সম্প্রতি বাংলাদেশে তুমুল আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যপুস্তক, সর্বত্র এই ইস্যুতে জল ঘোলা হতে দেখা যাচ্ছে। সৃষ্টিগত ভাবে মানুষ যে সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে, তার উপর খবরদারির এক অনভিপ্রেত প্রচেষ্টা বেশ জোরেশোরে চলছে বললে অত্যুক্তি হবে না। অবশ্য একটু ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায়, নীরবে এসব কার্যক্রম আসলে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে।
মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে পাঠকের সুবিধার্থে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জন্মসূত্রে তারা দুইরকম হতে পারে, নারী অথবা পুরুষ। এখানে এই শব্দগুলো মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হচ্ছে মানুষের যে সকল বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানব সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে মানুষকে দুটি ভাগে আলাদা করা হয় সেসকল বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য খুবই সুস্পষ্ট যে মানব শিশুর জন্মলগ্ন থেকেই অনেকগুলো চোখে পড়ে, তারপর শিশুর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে পা রাখলে ধীরে ধীরে এমন আরো অনেক বৈশিষ্ট্য পরিস্ফূটিত হয়, শিশু থেকে ক্রমে সে নারী কিংবা পুরুষ হয়ে ওঠে। ইসলামি শরীয়তের বিধান অনুযায়ী তাই একদম ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে বিধিবিধান একরকম, আর ধীরে ধীরে নারী বা পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হতে শুরু করলে তার বিধিবিধান তখন ভিন্ন হয়ে থাকে। এটিই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম, আল্লাহর তৈরি রীতি। এই দুইয়ের বাইরে, কখনো কখনো মানব শিশুর বৈশিষ্ট্যগত কিছু জটিলতা দেখা দেয়, সেটা জন্মসূত্রে হোক কিংবা তারপর শিশুর বেড়ে ওঠার সময়ে নারী বা পুরুষের বৈশিষ্ট্যসমূহ স্পষ্ট যখন হওয়ার কথা, তখন হোক। বিরল এই পরিস্থিতিতে একই মানবশিশুর মধ্যে নারী এবং পুরুষের আংশিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ হতে পারে, কিংবা নারী হলেও নারীর সৃষ্টিগত সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নয় বা পুরুষ হলেও পুরুষের সৃষ্টিগত সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান নয়, এমনটা হতে পারে। এই শ্রেণির মানবসন্তানকে তৃতীয় লিঙ্গ, হিজড়া কিংবা অন্য যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, বিরল হলেও তাদের অস্তিত্বও মানব সমাজে সব সময়ই ছিল এবং আছে।
এই পুরো বিষয়টি এতো স্বাভাবিক ও সকলের জানা যে এসব আলোচনা করে নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করার কোন অর্থই হয় না, তবু আজ এসব আলোচনা করতে হচ্ছে। তার কারণ— একদল মানুষ পশ্চিমা অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের সমাজে এই সহজ ও স্বাভাবিক বিষয়টার সাথে জঘন্য মানসিক বিকৃতিকে মিলিয়ে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য কিছু বিষয়কে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। হিজড়া আর ট্রান্সজেন্ডারকে সমার্থক শব্দ হিসেবে উপস্থাপনের মাধ্যমে জলঘোলা করে ট্রান্সজেন্ডারের বিষয়টাকে স্বাভাবিকীকরণের ঘৃণ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাই আমরা পরিভাষায় সীমাবদ্ধ না থেকে পুরো বিষয়টাকে প্রায়োগিকতার আলোকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবো।
