সালাতুত তারাবীহ অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ একটি নামায। রামাদান মাসে ইশার নামাযের পর জামাআতে এ নামায আদায় করা হয়। এটি সুন্নতে মুআক্্কাদাহ। তারাবীহ (تراويح) শব্দটি তারবীহাতুন (ترويحة) শব্দের বহুবচন। ترويحة শব্দের অর্থ হলো একবার বিশ্রাম নেয়া। তারাবীহ একটি বিশেষ নামায, যা মাহে রামাদ্বানের মুবারক রজনীতে জামা‘আতের সাথে আদায় করা হয়। সাহাবায়ে কিরাম (রা.) যখন সম্মিলিতভাবে এ নামায পড়তে শুরু করেন তখন থেকেই তাঁরা প্রতি দুই সালাম অর্থাৎ চার রাকাআতের পর একবার বিশ্রাম নিতেন। এ জন্য এ নামাযকে সালাতুত তারাবীহ বলা হয়।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা সিয়াম তথা রোযা ও তারাবীহকে গুনাহ মাফের মাধ্যম বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন, হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ لِرَمَضَانَ مَنْ قَامَهُ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
-আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাহে রামাদ্বান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সওয়াবের প্রত্যাশায় এ মাসে রাত্রিজাগরণ করে তার পূর্বেকার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। (বুখারী, بَابُ فَضْلِ مَنْ قَامَ رَمَضَانَ হাদীস নং-২০০৮)
তারাবীহ নামাযের সূচনা
তারাবীহ নামায রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যামানাতেই শুরু হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে জামাআতে এ নামায আদায় করেছেন। মুসলিম শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামে রামাদ্বান তথা তারাবীহ নামাযের প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন, তবে তিনি তা অপরিহার্য করেননি (মুসলিম, বাব- باب الترغيب فى قيام رمضان وهو التراويح হাদীস নং-১৮১৬)
অনুরূপভাবে উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তা নিয়মিত জামাআতে আদায় করেননি। বুখারী শরীফে আছে, হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদ্বান মাসের এক রাতে মসজিদে গমন করে নামায (তারাবীহ’র নামায) পড়লেন এবং অনেক সাহাবীও তাঁর সাথে নামাযে শামিল হলেন। সকালে সাহাবায়ে কিরাম এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। ফলে পরবর্তী রাতে আরো অধিক সংখ্যক সাহাবী জমায়েত হলেন। তখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায আদায় করলেন, উপস্থিত সাহাবীগণও তাঁর সাথে নামায পড়লেন। এ দিনও সকালে হলে তারা এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। ফলে তৃতীয় রাতে মুসল্লির সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেল। ঐ রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায আদায় করলেন, তার সাথে সাহাবায়ে কিরামও নামায পড়লেন। চতুর্থ রাতে মুসল্লির সংখ্যা মসজিদের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে গেল। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাযের আগে মসজিদে আসলেন না। ফজরের নামায শেষে তিনি মুসল্লিদের দিকে ফিরলেন, আল্লাহর ওয়াহদানিয়াত ও আপন রিসালতের সাক্ষ্য দিলেন, অতঃপর বললেন, (হে আমার সাহাবীগণ!) তোমাদের অবস্থা আমার নিকট গোপন ছিল না । তবে এ নামায তোমাদের উপর ফরয হয়ে যাবে অতঃপর তোমরা তা আদায় করতে পারবে না এ আশঙ্কায় আমি তোমাদের কাছে আসিনি। (বুখারী, বাব- باب فضل من قام رمضان হাদীস নং ২০১২)
উক্ত হাদীস থেকে জানা গেল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারাবীহর নামাযকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চতুর্থ রাতে তিনি মসজিদে আসেননি। ফলে তৃতীয় রাতের পর উক্ত নামায জামাআত সহকারে আদায় হয়নি। উক্ত হাদীসের শেষে এ বর্ণনাও আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকাল পর্যন্ত তারাবীহর নামাযের বিষয়টি এমনই ছিল। হাদীসের ভাষ্য হলো- فَتُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْأَمْرُ عَلَى ذَلِكَ এর সারকথা হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় বর্তমানের মত নিয়মিত জামাআতে বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায়ের প্রচলন হয়নি। বরং তখন প্রত্যেকে একাকী এ নামায আদায় করতেন।
