এক.
একগ্রামে এক নাপিত বাস করত। চুল কাটার পাশাপাশি তার একটা বিশেষ দক্ষতা ছিল সে ছোটখাট কাটাছেঁড়া করতে পারত। গ্রামের লোকজনও নির্দ্বিধায় তার কাছে বাহ্যিক ছোটখাট অপারেশন করিয়ে নিত। ঘটনাক্রমে গ্রামে একবার একজন চিকিৎসক আসলেন। নাপিতের দক্ষতা দেখে তিনি ভাবলেন, একে যদি অপারেশনের কিছুটা নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে খুব ভালো হয়; সে আরো ভালো করে গ্রামবাসীর সেবা করতে পারবে। যা ভাবা তাই কাজ। তিনি নাপিতকে নিয়ে শহরে এলেন। কিছুদিন নিজের কাছে রেখে নার্ভ, শিরা-উপশিরা কোথায় কি আছে তা চিনিয়ে দিলেন। শিক্ষা সমাপনান্তে নাপিত তার গ্রামে ফিরে গেল।
গ্রামে লোকেরাও বেজায় খুশি। এতদিন নাপিত না জেনে করেছে; এবার জেনে বুঝে করবে, খুব ভালো হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, নাপিত এখন কাটাছেঁড়া করতেই ভয় পাচ্ছে। কেননা আগে যখন সে চাকু/কাঁচি চালাত তখন জানত না কোথায় কি আছে, কিংবা কি হতে যাচ্ছে। এখন সবকিছু শেখার পর শুধুই টেনশন কাজ করে, না জানি কোনো শিরা কেটে যায় কিনা। ফলে সে আগের মতো নিস্পৃহভাবে কাটার সাহসই করতে পারে না।
প্রিয় পাঠক, এটা নিছকই এক গল্প। কোথায় যেন শুনেছিলাম। কিন্তু যখনই লা-মাযহাবী ভাইদের কথা মনে হয়, তখনই আমার এ নাপিতের কথা মনে হয়। হাদীস আর ফিকহ না জানার ফলে নাপিতের মতো সাহসী হতে তাঁদের কোনো বাধাই নেই। কিন্তু সেসব শিখিয়ে দিলে সম্ভবত যা ইচ্ছা তা-ই বলার মতো সাহস তারা করতেন না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টিটা বাঁধবে কে? কে তাঁদের শেখাতে যাবে? এ জিজ্ঞাসার জবাব অন্য কোনো দিন দেব। আজ লিখছি হাদীস বিষয়ে তাঁদের সামাজিক অবস্থান।
দুই.
হাদীস প্রসঙ্গে লা-মাযহাবী সাধারণ লোকদের প্রচলিত ধারণা বেশ শিশুসুলভ। তাদের অনেক আলিমের বক্তব্যেও এমন মনে হয়; যদিও আমি আশা করি, আলিমগণ হাদীস সম্পর্কে ভালোই জানেন। কেন শিশুসুলভ বলছি, তা ব্যাখ্যা করছি।
১. তাঁদের কাছে হাদীস মানেই- বুখারী ও মুসলিম। বাকী হাদীসের সব কিতাবই অসহীহ (অশুদ্ধ)। মুয়াত্তা, মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকিম ইত্যাদির কথা বাদই দিলাম, সিহাহ সিত্তাহর বাকী চারটি কিতাবের রেফারেন্স তাদের কাছে কোনো মূল্যই নেই। অথচ সারা বিশ্বে সহীহ হিসেবেই ছয়টি কিতাব সমাদৃত। হ্যাঁ, কিছু দঈফ হাদীস (হয়ত কোনো কোনো আলিমের তাহকীকে/তাখরীজে) এসব কিতাবেও রয়েছে। তবে সর্বসম্মতিক্রমে দঈফ এমন হাদীস কয়টি আছে তা জিজ্ঞাস্য।
