1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
সূরা ফাতিহার তাফসীর
আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)
  • ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

  اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ – الرَّحمٰنِ الرَّحِيْمِ – مٰلِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ – اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ- اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ- صِرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ- غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ- اٰمِيْن

সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল সৃষ্টির পালনকর্তা। পরম দয়ালু ও অসীম করুণাময়। যিনি বিচার দিনের মালিক। আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। আমাদেরকে সরল পথ দেখাও। সে সকল লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নিআমত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত এবং যারা পথভ্রষ্ট।

সূরা ফাতিহার নাম

সূরা ফাতিহার বেশ কয়েকটি নাম আছে। প্রায় সকল নাম থেকেই এ সূরার মর্যাদার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন-
১. فاتحة الكتاب: এ নামকরণের কারণ হচ্ছে- যেহেতু এ সূরা দিয়ে কুরআন কারীম শিক্ষা ও নামাযের কিরাত শুরু করা হয় এবং প্রত্যেক কিতাবের শুরুতেই সূরা ফাতিহা দিয়ে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করা হয়। যেমনিভাবে কুরআনের শুরুতেই সূরা ফাতিহা রয়েছে।
২. الحمد: কারণ এ সূরার শুরু الحمد শব্দ দিয়ে করা হয়েছে।
৩. اُمُّ الْكِتَاب وَاُمُّ الْقُرْاٰن: যেহেতু এটি কুরআনের আসল এবং প্রত্যেক আসমানী কিতাবের আসল। কারণ এ সূরায় আল্লাহ তাআলার একত্ব, শেষ বিচারের দিনের কথা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে অথবা এ জন্যে যে, এ সূরা সকল আসমানী কিতাবের সার। অথবা এজন্য যে, এতে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা, তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যে নিয়োজিত থাকা, মুকাশাফা ও মুশাহাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে। বা এ জন্যে যে, সকল ইলমের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার আল্লাহর রবুবিয়াতের মহত্ত্ব ও বান্দাহ’র অসহায়ত্ব অনুধাবন করা। আর এ বিষয়টি এ সূরায় উল্লেখ রয়েছে। অথবা হয়তো এ জন্য ام الكتاب বা ام القران রাখা হয়েছে যে, এ সূরা কুরআনের সকল সূরার মধ্যে সর্বোত্তম। যেমন, মক্কা মুয়ায্যামাকে ام القري অর্থাৎ গ্রামের মধ্যে সর্বোত্তম গ্রাম বা মূল বলা হয় এটি জনপদগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বা সকল জনপদের মূল হওয়ার কারণে।
৪. سبع المثاني: সূরা ফাতিহাকে سبع المثاني বলা হয়, কারণ এ সূরাটি সাত আয়াত বিশিষ্ট। অধিকন্তু এ সূরা প্রত্যেক নামাযের মধ্যে অবশ্যই দুবার পড়তে হয় (অর্থাৎ নামাযের প্রথম দুই রাকাতে অবশ্যই পড়তে হয়)। বা এ সূরার প্রথম অংশ বান্দাহ কর্তৃক আল্লাহর প্রশংসা আর শেষ অংশ বান্দাহর তরে আল্লাহর দান। অথবা এটি এই উম্মতের জন্য বিশেষভাবে নাযিলকৃত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কসম ঐ যাতের, যার হাতের মুঠোয় আমার প্রাণ, সূরা ফাতিহার মতো মূল্যবান সূরা তাওরাত, ইঞ্জিল ও যাবূরের মধ্যে নাযিল করা হয়নি। এটি سبع المثاني ও কুরআনে আযীম। (আল মুসতাদরাক লিল হাকিম, কিতাবুত তাফসীর সূরাতুল ফাতিহা) অথবা এ সূরা দুবার নাযিল হয়েছে বা এ সূরায় আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করা হয়েছে এজন্য এই নাম রাখা হয়েছে।
৫. وافية: এ শব্দের অর্থ পূর্ণ। যেহেতু নামাযের মধ্যে পূর্ণ সূরাটি পাঠ করা ওয়াজিব। এ সূরা ছাড়া অন্য সূরা পড়লে নামায পূর্ণ হবে না।
৬. الكافيه: এ শব্দের অর্থ হচ্ছে সম্পূরক। কারণ এ সূরা অন্য সূরার সম্পূরক হতে পারে কিন্তু অন্য সূরা এ সূরার সম্পূরক হতে পারে না।
৭. الشفاء والشافية: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, সূরা ফাতিহা প্রত্যেক রোগের শিফা বা প্রতিষেধক। (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হা/২৩৭০)
৮. اساس: এ শব্দের বাংলা অর্থ হলো মূল ভিত্তি। যেহেতু এটি কুরআন পাকের প্রথম সূরা বা মূল বিষয়ের মতো বা এ সূরা সমস্ত ইবাদতের মূল। ইমাম শা’বী (র.) বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে শুনেছি, তিনি বলতেন, পবিত্র কুরআন হচ্ছে অন্যান্য সকল কিতাবের اساس বা ভিত্তি। আর কুরআনের মূল হচ্ছে ফাতিহাতুল কিতাব অর্থাৎ সূরা ফাতিহা। আর সূরা ফাতিহার মূল হলো بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ যখন তুমি অসুস্থ হবে বা তোমার অন্য কোনো অসুবিধা হবে, অবশ্যই তুমি اساس পাঠ করবে, আল্লাহর হুকুমে ভালো হয়ে যাবে। (তাফসীরে কুরতুবী, সূরা ফাতিহা)
৯. الصلوة: নবী করীম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, الصلوة অর্থাৎ সূরা ফাতিহাকে আমার ও আমার বান্দাহর মধ্যে দু’অংশে বিভক্ত করেছি।’ (সহীহ মুসলিম, কিতাবুস সালাত, বাব: উজুবু কিরাআতিল ফাতিহা ফি কুল্লি রাকাআহ..) কোনো বস্তুর অধিকাংশের ভিত্তিতে তার নাম রাখার রীতি থেকে এ নাম রাখা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব।
১০. سورة تعليم المسئلة: যেহেতু এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাহকে কীভাবে চাইতে হয় সে পদ্ধতি শিক্ষা প্রদান করেছেন। এ সূরা প্রথমে আল্লাহ তাআলার প্রশংসার মাধ্যমে শুরু করা হয়েছে। তারপর দুআর মধ্যে ইখলাস অর্থাৎ লোক দেখানো বা রিয়া থেকে মুক্ত রাখার শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
১১. سورة الكنز: হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সূরা ফাতিহা আরশে আযীমের ভা-ার থেকে মক্কা শরীফে নাযিল করা হয়।
হাদীস থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠে, সূরা ফাতিহা মক্কী সূরা। যারা এ সূরাকে মাদানী সূরা বলেন, তাদের কথার সামঞ্জস্য বিধান করা যায় এভাবে, এ সূরা দু’বার অবতীর্ণ হয়। তবে দু’বার অবতীর্ণ হয়েছে বলে মুতাওয়াতির কোনো প্রমাণ নেই।

اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ (সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার যিনি সকল সৃষ্টির পালনকর্তা)
আলহামদুলিল্লাহর মহত্ব
বিসমিল্লাহর বরকতে জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ এর বরকতে জান্নাতের দরজাগুলো খোলে যায়। যেহেতু, اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ এ আটটি হরফ বা বর্ণ রয়েছে। জান্নাতের দরজাও আটটি। তাছাড়া মানুষের প্রথম বাক্যই হচ্ছে اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ।
হযরত আদম (আ.) এর রূহ যখন নাভী পর্যন্ত পৌঁছেছিল, তখন তিনি হাঁচি দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ। (তিরমিযী, হা/৩৩৬৮)
জান্নাতবাসীদের শেষ চাহিদাও اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ।
এ বিশ্বজগতের সূচনার ভিত্তিও হচ্ছে حمد অর্থাৎ প্রশংসার উপর। সুতরাং প্রত্যেক কাজের শুরু এবং শেষ اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ দিয়ে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সূরা ফাতিহার মধ্যে সাত আয়াত। মানব সৃষ্টির বিবর্তন ও উন্নয়ন সাতটি স্তরের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن سُلَالَةٍ مِّن طِيْنٍ- ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَّكِيْنٍ- ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ ۚ فَتَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِيْنَ.
-আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিন্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিন্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়। (সূরা মুমিনুন, আয়াত- ১২-১৪)
এ কারণে মানুষের উন্নতির সর্বোত্তম মাধ্যম হলো সূরা ফাতিহা।

