বিশেষ থেকে বিশেষতর, উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর, পূর্ণ থেকে পূর্ণতর এবং বিস্ময়কর মুজিযা হচ্ছে মিরাজ। কোনো নবী বা রাসূলকে এমন মুজিযা দেওয়া হয়নি। এই মিরাজ শরীফের মাধ্যমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মাকামে উলিয়া পর্যন্ত পৌঁছানো হয়েছে। সেখানে পৌঁছে তিনি যা অবলোকন করেছেন, তা অন্য কেউই দেখেননি। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ ইসরা শব্দের অর্থ নিয়ে যাওয়া, সায়ের বা ভ্রমণ করানো। আল্লাহ তাআলা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মক্কা মুকাররামা থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন- এটুকুকে অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে। কেননা তা কিতাবুল্লাহ দ্বারা প্রমাণিত। তারপর মসজিদে আকসা থেকে আকাশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নাম হচ্ছে মিরাজ। এটুকু মশহুর হাদীসসমূহের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভ্রমণের এ অংশটুকু যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলে সে বিদআতী, ফাসিক এবং লাঞ্ছিত। এছাড়া আনুসঙ্গিক ছোটখাটো আশ্চর্যজনক এবং সূক্ষ্ম ঘটনাদি বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। সেগুলো যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলে সে মূর্খ এবং বঞ্চিত। মিরাজ সম্পর্কে বিশুদ্ধ মাযহাব এই যে, ইসরা এবং মিরাজ উভয়টিই জাগ্রত অবস্থায় এবং সশরীরে সংঘটিত হয়েছিল। সাহাবা, তাবিঈন এবং তাবে তাবিঈনগণের মশহুর আলিমগণ এবং তাঁদের পর মুহাদ্দিস, ফকীহ এবং ইলমে কালাম শাস্ত্রবিদগণের মাযহাব এই মতের উপরই প্রতিষ্ঠিত। এ সম্পর্কে বহু সহীহ হাদীস এবং সহীহ খবর মুতাওয়াতির হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ আবার এরকম মত পোষণ করেছেন, মিরাজ স্বপ্নে এবং আত্মিকভাবে হয়েছিল।
এই দুই মতের সামঞ্জস্য বিধান এভাবে করা হয়েছে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ বিভিন্ন সময়ে হয়েছিল। তন্মধ্যে একবার সংঘটিত হয়েছিল জাগ্রত অবস্থায়। অন্যান্য সময় হয়েছিল স্বপ্নযোগে, আত্মিকভাবে। সেগুলোও আবার কিছু হয়েছিল মক্কা মুকাররামায় এবং কিছু হয়েছিল মদীনা মুনাওয়ারায়। আর স্বপ্নের মিরাজও ওহী। কেননা এ কথায় ঐকমত্য রয়েছে যে, আম্বিয়া কিরামের স্বপ্নও ওহী। সন্দেহের অবকাশ নেই। নিদ্রিত অবস্থায়ও তাঁদের অন্তর জাগ্রত থাকে। নিদ্রিত অবস্থায় তঁদের চোখ মুদিত থাকত, যেমন মুরাকাবার হালতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চোখ মুবারক মুদিত থাকে। আর এই মুদিত রাখার কারণ হচ্ছে, মুরাকাবার অনুভূতিতে জাগতিক প্রভাব যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী (র.) বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নযোগে যা কিছু লাভ করতেন, তা ছিল তাউতিয়া এবং তায়সির হিসেবে। অর্থাৎ বিধান বা অবস্থাকে বুঝিয়ে দেওয়া এবং সহজসাধ্য করে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। যেমন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ওহী আগমনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি সুস্বপ্ন দর্শন করতেন, যাতে করে ওহীর কঠিন ভার হালকা অনুভূত হয় এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ সাপেক্ষে উক্ত গুরুদায়িত্বটি সহজে বহন করতে পারেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ প্রথমে কয়েকবার স্বপ্নযোগে সংঘটিত হয়েছিল, যেহেতু জাগ্রত অবস্থায় মিরাজ সংঘটিত হবে। আল্লাহ পাকের পরিকল্পনা ছিল সেরকমই। মিরাজ স্বপ্নে হয়েছিল এ কথার প্রবক্তারা বলেছেন, স্বপ্নের মিরাজ নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে হয়েছিল। কোনো কোনো আরিফীন বলেছেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসরা এবং মিরাজ বহুবার সংঘটিত হয়েছিল। তাঁরা এ সংখ্যা চৌত্রিশ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে একটি হয়েছিল সশরীরে, জাগ্রত অবস্থায়। আর বাকীগুলো হয়েছিল স্বপ্নযোগে, আত্মিকভাবে। আবার এক শ্রেণি এমন বলে থাকেন, ইসরা যা মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত হয়েছিল তা ছিল সশরীরে। আর সেখান থেকে আকাশে যে মিরাজ হয়েছিল, তা স্বপ্নের মাধ্যমে আত্মিক অবস্থায় হয়েছিল। তারা উপরোক্ত আয়াতে কারীমার মাধ্যমে দলীল দিয়ে থাকেন। তাঁরা বলেন, ইসরার শেষ সীমায় মসজিদে আকসার পরেও হয়ে থাকত, তাহলে কুরআন মাজীদে এর উল্লেখ করা হতো। এ কথা উল্লেখ করলে তো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বুযুর্গী, সম্মান, প্রশংসা এবং আল্লাহ তাআলার কুদরত ও বিস্ময় আরও অধিক প্রতিভাত হত। তাঁদের এমন বক্তব্যের উত্তরে বলা হয়েছে, আয়াতে কারীমায় বিশেষ করে মসজিদে আকসাকে উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, উক্ত স্থানটিকে কেন্দ্র করে ঝগড়া ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল। তাই সে স্থানটিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বাইতুল্লাহ শরীফ থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেছেন, মসজিদে আকসা দর্শন করেছেন একথা কুরাইশরা অস্বীকার করেছিল। শুধু তাই নয়, কাফিররা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে মসজিদে আকসার কী কী আলামত রয়েছে, এ সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিল এবং তার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রীতিমতো পরীক্ষা করেছিল। আর সে কারণেই উক্ত স্থানটির উল্লেখ বিশেষভাবে করা হয়েছে। এটা ইসরার শেষ সীমা বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। এ সম্পর্কে কুরআনের আয়াতও রয়েছে। সূরা আন নাজমে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আন নাজমে যা বলা হয়েছে এবং যা ঘটেছে, সেগুলো সম্পর্কে কিছু কিছু চিন্তাবিদ মন্তব্য করে থাকেন যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জিবরাইল (আ.) কে দেখেছিলেন এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করেছিলেন- এটাই বুঝানো হয়েছে আন নাজম এর বর্ণনায়। কিন্তু সুসাব্যস্ত ও সুপ্রমাণিত কথা এটাই যে, এর দ্বারা মিরাজের ঘটনাই বলা হয়েছে।
বান্দা মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী র.) বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমার কুদরতের নিদর্শনসমূহ তাকে দেখাব এ উদ্দেশ্যে আমি ভ্রমণ করিয়েছি- এ আয়াতখানা মেরাজের সাথে যুক্ত। কথাটির তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ তাআলা তার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন। তারপর সেখান থেকে আকাশে নিয়ে গেলেন। আকাশে নিয়ে নিদর্শন দর্শন করানোর কারণ এই যে, আল্লাহ তাআলার কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শনসমূহ তো আকাশেই, আর চূড়ান্ত পর্যায়ের অলৌকিকতা ও মুজিযার বহিঃপ্রকাশ তো সেখান থেকেই হয়ে থাকে। তাই এই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা তার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই ঘটনা মসজিদে আকসা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেননি। ঊর্ধ্বাকাশে যে মিরাজ হয়েছিল, তা শুরু হয়েছিল মসজিদে আকসা থেকে। মসজিদে আকসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রেক্ষিতেই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ স্বপ্নযোগে সংঘটিত হলে কাফিররা একে