২. লা-মাযহাবীদের কাছে হাদীস দুই প্রকার- সহীহ ও দঈফ/মাউদূ। হয় হাদীস সহীহ হবে, নয়ত দঈফ। এটা কেমন বিভাজন আমি জানি না। হাসান হাদীসের কোন উল্লেখই নেই। লিযাতিহি, লিগাইরিহী এর পার্থক্য বাদই দিলাম। আরো সমস্যা হচ্ছে, মুরসাল, মুদাল্লাস, মুদরাজ এসবের প্রেক্ষিতে দঈফ হাদীসের যে উসূলী পার্থক্য রয়েছে তারও কোন স্পষ্ট বক্তব্য নেই।
৩. সহীহ হাদীসের সংজ্ঞায়নেও পার্থক্য রয়েছে। যে পাঁচটি বৈশিষ্টের আলোকে মুহাদ্দিসগণ কোন হাদীসকে সহীহ বলেন, সে সবের কোন সুনির্দিষ্ট বর্ণনাও তারা দেন না। বরং কেবল একজন মুহাক্কিকের (সময় বিশেষে তাঁদের বক্তব্যের সমর্থক মুহাক্কিকের) বক্তব্যের আলোকেই তাঁদের সব বক্তব্য।
৪. সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে দঈফ কে মাউদূ এর কাতারে ফেলে দেওয়া। এটা নিতান্তই বালকসুলভ ধারণা। প্রিয় পাঠক, হাদীস দঈফ হয় সাধারণত সনদের মধ্যে কোন রাবীর দুর্বলতায়। মতনের কারণে দঈফও আছে, তবে তা সনদের প্রেক্ষিতের তুলনায় নিতান্ত কম।
হাদীস দঈফ হওয়া মানে এই নয় যে, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্য নয়। মনে রাখবেন, রাবী হাদীস বর্ণনায় মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হলে তার হাদীস মাতরূক (পরিত্যাজ্য), কিন্তু দঈফ বলতেই মাতরূক নয়। কোনো হাদীস দঈফ হওয়া মানে সে বক্তব্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা হওয়ার সম্ভাবনা ৫০%। সময় বিশেষে এ হার কম-বেশি হতে পারে।
এখন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথাকে জাল বা বানোয়াট বলার ধৃষ্টতা কে দেখাতে পারে। বলবেন, এটা যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা তা প্রমাণিত নয়। ঠিক, কিন্তু তা অপ্রমাণিতও নয়। অর্থাৎ এটা যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্য নয়, তাও কিন্তু প্রমাণিত নয়। এমতাবস্থায় কীভাবে নিশ্চিত করে বলা যায় মাউযূ বা জাল। লা মাযহাবীদের অনেকেই এমন বলে থাকেন।
তিন.