অন্য হাদীসে আছে, হযরত আবূ বকর (রা.)-এর পূর্ণ খিলাফতকাল ও ওমর (রা.)-এর খিলাফতের প্রথম দিক পর্যন্ত বিষয়টি এমনই ছিল। অর্থাৎ প্রত্যেকে একাকী তারাবীহ আদায় করতেন। অথবা ছোট ছোট জামাআতে আদায় করতেন। অতঃপর হযরত ওমর ফারুক (রা.) তাঁর খিলাফতকালে একদা মসজিদে গিয়ে দেখতে পান যে, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামাআত হচ্ছে। তখন তিনি মনে করেন সকল মুসল্লিকে এক ইমামের পিছনে একত্রিত করা উচিত। এ বিবেচনা থেকেই তিনি এক ইমামের অধীনে বিশ রাকাআত তারাবীহ জামাআতে আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এ সম্পর্কে বুখারী শরীফে আছে, ইবনে শিহাব যুহরী উরওয়া ইবনুয যুবায়র থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কারী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা রামাদ্বানের রাতে আমি ওমর (রা.)-এর সাথে মসজিদে গেলাম। তখন মানুষেরা পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত ছিল। কোনো ব্যক্তি নিজে নামায আদায় করছিলেন এবং তার সাথে একটি দল নামায পড়ছিল। তখন ওমর (রা.) বললেন, আমি মনে করি এ সকল লোককে একজন ইমামের অধীনে একত্রিত করতে পারলে ভালো হবে। অতঃপর তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তাদেরকে উবাই ইবনে কা’ব (রা.) এর অধীনে (ইমামতিতে) একত্রিত করে দিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, অন্য একদিন আমি আবার ওমর (রা.)-এর সাথে বের হলাম। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সাথে নামায আদায় করছিলেন। তা দেখে উমর (রা.) বললেন, نِعْمَ الْبِدْعَةُ هَذِهِ অর্থাৎ এটা কতই না সুন্দর আবিস্কার। (বুখারী, বাব- باب فضل من قام رمضان হাদীস নং ২০১০)
এখানে হযরত ওমর (রা.) ‘বিদআত’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা মোল্লা আলী কারী (র.) বলেন, হযরত উমর (রা.) তারাবীহকে যে বিদ’আত বলে আখ্যায়িত করেছেন তা ছিল নিছক আকৃতিগত উদ্ভাবন। কারণ তারাবীহতে এভাবে একত্রিত হওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পরে হলেও এর বাস্তবতা ও মূল বিষয়ের প্রমাণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগেও ছিল। সে হিসাবে একে বিদ’আত বা নতুন উদ্ভাবন বলা যায় না। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই সাহাবায়ে কিরামকে তারাবীহ ঘরে পড়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তাঁদের উপর তা ফরয হয়ে না যায়।
তারাবীহর নামায বিশ রাকাআত
তারাবীহর নামায বিশ রাকাআত ও তা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর যুগ থেকে তারাবীহ’র নামায বিশ রাকাআত হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। তাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের যুগ এবং পরবর্তী কোনো যুগে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। চার মাযহাবের প্রত্যেক ইমাম তারাবীহর নামায বিশ রাকাআত বলেছেন। বিশ রাকাআতের কম কেউ বলেননি। এমনকি ইমাম মালিক (র.) থেকে এক বর্ণনায় তিন রাকাআত বিতরসহ তারাবীহর নামায ৩৯ রাকাআত এবং অন্য বর্ণনায় একচল্লিশ রাকাআত বলে উল্লেখ রয়েছে। ইমাম মালিক (র.)-এর অন্য বর্ণনা জমহুরের অনুরূপ, অর্থাৎ তারাবীহর নামায বিশ রাকাআত।
আল্লামা ইবনে কুদামা (র.) বলেন,
والمختار عند أبي عبد الله رحمه الله فيها عشرون ركعة وبهذا قال الثوري و أبو حنيفة و الشافعي وقال مالك : ستة وثلاثون