الرَّحمٰنِ الرَّحِيْمِ (পরম দয়ালু ও অসীম করুণাময়)
الرَّحمٰنِ الرَّحِيْمِরহমান ও রহীম শব্দদ্বয় বিশ্বজগতের জন্য দয়া ও করুণার কারণ। সুতরাং যে কষ্ট এবং বালা মুসিবত দুনিয়াতে হয়ে থাকে তাও প্রকৃতপক্ষে রহমত আর নিয়ামত। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন, عَسٰى أَنْ تَكْرَهُوْا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسٰى أَنْ تُحِبُّوْا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ‘হতে পারে তোমরা যা অপছন্দ কর তার মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত আর যা তোমরা পছন্দ কর, হয়তো তা তোমার জন্য অকল্যাণকর।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২১৬) এ বিষয়ের ক্ষেত্রে মূসা এবং খিযির (আ.) এর ঘটনা প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।
আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রহমত উপাধিতে ভূষিত করেছেন। এ জন্যই তিনি নিজের দাঁত মুবারক শহীদ হওয়া সত্ত্বেও দুঃখ না করে সানন্দে বলেছিলেন, اللهم اهد قومي فانهم لا يعلمون ‘আল্লাহ, আমার কাওমকে হিদায়াত দান করুন। কারণ তারা জানে না।’ (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান) আর তিনি কিয়ামতের দিন বলতে থাকবেন, امتي، امتي আমার উম্মত, আমার উম্মত।
আল্লাহ তাআলা নিজ সত্তাকে ‘রাহমান’ এবং ‘রাহীম’ শব্দ দ্বারা বিশেষিত করেছেন। তা থেকে বুঝা যায় একবার রহমত করার মাধ্যমে মানুষ সংশোধন হবে না। (আল্লাহ যেন বলছেন) আমাকে এবং আমার বান্দাকে ছেড়ে দাও। আমার রহমত অসীম। পক্ষান্তরে বান্দাহ’র গোনাহ সসীম। যেভাবে সসীম অসীমের মধ্যে ডুবে যায়, এভাবে বান্দাহ’র গোনাহ আল্লাহর রহমতের সাগরে ডুবে যায়। এ জন্যই আল্লাহ বলেন, وَلَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰى‘আপনার রব অচিরেই আপনাকে এমন দান করবেন, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।’ (সূরা দুহা, আয়াত-৫)
হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম বলেন, আমি এক সম্প্রদায়ের মেহমান হয়েছিলাম। আমার জন্য খাবার আনা হলো। একটি কাক এ খাবার থেকে একটি রুটি নিয়ে গেল। দেখলাম এই রুটিখানা একটি টিলার উপর হাত-পা বাঁধা এক ব্যক্তির মুখে নিয়ে দিল।
হযরত যুননুন বলেন, আমি এক ঘরে ছিলাম। হঠাৎ আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার খেয়াল আসল। আমি ঘর থেকে বের হয়ে নীল নদের কাছে পৌঁছলাম। সেখানে দেখলাম একটা বিচ্ছু এদিক-সেদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। যখন বিচ্ছু নীল নদের কাছে আসল, তখন একটি ব্যাঙ নীল নদের তীরে আসল এবং বিচ্ছুটি ব্যাঙের পিঠে উঠল আর নীল নদের পানিতে সাঁতার কাটতে লাগল, আমিও একটি নৌকা নিয়ে বিচ্ছুর পিছু ছুটলাম। যখন ব্যাঙ নীল নদের তীরে উঠল, বিচ্ছু ব্যাঙের পিঠ থেকে নেমে দৌঁড়াতে লাগল। আমিও পিছু ছুটলাম। দেখলাম একটি বৃক্ষের নিচে এক যুবক ঘুমাচ্ছিল এবং এ যুবকের নিকট একটি সাপ তাকে কামড় দেবার মনস্থ করছিল, যখনই সাপ একেবারে ওই যুবকের নিকটবর্তী হচ্ছিল, তখনই ওই বিচ্ছু সাপের কাছে গিয়ে সাপকে কামড়ে দিল এবং সাপও বিচ্ছুকে কামড় দিল। ফলে উভয়ে একসাথে মারা গেল।
আরববাসী দুআর সময় বলতেন, يا رزاق النعاب في عشه ‘হে কাকের বাচ্চার মুখে রিযিক পৌঁছিয়ে দানকারী।’ ঘটনা হলো, কাকের বাচ্চা ডিম থেকে বের হওয়ার পর সাদা একটা গোশতের টুকরার মতো দেখায়। কাক বাচ্চার রঙ তার নিজের রং এর বিপরীত দেখে ঘৃণাভরে বাচ্চাদের ছেড়ে চলে যায়। হযরত ইমাম দামীরী লিখেন, দু থেকে এগারো দিন যখন বাচ্চা এভাবে একা পড়ে থাকে, এ সময়ের মধ্যে আল্লাহ তাআলা বাচ্চাগুলোর শরীরে এক প্রকার গন্ধ সৃষ্টি করে দেন, এতে মাছি এদের চারপাশে ঘিরে বসে, বাচ্চাদের মুখের ভিতর আরো বেশি গন্ধ হয় আর বাচ্চাগুলো মুখ খোলে রাখে, মাছি কাকের বাচ্চার মুখে ঢুকে আর কাকের বাচ্চারা তা খেতে থাকে। এভাবে পাখা গঁজিয়ে উঠা পর্যন্ত চলতে থাকে। এরপর যখন কাকের বাচ্চার শরীরে পাখা গজিয়ে রং কালো হয়, তখন এদের মা তাদের কাছে আসে।
বর্ণিত আছে, এক সাহাবী মুমুর্ষূ অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু তার মুখ দিয়ে لا اله الا الله বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ ব্যাপারে অবহিত করা হলো। তিনি তাকে তালকীন করতে লাগলেন কিন্তু তার মুখ দিয়ে কালিমা বের হচ্ছিল না। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এ লোক কি নামায পড়ত না? এ লোক কি যাকাত দিত না? এ লোক কি রোযা রাখত না? তখন সকলে জবাব দিলেন, হ্যাঁ সবকিছু করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, এ লোক কি নিজের মায়ের নাফরমানী করত? লোকেরা বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার মাকে ডাক। এরপর এক বৃদ্ধা অন্ধ মহিলাকে ডাকা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃদ্ধা মহিলাকে বললেন, হে বৃদ্ধা! তুমি কি একে ক্ষমা করবে না? বৃদ্ধা জবাব দিলেন, আমি কখনো একে ক্ষমা করবো না। কারণ এ আমাকে চড় মেরে আমার এ চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাহলে আগুন এবং লাকড়ী আন। এতে বৃদ্ধা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আগুন আর লাকড়ী দিয়ে কি করবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একে তোমার সামনেই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেব; সে তার কাজের ফল পাবে। এ কথা শুনে বৃদ্ধা বললেন, আমি তাকে মাফ করে দিলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ। তাকে আগুনে পোড়ানোর জন্যই কি আমি নয় মাস উদরে রেখেছিলাম? আগুনে পোড়ানোর জন্যই কি তাকে দু’বছর দুধ পান করিয়েছিলাম? তাহলে মা এর রহমত বলতে আর কি রইলো? সাথে সাথে ওই লোকের মুখ খুলে বের হলো, لا اله الا الله এ তো শুধু মায়ের দয়া থেকেই হয়েছে। মায়ের দয়ায় যদি আগুনের পোড়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, তাহলে رحمٰن رحيم এর দয়ার বিস্তৃতি কত মহীয়ান হবে তা সহজেই অনুমেয়। তিনি কিভাবে তার বান্দাহকে আগুনে পোড়াবেন- যার মুখ দিয়ে ৭০ বছর পর্যন্ত অবিরত رحمٰن رحيم অনুশীলন হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলার একশত রহমত রয়েছে। তন্মধ্যে একশত ভাগের এক ভাগ রহমত এ পার্থিব সৃষ্টি জীব তথা মানুষ, জিন, পশু-পাখি, জানোয়ার সকলকে দান করেছেন। এর ভিত্তিতেই তারা পরস্পরের প্রতি রহম করেন। আর ৯৯ ভাগ রহমত দ্বারা কিয়ামতের দিন তিনি তার বান্দাদের রহম করবেন, (সহীহ মুসলিম, কিতাবুত তাওবাহ, বাবু ফি সাআতি রাহমাতিল্লাহ…) আল্লাহ তাআলার করুণার সীমা নেই আর রহমতের শেষ নেই।

مٰلِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ (যিনি বিচার দিনের মালিক)
আদালত বা ন্যায়পরায়ণতার অর্থ হচ্ছে, ভালো আর খারাপের মধ্যে পার্থক্য করা, কৃতজ্ঞ ও কৃতঘ্ন, অনুকূল ও প্রতিকূলের মধ্যে পার্থক্য করা, সীমারেখা টানা। এগুলো বিচারের দিবস ছাড়া হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيْهَا لِتُجْزٰى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعٰى
-কিয়ামত নিকটবর্তী ও আসন্ন। আমি তা গোপন রাখতে চাই যাতে প্রত্যেকেই নিজ নিজ আমল অনুযায়ী তার ফল পেতে পারে। (সূরা ত্বা-হা, আয়াত-১৫)
হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে, কিয়ামতের দিন এক লোককে বিচারের জন্য আনা হবে, সে তার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখবে কিন্তু তার একটা নেকীও খোঁজে পাবে না। এরপর গায়িবী আওয়াজ আসবে! হে আল্লাহর বান্দাহ! তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর। এতে ওই ব্যক্তি বলবে রব, আমি কী আমল করেছি, যার কারণে বেহেশতে প্রবেশ করব! আল্লাহ তাআলা উত্তর দেবেন, যখন তুমি রাত্রে ঘুমাতে, তখন এপাশ ওপাশ হওয়ার সময় আল্লাহ বলেছিলে। তারপর ঘুমের মধ্যে তা ভুলে গিয়েছিলে; কিন্তু আমার তো ঘুম নেই, তাই আমি তা ভুলিনি। অপর এক লোককে উপস্থিত করা হবে। তার নেকী আর পাপ ওজন করা হবে, তার নেক কাজগুলো হালকা হয়ে যাবে। তারপর একটা কার্ড দেওয়া হবে, যাতে لا اله الا الله লিখা থাকবে যার কারণে নেকীর পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। (তাফসীরে কুরতুবী, সূরা আরাফ, আয়াত: والوزن يومئذ الحق…) মোট কথা আল্লাহ তাআলা মহান, তাঁর মহত্বের গুণেই ক্ষমার আশা করা যায়। কারণ তিনি এ বিশ্ব ভূম-লের মুখাপেক্ষী নন। কিন্তু বান্দাহর হক থেকে বেঁচে থাকা প্রয়োজন। কেননা হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুফলিস অর্থাৎ গরীব কে তা জানো? আমরা সাধারণত মনে করি মুফলিস বা গরীব সে ব্যক্তি, যার দিরহাম বা আনন্দ উপভোগ করার মতো সামগ্রী নেই। কিন্তু আসলে তা নয়। মুফলিস বা দরিদ্র সেই ব্যক্তি কিয়ামতের দিন যার নামায, যাকাত ও রোযা সবকিছু হাজির করা হবে। কিন্তু এর সাথে হাজির করা হবে অমুককে সে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের মাল আত্মসাৎ করেছে, অমুকের রক্তপাত ঘটিয়েছে, অমুককে প্রহার করেছে। তখন তার পূণ্য থেকে এদের সবাইকে প্রদান করা হবে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে তার সকল নেকী শেষ হয়ে যাবে। তখন পাওনাদারের পাপ ঐ ব্যক্তিকে দিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তাকে দুযখে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাতি ওয়াল আদাব, বাবু তাহরীমিয যুলম)
مالك শব্দের মধ্যে আলিফ অতিরিক্ত ব্যবহার করার রহস্য হলো, কিয়ামতের দিন অনেকেই মালিক হবে কিন্তু শেষ অবধি আল্লাহ তাআলার মালিকানা ছাড়া কারো মালিকানা থাকবে না। ملك আর مالك শব্দদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো ملك শব্দের মধ্যে ভয়-ভীতি ও কার্য কৌশলের অর্থ আছে, অন্যদিকে مالك শব্দের মধ্যে ন¤্রতা ও করুণার অর্থ রয়েছে। অধিকন্তু مالك বলা হয় রাজত্বের অধিকারী হওয়াকে। যেমন, আল্লাহ তাআলার বাণী, قُلِ اللّٰهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِيْ الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ- وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ-
-বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর। (সূরা আল ইমরান, আয়াত-২৬)
এখানে مالك দ্বারা সাম্রাজের মালিক তথা স¤্রাটকে বুঝানো হয়েছে। পক্ষান্তরে কোনো বিষয়ে একক কর্তৃত্বের অধিকারীকে বলা হয় ملك। যেমন বলা হয়েছে- لا ملك الا هو অর্থাৎ কিয়ামতের দিনে তিনি ছাড়া কর্তৃত্ববান আর কেউ নেই। আল্লাহ তাআলার বাণী, لِمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ لِلّٰهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ (আজকের কর্তৃত্ব কার? এক ও পরাক্রমশালী আল্লাহর) এবং اَلْمُلْكُ يَوْمَئِذِنِ الْحَقُّ لِلرَّحْمٰنِ (সে দিনের সত্যিকার কর্তৃত্ব করুণাময় আল্লাহর থাকবে)। এ আয়াতসমূহে مالك বলতে কর্তৃত্ব বুঝানো হয়েছে রাজত্ব নয়। উল্লেখ্য যে, দুনিয়ার রাজত্বের জন্য যোগ্যতা ও ন্যায়পরায়ণতা আবশ্যক, কারণ এর উপরই জীবন সুখী হওয়া নির্ভর করে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثٰى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً ۖ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ “নর-নারী যেই হোক যদি ভালো কাজ করে এমতাবস্থায় যে সে মুমিন, আমি তাকে উত্তম জীবন দান করব, তাকে উত্তম পুরস্কারে পুরস্কৃত করব।” (সূরা নহল, আয়াত-৯৭)
এর প্রমাণস্বরূপ একটা উদাহরণ প্রদান করা হলো, বাদশাহ নওশিরওয়ান একদিন শিকার করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে নিজ সৈন্য থেকে পৃথক হয়ে পড়লেন। তিনি খুবই তৃষ্ণার্ত হলেন। তিনি বনের ভিতর আনারের একটি বাগান দেখলেন। বাগানে প্রবেশ করে এক বালককে বললেন, আমাকে একটা আনার দাও। সে আনার দিল। আনার ভেঙে তিনি সুস্বাদু নির্যাস বের করে তা পান করলেন। অতঃপর তাঁর এ বাগান পছন্দ হলো। তিনি মালিকের নিকট থেকে বাগান নিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তারপর বালকটিকে বললেন, আমাকে আরও একটা আনার দাও। বালক আরও একটি আনার দিল। যখন ওটা ভাঙলেন, কিছু নির্যাস বের হলো এবং তা পান করলেন, কিন্তু টক পেলেন। তিনি বালকটিকে বললেন, হে বালক, আনারের এ অবস্থা কেন? বালকটা বললেন, সম্ভবত এ দেশের বাদশাহ অত্যাচারের সংকল্প করেছেন, তার অত্যাচারের মন্দ প্রভাবে আনারের ঐ অবস্থা। সেই সময়েই নওশিরওয়ান মনে মনে তাওবাহ করে নিলেন এবং বালককে বললেন, আরও একটা আনার দাও, যখন ওই তৃতীয় আনারটা ভাঙলেন এবং নির্যাস বের করলেন, আগেরটার চেয়ে আরো ভালো ও সুস্বাদু পেলেন। তখন বালকটিকে বললেন, এখনতো অবস্থার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বালক জবাব দিল, সম্ভবত বাদশাহ তার ধারণা থেকে তাওবাহ করেছেন। যখন বাদশাহ বালকটার কথার সঙ্গে নিজের ধ্যান-ধারণার মিল খোঁজে পেলেন, তখন সম্পূর্ণভাবে তাওবাহ করলেন। এমনকি তখন থেকে তিনি এমন ন্যায়বান হয়ে গেলেন যে, তার সুনাম ও সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বলেন, এ যামানায় একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ’র আবির্ভাব হয়েছে।
সূরা ফাতিহার মধ্যে আল্লাহ তাআলার পাঁচটি নাম রয়েছে।
১. الله ২. الرب ৩.الرحمٰن ৪.الرحيم ৫.الملك
হয়তো এ শব্দের দ্বারা তিনি এভাবে ইশারা করে বলছেন যে, আমি আল্লাহই তোমাকে সৃষ্টি করেছি। তারপর বিভিন্ন ধরনের নিয়ামতের মাধ্যমে লালন-পালন করেছি সুতরাং আমি রব। এরপর তুমি নাফরমানী করেছ কিন্তু তা আমি প্রকাশ করিনি, যেহেতু আমি রাহমান। এরপর তুমি তাওবাহ করেছ, আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি যেহেতু আমি রাহীম অর্থাৎ তাওবাকারীর তাওবাহ কবূল করে বান্দাহকে ক্ষমা করে দেই। এরপর তোমার আমলের ফল প্রদান করব যেহেতু আমি শেষ বিচারের দিনের মালিক।
আল্লাহ তাআলা যেন বলেছেন, তোমরা আমার যাতে কামালের মহত্ব বর্ণনা করে আমার প্রশংসা কর, কারণ আমিই আল্লাহ। তোমরা আমার ইহসানের জন্য প্রশংসা কর, কারণ আমিই রাব্বুল আলামীন। অনন্তর তোমরা আমার ইহসানের প্রত্যাশা কর যেহেতু আমি রাহমান রাহীম। পক্ষান্তরে আযাবের ভয়ে ভীত হও, যেহেতু আমি শেষ বিচারের দিনের মালিক।

اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ  (আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি) 