আমার জানামতে, লা-মাযহাবীদের উসূল হচ্ছে- হাদীস সহীহ হলে এর বাহ্যিকার্থের উপর আমল করতে হবে। অন্য কিছু বিবেচ্য নয়। সুন্দর কথা, আমরাও তা চাই। কিন্তু তাঁদের ভাষায় সহীহ হাদীসের বাহ্যিক অর্থের উপর আমল না করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাযহাবে কেন অন্যরূপ ফতওয়া দেওয়া হলো? ভেবে দেখেছেন কি? প্রিয় ভাই এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যারা ফতওয়া দিলেন তাঁদের উদ্দেশ্য জানা একান্তই জরুরি।
এটা কি মাযহাবের ইমামদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য, নাকি মানুষকে ভুল ইসলামের দিকে চালানোর নিয়তে, নাকি তাঁদের ইলমের স্বল্পতার কারণে, নাকি হাদীস না জানার কারণে? আমি যেসব ধারণা করলাম, আমাদের সালাফ ইমামগণের ক্ষেত্রে এর কোনটাই প্রযোজ্য নয়। এমনকি খালাফদের অসংখ্য আল্লাহওয়ালা মুমিনদের জন্যও প্রযোজ্য নয়। তাঁদের ইমান, আমল, তাকওয়া, ইলম সবই পরীক্ষিত।
এমতাবস্থায় অন্য কোনো মোটিভ হয়ত থাকতে পারে। পাশাপাশি এ চিন্তাও করা উচিত, যারা (লা-মাযহাবী) এসব বলছেন তাঁদের মোটিভ কি? আমি আশা করব, তাঁদের নিয়তও ভালো। তবে তাঁদের ইলম, আমল, তাকওয়া আর ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে আমার সন্দেহ থেকেই যাবে। যেমনিভাবে আমি নিঃসন্দেহ আমাদের সালাফদের ব্যাপারে।
উসূল প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন জাগে-
ক. দুইটি সহীহ হাদীসে বিরোধিতা হলে কি করবেন? উত্তর; অধিক শক্তিশালী (আক্বওয়া) মত গ্রহণ করা হবে। তার মানে বাকীটার আমল বাদ। প্রিয় ভাই, এইটা কেমন কথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস হিসেবে জানার পরও তাঁর আমল বাদ। শুধু রাবীদের দুর্বলতার কারণে। কি আশ্চর্য! মাযহাবের ইমামগণ এখানে সমন্বয় করতেন, হাদীসের শানে উরূদ বা প্রেক্ষাপট দেখতেন, সাহাবাদের আমল দেখতেন। এবার বলুন, উসূল হিসেবে কোনটা বেশি যৌক্তিক, কোনটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস মানার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
খ. সহীহ হাদীসের বিপরীতে দঈফ হাদীস থাকলে তো কথাই নেই। বাদ। অথচ দঈফের ব্যাপারেও নিশ্চিত করে বলা যায় না, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস নয়। এবার দেখুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস কে বেশি মানছেন? মাযহাবীগণ নাকি লা মাযহাবীগণ?
ইমামগণ, বিশেষত ইমাম আবূ হানীফা, দুর্বল হাদীসকেও শর্তসাপেক্ষে বিবেচনায় নিতেন। কারণ তারা নিজেদের ইজতিহাদ প্রয়োগের চেয়ে দুর্বল হাদীসকেও উত্তম মনে করতেন। [কতিপয় শর্ত- দঈফ হাদীস সহীহ হাদীসের বিরোধী না হওয়া, সমন্বয় করার সুযোগ থাকা, আমল জারী থাকা ইত্যাদি।]
গ. যদি কোনো মাসআলায় সহীহ হাদীস পাওয়া না যায়, তাহলে? এ প্রেক্ষিতে লা-মাযহাবীগণও দঈফ হাদীস আমল করেন। যেমন, নামাযে হাত বাঁধার হাদীস। তাহলে ‘দঈফ হাদীস আমলযোগ্য নয়’ বলাটা কি স্ববিরোধিতা নয়? আমি জানি না।
ঘ. যেসব মাসআলায় কোন হাদীসই পাওয়া যায় না, বিশেষ করে বর্তমান সময়ের নানা সমস্যায়, তাঁরা ইজতিহাদের কথা বলেন। অথচ ইজতিহাদের কথা মাযহাবের পক্ষ থেকে বললেই গোমরাহী! কী আজব ফতওয়া!
ঙ. কিছু প্রশ্ন আমার মাথায় প্রায় সময়ই জাগে, লা-মাযহাবীগণ কি উত্তর দেবেন-
– যদি রাবীর আমল তাঁর বর্ণিত হাদীসের বিপরীত হয়, তবে সে হাদীসের হুকম কি?
– যদি মুরসাল হাদীসের উপর আমল প্রসিদ্ধ হয়। সে বিষয়ে আমল কীভাবে হবে?
– ক্বাওলী-ফেলীর পার্থক্য, মাওকুফ-মাকতুর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাখ্যা কি? ইত্যাদি।
চার.