ইমাম আবূ আবদিল্লাহ অর্থাৎ ইমাম আহমদ (র.)-এর নিকট গ্রহণযোগ্য অভিমত হলো তারাবীহ’র নামায বিশ রাকাআত। সুফিয়ান সাওরী, ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফিঈও অনুরূপ বলেছেন। আর ইমাম মালিক (র.) বলেছেন, তারাবীহর নামায ৩৬ রাকাআত। (আল মুগনী, খ- ১, পৃষ্ঠা ৮৩৩)
ইমাম নববী (র.) বলেন,
إعلم أن صلاة التراويح سنة باتفاق العلماء ، وهي عشرون ركعة ، يسلم من كل ركعتين ، وصفة نفس الصلاة كصفة باقي الصلوات على ما تقدم بيانه
-জেনে রাখো, উলামায়ে কিরামের ঐকমত্যে তারাবীহর নামায সুন্নত। আর এটি বিশ রাকাআত। প্রত্যেক দুই রাকাআতে সালাম ফিরাবে। আর এ নামাযের পদ্ধতি অন্যান্য নামাযের মতোই, যার বর্ণনা পূর্বে রয়েছে।
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম মালিক (র.) থেকে বিশ রাকাতের অধিক যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে অতিরিক্ত রাকাআতসমূহ মূলত তারাবীহ নয়। যেমন ইবনে কুদামা বলেন, কোনো কোনো আলিম বলেছেন, মক্কার অধিবাসীগণ চার রাকাআত তারাবীহ পড়ে সাতবার তাওয়াফ করতেন। এর পরিবর্তে মদীনাবাসীগণ চার রাকাআত করে অতিরিক্ত নামায পড়তেন, যাতে তারা মক্কাবাসীদের মতো অধিক সওয়াব হাসিল করতে পারেন। (আল মুগনী, খ- ১, পৃষ্ঠা ৮৩৩) ফলে বিতরসহ তাদের নামায ৩৯ রাকাআত হয়ে যেত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করেছেন
বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাত জামাআতে তারাবীহ আদায় করেছেন। তবে এসব হাদীসে রাকাআত সংখ্যা উল্লেখ নেই। হযরত ইবনে হাজার আসকালানী (র.) ‘আত তালখীস’ এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর এক বর্ণনায় আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাকী বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করতেন। (আল তালখীস আল হাবীর, ২য় খ-, বাব-باب صلاة التطوع)
উক্ত হাদীসের সনদের মধ্যে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। সূতরাং নিশ্চিতভাবে এটি বলা যাবে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করেছেন। তবে বিশ রাকাআত তারাবীহ’র উপর সাহাবায়ে কিরাম আমল করেছেন এবং মুসলিম উম্মাহও এটি গ্রহণ করেছেন।
তারাবীহ নামাযের রাকাআত নিয়ে বিভ্রান্তি
হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর যুগ থেকে মুক্কা মুর্ক্রাামা ও মদীনা মুনাওয়ারাসহ দুনিয়ার মুসলমানগণ শত শত বছর ধরে তারাবীহর নামায বিশ রাকাআতই আদায় করে আসছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে আহলে হাদীস ও সালাফী নামধারী গায়র মুকাল্লিদগণ (লা-মাযহাবীরা) তারাবীহ নামাযের রাকাআত নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। হিজরী তের শতকের শেষদিকে (১২৮৫ হিজরীতে) ভারত উপমহাদেশে মাযহাব অস্বীকারকারী গায়র মুকাল্লিদ আলিম মুফতী মুহাম্মদ হুসাইন বিটালভী এ বিভ্রান্তি শুরু করেন। তিনি ফতওয়া প্রদান করেন যে, আট রাকাআত তারাবীহ পড়া সুন্নাত, বিশ রাকাআত পড়া বিদআত। আরববিশ্বে এ ফিতনা শুরু হয় আরো অনেক পরে। আরববিশ্বে সর্বপ্রথম এ ফিতনাকে দলীল দ্বারা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেন শায়খ নাসীব রেফাঈ। সমকালীন আলিমগণ তার মতামতকে খ-ন করেন। এর পরবর্তীতে ১৩৭৭ হিজরী সনে শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামক একটি বইয়ের মাধ্যমে এ বিষয় প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও তিনি তার মতের স্বপক্ষে কোনো সাহাবী, তাবিঈ বা কোনো ফকীহ ইমাম অথবা কোন মুহাদ্দিস ইমামের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেননি, যিনি বিশ রাকাআত তারাবীহর ব্যাপারে আপত্তি করেছেন। তবে তিনি এ বিষয়ে মনগড়াভাবে বলে দিয়েছেন যে, ইমাম মালিক (র.) নাকি বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়তে নিষেধ করেছেন।
বিভ্রান্তির জবাব
তারাবীহ নামাযের রাকাআত নিয়ে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনের বর্ণনা