অসম্ভব মনে করত না। আর দুর্বল ঈমানদাররা এর কারণে ফিতনায় পতিত হতো না। তাছাড়া স্বপ্নে দর্শনকৃত ঘটনাবলি বাস্তবে সংঘটিত হওয়ার প্রচলন অপ্রসিদ্ধ। ইসরা শব্দের ব্যবহারও স্বপ্নের ক্ষেত্রে হয় না। সুতরাং এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইসরা যখন জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছে, তখন তার পরবর্তী সংঘটিত মিরাজও বাস্তবেই হয়েছে। এরপরও বলতে হয়, মিরাজ স্বপ্নযোগে হয়েছে- এরকম প্রমাণও নেই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ শরীফ স্বপ্নযোগে হয়েছে বলে যারা দাবি করেন তাদের সন্দেহের কারণ কয়েকটি। যথা:
১. ‘যা আমি আপনাকে দেখিয়েছি ওই স্বপ্নকে আমি কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্য বানিয়েছি।’ এই আয়াতকে কোনো কোনো মুফাসসির মিরাজের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে থাকেন। কেননা ‘রুইয়া’ নিদ্রাবস্থায় স্বপ্নে কিছু দেখাকে বলা হয়। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এখানে ‘রুইয়া’ বা স্বপ্ন শব্দ উল্লেখ করে হুদায়বিয়া বা বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাকেই বুঝানো হয়েছে। আহলে ইলম ‘রুইয়া’ শব্দকে চাক্ষুষ দর্শন অর্থেও প্রয়োগ করে থাকেন। যেমন কবি মুতানাব্বি তার কবিতায় বলেছেন। কোনো কোনো আহলে ইলম বলেছেন, যেহেতু মিরাজ শরীফ রাত্রি বেলায় হয়েছে তাই এক্ষেত্রে ‘রুইয়া’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
২. হাদীস শরীফে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অতঃপর আমি জাগ্রত হলাম’- এ কথায়ও প্রমাণ হয়, মিরাজ জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল। ‘আমি জাগ্রত হলাম’ এ কথার তাৎপর্য এই যে, ফিরিশতা আসার পূর্বে তিনি নিদ্রায় ছিলেন। সেই নিদ্রা থেকে তিনি জাগলেন এবং জিবরাইল (আ.) তাকে বোরাকে সাওয়ার করিয়ে নিলেন। অথবা এর অর্থ এও হতে পারে, মিরাজের যাবতীয় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর পরবর্তী নিদ্রা থেকে তিনি জাগ্রত হলেন। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে, আমি জেগে উঠতেই দেখি মসজিদে হারামে শুয়ে আছি। এখানে জেগে উঠার অর্থ হতে পারে যখন সকাল হলো তখন আমি মসজিদে হারামে। অথবা জাগ্রত হওয়ার কথা সম্ভবত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কোনো নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়া সম্পর্কে বলেছেন, যা বায়তুল হারামে আসার পর হয়েছিল।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইসরা সারা রাতব্যাপী ছিল না, বরং রাতের কিছু অংশে হয়েছিল। কোনো কোনো মুহাক্কিক বলেন, ইসতেকাফ এর অর্থ ইফাকা অর্থাৎ চেতনতা। উক্ত চেতনাবস্থা থেকে মিরাজের অবস্থায় উপনীত হওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে যখন আসমান ও যমীনের মালাকুতের বিস্ময়কর ও সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো দেখানো হয়েছিল, মালায়ে আলা এবং তথাকার আল্লাহ তাআলার বড় বড় নিদর্শনাবলি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের ভেদের বস্তুসমূহ অবলোকন করানো হয়েছিল, তখন তাঁর হাল অত্যন্ত কঠিন হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর বাতিন বা অন্তর্জগত নিদ্রার অবস্থা সদৃশ হয়ে গিয়েছিল। আহলে ইলমগণ বলেন, মালাকুত অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার কুদরতের জগত দর্শনকালে তিনি যদিও জাগ্রত ছিলেন, তথাপিও সে অবস্থাটা ছিল একপ্রকারের অনুভূতির অনুপস্থিতি। আর সে অবস্থাটাকেই আহলে ইলম নিদ্রা ও জাগরণ এ দুইয়ের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সেটা জাগ্রত অবস্থা-ই। কিন্তু অনুভূতির