লা-মাযহাবীগণ হাদীসের দুর্বলতা প্রমাণের জন্য বিশেষ করে শায়খ আলবানী (র.) এর বক্তব্যের অনুসরণ করেন। বুখারী-মুসলিমের বাইরে হাদীস পেলেই সে সম্পর্কে আলবানী (র.) এর ফাতওয়া দেখেন। যদি সহীহ হিসেবে পাওয়া যায়, তবে ঠিক আছে, না হলে নয়। অথচ শায়খ আলবানী (র.) এর পূর্বে বহু মুহাদ্দিস এ নিয়ে কাজ করে গেছেন। কতই আশ্চর্য যে হাদীসের সনদের বিশুদ্ধতা নিরূপণের জন্য একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্রও (আসমাউর রিজাল) সালাফগণ প্রবর্তন করেন। অথচ সালাফদের কারো মতে হাদীস সহীহ বা হাসান হলেও কেবল আলবানীর তাহকীকের কারণে লা-মাযহাবীগণের কাছে তা অগ্রহণযোগ্য। আবার তারা নাকি সালাফী, সালাফদের অনুসরণ করেন!
হাদীস শাস্ত্রে শায়খ আলবানী (র.) এর খেদমত সমসাময়িক সময়ে অতুলনীয়। কিন্তু তাঁর ভুল হয়নি এমন তো নয়, কোনো কোনো রাবীর ব্যাপারে তাঁর দুইমতও পাওয়া যায়। কেবল একজনের অনুসরণ করে, অন্যদের গোমরাহ বলে দেওয়াই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গোমরাহী।
পাঁচ.
বস্তুত লা-মাযহাবীগণও হাদীসের ব্যাখ্যা করে থাকেন। সেটা নিজেদের মতো করে। উদাহরণ হিসেবে নামাযে ফাতিহার বিষয়টাই বলতে চাই। এক্ষেত্রে তিনটি দলীল খুব বেশি প্রযোজ্য।
– কুরআন পড়াবস্থায় শুনা ও চুপ থাকা (সূরা আরাফ, ২০৪)
– সূরা ফাতিহা ব্যতীত নামায হয় না (বুখারী)
– ইমামের কিরাআত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট (মুয়াত্তা, ইবন মাজাহ, আহমদ)
হানাফীগণের ব্যাখ্যা হচ্ছে, কুরআনের দলীল এখানে প্রাধান্য পাবে হাদীসের উপর। অতএব ইমাম কুরআন জোরে তিলাওয়াত করলে তা শুনা আবশ্যক। আর দ্বিতীয় হাদীস ইমাম ও একাকী নামাজ আদায়কারীর জন্য প্রযোজ্য। আর তৃতীয় হাদীস মুক্তাদীর জন্য প্রযোজ্য।
ইমাম মালিকের (র.) ব্যাখ্যা কুরআন জোরে পড়াকালীন মুক্তাদী শুনবে, আস্তে পড়াকালীন অবস্থায় পড়বে। এতে তিন দলীলকেই ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহার করা হয়েছে।
ইমাম শাফিঈ ও আহমদের (র.) বক্তব্য অনুযায়ী, কুরআনের আয়াত নামাজের প্রেক্ষিতে নয়। দ্বিতীয় দলীল সকলের জন্যই প্রযোজ্য। আর তৃতীয় দলীল ফাতিহা ব্যতীত অন্য কিরাআতের জন্য প্রযোজ্য।
পাঠকগণ কি বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন? কি, সবগুলোই কি সঠিক মনে হচ্ছে না? এখানেই হচ্ছে সমস্যা, যার যার ইজতিহাদে সঠিক মনে হওয়ায় তিনটি মত দেখা যাচ্ছে। এখন কোন বিচারক রায় দেবেন যে, এটা ঠিক আর বাকী দুইটা ভুল। এমন বিচারক কি আছেন? যিনি এমন করবেন তার ইলম নিয়েই সন্দেহ। কেননা ব্যাখ্যার (তাবীল) ক্ষেত্রে অকাট্যভাবে কিছুই বলা যায় না।