পূর্বে উল্লেখিত সহীহ বুখারীর বর্ণনা থেকে প্রমাণিত যে, হযরত ওমর (রা.) নিয়মিতভাবে জামাআতে তারাবীহর নামায আদায়ের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এ হাদীসে রাকাআত সংখ্যার উল্লেখ নেই। তবে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনে ইযামের বিভিন্ন বর্ণনায় বিশ রাকাতের কথা সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। যারা তারাবীহ নামাযের রাকাআত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায় তাদের জবাব হিসেবে এসকল বর্ণনাই যথেষ্ট। নি¤েœ এ সংক্রান্ত কিছু বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, كان النبي صلى الله عليه و سلم يصلي في شهر رمضان في غير جماعة بعشرين ركعة والوتر -নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদ্বান মাসে একাকী বিশ রাকাআত তারাবীহ ও বিতর আদায় করতেন। (মুসান্নাফু ইবনে আবি শায়বাহ, খ- ২, পৃষ্ঠা ৩৯৪)
হযরত সাইব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) বলেন- كنا نقوم في زمان عُمَر بن الخطاب رضي الله عنه بعشرين ركعة والوتر
-আমরা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সময়ে বিশ রাকাআত তারাবীহ ও বিতর নামায (জামাআতে) আদায় করতাম। (আস সুনানুস সুগরা লিল বায়হাকী; নাসবুর রায়াহ, খ- ২, পৃষ্ঠা ১৭৫)
বিশিষ্ট তাবিঈ হযরত ইয়াযীদ ইবনে রুমান (রা.) বলেন,
انَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِى زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ فِى رَمَضَانَ بِثَلاَثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَة
-ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে মানুষেরা রামাদ্বান মাসে ২৩ রাকাআত নামায পড়তেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, খ- ২, পৃষ্ঠা ৪৯৬)
হযরত ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা (র.) বলেন, সাইব ইবনে ইয়াযীদ (রা.) বলেছেন,
كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ فِى شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً . قَالَ: وَكَانُوا يَقْرَءُونَ بِالْمِئِينِ ، وَكَانُوا يَتَوَكَّئُونَ عَلَى عُصِيِّهِمْ فِى عَهْدِ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ مِنْ شِدَّةِ الْقِيَامِ
-তাঁরা (সাহাবা ও তাবিঈন) ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যামানায় রামাদ্বান মাসে বিশ রাকাআত নামায (তারাবীহ) পড়তেন। তিনি আরো বলেন, তারা নামাযে শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সূরাসমূহ পড়তেন এবং ওসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর যুগে দীর্ঘ নামাযের কারণে তারা (কেউ কেউ) তাদের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। (আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, খ- ২, পৃষ্ঠা ৪৯৬)
বিখ্যাত তাবিঈ আবূ আবদুর রহমান আস সুলামী (রা.) বলেন,
أَنَّ عَلِيا رَضِىَ اللهُ عَنْهُ دَعَا الْقُرَّاءَ فِى رَمَضَانَ ، فَأَمَرَ مِنْهُمْ رَجُلاً يُصَلِّى بِالنَّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً. قَالَ : وَكَانَ عَلِىٌّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ يُوتِرُ بِهِمْ
হযরত আলী (রা.) (তাঁর খিলাফতকালে) রামাদ্বানে কারীগণকে ডাকেন এবং তাদের একজনকে আদেশ করেন তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত নামায পড়েন। আর আলী (রা.) তাদেরকে নিয়ে বিতর পড়তেন। (আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, খ- ২, পৃষ্ঠা ৪৯৬)
এ আলোচনা থেকে প্রমান হয় যে, তারাবীহর নামায বিশ রাকাআত। তিন খলীফা হযরত ওমর, ওসমান ও আলী (রা.)-এর যুগে বিশ রাকাআত তারাবীহই পড়া হয়েছে। সুতরাং বিশ রাকাআত তারাবীহ খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত। আর তাঁদের সুন্নাতকে আকঢ়ে ধরার জন্য স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন। যেমন, তিনি ইরশাদ করেন,