অনুপস্থিতিকে কেউ কেউ নিদ্রা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কোনো কোনো বর্ণনাতেও এরকম এসেছে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি তখন নিদ্রা ও জাগরণ দু’এর মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলাম। কেউ কেউ এই হাদীসের ব্যাখ্যা এরকম করেছেন যে, নাওম এর অর্থ হলো, তিনি নিদ্রিতদের মতো শায়িত ছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, আমি তখন হাজারে আসওয়াদের নিকটে প্রায় শায়িত অবস্থায় ছিলাম। আবার কখনও এক পাশে শায়িত ছিলাম -এরকম বলা হয়েছে। হযরত আনাস (রা.) কিন্তু এরকম অবস্থা অবলোকন করেননি। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা শুনেছেন। মিরাজের ঘটনা হিজরতের পূর্বে ঘটেছিল। আর হযরত আনাস (রা.) তো হিজরতের পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহচর্যে গিয়েছিলেন। তদুপরি তখন তার বয়স ছিল মাত্র সাত আট বছর। আলিমগণ এরকমই ব্যাখ্যা করেছেন। হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) এর বর্ণিত হাদীসের অবস্থাও একই। তিনি বলেছেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহ মুবারক সে রাত্রিতে বিছানা থেকে হারিয়ে যায়নি। আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) এর এই হাদীসটি ওই সম্প্রদায়ের দলীল, যারা বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল স্বপ্নযোগে।
একদল আলিম বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির এক বা দেড় বছর পর ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। তাদের উক্ত মতানুসারে তো হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) এর তখন ধারণা ও স্মরণশক্তিই ছিল না। বরং এমনও হতে পারে যে, তখন তাঁর জন্মই হয়নি। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
মোট কথা হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) এর এই হাদীস পূর্বোক্ত হাদীসদ্বয়ের তুলনায় অগ্রগণ্য নয়, যা দর্শনের ভিত্তিতে বিবৃত হয়েছে। হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহ মুবারক আমার থেকে হারিয়ে যায়নি। এই হাদীসের মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করা নিঃসন্দেহে ভুল। পবিত্র কালামে উল্লেখ করা হয়েছে ‘এবং চোখ যা দর্শন করেছে, অন্তর তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি।’ এই আয়াতটি স্বপ্নদর্শনকে প্রমাণিত করে না। আয়াতখানার সুস্পষ্টভাব হচ্ছে, তিনি চোখে যা দেখেছেন, তার হৃদয় তাকে অবাস্তব দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেনি। বরং তার চোখের দর্শনকে অন্তর স্বীকৃতি দিয়েছে, অস্বীকার করেনি। তার দলীল হচ্ছে এই আয়াত, ‘ওই সময় তার চোখ বিচ্যুত হয়নি এবং অবাধ্য হয়নি।’
এখন আলোচনায় আসা যাক, দার্শনিকদের বাতিল এবং মনগড়া যুক্তি প্রসঙ্গে। তারা বলে থাকে, ভারী দেহ কখনও ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে পারে না। তাছাড়া আকাশের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হওয়া এবং তা মিলিত হয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। এ জাতীয় কথাবার্তা ইসলামী তরীকায় পরিত্যাজ্য এবং অনর্থক। আরেকদল আছে, যারা মিরাজকে আত্মিক বলে ধারণা করে থাকে। তারা এ মিরাজের উপর অনুমান করে হাশরকেও আত্মিক বলে আখ্যায়িত করে। তারা যে মিরাজকে আত্মিক বলে, তা এই অর্থে নয় যে, স্বপ্নযোগে আত্মার মিরাজ হয়েছিল। বরং তারা আত্মার বিভিন্ন মাকাম ও অবস্থায় আরোহণ এবং পূর্ণতায় পৌঁছা- এরূপ অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে থাকে। যেমন তারা বলে থাকে, জিবরাইল এর অর্থ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আত্মা, বোরাকের