আমাদের লা-মাযহাবী ভাইগণও ইমাম শাফিঈ ও আহমদের মত অনুসরণ করেন। কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, যখন তারা বলেন অন্যরা ভুল। অথচ ইমাম শাফিঈ বা আহমদ (র.) নিজেও এমন কথা বলেনননি। এখানেই তাঁদের সাথে হাদীসের ব্যাখ্যার পার্থক্য। তাদের অনেকে তৃতীয় হাদীসটি দঈফ বলে থাকেন। অথচ হাদীসটি সম্পর্কে নানা বক্তব্য আছে। সহীহ, সহীহ লিগাইরিহী, হাসান, দঈফ অনেক ধরনের বক্তব্যই পাওয়া যায়। তবে এই মর্মার্থের অনেক হাদীস আছে, সাহাবা আর তাবেঈদের আমলও আছে। এমতাবস্থায় তাঁদের একদেশদর্শী ফাতওয়া ইলমে হাদীসের ব্যাপারে তাঁদের অজ্ঞতাই প্রকাশ করে।
ছয়.
তাবীলের ক্ষেত্রে আমরা কি করব? কার বক্তব্য মাথা পেতে নেব? সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে, হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে, আমার বক্তব্য হচ্ছে, যিনি ইলম ও তাকওয়ায় আমাদের চাইতে বেশি অগ্রগামী তাঁকে প্রাধান্য দেব।
উদাহরণস্বরূপ, উপরের মাসআলার কথাই বলি। সাহাবীগণ হচ্ছেন এক্ষেত্রে অনুসরণের জন্য আদর্শ। কেননা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুক্তাদী হিসেবে নামাজ পড়েননি, ফলে তাঁর আমল জানা অসম্ভব। বাকী রইলেন সাহাবীগণ। তাঁদের আমলে ভিন্নতা ছিল, তা ছিল তাবেঈদের ক্ষেত্রেও। এখন আমদের উচিত তাঁদের যে কোনো একদলকে অনুসরণ করা। নিজে নিজে ব্যাখা না করা।
নিজের জ্ঞানে আমলকারীর ভাবটা এমন যে, তাঁদের যোগ্যতা কম ছিল ফলে তারা কুরআন-হাদীস বুঝতে পারেননি। ফলে আমলও ঠিক করেননি। অথচ লা-মাযহাবী সালাফীরাই বলে থাকেন, আমরা কুরআন-হাদীস বুঝব যেভাবে সাহাবীগণ বুঝেছেন, তাবেঈগণ বুঝেছেন। কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় তাদের ভিন্নতা। আল্লাহই জানেন, তাঁদের উদ্দেশ্য কি?
প্রিয় পাঠক, আমাদের ইলম কম, আমল কম, তাকওয়া আরো কম (আছে কি না তাতেই সন্দেহ)। অথচ সাহাবা, তাবিঈ ও তাবে-তাবিঈগণের ইলম, আমল, তাকওয়া সবই পরীক্ষিত। এমনকি তারা তাঁদের এসব নিয়েই গত হয়েছেন, আমাদের সে নিশ্চয়তাও নেই। হ্যাঁ, হয়ত বাহ্যিক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অনেক ইলমী যোগ্যতাসম্পন্ন মনে হতে পারে, অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। আর আমল ও তাকওয়ার বিচারে সালাফদের সাথে আমাদের কোন তুলনাই চলে না। [নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জামানা হতে যত দূরে যাচ্ছি ততই ইলম, আমল আর তাকওয়ার ঘাটতি বাড়ছে। তাতে যিনি সন্দেহ করছেন, তিনি এ লিখার পাঠক নন]।
সালাফদের সিদ্ধান্ত ছিল দীনের জন্য; আর আমাদের সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই নিজেদের স্বার্থে, দলের স্বার্থে, গলাবাজির স্বার্থে। এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। সাহাবা তাবিঈদের অনুসরণ করে হাদীস ব্যাখ্যা করবেন? নাকি নিজেদের ইলমের উপর আস্থা রেখে হাদীসের বাহ্যিক অর্থ দেখেই বাকী সব হাদীস ও দলীল অগ্রাহ্য করে আমল করবেন?
