশে ইসলামী শিক্ষা রক্ষায় অকুতোভয় সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করেছিলেন। এদেশের ছাত্র-শিক্ষক সমাজ তাঁর নির্দেশনায় যেকোন আন্দোলনে পিছপা হননি। ফলশ্রুতিতে বহুবার ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী শিক্ষাকে আঘাত করার নীল নকশা। আমাদের রাহবার আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর নসীহতও বর্তমান ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য পরিস্কার পথপ্রদর্শক। এই নির্দেশনা অনুসরণ করে দ্বীনি শিক্ষার প্রহরী হিসেবে আমরা যেন কবুল হই। আমীন।

ফেইসবুকে আমরা...