ট্রান্সজেন্ডার বলতে সাধারণত সেই মানুষকে বুঝানো হয়, যে জন্মসূত্রে যে বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে, তার বিপরীত লিঙ্গের পরিচয় ধারণ করতে চায়। অর্থাৎ যেসকল মানুষ সম্পূর্ণ পুরুষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠার পর নিজেকে নারী হিসেবে, কিংবা সম্পূর্ণ নারী হিসেবে বেড়ে ওঠার পর নিজেকে পুরুষ হিসেবে দাবি করে, তারাই মূলত ট্রান্সজেন্ডার। কিন্তু মুশকিল হলো, এদের আবার দুইটা ভাগ আছে। একদল শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ এক লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য ধারণ করেও নিজেকে ঠিক বিপরীত লিঙ্গের বলে দাবি করে, আরেক দল চিকিৎসা বিজ্ঞানের অপব্যবহারের মাধ্যমে নিজের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যকে রদবদল করার মাধ্যমে অনেকটা খোজা হয়ে যায়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলুন, আর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলুন, এই দুইটার কোনটাই আসলে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু দুইটার বিপদ আলাদা।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অপব্যবহার করে খোজাকরণের মাধ্যমে যারা নিজেদেরকে ট্রান্সজেন্ডার দাবি করে, তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃতি এবং সমকামিতাসহ আরো বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। একটি সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজে তাদের উপস্থিতি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। চূড়ান্ত মানসিক বিকৃতি ও অমানবিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে না পৌঁছালে কোন সমাজ কিংবা সভ্যতা এই বিষয়কে গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিপদ ডেকে আনে তারা, যারা শারীরিকভাবে এক লিঙ্গের সকল বৈশিষ্ট্য বহাল তবিয়তে বহন করে সামাজিকভাবে ভিন্ন লিঙ্গের পরিচয় ধারণ করতে চায়। বিকৃত মানসিকতার মানুষদেরকে এমন উদ্ভট অধিকার পশ্চিমা সমাজে ইতিমধ্যে প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে সেখানে এমন সব জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে, যা আসলে সমাধানের অযোগ্য। এমন ঘটনাও ঘটেছে ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত এক পুরুষ আসামীর অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পর সে নিজেকে ‘মনে মনে নারী’ দাবি করে। তথাকথিত ব্যক্তি স্বাধীনতার জিগির তোলে তখন তাকে নারীদের কারাগারে পাঠানো হলে কারাগারে সে আবার ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত হয়। এছাড়া নারীদের জন্য বিশেষায়িত সুযোগ-সুবিধা ভোগের জন্য নিজেকে মনে মনে নারী দাবি করা থেকে শুরু করে আরো নানাবিধ বিষয় তো আছেই।
গ্রিক-রোমান সভ্যতার উত্তারাধিকার খ্যাত পাশ্চাত্য সমাজে এই সব অস্বাভাবিকতার চর্চা স্বাভাবিক হয়ে পড়লেও প্রাচ্যের কোন সভ্যতাই এসকল চূড়ান্ত অসভ্য ও অমানবিক বিষয়কে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করেনি। আর এ কারণেই, পশ্চিমাদের এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো প্রাচ্যে এসকল প্রকৃতিবিরোধী ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা। এ জন্য পশ্চিমাদের অর্থায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে এসকল এজেন্ডা বাস্তবায়নকারীরা দুটো উপায়ে এগুচ্ছে; একদল সরাসরি ট্রান্সজেন্ডারে সঠিক সংজ্ঞায়নে সেটিকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে, অপর দল সৃষ্টিগত জটিলতার শিকার হিজড়াদের সাথে ট্রান্সজেন্ডারদেরকে মিলিয়ে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় দলের কর্মকাণ্ড বেশি ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলছে, কারণ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তারা হিজড়াদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলে হিজড়া বিরোধিতার জন্য পাল্টা ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে, অথচ বাস্তবে তারা হিজড়াদের ব্যানার ব্যবহার করে প্রকৃতি বিরোধী টান্সজেন্ডারদের জন্য কাজ করছে। জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতেও এমন নযীর তৈরি হয়েছে। সেখানে “হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার”দের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা উল্লেখ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়টির সচেতন শিক্ষার্থীরা সরব হয়ে ওঠেন। তখন পরবর্তী স্পষ্টীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে ‘ট্রান্সজেন্ডার/হিজড়া’ কোটায় ‘স্বেচ্ছায় লিঙ্গ পরিবর্তনকারীরা’ ভর্তির সুযোগ পাবেন না। শুধু জন্মগতভাবে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের অধিকারী শিক্ষার্থীরা ‘ট্রান্সজেন্ডার/হিজড়া’ কোটায় ভর্তি হতে পারবেন।” অথচ ট্রান্সজেন্ডার পরিভাষাটির অর্থই হচ্ছে যারা জন্মগত লিঙ্গপরিচয়কে স্বেচ্ছায় পরিবর্তন করেন। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াকে সমার্থক হিসেবে উপস্থাপন করার ফলে সমাজে ট্রান্সজেন্ডারের মতো ঘৃণ্য বিষয়কে স্বাভাবিকীকরণের এজেন্ডাই উপকৃত হচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যপুস্তকেও একইভাবে ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টির জন্য হিজড়া পরিভাষাকে ব্যবহার করা হয়েছে।
একদিকে যেমন এসকল প্রচেষ্টা চলমান, একই সাথে অন্যদিকে পশ্চিমাদের আনুকূল্যধন্য কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি ট্রান্সজেন্ডারদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা প্রকাশ্যে চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রান্সজেন্ডারের বিরোধিতা করায় চাকরিচ্যূত করার ঘটনাও ঘটেছে। অবশ্য এই প্রচেষ্টা নীরবে নিভৃতে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। বিভিন্ন সময়ে ট্রান্স নামক এই বিকৃত মানসিকতার মানুষদেরকে এসব সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় নানাবিধ অন্যায্য সহযোগিতা প্রদান করে, যোগ্যতা ছাড়াই বৃত্তি কিংবা চাকরি প্রদানের মাধ্যমে এদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মূলত মুসলিম সভ্যতার (পাশাপাশি প্রাচ্যের অন্যান্য সভ্যতাসমূহেরও) যে ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো রয়েছে, তা ভেঙে একটি ভঙ্গুর সমাজে পরিণত করার লক্ষ্যে এ সব মানব প্রকৃতবিরুদ্ধ বিষয়গুলোকে পাশ্চাত্য থেকে অর্থায়নসহ সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। পাশ্চাত্যে যেমন ভঙ্গুর সমাজ কাঠামোকে প্রাচ্যের সুবিন্যস্ত সামাজিক কাঠামোর উপর চাপিয়ে দেওয়ার এ অপচেষ্টা যেন লেজকাটা শেয়াল কর্তৃক অন্য শেয়ালদেরকে লেজ কাটতে উৎসাহ প্রদানের গল্পের মতো। এই প্রচেষ্টার আরেক কারণ হলো এর মাধ্যমে পশ্চিমারা মুসলিম দেশসমূহে একদল বিশ্বস্ত এজেন্ট তৈরিও করে ফেলতে পারবে খুব সহজে। কারণ মুসলিম সমাজে যেহেতু এসকল বিকৃত মানসিকতার লোকদেরকে কখনোই গ্রহণ করা হবে না, ফলে এরা স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমাদের দালালি করতে বাধ্য হবে।
সর্বোপরি এ ফিতনা কেবল একটি পাঠ্যবইয়ের দুই পৃষ্ঠা কিংবা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষককে বরখাস্ত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বরং আরো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ফিতনা। মুসলিম সমাজে যেভাবে একের পর এক ফিতনা ধারাবাহিকভাবে স্বাভাবিকীকরণ হচ্ছে, এর ধারাবাহিকতায় যদি এটিও স্বাভাবিক হয়ে যায়, তবে মুসলিম সমাজ বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। এখনই বহু মুসলিম হিজড়াদের সাথে গুলিয়ে ফেলে ট্রান্সদের প্রতিও সহানুভূতি প্রদর্শন করছেন। এটি চলতে থাকলে বাংলাদেশের সমাজে এদের শিকড় গজাতে শুরু করবে, যা কিনা পুরো সামাজিক কাঠামোকেই নিঃশেষ করে দিবে। ধারাবাহিক প্রোপাগান্ডা আর প্রলোভনের মাধ্যমে এ ফিতনাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টাকে তাই রুখে দাঁড়াতে হবে। শুধু প্রতিবাদ নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সর্বোচ্চ সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ট্রান্সজেন্ডার আর হিজড়া প্রভৃতি পরিভাষা ব্যবহারের ভাওতাবাজি সম্পর্কে সর্বোচ্চ সচেতন হতে হবে।