প্রিয় ভাই, নিজের আমল, ইলম আর তাকওয়ার উপর আমার অন্তত কোনই ভরসা নেই; বরং সালাফ ও ইমামদের ইলম, আমল ও তাকওয়ার ভরসাতেই তাঁদের ব্যাখ্যা গ্রহণকেই কল্যাণকর মনে করি, আবশ্যক মনে করি। আমাদের ইমামগণ, সালাফ, তাবিঈ, সাহাবাগণের চাইতে যদি আপনার নিজেদের ইলমের উপর বেশি আস্থাবান হন, তবে তো ভালো! সময় সুযোগ পেলে এমন মহারথীদের সাথে সাক্ষাত করে রাখা বোধ হয় জরুরি। কেননা সালাফদের চাইতেও আমল, আখলাক আর ইলমে উন্নত প্রাণির দেখা পাওয়া কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।
সাত.
নিজেদের জ্ঞান দ্বারা বুঝার ক্ষেত্রে আমি একটি হাদীসের উল্লেখ করছি। যাতে খুবই প্রয়োজনীয় একটি মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে। ‘আব্বাদ ইবনু তামীম (র.) এর চাচা থেকে বর্ণিত, একদা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হলো যে, তার মনে হয়েছিল যেন নামাযের মধ্যে কিছু হয়ে গিয়েছিল (বায়ু নির্গত হয়েছিল)। তিনি বললেন, সে যেন ফিরে না যায় যতক্ষণ না শব্দ শোনে বা দুর্গন্ধ পায়। (বুখারী-মুসলিম)
প্রিয় পাঠক, বুখারী-মুসলিমের হাদীস, সুতরাং অসহীহ প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। এবার একটু চিন্তা করুন, এর আমল কিরূপ? শব্দ না শুনলে বা গন্ধ না পেলে নামাজ ছাড়া যাবে না। তাই তো। প্রিয় ভাই, গন্ধ বা শব্দ ছাড়া যদি বায়ু নির্গত হয়? তাহলে? এ হাদিসের বাহ্যিকার্থ কিন্তু বলে নামাজ চালিয়ে যেতে হবে। এমনভাবে আমল করেছেন বলে আমি ঘটনা জানি, অর্থাৎ গন্ধ বা শব্দ না হওয়ায় বায়ু নির্গত হয়েছে জেনেও নামাজ ছাড়েননি। হাদীসে আছে যে!
প্রিয় পাঠক, এই কাজটা কিন্তু মারাত্মক ভুল। এ হাদীসের উদ্দেশ্য সন্দেহবাতিক লোক। যারা সবসময় উযূ চলে গেল বলে সন্দেহে ভুগেন, আপনি-আমি নয়। তাছাড়া এ হাদীসের শব্দগুলোর উদ্দেশ্য, উযূ চলে যাওয়া প্রসঙ্গে নিশ্চিত হওয়ার কথা বলা। অর্থাৎ আপনি যদি নিশ্চিত হন উযূ চলে গিয়েছে তাহলে শব্দ আর গন্ধের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই।
কেননা অন্য হাদীসে গন্ধ ছাড়া শব্দের উল্লেখও পাওয়া যায়। যেমন- আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তির হাদাস হয় তার সালাত কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে উযূ করে। হাযরা-মাওতের জনৈক ব্যক্তি বলল, ‘হে আবূ হুরায়রা! হাদাস কী? হাদাস কী?’ তিনি বললেন,‘‘নিঃশব্দে বা সশব্দে বায়ু বের হওয়া।” (বুখারী-মুসলিম)।
আট.