ব্যাখ্যা: আরবী ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী, مفعول কে আগে আনলে বিশেষত্ব প্রকাশ পায়। অর্থাৎ আমরা আপনি ছাড়া আর কারো ইবাদত করি না। ইবাদতের উপযুক্ত ঐ সত্তা হতে পারেন, যার থেকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের আশা করা যায়। তিনি হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। আর ইবাদত আল্লাহ তাআলার জন্যই নির্ধারিত। এর কারণ হলো, বান্দাহ’র তিনটি অবস্থা হয়ে থাকে। যেমন- ১. অতীত ২. বর্তমান ৩. ভবিষ্যৎ। অতীতে বান্দাহ’র কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আল্লাহ তাআলা তাকে আবিষ্কার করলেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, وَقَدْ خَلَقْتُكَ مِن قَبْلُ وَلَمْ تَكُ شَيْئًا অর্থাৎ “আমি তোমাকে আগে সৃষ্টি করেছি। তখন তুমি কিছুই ছিলে না” (সূরা মরিয়ম, আয়াত-৯) এরপর তাকে শ্রবণের, দর্শনের এবং উপলব্ধি করার শক্তি দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী, وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ ‘তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন।’ (সূরা আন নাহল, আয়াত-৭৮) বর্তমানকালে বান্দাহর অনেক প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা রয়েছে। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বান্দাহর গোনাহ আর অবাধ্যতা সত্ত্বেও আল্লাহ রব, রাহমান ও রাহীম। আর ভবিষ্যৎ তথা মৃত্যুর পর বান্দাহের সমস্ত কাজের সম্পর্ক তার মালিকের সাথে, কারণ তিনি শেষ বিচারের দিনের মালিক। আর সকল অবস্থায় বান্দাহ তার রবের নিকটই প্রার্থনা করে। এ জন্যই আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্যিকার মা’বুদ নেই। তিনি চিরন্তন অমুখাপেক্ষী। সমস্ত সৃষ্টি তাঁর মুখাপেক্ষী। এটা নিয়ম যে, নিজের চাহিদা পূরণের জন্য খিদমাতের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন বরং সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। সুতরাং তিনিই ইবাদতের অধিকারী। এজন্য আল্লাহ বলেন, وَقَضٰى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْا إِلَّا إِيَّاهُ ‘তোমার রব নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যেন তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে। (বনী ইসরাইল, আয়াত-২৩)
اياكআগে ব্যবহারে খোদাভীতি সৃষ্টি হয়, যাতে ইবাদত এদিক সেদিক না হয়। শয়তান যখন মানুষের অন্তরে আলস্য ও বাতিল খেয়ালের সঞ্চার করে, তখন اياك نعبد বললে সাথে সাথে আল্লাহ তাআলার জালালতের প্রভাব অন্তরকে প্রভাবিত করে। তখন অন্তর দাসত্বের হক আদায় করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। শয়তান ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে যে, মা’বুদ কে? শয়তানের এ ওয়াসওয়াসা থেকে বেঁচে থাকার উত্তম পদ্ধতি হলো এই اياك نعبد। এছাড়া এটাও একটা বাস্তব সত্য যে, যে সত্তা সকলের ঊর্ধ্বে এবং আগে, তাঁকে সর্বদা সকলের আগে উল্লেখ করাই উচিত। তাছাড়া হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের জন্য এটা ইবাদতের বিশেষ পদ্ধতি। কারণ আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাইলকে সম্বোধন করে বলেন, اُذْكُرُوْا نِعْمَتِيَ তোমরা আমার নিআমতের কথা স্মরণ কর। তাদেরকে নিআমতের স্মরণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। আর উম্মতে মুহাম্মদীকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, فَاذْكُرُوْنِيْ اَذْكُرُكُمْ তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। এটাই হচ্ছে এ আয়াতের বৈশিষ্ট্য।
نعبدশব্দের মধ্যে বহুবচন ব্যবহারের হিকমত
এখানে نعبد বহুবচন ব্যবহার করায় আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে বান্দাহকে সম্মান প্রদান করা হয়েছে। এখানে এমন শব্দ ব্যবহার হয়েছে যাতে সম্মান এবং মর্যাদা রয়েছে। আর এটা আল্লাহ তাআলার নিয়ম। যেমন আল্লাহ বহুবচনের সিগাহ ব্যবহার করে বলেন, نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ أَحْسَنَ الْقَصَصِ ‘আমি তোমার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছি।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত-০৩)
আল্লাহ তাআলা যেন বলছেন, হে বান্দাহ! যখন তুমি আমার দাসত্ব প্রকাশ করেছ এবং আমার গোলাম হওয়াকে অস্বীকার করনি, আমি তোমাকে একটি উম্মত বানিয়ে দিয়েছি, যেভাবে ইবরাহীমকে বানিয়েছি।إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً -অবশ্যই হযরত ইবরাহীম (আ.) একটি উম্মত ছিলেন। (সূরা নহল, আয়াত-১২০)
দ্বিতীয়ত: যদি اياك اعبد বলা হতো, তা আবদ হওয়ার দাবি রাখত। আর اِيَّاكَ نَعْبُدُ বলা হলে তার অর্থ হবে, আমি আপনার গোলামদের মধ্য হতে একজন গোলাম; আর নিঃসন্দেহে এর মধ্যে বের্শি আদব ও বিনয় পাওয়া যায়। এর মধ্যে আরও একটি ইঙ্গিত রয়েছে, জামাআতের সাথে নামায আদায় করা উত্তম। এর মধ্যে আরও ইশারা রয়েছে যে, আমি আপনারই ইবাদত করছি, ফিরিশতারা আমার সাথে আছেন, এমনকি উপস্থিত সবাই এবং আল্লাহ তাআলার নেককার বান্দাহগণও আছেন।
বর্ণিত আছে জনৈক গ্রাম্য লোক মসজিদের দরজায় এসে নিজের উট থেকে নেমে পড়লেন এবং উটটি রেখে মসজিদে প্রবেশ করলেন। অত্যন্ত প্রশান্তি ও ভক্তি সহকারে নামায আদায় করলেন ও দুআ করলেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা এ দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তারপর যখন মসজিদ থেকে বের হলেন, তখন নিজের উট পেলেন না। উট না পেয়ে তিনি বললেন, আল্লাহ! আমি আপনার আমানত আদায় করেছি, আমার আমানত কোথায়? বর্ণনাকারী বলেন, আমি এতে আরও আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আল্লাহ তাআলার নিকট এরকম বলার পরপরই বিলম্ব না করে একটি লোক উটের উপর আরোহণ করে চলে আসল, আরো দেখলাম তার হাত কেটে দেওয়া হয়েছে। সে উটটি তাকে সোপর্দ করে চলে গেল। (তাফসীরু গারাইবিল কুরআন লিন নিশাপুরী, সূরা ফাতিহা)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে আব্বাস (রা.) কে বলেন, হে বৎস! একাকী অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশ পালন কর, আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন। এজন্য বলা হয়, ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার অর্থ হচ্ছে অকল্যাণ হতে আনন্দের জগতে পদার্পণ করা। (তাফসীরে কাবীর; ইমাম রাযী, সূরা ফাতিহা, فصل- تفسير اياك نعبد واياك نستعين)
মোট কথা, نعبد শব্দ দ্বারা আল্লাহর প্রেম সাগরে এমন ইখলাস সৃষ্টি হয়, যার দ্বারা বান্দাহ অন্তরের মধ্যে আনন্দ, স্বাদ, নৈকট্য অনুভব করে। যার দ্বারা বান্দাহ নামাযের বাইরের সকল বস্তু হতে বেখবর হয়ে যায়। হাদীস শরীফে আছে, عن رسول الله صلى الله عليه وسلم انه كان حين يشرع في الصلوة كانوا يسمعون من صدره ازيزا كازيز المرجل রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামায শুরু করতেন তাঁর বক্ষ মুবারক থেকে শ্রুতিমধুর সুর অনুরণিত হত (তাফসীরে কাবীর, ইমাম রাযী, সূরা ফাতিহা)। এটা মোটেই দুরূহ নয়। কারণ আল্লাহ তাআলার বাণী فَلَمَّا رَأَيْنهُ أَكْبَرْنَهُ وَقَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ “অতঃপর যখন তারা তাকে দেখল তখন তারা তার মহিমায় আভিভূত হলো এবং নিজেদের হাত কেটে ফেলল।” (সূরা ইউসুফ-৩১)
এখানে মানুষের সৌন্দর্য দর্শনে যদি এমন প্রভাব পড়তে পারে, তাহলে আল্লাহ তাআলার মাহাত্ম্য-মর্যাদা অন্তরে উপলব্ধি করে বান্দাহর মনেও অনুরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়া একজন বাদশাহের সামনে যদি তার প্রজা দাঁড়াতে ভয় পায়, তাহলে রাব্বুল আলামীনের সামনে বান্দাহ’র কী অবস্থা হতে পারে, তা তো সহজেই বুঝা যায়।
আবিদ তিন স্তরে ইবাদত করেন। এর মধ্যে একদল সাওয়াবের আশায় প্রেরণা পায় আবার শাস্তির ভয়ে ইবাদত করার জন্য উদ্যত হয়। এ ধরনের লোককে ‘যাহিদ’ বলা হয়। যে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ এবং তাঁর সাথে সম্পর্ক গড়ার জন্য ইবাদত করে তাকে ‘আরিফ’ বলা হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে মালিক এবং নিজেকে আল্লাহ তাআলার গোলাম মনে করে। মালিকের সম্মানার্থে মালিককে ভয় করে এবং তার দাসত্বের জন্য নিজেকে বিনয়ী ও হীন মনে করে। এমন চিন্তা-ধারা নিয়ে যে যা-ই করবে তা ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে; আর ইবাদতের অন্তিম স্তর হচ্ছে ঐটাই। যার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে اِيَّاكَ نَعْبُدُ (অর্থাৎ আমরা আপনারই ইবাদত করি) এর মাধ্যমে।
বর্ণিত আছে, বনী ইসরাইলের এক আবিদ সত্তর বছর পর্যন্ত একাকী ইবাদত করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা ফিরিশতা পাঠিয়ে বলেন, হে আবিদ! তুমি কষ্ট কর না। কারণ তোমার ইবাদত কবুল হচ্ছে না। আবিদ জবাব দিলেন, এটা আমার দায়িত্ব। আমি গোলামী করতেই থাকব। আর কবুল করা না করা এটা মাবুদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে। যখন ফিরিশতা ফিরে গেলেন, তখন আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করলেন, আমার বান্দাহ কী জবাব দিয়েছে? ফিরিশতা বলেন, হে রব! আপনি তো জানেন, সে এরকম এরকম বলেছে। এতে আল্লাহ তাআলা ফিরিশতাকে বলেন, তুমি আবার গিয়ে বল। হে আবিদ! তোমার নিয়তের দৃঢ়তার কারণে তোমার ইবাদত কবুল করা হয়েছে।
আল্লাহর দাসত্বের মর্যাদা লাভ করাই একজন মানুষের চূড়ান্ত মর্যাদা। এজন্য আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসা করে বলেন, سُبْحَانَ الَّذِيْ أَسْرٰى بِعَبْدِهِ لَيْلًا “ঐ মহান আল্লাহ তাআলা অতিশয় পবিত্র যিনি তার বান্দাহকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন।” (সূরা বনী ইসরাইল-১)
হযরত ঈসা (আ.) এই বলে গৌরব করেছেন, اني عبد الله আমি আল্লাহর গোলাম। আর হযরত আলী (রা.) বলেন,
كفاني فخرا ان اكون لك عبدا * كفاني شرفا ان تكون لي ربا
-(হে আল্লাহ) আমার গৌরবের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, আমি আপনার গোলাম। আমার সম্মানের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, আপনি আমার রব।
কোনো কিছু করা বা না করার ক্ষেত্রে বান্দাহর ইচ্ছার স্বাধীনতা রয়েছে। এতে একটা বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। এ প্রাধান্য আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কাউকে দেওয়া যায় না। সুতরাং আল্লাহ তাআলার দিকে আকৃষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কোনটা ভালো কোনটা খারাপ তা উপলব্ধি করার মতো বিবেক বান্দাহর থাকা সত্ত্বেও সঠিক পথ প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ তাআলার সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া সত্যের অনুসন্ধান করার জন্য অন্তরে আগ্রহ সৃষ্টি করে দেওয়াও আল্লাহ তাআলার কাজ। এজন্য বলা হয়, لا حول عن معصيت الله الا بعصمة الله ولا قوة علي طاعة الله الا بتوفيق الله
-আল্লাহ তাআলার পরিত্রাণ ছাড়া কেউ গোনাহ থেকে ফিরে থাকতে পারে না। আল্লাহ তাআলার তাওফীক ছাড়া তার অনুগত হয়ে চলার শক্তি কারো নেই।
সকল কাজের ফলাফল আল্লাহ তাআলার কুদরতী হাতের মুঠোয় রয়েছে, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। প্রশ্ন হতে পারে কাজের শুরুতেই কী সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে? এর জবাবে বলা যায়, কাজের শুরুতেই যেন বান্দাহ বলছে, আল্লাহ! আমি ইবাদত শুরু করলাম, তুমি তা পূর্ণ করে দাও। আল্লাহ তোমার সাহায্য কামনা করি, যেন কোনো অন্তরায় সৃষ্টি না হয়। কেননা قلوب المؤمنين بين اصبعين من اصابع الرحمٰن মুমিনদের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মধ্যখানে। হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ তাআলার উপর নির্ভর করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট সাহায্য চাইব না। তাঁর হাত পা বেঁধে আগুনে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। তখন হযরত জিবরাইল (আ.) এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সাহায্যের প্রয়োজন আছে? হযরত ইবরাহীম খলীল জবাব দিলেন, তোমার কাছে আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। এতে জিবরাইল (আ.) বললেন, তাহলে আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য চাও। হযরত ইবরাহীম (আ.) জবাব দিলেন, حسبي من سؤالي علمه بحالي আমার চাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমার অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানেন। (তাফসীরে বাগভী, সূরা আম্বিয়া)
এ থেকে একটি সূক্ষ্ম বিষয় উদঘাটিত হয় যে, মুমিন নামাযে দাঁড়ালে হাঁটা-চলা থেকে পা বেঁধে নেওয়া হয়, হাত কোনো কিছু ধরা থেকে বেঁধে নেওয়া হয়, আর মুখকে কুরআন পাঠ এবং তাসবীহ ব্যতীত অন্যান্য সকল কথা বলা থেকে বন্ধ রাখা হয়। যেভাবে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, يَا نَارُ كُوْنِي بَرْدًا وَّسَلَامًا عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ “হে আগুন তুমি ইবরাহীমের উপর ঠান্ডা এবং শান্তিপূর্ণ হয়ে যাও।” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৬৯)
এভাবে জাহান্নামের আগুন বলবে, جز يا مؤمن فقد اطفأ نورك لهبي হে মুমিন! তুমি তাড়াতাড়ি কর। কারণ তোমার নূর আমার অগ্নিশিখা নিভিয়ে দিচ্ছে। (আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, হাদীস নং ১৮১৫৮)

