রাসূলুল্লাহ (সা.) কি নূরের সৃষ্টি? নূরের হলে সে নূর সত্তাগত নাকি হিদায়াতের? বিষয়টি কি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদার অন্তর্ভুক্ত? জানতে চাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
জবাব: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মহান আল্লাহ তাআলা ‘নূর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
قد جاءكم من الله نور وكتاب مبين
-নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নূর বা স্পষ্ট কিতাব এসেছে। (সূরা মায়িদা, আয়াত-১৫)
অধিকাংশ মুফাসসিরীনে কিরামের মতে এ আয়াতে বর্ণিত নূর হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যেমন- তাফসীরে তাবারীতে এসেছে,
“من الله نور”، يعني بالنور، محمدا صلى الله عليه وسلم الذي أنار الله به الحق
من الله نور এ আয়াতে নূর দ্বারা উদ্দেশ্য হলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা সত্যকে আলোকিত করেছেন। (তাফসীরে তাবারী, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৩)
হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নূরকে আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি বলে ঘোষণা করেছেন। আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ কিতাবে ইমাম কস্তল্লানী এ সম্পর্কে হাদীস উল্লেখ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নূর যে আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি তা প্রমাণ করেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন,
وروى عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله الأنصارى قال: قلت يا رسول الله، بأبى أنت وأمى، أخبرنى عن أول شىء خلقه الله تعالى قبل الأشياء. قال: يا جابر، إن الله تعالى قد خلق قبل الأشياء نور نبيك من نوره، فجعل ذلك النور يدور بالقدرة حيث شاء الله تعالى، ولم يكن فى ذلك الوقت لوح ولا قلم، ولا جنة ولا نار، ولا ملك ولا سماء، ولا أرض ولا شمس ولا قمر، ولا جنى ولا أنسى، فلما أراد الله تعالى أن يخلق الخلق قسم ذلك النور أربعة أجزاء، فخلق من الجزء الأول القلم، ومن الثانى اللوح، ومن الثالث العرش. ثم قسم الجزء الرابع أربعة أجزاء، فخلق من الجزء الأول حملة العرش، ومن الثانى الكرسى، ومن الثالث باقى الملائكة، ثم قسم الجزء الرابع أربعة أجزاء، فخلق من الأول السماوات، ومن الثانى الأرضين ومن الثالث الجنة والنار – (الخ)
-আব্দুর রাজ্জাক তাঁর সনদসহ হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আমাকে এই খবর দিন যে, আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম কোন বস্তু সৃষ্টি করেছেন? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, হে জাবির! আল্লাহ পাক সব কিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূরকে তাঁর নূর থেকে (অর্থাৎ নিজের নূরের ফয়েয দ্বারা) সৃষ্টি করেছেন। সেই নূর আল্লাহ পাকের কুদরতে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ভ্রমণরত ছিল; আর সে সময় লওহ, কলম, বেহেশত, দুযখ কিছুই ছিল না, ফেরেশতাও ছিল না, এমনকি আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্য, জিন ও মানব এক কথায় কিছুই ছিল না। অতঃপর যখন আল্লাহ পাক বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলেন, তখন সেই নূরকে চারভাগে বিভক্ত করেন। একভাগ দ্বারা কলম সৃষ্টি করলেন, দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা লাওহ, আর তৃতীয় ভাগ দ্বারা আরশ সৃষ্টি করেন। (এরপর সুদীর্ঘ হাদীস রয়েছে)। (আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, আল জুযউল মাফকূদ মিনাল মুছান্নাফ)
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র.) লিখেছেন, এই হাদীস দ্বারা এই কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, নূরে মুহাম্মদী হলো আল্লাহ পাকের সর্বপ্রথম সৃষ্টি। কেননা যেসব জিনিসের ব্যাপারে প্রথমে সৃষ্টি হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়, সেই সবগুলোর সৃষ্টি যে নূরে মুহাম্মদীর পর, তা এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং প্রতিভাত হয়। (নাশরুত তীব)
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিদায়াতের নূর হওয়া মেনে নেওয়াতে কোনো বৈপরিত্যের কারণ নেই। কেননা ঐ নূরকে মাজাযী বা রূপকার্থে হিদায়াতের আলো হিসেবে কেউ কেউ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেখানে হাকীকী অর্থে নূর হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান সেখানে হাকীকত পরিহার করে কেবল মাজাযী তথা রূপক অর্থে বিশ্লেষণ অসমীচীন। অবশ্য এরূপ বিশ্বাস আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আবশ্যকীয় কোনো আকীদার অন্তর্ভুক্ত নয়। যে কারণে আকীদার কিতাবসমূহে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়নি। সর্বোপরি বিষয়টি জটিল এবং সর্বসাধারণের বোধগম্য নয়। এর জটিলতা নিরসনে বিশুদ্ধ আকীদাপন্থী গভীর জ্ঞানের অধিকারী হক্কানী আলিমগণের শরণাপন্ন হওয়ার বিকল্প নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ প্রদত্ত সকল গুণাবলি ও মর্যাদাসহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী ও রাসূল মেনে নেয়াই বিশুদ্ধ আকীদা পোষণের সহজ পথ।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর যাত বা সত্তার অংশ নন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহর অংশ মনে করা শিরক।
জবাবদাতা: প্রিন্সিপাল ও খতীব, আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টার
মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র