প্রিয় পাঠক, বলতে পারেন এমন তো সব সময় হয় না। সব হাদীসেও হয় না। দু একটাতে এমন ঝামেলা থাকতে পারে।
হ্যাঁ, আমিও তাই বলি। বেশিরভাগ হাদীসের বাহ্যিকার্থ ফিকহের দলীল হিসেবে গৃহীত। কেননা এদের প্রেক্ষাপট, ইল্লত-হিকমত, আমল ইত্যাদি বিবেচনা করে এমনই পাওয়া গেছে। এসব হাদীস পড়ে, সে অনুযায়ী আমল করতেই পারেন। কিন্তু যেসব হাদীস বাহ্যিকার্থ বুঝা দুষ্কর, কিংবা যার প্রেক্ষাপট ভিন্ন, অথবা যেসব হাদীসের বিপরীত বর্ণনা আছে, সেসবের ক্ষেত্রে কি করবেন? আর কীভাবেইবা বুঝবেন কোনটা সরাসরি আমলযোগ্য কোনটা নয়? আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এসব হাদীস আমলের জন্য বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন, প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট উসূল বা মূলনীতির অনুসরণ। মাযহাবের ইমামগণ এ কাজটাই করে গেছেন। এরপরও যদি আপনি নিজে ইজতিহাদ করতে চান, করুন! মুজতাহিদ হলে কোন সমস্যা নেই। আর না হলে বিনা উযূতে নামাজ পড়ে কিয়ামতে দেখবেন আমলনামা শূন্য। সেটা আমরা যেমন চাই না, তেমনই নিশ্চয় আপনারাও চান না।
নয়.
১. প্রিয় পাঠক, নিচে একটি হাদীস উল্লেখ করছি। এতে সাহাবাদের দুই রকমের অভিমত আছে। আমি জানতে চাই, আপনি সে সময় থাকলে কোনটা অনুসরণ করতেন? এবং কেন? যারা আরবী জানেন তাঁদের জন্য আরবী টেক্সটও দিয়ে দিচ্ছি।
ইবনু উমার (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ব আহযাব যুদ্ধের দিন (যুদ্ধ শেষে) বললেন, বনূ কুরাইযায় না পৌঁছে কেউ আসরের সালাত আদায় করবেন না। পথিমধ্যে আসরের সালাতের সময় হয়ে গেলে তাদের একাংশের কেউ কেউ বললেন, আমরা সেখানে পৌঁছার আগে সালাত আদায় করব না। আবার কেউ কেউ বললেন, আমরা এখনই সালাত আদায় করব, সময় হলেও রাস্তায় সালাত আদায় করা যাবে না উদ্দেশ্য তা নয়। বিষয়টি নবী ব এর কাছে বলা হলে তিনি তাদের কোন দলের প্রতিই অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেননি। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল মাগাযী, হাদীস নং ৪১১৯)
عَنِ ابْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ الأَحْزَابِ “لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الْعَصْرَ إِلاَّ فِي بَنِي قُرَيْظَةَ”. فَأَدْرَكَ بَعْضُهُمُ الْعَصْرَ فِي الطَّرِيقِ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ نُصَلِّي حَتَّى نَأْتِيَهَا. وَقَالَ بَعْضُهُمْ بَلْ نُصَلِّي، لَمْ يُرِدْ مِنَّا ذَلِكَ، فَذُكِرَ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمْ يُعَنِّفْ وَاحِدًا مِنْهُمْ.