من يعش منكم بعدى فسيرى اختلافا كثيرا، فعليكم بسنتى وسنة الخلفاء المهديين الراشدين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ
-তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তোমরা অনেক ইখতেলাফ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাহ ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাহ আঁকড়ে ধরবে। তোমরা তা আঁকড়ে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখবে। (সুনানু আবি দাউদ, বাব باب فِى لُزُومِ السُّنَّةِ হাদীস নং ৪৬০৯)
বিশ রাকাআত তারাবীহ-এর উপর সাহাবায়ে কিরাম ও সালফে সালিহীনের ইজমা
হযরত ওমর (রা.)-এর সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, তাবে তাবিঈন সকলেই তারাবীহর নামায বিশ রাকাআতই আদায় করেছেন। এ বিষয়ে কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করেননি। এ বিষয়ে আমলগত দিক থেকে সাহাবায়ে কিরাম ও সালফে সালিহীনের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হযরত মোল্লা আলী কারী (র.) বলেন, أجمع الصحابة على أن التراويح عشرون ركعة
-সাহাবায়ে কিরাম এ বিষয়ে একমত যে, তারাবীহ’র নামায বিশ রাকাআত। (মিরকাতুল মাফাতীহ, খ- ৪, পৃষ্ঠা ৪৩৯)
ইমাম ইবনে কুদামা তারাবীহ’র নামায বিষয়ে ইমাম আহমদ (র.)-এর মত আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, “আমাদের (হাম্বলীদের) দলীল হলো, হযরত ওমর (রা.) যখন উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর পেছনে সাহাবায়ে কিরামকে একত্র করেছেন তখন তারা বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়েছেন। … ইমাম মালিক (র.) হযরত ইয়াযীদ ইবনে রূমান থেকে বর্ণনা করেন, মুসলমানগণ ওমর (রা.)-এর যুগে (বিতরসহ) ২৩ রাকাআত তারাবীহ পড়তেন। আর হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত আলী (রা.) একজনকে নির্দেশ দেন যেন তিনি তাদের নিয়ে রামাদ্বান মাসে বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়েন। এটা মূলত: সাহাবায়ে কিরামের ইজমাকেই প্রকাশ করে। …আর সাহাবায়ে কিরাম যে বিষয়কে অবলম্বন করেছেন তা-ই গ্রহণীয় ও অনুসরণীয়।” (আল মুগনী, খ- ১, পৃষ্ঠা ৮৩৩)
ইমাম নববী (র.) বলেন, তারাবীহ নামায সুন্নাত হওয়ার বিষয়ে সকল আলিম একমত। এ নামায বিশ রাকাআত, যার প্রতি দুই রাকাআতে সালাম ফিরাতে হয়। (আল আয্কার : ৮৩)
ইবনে তাইমিয়া’র দৃষ্টিতে বিশ রাকাআত তারাবীহ সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত
লা-মাযহাবীদের মান্যবর শায়খ ইবনে তায়মিয়া লিখেছেন :“যখন উমর (রা.) লোকদেরকে উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর পিছনে একত্রিত করে দিলেন তখন তিনি বিশ রাকাআত তারাবীহ ও বিতর পড়তেন। (আল-ফাতওয়া আল মিসরিয়্যা) তারাবীহ’র বিষয়ে ওমর (রা.)-এর সিদ্ধান্ত অর্থাৎ জামাআতবদ্ধভাবে বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়াকে সুন্নত বলেছেন। তিনি লিখেছেন : “হযরত উমর (রা.) সকল সাহাবীকে উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর পিছনে এক জামাতে একত্রিত করেছেন। বলাবাহুল্য, উমর (রা.) খুলাফায়ে রাশিদীনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
فعليكم بسنتى وسنة الخلفاء المهديين الراشدين تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ
অর্থাৎ ‘আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাহকে অবলম্বন করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখবে।’ মাড়ির দাঁতের কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এজন্য বলেছেন যে, এভাবে ধারণ করলে তা মজবুত হয়ে থাকে। তারাবীহ বিষয়ে উমর (রা.)-এর এই কাজ সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত।” (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া)
ইবনে তায়মিয়া যেখানে ওমর (রা.)-এর কাজকে সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত বলছেন সেখানে আধুনিক লা-মাযহাবীরা কিভাবে এটাকে বিদআত বলে?