সম্বোধনের প্রতি প্রত্যাবর্তন করার মধ্যে উপকারিতা
প্রশ্ন হতে পারে مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ পর্যন্ত সম্বোধন ছাড়া প্রশংসা করে اِيَّاكَ نَعْبُدُ থেকে সম্বোধনের দিকে প্রত্যাবর্তন করার মধ্যে কি হিকমত রয়েছে? এর উত্তরে বলা যায় যেহেতু নামায শুরু করার সময় মুসল্লী অপরিচিত ছিল, কাজেই সম্বোধন ছাড়াই مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করেছে। এরপর যেন আল্লাহ তাআলা বলেন, হে বান্দাহ! তুমি আমার প্রশংসা করেছ এবং তুমি স্বীকার করেছ, আমি সমস্ত সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা, রহমান, রহীম, বিচার দিবসের মালিক। তাই সত্যিই তুমি আমার খুব ভালো বান্দাহ। তোমার জন্য আমি আমার পর্দাকে উঠিয়ে দিলাম। যে দূরত্ব ছিল তা নৈকট্য দ্বারা পরিবর্তন করে দিলাম। তুমি সম্বোধন করে কথা বল এবং বল, اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ
যেহেতু اِيَّاكَ نَعْبُدُ এর মধ্যে ভয়-ভীতির ভাব পরিলক্ষিত হয়। সেহেতু তা দূর করার জন্য সাথে সাথে اِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ আনা হয়েছে।

اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ (আমাদেরকে সরল পথ দেখাও)
এ আয়াতে হিদায়াত চাওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে মুমিন তো হিদায়াতপ্রাপ্তই হয়। সুতরাং পুনরায় হিদায়াত চাইলে তো পাওয়া জিনিস আবার চাওয়ার মতো হয়।
এর জবাবে বলা যায়, الصراط المستقيم এর মর্মার্থ হচ্ছে صراط الاولين বা পূর্ববর্তীগণের রাস্তা, যা افراط ও تفريط থেকে মুক্ত। আনুগত্যের দিক থেকে ইহা পূর্ববর্তী নবীগণের মতো। যেমন, আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীম (আ.) নিজের ছেলেকে কুরবানী দিয়েছিলেন। হযরত ইসমাইল (আ.) এতে রাজী হয়ে আনন্দে গর্দান পেশ করে দিয়েছিলেন। হযরত ইউনুস (আ.) নিজেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার জন্য রাজী হয়েছিলেন।
কেউ কেউ صراط শব্দ দ্বারা কুরআন এবং ‘ইসলাম’ অর্থ নিয়ে থাকেন। কিন্তুصراط المتقدمين বলার পর কুরআন অর্থ নেওয়া কিভাবে ঠিক হতে পারে? কারণ সে সময় কুরআন ছিল না। কাজেই এর অর্থ নেওয়া হবে শরীআতের নিয়মনীতি এবং আইনসমূহ। যেমন আল্লাহ বলেন, فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ -অতএব, আপনিও তাদের পথ অনুসরণ করুন।
হযরত আলী (রা.) বলেন, اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ এর মর্মকথা হচ্ছে, ثبتنا علي الهداية ربنا لا تزغ قلوبنا بعد اذ هديتنا “আল্লাহ! আমাদেরকে হিদায়াতের উপর সুদৃঢ় রাখুন। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের অন্তরকে হিদায়াত দান করার পর বক্র করবেন না।” কারণ অনেক আলিমের পদস্থলন হয়ে যায়, অনেক হিদায়াতপ্রাপ্ত লোকও গোমরাহ হয়ে যায়। (তাফসীরে বাগাভী, সূরা ফাতিহা)
এখানে صراط শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, سبيل এবং طريق শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। কারণ এখানে صراط বলতে জাহান্নামের উপরস্থিত সিরাতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জাহান্নামের রাস্তা অতিক্রম করে জান্নাতে প্রবেশের পথ সহজ করে দেন।
اهدنا শব্দের মধ্যে সর্বনাম (ضمير) বহুবচন এজন্য নেওয়া হয়েছে, যেন দুআ করার সময় বিশ্বের সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এমন দুআ কবূল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়। দুআ করার সময় সকল মুসলমানকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কেননা তাদের মধ্যে এমন কেউ থাকতে পারে যার দুআ কবূল করা হয়। আর আল্লাহ তাআলা কিছু লোকের জন্য দুআ কবূল করবেন আর কিছু লোকের দুআ ফিরিয়ে দেবেন তা তাঁর শানের খেলাফ। তিনি একজনের ওসীলায় সকলকে কবূল করে নেন।
এর উপর ভিত্তি করেই দুআর আগে পিছে দুরূদ পাঠ করাকে নিয়ম বলা হয়েছে। কারণ দুরূদ কবূল হওয়া সম্পর্কে কারো মতানৈক্য নেই। যদি দুআর শুরুতে এবং শেষে দুরূদ পাঠ করা হয়, তাহলে শেষ আর শুরুর অংশ কবূল করে নিলে মধ্যের অংশ কবূল হয়ে যাবে। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এমন মুখ দিয়ে দুআ করো, যে মুখ দিয়ে গোনাহের কথা বের হয়নি। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ ধরনের লোক আমাদের মধ্যে কে আছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা একে অপরের জন্য দুআ কর। কারণ তুমি ওই লোকের মুখ দিয়ে গুনাহ করনি আর সে তোমার মুখ দিয়ে গোনাহ করেনি।
মোটকথা, اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ হলো সকল প্রশংসাকারীর পক্ষ থেকে প্রশংসা। আর اِيَّاكَ نَعْبُدُ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইবাদত সকলের পক্ষ থেকেই। اِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ দ্বারা সকলের পক্ষ থেকে সাহায্য তলব করা হয়। আর যখন হিদায়াত চাওয়া হয় তা সকলের জন্য তলব করা হয়। এভাবে সালিহীনের ইকতিদা তলব করা হয়। غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ দ্বারা সব ধরনের গোমরাহী ও ক্রোধ থেকে রক্ষা করা বুঝায়। দুনিয়ায় যদি এভাবে অনুসরণ হয়ে থাকে তাহলে আশা রাখা যায় পরকালেও অনুরূপ হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَأُولٰئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِّنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ ۚ وَحَسُنَ أُولٰئِكَ رَفِيْقًا
-আর যারা আল্লাহর এবং রাসূলের আনুগত্য করবে, তারা যাদের প্রতি আল্লাহ নিআমত দান করেছেন, তাদের সঙ্গী হবে। তারা হলেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর সঙ্গী হিসেবে তারা কতইনা উত্তম। (সূরা নিসা, আয়াত-৬৯)
হিদায়াত যখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, তখন ايصال الى المطلوب হয়। অর্থাৎ হিদায়াতের কর্তা যদি আল্লাহ হন, তখন মাধ্যম ছাড়াই হিদায়াত হয়, মাধ্যম ছাড়াই অভিষ্ট লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা পৌঁছিয়ে দেন। কারণ আল্লাহ তাআলা কারো মুখাপেক্ষী নন।
আর الصِرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَএর উদ্দেশ্য হলো মধ্যম পন্থা, যা চরমপন্থা থেকে মুক্ত।

صِرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ (সে সকল লোকের পথ, যাদেরকে তুমি নিআমত দান করেছ)
নিআমত দুভাগে বিভক্ত- এক প্রকার নিআমত মুমিন নর-নারী এবং কাফির সকলের জন্য। যেমন, জীবন। এটি এমন একটি নিআমত যার উপর অন্যান্য সকল নিআমত নির্ভরশীল। কারণ যখন জীবনের সমাপ্তি ঘটে, তখন পার্থিব নিআমতেরও অবসান ঘটে। যদিও এর মধ্যে কাফিররা অন্তর্ভুক্ত আছে; তবে পার্থিব জগতের এ নিআমত তাদের জন্য গৌরবের বা মঙ্গলের কিছুই নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَنَّمَا نُمْلِيْ لَهُمْ خَيْرٌ لِّأَنفُسِهِمْ ۚ إِنَّمَا نُمْلِيْ لَهُمْ لِيَزْدَادُوْا إِثْمًا
-তোমরা কাফিরদের ব্যাপারে এ কথা ধারণা কর না যে, তাদের কল্যাণ সাধনের জন্য আমি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি বরং আমি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি এজন্য যে তারা আরো বেশি গোনাহ করে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৭৮)
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, وَمَنْ كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُ قَلِيْلًا ثُمَّ أَضْطَرُّهُ إِلٰى عَذَابِ النَّارِ -যারা কাফির তাদেরও নিআমত প্রদান করব অল্প কয়েকদিনের জন্য, তারপর তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব। (সূরা বাকারা, আয়াত-১২৬)
আসল ব্যাপার হচ্ছে, এ পৃথিবীর যত ধরনের নিআমত আছে, সব ধরনের নিআমতে কাফিররাও শরীক। কিন্তু তা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। যেমন কোনো লোককে ভালো মিষ্টি খাওয়ানো হলো, কিন্তু তার পেটে অসুখ থাকলে মিষ্টি যতোই ভালো হোক না কেন, তাতে তার পেট পীড়া হবেই। যেমন ডিম, দুধ, মধু ও সূর্যের আলো অনেকের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যদিওবা এসব জিনিস খুবই ভালো ও পুষ্টিকর।
এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, نعم المال الصالح للرجل الصالح অর্থাৎ নেককার লোকের উত্তম সম্পদই হলো সর্বোত্তম সম্পদ। (আল আদাবুল মুফরাদ, বাবুল মালিস সালিহি লিল মারইস সালিহ)

দ্বিতীয় নিআমত হলো ঈমান। দৈহিক পূর্ণতা যেমন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, তেমনি আত্মিক পূর্ণতা লাভ করা যায় ঈমানের মাধ্যমে। দৈহিক পূর্ণতা যেমন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, তেমনি ঈমানও আল্লাহ প্রদত্ত তাওফীক এর মাধ্যমে হয়। তখন আয়াতের ভাবার্থ হবে, যেন বান্দাহ বলছে-
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ يَعْنِيْ يَهُوْد وَلَا الضَّالِّيْنَ يَعْنِيْ النَّصَارِىْ-
-আমাদেরকে নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহীনের পথে পরিচালিত করুন, যাদের আপনি নিআমত দান করেছেন। আপনার অভিশপ্তদের পথ অর্থাৎ ইয়াহুদীদের পথে আমাদের পরিচালিত করবেন না, আর তাদের পথেও না, যারা গোমরাহীতে আছে অর্থাৎ নাসারা। অন্যত্র ইয়াহুদী সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, وَبَاؤُا بِغَضَبٍ مِّنَ اللهِ -তারা আল্লাহ তাআলার ক্রোধে পতিত হয়েছে। আর নাসারা সম্পর্কে বলেন, وَضَلُّوْا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيْلِ -তারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে মুমিন তো হিদায়াত প্রাপ্তই হয়। সুতরাং পুনরায় হিদায়াত চাইলে তো একটা জিনিস আছে, তা পুনরায় চাওয়ার মতো হয়।
এর জবাবে বলা যায়, صراط المستقيم এর মর্মার্থ হচ্ছে صراط الاولين বা পূর্ববর্তীগণের রাস্তা, যা افراط ও تفريط থেকে মুক্ত। আনুগত্যের দিক থেকে ইহা পূর্ববর্তী নবীগণের মতো। যেমন, আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীম (আ.) নিজের ছেলেকে কুরবানী দিয়েছিলেন। হযরত ইসমাইল (আ.) এতে রাজী হয়ে আনন্দে গর্দান পেশ করে দিয়েছিলেন। হযরত ইউনুস (আ.) নিজেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার জন্য রাজী হয়েছিলেন। পক্ষান্তরে কেউ কেউ صراط শব্দ দ্বারা কুরআন এবং ‘ইসলাম’ অর্থ নিয়ে থাকেন। কিন্তুصراط المتقدمين বলার পর কুরআন অর্থ নেওয়া কিভাবে ঠিক হতে পারে? কারণ সে সময় তো কুরআন ছিল না। কাজেই অবশ্যই এর অর্থ নেওয়া হবে শরীআতের নিয়মনীতি এবং আইনসমূহ। যেমন আল্লাহ বলেন, فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ -অতএব আপনিও তাদের পথ অনুসরণ করুন। যেমন, হযরত আলী (রা.) বলেন, اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ এর মর্মকথা হচ্ছে, ثبتنا علي الهداية ربنا لا تزغ قلوبنا بعد اذ هديتنا “আল্লাহ! আমাদেরকে হিদায়াতের উপর দৃঢ় রাখুন। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের অন্তরকে হিদায়াত দান করার পর তা থেকে সরিয়ে দেবেন না।” কারণ অনেক আলিমের পা-ও পিছলে যায়, অনেক হিদায়াতপ্রাপ্ত লোকও গোমরাহ হয়ে যায়। (তাফসীরে বাগাভী, সূরা ফাতিহা)
আয়াতে صراط শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, سبيل এবং طريق শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। কারণ صراط শব্দ উল্লেখ করে জাহান্নামের রাস্তাসমূহকে বন্ধ করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জাহান্নামের রাস্তা অতিক্রম করে জান্নাতে প্রবেশের পথ সহজ করে দেন। اهدنا শব্দের সর্বনাম (ضمير) বহুবচন এজন্য নেওয়া হয়েছে, যেন দুআ করার সময় সমস্ত মুসলমানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ মুসলমানদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যাদের দুআ কবূল করা হয়। আর আল্লাহ তাআলা কিছু লোকের দুআ কবূল করবেন আর কিছু লোকের দুআ ফিরিয়ে দেবেন তা তাঁর শানের খেলাফ। তিনি একজনের ওসীলায় সকলের দুআ কবূল করে নিতে পারেন।
এর উপর ভিত্তি করেই দুআর আগে পিছে দরূদ পাঠ করার জন্য বলা হয়। কারণ দরূদ কবূল হওয়া সম্পর্কে কারো মতানৈক্য নেই। যদি দুআর শুরুতে দরূদ পাঠ করা হয় এবং দুআর শেষে দরূদ পাঠ করা হয়, তাহলে প্রবল আশা রাখা যায় যে, শেষ আর শুরুর অংশ আল্লাহ কবূল করে নিলে মধ্যের অংশও কবূল করে নিবেন। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এমন জিহ্বা দিয়ে দুআ করবে, যা দিয়ে গোনাহের কথা বের হয়নি। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ ধরনের লোক আমাদের মধ্যে কে আছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা একে অপরের জন্য দুআ কর। কারণ তুমি ওই লোকের মুখ দিয়ে গুনাহ করনি আর সে তোমার মুখ দিয়ে গোনাহ করেনি।
কাজেই اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ বলার দ্বারা প্রশংসা আদায় করা হয় সকল প্রশংসাকারীর পক্ষ থেকেই। আর اِيَّاكَ نَعْبُدُ এর মধ্যে ইবাদত সকলের পক্ষ থেকেই। اِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ দ্বারা সকলের পক্ষ থেকে সাহায্য তলব করা হয়, হিদায়াত সকলের জন্য তলব করা হয়। আর এভাবে নেককারদের পথে চলার দুআ করা হয়।

غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ (তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত এবং যারা পথভ্রষ্ট)
غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ দ্বারা সব ধরনের গোমরাহী ও ক্রোধ থেকে রক্ষা করা বুঝায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَأُولٰئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِّنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ ۚ وَحَسُنَ أُولٰئِكَ رَفِيْقًا
-আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রাসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাদের প্রতি আল্লাহ নিআমত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হলো উত্তম। (সূরা নিসা, আয়াত-৬৯)
যারা আল্লাহ আর রাসূলের অনুসরণ করবেন, তাঁরা ঐ সমস্ত লোকের সঙ্গী হবেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা নিআমত প্রদান করেছেন। এরা হলেন, নবী, সিদ্দীকীন, শহীদ ও সালেহীন। উল্লেখ্য যে, হিদায়াত যখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, তখন ايصال الى المطلوب হয়। অর্থাৎ হিদায়াতের কর্তা যদি আল্লাহ হন, তখন মাধ্যম ছাড়াই হিদায়াত বুঝায়, কোনো মাধ্যম ছাড়াই অভিষ্ট লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা পৌঁছিয়ে দেন, কারণ আল্লাহ তাআলা কারো মুখাপেক্ষী নন।
আর الصِرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَএর উদ্দেশ্য হলো, মধ্যম পন্থা, যা চরমপন্থা থেকে মুক্ত।

নিআমত দুভাগে বিভক্ত- এক প্রকার হলো এমন নিআমত যাতে মুমিন নর-নারীর সাথে কাফিররাও অন্তর্ভুক্ত। ইহাকে জাগতিক নিআমত বলা হয়। যেমন, জীবন। এটি এমন একটি নিআমত যার উপর অন্যান্য সকল নিআমত নির্ভরশীল। কারণ যখন জীবনের সমাপ্তি ঘটে, তখন পার্থিব নিআমতেরও অবসান ঘটে। এ নিআমতে কাফিররা শামিল থাকলেও; এতে তাদের জন্য গৌরবের বা কল্যাণের কিছুই নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَنَّمَا نُمْلِيْ لَهُمْ خَيْرٌ لِّأَنفُسِهِمْ ۚ إِنَّمَا نُمْلِيْ لَهُمْ لِيَزْدَادُوْا إِثْمًا
-কাফিররা যেন মনে না করে আমি যে অবকাশ দান করি, তা তাদের পক্ষে কল্যাণকর। আমি তো তাদেরকে অবকাশ দেই যাতে করে তারা পাপে উন্নতি লাভ করতে পারে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৭৮)
অন্যত্র বলা হয়েছে, قَالَ وَمَنْ كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُ قَلِيْلًا ثُمَّ أَضْطَرُّهُ إِلٰى عَذَابِ النَّارِ -যারা কাফির তাদের এ নিআমত শুধু কয়েকদিনের জন্য, তারপর আমি তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব। (সূরা বাকারা, আয়াত-১২৬) আসলে এ পৃথিবীর যত ধরনের নিআমত আছে, সব ধরনের নিআমতে কাফিররাও শরীক। কিন্তু তা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ। যেমন কোনো লোককে ভালো মিষ্টি খাওয়ানো হলো, কিন্তু তার পেটে অসুখ থাকলে তা যতোই ভালো হোক না কেন, তাতে তার পেট পীড়া হবেই। ডিম, দুধ, মধু ও সূর্যের আলো অনেকের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় যদিওবা এসব জিনিস খুবই ভালো ও পুষ্টিকর।
কাজেই কাফিরদের নিআমত তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। সম্পদ আল্লাহর নিআমত। কিন্তু কাফিররা সেটার যথাযথ ব্যবহার না জানার কারণে, তাদের ঈমানহীনতার কারণে তা তাদের ক্ষতির কারণ। এজন্য রাসূলুল্লাহ  বলেন, نعم المال الصالح للرجل الصالح অর্থাৎ নেককার লোকের ভালো সম্পদই হলো সর্বোত্তম সম্পদ। (আল আদাবুল মুফরাদ, বাবুল মালিস সালিহি লিল মারইস সালিহ)
আল্লাহর দ্বিতীয় নিআমত হলো দ্বীনী, আর তা হলো ঈমান। দৈহিক পূর্ণতা যেমন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, তেমনি আত্মিক পূর্ণতা আসে ঈমানের মাধ্যমে। দৈহিক পূর্ণতা যেমন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, তেমনি ঈমানও আল্লাহ প্রদত্ত তাওফীক এর মাধ্যমে হয়। তখন আয়াতের ভাবার্থ হবে,
اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ يَعْنِيْ يَهُوْد وَلَا الضَّالِّيْنَ يَعْنِيْ النَّصَارِىْ-
-আমাদেরকে নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালিহীনদের পথে পরিচালিত করে তাদেরকে যে পুরস্কারে পুরস্কৃত করেছেন, সেই ধরনের পুরস্কারে আমাদেরকেও পুরস্কৃত করুন। আপনার অভিশপ্ত ইয়াহুদীদের পথে বা পথভ্রষ্ট নাসারাদের পথে পরিচালিত করবেন না। ইয়াহুদী সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনের অন্যত্র বলেন, وَبَاؤُا بِغَضَبٍ مِّنَ اللهِ -তারা আল্লাহ তাআলার ক্রোধে পতিত হয়েছে। আর নাসারা সম্পর্কে বলেন, وَضَلُّوْا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيْلِ -তারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।