অর্থ তাঁর নফস যা রূহের বাহন ছিল, যার স্বভাব হচ্ছে অবাধ্যতা। এটা কখনও বাধ্য হয় না, যতক্ষণ রূহানী শক্তি তার উপর প্রবল না হয়। তারা আকাশের অর্থ করে নৈকট্যের মাকাম, সিদরাতুল মুনতাহার অর্থ করে চূড়ান্ত মাকাম ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সম্প্রদায়টি তাদের এমন মনগড়া ব্যাখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত মূসা (আ.) এর ঘটনার ফিরআউন, লাঠি, জুতা ও ওয়াদী ইত্যাদি সম্পর্কেও মনগড়া অর্থ করে থাকে। তারা শব্দ ও বাক্যের বাহ্যিক অর্থকে স্বীকার করলেও বলে, ইলম ও মারিফত বলে একটি বস্তু আছে এবং তারও আলাদা স্তর আছে। তাদের অনুমান অনুসারে হাশর, মিরাজ আত্মিক ও দৈহিক- এ দুয়ের মধ্যবর্তী একটি অবস্থা। ইমাম গযযালী (র.) এই ধারণার চক্রাবালে পতিত হয়েছেন। হাশরকে যদি আত্মিক মনে করা হয়, শাব্দিক অর্থের গুরুত্ব না দিলে এবং আকৃতিগতভাবে হাশর হবে বলে মনে না করলে, সুস্পষ্ট কুফুরী করা হবে ও সীমালংঘন হবে। ইহা হলো বাতিনীয়াদের মাযহাব।
বান্দা মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী র.) বলেন, রুচিবান ঈমানদারের নিকট প্রথম পন্থাও অসম্ভব ও অস্বীকৃতির ইঙ্গিতবাহক। বস্তুত, এরা আকৃতি জগতকে স্বাভাবিক দায়েরায়ে এমকান বা সম্ভাব্যের বৃত্ত থেকে দূরবর্তী মনে করে বলে ভাবার্থের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। প্রকৃতপক্ষে ঈমান হচ্ছে শোনা এবং মানার নাম, যেমন মিরাজের ঘটনায় সাইয়্যিদুনা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) করেছিলেন। আর সেদিন থেকেই তিনি সিদ্দীক নামে ভূষিত। আর এই ঘটনাকে অবিশ্বাস করে কোনো কোনো দুর্বল ঈমানদার তো ঈমানের বৃত্ত থেকে বেরিয়েও গিয়েছিল। ইলমুল ইয়াকীন তো প্রত্যক্ষ দর্শনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। সে সম্পর্কে আপত্তি তোলা, উচ্চ বাচ্য করা, ভাবার্থের দিকে ঝুঁকে পড়া সম্ভাব্য অসম্ভাব্য নিয়ে যুক্তিবিদ্যার মাপকাঠিতে বিচার বিশ্লেষণ করা, বুদ্ধি এবং তার মাধ্যম দ্বারা তাকে বন্দী করা ঈমান এবং বন্দেগি থেকে দূরে থাকার লক্ষণ।
আমাদের অর্থাৎ ঈমানদারদের জন্য তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার চাইতে বড় দলীল আর কিছু হতে পারে না। আমরা তার কাছ থেকে যা শুনব তাই আমল করব। যে সম্প্রদায় এই কাজটিকে তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণ বলে থাকে, তারা জানে না আমরা কার তাকলীদ করে থাকি। আমাদের তাকলীদ বা অনুসরণ তো ওই মহান পয়গম্বরের তাকলীদ যার পয়গম্বরী সাব্যস্ত হয়েছে মুজিযাসমূহের মাধ্যমে। সুসাব্যস্ত জনের তাকলীদ করাই প্রকৃত তাকলীদ আর এটা কোনো গতানুগতিক তাকলীদ নয়। এটা সিরাতে মুস্তাকীমের অনুসরণেরই নামান্তর। অন্ধ মুকাল্লিদ তো তোমরাই, যারা স্বীয় বুদ্ধিবাদিতার তাকলীদ করে থাকো এবং প্রবৃত্তির নির্দেশ মতো চলো, যার সত্যাসত্য সুসাব্যস্ত নয়। এ পথ দ্বিধা ও সন্দেহে ভরা। দার্শনিকেরা তো মূলত আম্বিয়া কিরামের সিলসিলাকেই অস্বীকার করে থাকে। তাদের কথায় প্রয়োজন কী? তাদের নবী তো তাদের বুদ্ধি। যুক্তিবাদী ও তর্কবাগীশদের কী যে হলো। চলার পথ সহজ সরল হওয়া সত্ত্বেও তারা পথচ্যুত। রাস্তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা কথা বলে কেন? সন্দেহের অবতারণা করে মতানৈক্যের সৃষ্টি করে কেন? তর্কবাগীশদের নিয়ত যদিও দার্শনিকদের বিপরীত, তবু পথ চলার দিক দিয়ে তারাও স্বীয় প্রবৃত্তি এবং দার্শনিকদের দর্শনশাস্ত্রের অনুসরণ করে। এতে করে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে যাচ্ছে।
[শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) কৃত মাওলানা মুমিনুল হক অনূদিত প্রবন্ধ থেকে ঈষৎ পরিমার্জিত]