বিশ রাকাআত তারাবীহ বিদআত নয়
সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈন, তাবে তাবিঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনসহ অন্যান্য উলামায়ে কিরামের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, তারা সকলেই তারাবীহর নামাযকে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। আর বিশ রাকাআত তারাবীহ জামাআতে আদায় করা খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত, ইজমায়ে সাহাবা ও ইজমায়ে উম্মাহ হিসেবে গণ্য করেছেন। যদি তারাবীহর নামায সুন্নাত না হতো কিংবা বিশ রাকাআত আদায় করা বিদআত হতো তা হলে সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কিরাম এর উপর আমল করতেন না।
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা ও ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয় যে, মসজিদে নববীতে হিজরী ১৪ সন থেকে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর ইমামতিতে জামাআতে তারাবীহ পড়া শুরু হয়। এ সময় বিশ রাকাআত তারাবীহ পড়া হতো। ঐ জামাআতের মুক্তাদি ছিলেন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শে গড়া মুহাজির, আনসার ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম (রা.)। যারা কোনো দিন কোনো মিথ্যার সাথে আপস করেননি। যদি বিশ রাকাআত তারাবীহ বিদআত হতো তাহলে তারা এর প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করতেন। কিন্তু কেউই এ বিষয়ে কোন প্রতিবাদ করেন নি। বরং সকলে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে এ জামাআতে শামিল হতেন। সূতরাং তারাবীহর নামায আট রাকাআত সুন্নাত বলা এবং বিশ রাকাআতকে বিদআত বলা সুন্নাতে খুলাফা, ইজমায়ে সাহাবা ও ইজমায়ে উম্মাহর বিরোধিতার শামিল। বরং দলীল-প্রমাণের আলোকে বলতে হবে, যারা তারাবীহর নামায আট রাকাআত বলছেন তারা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।
শেষকথা
তারাবীহর নামায সুন্নাত। এটি যেমন সুন্নাতে রাসূল হিসাবে প্রমাণিত তেমনি খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত হিসেবেও সুপ্রতিষ্ঠিত। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করেছেন। তবে ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি পুরো রামাদ্বান পুরো নামায মসজিদে জামাআতে আদায় করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের পর ফরযিয়্যাতের আশঙ্কা রহিত হয়ে গেলে ওমর (রা.) উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর ইমামতিতে মসজিদে নববীতে বিশ রাকাআত তারাবীহ জামাআতে আদায়ের ব্যবস্থা করলে সাহাবায়ে কিরাম (রা.) সকলে এতে শামিল হন। তারা কেউই এর বিরোধিতা করেননি। ওমর (রা.)-এর যুগ থেকে অদ্যাবধি চৌদ্দশ বছরের অধিক সময় ধরে দুনিয়ার সকল প্রান্তের মুসলমানগণ এর উপরই আমল করে আসছেন। অতএব বিশ রাকাআত তারাবীহর উপর উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত। বিশ রাকাআত তারাবীহকে বিদআত কিংবা নাজায়িয বলা বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়।