1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
সুয়েজ খাল
মোহাম্মদ কামরুজ্জামান
  • ১ মে, ২০২১

সম্প্রতি এভার গিডেন নামক একটি জাহাজ আটকে পড়লে সুয়েজ খাল বেশ আলোচিত হতে থাকে।

মিসরের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো, ‘আপনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন, সুয়েজ খাল দ্বারা উপকৃত।’ বিশ্ববাণিজ্যে সুয়েজ খালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণেই হয়তো এই প্রবাদের সৃষ্টি। লোহিত সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সংযোগকারী ১২০ মাইল দীর্ঘ এই খাল এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশকে আলাদা করেছে। যা দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের ১২ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয়। বিশেষ করে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে ইউরোপের বাণিজ্যের একটি লাইফ-লাইন হলো মিশরের এই খালটি। সুয়েজ খাল খননের আগে ইউরোপের জাহাজগুলোর দক্ষিণ এশিয়ায় আসতে সময় লাগত ৪০-৫০ দিন। আর পাড়ি দিতে হতো অতিরিক্ত সাত হাজার কিলোমিটার পথ। কিন্তু সুয়েজ খাল ব্যবহার করে জাহাজগুলো মাত্র ২০ দিনে দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছতে পারে। সময় ও জ্বালানি বেঁচে যাওয়ায় বিশ্বজুড়েই বাণিজ্যিক পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের খরচ কমেছে অনেকাংশে।
প্রতিদিন প্রায় ৭০টি আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল করে সুয়েজ খালে। এতে পণ্য পরিবহন করা হয় তিন থেকে পাঁচ মিলিয়ন টন। বছরে প্রায় ২৫ হাজার জাহাজ সুয়েজ খাল ব্যবহার করে। যার বিনিময়ে বছরে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার রাজস্ব পাচ্ছে মিসর, যা দেশটির জিডিপির দুই শতাংশের মতো। ২০২৩ সালের মধ্যে এ আয় ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। করোনাভাইরাসের মহামারি চলাকালেও ২০২০ সালে প্রায় ১৯ হাজার জাহাজ বা প্রতিদিন গড়ে ৫১ দশমিক পাঁচটি জাহাজ সুয়েজ খাল দিয়ে চলাচল করেছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৯৭ থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই খাল খননের কাজ শুরু করেন ফারাও সম্রাট দ্বিতীয় নিকো। ষোড়শ শতকে ভারত মহাসাগর এবং কৃষ্ণসাগর ও ইজিয়ান সাগরে ইউরোপীয় তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ পাশা সুয়েজ খাল খননের পরিকল্পনা করেন। যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৮৫৪ সালে ফরাসি প্রকৌশলী ফার্দিনান্দ ডি লেসেপ্স মিসর ও সুদানের শাসক সায়্যিদ পাশাকে সুয়েজ খাল খননের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব দেন। সায়্যিদ পাশা তাতে সম্মত হন এবং ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম সুয়েজ চ্যানেল কোম্পানি নামের একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। তাঁর অধীনে ১৮৫৯ সালে খননকাজ শুরু হয়। ১৮৬৯ সালে খনন সম্পন্ন হলে তা সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এক দশক ধরে খালটি খননের কাজের নিয়মিত ৩০ হাজার করে নিয়োজিত ছিল ১০ লাখ মিসরীয় শ্রমিক। এতে হাজারো শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নির্মাণসামগ্রী পরিবহন করা হতো উট ও খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে। ১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর ১৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটিতে প্রথম জাহাজ ভাসে। ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে মিসর। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর সুয়েজ খাল বন্ধ হলে ১৯৭৫ সালে মিসর-ইসরাইল শান্তিচুক্তির মাধ্যমে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ বা শান্তি যেকোনো সময় যেকোনো দেশের জাহাজ সুয়েজ খাল ব্যবহার করতে পারবে।
সুয়েজ খালের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, ১৮৬৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত খালটি মোট ৯ বার সংস্কার করা হয়। বর্তমানে সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য ১৯৩.৩ কিলোমিটার, সর্বোচ্চ গভীরতা ২৪ মিটার এবং প্রস্থ সর্বোচ্চ ২২৫ মিটার। যা দিয়ে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৪০ হাজার টন ধারণক্ষমতার জাহাজ চলাচল করতে পারে। সুয়েজ খালের উত্তরমুখে ভূমধ্যসাগরের তীরে পোর্ট সৈয়দ এবং দক্ষিণ মুখে লোহিতসাগরের তীরে পোর্ট তৌফিক রয়েছে। খালটি এক লেনে জাহাজ চলাচল করতে পারে। এ ছাড়াও বাল্লাহ বাইপাস ও গ্রেট বিটার হ্রদ নামে দুটি পাসিং পয়েন্ট রয়েছে।

গত ২৩ মার্চ মিসরের মরুভূমিতে প্রবল ঝড়ে জোয়ারের চাপে ৪০০ মিটার দীর্ঘ একটি জাহাজ আড়াআড়িভাবে খালে আটকে যায়। ড্রেজারের মাধ্যমে মাটি সরিয়ে এবং ক্রেন দিয়ে ঠেলে জাহাজ মুক্ত করতে এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। এতে সুয়েজ খালে মালবাহী জাহাজের জট তৈরি হয়। সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, খাল বন্ধ থাকায় প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৫০ লাখ ডলার লোকসান হয়। অন্যদিকে বন্দর ও নৌ চলাচল বিষয়ক প্রাচীনতম জার্নাল লয়েডস লিস্ট প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, শত শত মাল ভর্তি জাহাজ আটকে থাকায় প্রতিদিন গড়ে ৯৬০ কোটি ডলারের ব্যবসা বন্ধ ছিল। যা প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪০ কোটি ডলার।

মিসরের কূটনীতি ও অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবক এই সুয়েজ খালের বিকল্প একটি খাল খননের পরিকল্পনা করছে ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্রে বিজনেস ইনসাইডার নামে একটি পত্রিকায় ১৯৬৩ সালের একটি গোপন সরকারি নথি ১৯৯৬ সালে আংশিকভাবে প্রকাশ করা হয়। যেখানে ১৬০ মাইল লম্বা একটি খাল খননের জন্য ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমির তলায় ৫২০টি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে ইসরাইল সুয়েজের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সমর্থন নিয়ে মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিল। অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সেই আকাক্সক্ষা থেকে ইসরাইল কখনই সরেনি। পুরোপুরি ইসরাইলের ভেতর দিয়ে না নিয়ে বরং মিশর-ইসরাইল সীমান্ত দিয়ে বিকল্প একটি খাল কাটার যে কথা হচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ওই খাল তৈরিতে বিনিয়োগ করার কথাও বলে। এই বিনিয়োগ করলে তা বিশ্বাসঘাতকতার সামিল হবে।

ফেইসবুকে আমরা...