২. প্রিয় পাঠক, আপনারা যেনো ভুল না বুঝেন সে জন্য এ হাদীসের দুটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরছি।
ক. হাদিসটি সাহাবাদের ইজতিহাদের অন্যতম এক দলীল।
খ. নবীজী ব উভয় দলের কাউকেই ভুল বলেননি। এমনকি কোনো এক দলকে ঠিক বা উত্তমও বলেননি।
গ. এটি ফিকহী ক্ষেত্রে ইল্লত আর হিকমত এর গুরুত্বেরও প্রমাণ বহন করে।
৩. সতর্কতা
প্রিয় পাঠক, আপনাদের অনুমান যেমনই হোক, এটাকে চূড়ান্ত ধরে নেবেন না, বা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবেন না। এ হাদীসের দুদলই ঠিক, দুটি ব্যাখ্যাই ঠিক। এটা মাথায় রাখবেন। এরপর নিজের অগ্রাধিকার বলবেন, আপনারা কেবল এক/দুই উল্লেখ করলেও চলবে। ইচ্ছা করলে কারণও বলতে পারেন। ধরে নিতে পারেন, আপনিও সে দলে ছিলেন। এমতাবস্থায় আপনার আমল নিশ্চয়ই একদলের ন্যায়ই হত, আপনি কোনটি করতেন? মত দুটি হচ্ছে-
এক. সময়মত রাস্তায় নামাজ পড়া।
দুই. বানূ কুরায়যায় গিয়ে নামাজ পড়া।
আমি কেন জিজ্ঞাসা করছি তা আপনাদের মতামত পেলে জানাব ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহু আলাম। ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
আমাদের করণীয়
প্রথম কথা, আমরা হাদীস পড়ব, জানব, কোন সমস্যা নেই। বরং মুসলিম হিসেবে এটাও আমাদের অন্যতম দ্বীনী দায়িত্ব। তবে সাথে সাথে কিছু সম্পূরক কাজও করব-
-একজন বিজ্ঞ, গ্রহণযোগ্য আলিমের কাছ থেকে প্রশ্ন ও খটকাগুলো নিরসণ করে নেব।
-ফেসবুকে পাবলিকের কাছে ব্যাখ্যা চাইব না
-নিজেদের পরিবারে একজন আলিম বানানোর চেষ্টা করব। যেন সময়ে অসময়ে তাঁর নিকট থেকে জেনে নিতে পারি।
-হ্যাঁ, তালিবে ইলম ও আলিমগণের জন্য, হাদীসের ভিত্তিতে গবেষণামূলক পড়া চালিয়ে যাওয়া জরুরি। তারা হাদীসের সার্বিক তাহকীক করবেন, এর হুকুম জানবেন, বর্তমান প্রেক্ষিতে এর আমলের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করবেন, ফিকহী ক্ষেত্রে তারজীহ দেওয়ার যোগ্যতা থাকলে দেবেন। এসবই জরুরি। কেননা তাতে উম্মতেরই ফায়দা।
তবে সবই দ্বীনের মূলনীতি অনুসরণ করে, নিজেদের যুক্তি আর বুদ্ধিতে নয়, আর নিয়তের গরমিলের সাথেও নয়। কেননা এ দু কারণে উলামা ও তালাবাগণ যেমন ডুববেন, উম্মতকেও ডুবাবেন।
-সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, হাদীস দেখেই তা থেকে ফতওয়া দেব না বা নেবও না। অর্থাৎ আমল শুরু করব না, যতক্ষণ না আলিমের নিকট থেকে এর ব্যাখ্যা ও ফিকহী আমল জেনে নেব।
এই একটি আমল যদি আপনি করতে পারেন তাহলে আপনার হাদীস অধ্যয়ন বিপথে যাবে না। নয়তো পড়বেন হাদীস, অনুসরণ করবেন খাহেশাতের, নিজের পছন্দের দলের। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্য, সালাফের অনুসরণ বা দীনের অনুশীলন কোনটাই হবে না। এবার সিদ্ধান্ত আপনার।