সূরা ফাতিহার মাহাত্ম্য
সূরা ফাতিহা যখন নামাযে পাঠ করা হয় তখন তার বিকশিত আলো যমীন হতে আকাশ তথা লাওহে মাহফূয এর দিকে উঠে যায়। যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যামানায় তা আসমান হতে যমীনে অবতরণ করত। এজন্য বর্ণিত আছে যে, الصَّلٰوةُ مِعْرَاجُ الْمُؤْمِنِيْنَ -নামায হচ্ছে মুমিনদের মিরাজ।
তিনটি দিক থেকে শয়তান মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে। ওই তিনটি হলো, ১. কাম ২. ক্রোধ ৩. লোভ। কাম হচ্ছে পশুত্ব, ক্রোধ হচ্ছে আরো মারাত্মক আর লোভ হচ্ছে শয়তানী। এজন্য বলা হয়, কাম হলো বিপদ, কিন্তু ক্রোধ তার চেয়েও ভয়ংকর, আর গজব বা ক্রোধের চেয়ে বড় হলো হাওয়া অর্থাৎ লোভ। আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰى عَنِ الْفَحْشَاءِ والمنكر -নামায ফাহিশা ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে দূরে রাখে। (সূরা আনকাবুত, আয়াত-৪৫) এখানে ফাহিশা দ্বারা উদ্দেশ্য করা হয়েছে কুপ্রবৃত্তি, আর منكر দ্বারা ক্রোধ।
এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যুলম তিন প্রকারের। এক প্রকারের যুলম যা ক্ষমা করা হয় না। আর এক প্রকার যুলম যা ছাড় দেওয়া হয় না। আর আরেক প্রকার যুলম সম্পর্কে আশা করা যায়, আল্লাহ তা মাফ করে দেবেন। যে যুলম ক্ষমা করা হয় না তা হলো শিরক। আল্লাহ তাআলার সাথে শরীক করা। আর যে যুলম ছাড় দেওয়া হয় না তা হলো আল্লাহর বান্দাহর উপর অপর বান্দাহর যুলম। আরেক ধরনের যুলম, যা আশা করা যায়, আল্লাহ মাফ করতে পারেন, তা হলো মানুষ নিজে নিজের উপর যে যুলম করে। (মুসনাদ; আবি দাউদ আত তায়ালিসী, হাদীস নং ২২২৩) শাহওত বা কামের ফল হলো, লোভ করা ও কার্পণ্য করা। ক্রোধের ফল হলো, নিজের কাজকে ভালো মনে করা আর অহংকার করা। কুপ্রবৃত্তির ফল হলো, কুফর ও বিদআত করা। আদম সন্তানের মাঝে এ ছয়টি স্বভাবের ফলে আরও একটি স্বভাব সৃষ্টি হয়, তা হলো حسد বা হিংসা। হিংসা হচ্ছে সব থেকে নিকৃষ্ট স্বভাব। যেমনিভাবে শয়তান হচ্ছে প্রাণিজগতের মধ্যে নিকৃষ্টতম। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেন, الَّذِيْ يُوَسْوِسُ فِي صُدُوْرِ النَّاسِ- مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ -‘যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।’ আল্লাহ তাআলা বলেন, وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ -‘এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।’ বর্ণিত আছে, ইবলিস ফিরআউনের দরজায় এসে আওয়াজ দিল। ফিরআউন বলল কে? ইবলিস বলল, তুমি যদি মাবুদ হতে, তাহলে চিনতে পারতে। শয়তান ঘরে প্রবেশ করলে ফিরআউন বলল, তুমি এ দুনিয়াতে আমার ও তোমার চেয়ে বেশি খারাপ কিছু আছে বলে জান? শয়তান উত্তর দিল হ্যাঁ জানি, হিংসুক। এ দুনিয়াতে মন্দ যা কিছু ঘটেছে হিংসার দ্বারাই হয়েছে।” (আত তাফসীরুল কাবীর, সূরা ফাতিহা) বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম এর মধ্যে আল্লাহর তিনটি নাম রয়েছে। তা দ্বারা মানব চরিত্রের এ দোষ দূর হয়ে যায়।
সূরা ফাতিহায় সাতটি আয়াত রয়েছে। এ সাতটি আয়াত দ্বারা মানুষের যে সাত ধরনের খারাপ স্বভাব রয়েছে, তা দূর হয়ে যায়।
أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَـٰهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللهُ عَلَىٰ عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِن بَعْدِ اللهِ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
-আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার খেয়াল-খুশিকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ জেনে শুনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মোহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে পথপ্রদর্শন করবে? তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না? (সূরা জাসিয়াহ, আয়াত-২৩)
কাজেই যে আল্লাহকে চিনতে পারে তার থেকে কামনার দ্বারা সৃষ্ট শয়তানী ভাব দূর হয়ে যায়। যে ব্যক্তি জানবে যে আল্লাহ হচ্ছেন রাহমান, তার মাঝে ক্রোধ থাকবে না। কারণ ক্রোধের জন্য অভিভাবক হওয়া শর্ত। আর অভিভাবকত্ব কেবল আল্লাহর, যেমন তিনি বলেন, الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ الْحَقُّ لِلرَّحْمٰنِ ‘সে দিনের প্রকৃত রাজত্ব হবে দয়াময় আল্লাহর।’ (সূরা আল ফুরকান, আয়াত-২৬) আর যে রাহীমকে চিনতে পেরেছে, সে নিজের উপর যুলম করবে না এবং নিজের কাজ নিয়ে গৌরব বোধ করবে না।
মোটকথা, বান্দাহ আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করার পর যা পায়, তাতে সন্তুষ্ট হয়ে যায়। এতে তার কুপ্রবৃত্তির চাহিদা দূর হয়ে যায়। আর যে জানতে পারল তিনিই رَبِّ الْعَالَمِيْنَ সে যা পেল তাতে কৃপণতা করবে না, আর যা পেল না তার প্রতি লোভ করবে না। আর যে জানল তিনিই مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ এবং তিনিই اَلرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ সে ক্রোধ দেখাবে না। আর যখন বলবে, اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ তখন তার গৌরব ও অহংকার চলে যাবে, নিজের কাজকে নিজে পছন্দ করা এবং নিজের প্রশংসা নিজে করার অভ্যাস চলে যাবে। আর যখন বলবে, اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ তখন হাওয়া নামক শয়তান দূর হয়ে যায়। আর যখন বলা হবে صِرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ সে সময় কুফর দূর হয়ে যাবে। আর যখন বলা হয় غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّيْنَ তখন তার থেকে যে বিদআত আবিষ্কার হয় তা দূর হয়ে যায়। আর যখন এ ছয় ধরনের খারাপ স্বভাব দূর হয়ে যায়, তখন এমনিতেই হিংসাও দূর হয়ে যায়।
সূরা ফাতিহা যেমনটি উল্লিখিত সাতটি মন্দ স্বভাবের প্রতিষেধক তেমনটি এ কথা মেনে নিতে হয় যে, কুরআন মানুষের জন্য সকল রোগের চিকিৎসা। এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় পরিলক্ষিত হয়, যা رب-ملك ও الٰه এ তিন শব্দের সাথে সম্পৃক্ত। رب، ملك، الٰه এ তিনটি শব্দের উপরই কুরআন শেষ হয়েছে (কেননা কুরআনুল কারীমের শেষ সূরা নাস এর মধ্যে এ তিনটি শব্দ রয়েছে)। যেন বলা হয়েছে, যদি শাহাওয়াতের মাধ্যমে শয়তানের ওয়াসওয়াসা আসে তাহলে বল قُلْ اَعُوْذُ بِرَبِّ النَّاسِ যদি রাগের মাধ্যমে আসে তাহলে বল مَالِكِ النَّاسِ যদি কুপ্রবৃত্তির মধ্য দিয়ে আসে তাহলে বল اِلٰهِ النَّاسِ। (প্রাগুক্ত) যত জিনিসের প্রতি মানুষ মুখাপেক্ষী সূরা ফাতিহা তার সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। الحمد لله এ কথার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে যে, তিনিই হচ্ছেন সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা যার জন্য তিনিই সমস্ত প্রশংসা, সানা ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। رب العالمين দ্বারা ইশারা করে মাবুদের একত্বের উপর। অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের মালিক ও রাজত্ব একমাত্র আল্লাহ তাআলার। বিশ্ব জগতে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ থেকে এ সত্য প্রতিভাত হয় যে, মৃত্যুর আগে-পরে এবং মৃত্যুকালে শুধু তারই ইহসান বিদ্যমান।
رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ইশারা করে এ সত্যের প্রতি যে, এ দিনের অবসান হওয়ার পর আর একটি দিন আছে, যেদিন নেককার বদকার থেকে, জালিম মজলুম থেকে পৃথক হয়ে যাবে। সেই দিনই সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর রুবুবিয়াত উপলব্ধি করা যাবে।
আর اِيَّاكَ نَعْبُدُ আয়াত থেকে আল্লাহ তাআলার ইবাদত এবং আল্লাহ তাআলার সাহায্য ছাড়া বান্দাহর যে কিছুই করার শক্তি নেই, তা উপলব্ধি করা যায়। এ কারণেই اِيَّاكَ نَسْتَعِيْنَ বলতে হয়। তাছাড়া সকল কাজেরই একটি প্রভাব থাকে, তদানুযায়ী মানুষের উপর اِيَّاكَ نَعْبُدُ এর প্রভাব পড়ে বলেই মানুষ হিদায়াত প্রাপ্ত হয়। এজন্য বলা হয়েছে اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ
صِرَاطَ الَّذِيْنَ اَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ আয়াত এ কথার প্রমাণ করে যে, যিনি পূর্ণ মালিক, তার নূরে আলোকিত হতে হলে তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। আর যারা (হিদায়াতপ্রাপ্ত) তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের সাথে উপবিষ্ট কেউ হতভাগ্য হয় না। আর غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ ইশারা করে যে, বিদআতী লোক এবং যারা কুপ্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে চলে, তাদের থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। যেমন কবির কবিতা-
عن المرء لا تسئل وسل عن قرينه + فكل قرين بالمقارن يقتدي
“ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর না বরং তার বন্ধু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর। কেননা প্রত্যেক বন্ধু তার বন্ধুর অনুসরণ করে।” (আদ দিওয়ান, উমর আল ইয়াফী)
সূরা ফাতিহার মধ্যে সাতটি আয়াত। আর নামাযে এমন সাতটি কাজ রয়েছে যা অনুভব করা যায়। যেমন- ১. কিয়াম অর্থাৎ দাঁড়ানো ২. রুকু ৩. রুকুর পর সোজা হয়ে দাঁড়ানো ৪.প্রথম সিজদা ৫. প্রথম সিজদার পর বসা ৬. দ্বিতীয় সিজদা ৭. শেষ বৈঠক। এসকল কাজকে ধরে নেওয়া যায় একজন ব্যক্তির মতো, যার রূহ হলো সূরা ফাতিহা।
তাছাড়া সূরা ফাতিহার اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ এর মধ্যে শুধু শাব্দিক সম্বোধন নয়; বরং রূহানী দিক থেকে আল্লাহ তাআলার সামনাসামনি হওয়া যায়। হাদীস শরীফে আছে, যদি কোনো মুসল্লীর থুথু ফেলার প্রয়োজন হয় সে যেন সামনে অথবা ডান দিকে না ফেলে। কারণ নামাযের মধ্যে বান্দাহ আল্লাহ তাআলার কাছে তার মনের গোপন কথা ব্যক্ত করে। (সহীহ বুখারী, কিতাবুস সালাত, আবওয়াবু ইসতিকবালিল কিবলাহ, বাবু দাফনিন নুখামাতি ফিল মাসজিদ)

[ আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কৃত ‘আত্ তানভীর’ কিতাব থেকে মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী কর্তৃক অনূদিত ]

ফেইসবুকে আমরা...