1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
সায়্যিদ আহমদ শহীদ ও দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমানদের রাজনৈতিক পথনির্দেশ
মুহাম্মাদ সায়ীদ
  • ৫ মে, ২০২৫

ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রাথমিক পর্বে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। একের পর এক বিভিন্ন অঞ্চলে বহির্দেশীয় শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থতার সম্মুখীন হলে মুসলিম সমাজে বিশাল রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই প্রেক্ষাপটে ইমাম শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) ও শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর আধ্যাত্মিক দহলিজ প্রাঙ্গণে বেড়ে ওঠা হযরত সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) (১৭৮৬–১৮৩১খ্রি.) নিজ হাতে হাল ধরেন; ইসলামী সংস্কার, পুনরুজ্জীবন এবং জিহাদের ধারণায় ভারতের যুগান্তকারী পরিবর্তনের দিকে মনোনিবেশ করেন। সেসময় তিনি তাসাওউফের কোমলতা, শরীআতের নিয়মানুবর্তিতা ও জিহাদের আপোসহীনতার সমন্বয়ে যে পথ-পরিক্রমা রচনা করেছিলেন, সেটি বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক মূল্যায়নের মুখোমুখি হয়েছে। তবে তার এই সামগ্রিক আন্দোলনের ব্যাপারে এই সত্য আজও প্রমাণিত যে, এটি দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের জন্য তাৎপর্যবহ ও প্রাতঃস্মরণীয় এক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার হিসেবে অপরিবর্তিত মূল্যে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।

১৭৫৭ সালে পলাশীতে পরাজয়ের পর থেকে ভারতে মুসলিম শাসনের পতন শুরু হয়। এসময় ভারতের শাসনক্ষমতা মুসলমানদের থেকে হাতছাড়া হওয়ার মাধ্যমে কেবল রাজনৈতিকভাবে তারা দুর্বল হয়নি, বরং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবেও ব্যাপক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয়। সাতশ বছরের মুসলিম শাসনের পর ভারতে এই সময়ে যে বন্ধ্যাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) এর শিশুমনেও ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। বিধায় বাল্যকাল থেকেই তিনি ভারতের মুসলামানদের সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়ন ও ঐ সময়ে আপতিত সংকট উত্তরণের চিন্তা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি আত্মিক উন্নয়ন,  সমাজ সংস্কার ও ইসলামী শরীআহ পুনরুজ্জীবন এবং চূড়ান্ত ধাপে জিহাদের কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। সায়্যিদ আহমদ বেরলভীর (র.) এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলামের মূল শিক্ষায় সমাজকে পুনরায় উজ্জীবিত করা এবং ঔপনিবেশিক শাসন ও স্থানীয় শাসকগোষ্ঠীর অনৈতিক ও যুলমধর্মী কার্যকলাপের ফলে মুসলিম সমাজে যে বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল, তা সংশোধন করা। তিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত তাওহীদের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ, শিরক, বিদআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং মানুষের সামনে ইসলামের সঠিক শিক্ষা উপস্থাপন করেন। তাঁর দাওয়াত ছিল কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক খাঁটি ইসলামী জীবনযাত্রার প্রতি প্রত্যাবর্তন, যা মুসলিম সমাজকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিকভাবে পুনর্গঠনের দিকে ধাবিত করবে। ঔপনিবেশিক শক্তির সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও স্থানীয় শাসকদের দুর্নীতি মুকাবিলায় সায়্যিদ আহমদ বেরলভী ‘জিহাদ’ ধারণাকে এক বৈপ্লবিক সমাধান হিসেবে তুলে ধরেন।

সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) শুরুর দিকে তৎকালীন সামাজিক অসঙ্গতিগুলো দূর করার জন্য সংস্কার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। সে সময় ভারতের মুসলিম সমাজে মদপানের অভ্যাস মহামারি আকার ধারণ করেছিল। বেশ কিছু অঞ্চলে হিন্দু রীতির প্রভাবে বিধবা বিবাহের ব্যাপারে মুসলমানদেরও অনীহা তৈরি হয়েছিল। ধর্মকর্ম ও বিশ্বাসে শিআ মতবাদ প্রভাব বিস্তার করেছিল। নিরাপত্তার অজুহাতে ফরয হওয়া সত্ত্বেও হজ্জ করা থেকে বিরত থাকার মতো সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছিল। সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) এসব কুসংস্কার ও অপচর্চার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রচারণা চালিয়ে ব্যাপক সংস্কার সাধনে সফল হোন। তৎকালীন ভারতে মুসলিম জনসমাজের সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অচলাবস্থা নিরসনকল্পে সায়্যিদ আহমদ বেরলভীর সংস্কার কার্যক্রমের সাথে একাত্ম হওয়া বিশাল জনগোষ্ঠীর ব্যাপক উৎসাহ এবং তদুপরি সীমান্ত অঞ্চলে পাঠান নেতাদের আনুগত্য সায়্যিদ সাহেবের জন্য ঐ অঞ্চলে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। ফলে নানাবিধ বাধাবিপত্তি উতরিয়ে, সংগ্রাম-জিহাদের মাধ্যমে তিনি আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চল পেশোয়ারে একটি শরীআহ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হোন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে শিখ-ব্রিটিশ যৌথ আক্রমণের মুখে এবং সীমান্ত অঞ্চলের স্থানীয় পাঠানদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ১৮৩১ সালে বালাকোট যুদ্ধে উপমহাদেশের মুসলমানের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির মহান স্বপ্নদ্রষ্টার জীবনাবসান ঘটলেও, তার স্বপ্ন ও লক্ষ্য এখনো ভারতের মুসলমানদের জন্য চেতনার বিষয় হিসেবে সমান প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে।

বহু বছর পূর্বে ভারতে ইসলাম ও মুসলমানের যে পরিণতির আশঙ্কা করে তাদের জন্য একটি নিরাপদ আবাস রচনার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এই মুজাহিদ, তাঁর ইন্তিকালের প্রায় দুইশ বছর পরে আজও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল জুড়ে সে গঞ্জনা ও অসময় কার্যকর অর্থে কাটিয়ে উঠতে পারেনি মুসলিম সমাজ। বাহাদুর শাহের নির্বাসনের মাধ্যমে মুঘল শাসনের পতন পরবর্তী সময় থেকে স্বাধীন হায়দ্রাবাদের অবলুপ্তির পথ ধরে আজকের দিনের বিতর্কিত ভারতের ওয়াকফ বিল প্রস্তাবের সময় পর্যন্ত মুসলমানের যে রাজনৈতিক অবনমন, অন্যদিকে কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁ থেকে বাংলাদেশের শাহবাগের উল্লম্ফন পর্যন্ত যে সাংস্কৃতিক দমনপীড়ন– এসব কিছু স্পষ্টভাবে সায়্যিদ আহমদের জিহাদ ও রাষ্ট্রসাধনার দিকে ফিরে যাওয়ার পথ নির্দেশ করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের রাজনৈতিক অবস্থান আজ কেমন? –এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের মাধ্যমে সায়্যিদ আহমদ শহীদের আন্দোলনের তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়। আজকের ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি মুসলিম বিরোধী সহিংসতায় মেতে উঠেছে। বিজেপি ও তার মূল আদর্শিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) হিন্দু জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে একটি রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণ করেছে, যা মুসলমানদের প্রান্তিক করে তুলেছে। এই বয়ানে মুসলমানদের ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।  নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) প্রকল্প, কাশ্মিরের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তন, ওয়াকফ বিলের মাধ্যমে মুসলমানদের ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়সাধন ইত্যাদি মুসলমানদের অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আজকের হিন্দুত্ববাদী ভারত পুরোপুরি মুসলিম বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির প্রতিষ্ঠা ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম স্থাপনা ধ্বংস করা, শিক্ষানীতি ও পাঠ্যবইয়ে মুসলিমবিদ্বেষ অন্তর্ভুক্ত করা, মুসলিম নারীদের জোরপূর্বক বন্ধ্যাত্ববরণে বাধ্যকরণ, গরু রক্ষার নামে মুসলমানদের গণপিটুনির ঘটনা, হিজাব নিষিদ্ধকরণ এবং মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বৈষম্যমূলক আচরণ ইত্যাদি বর্তমান ভারতের মুসলিম বিদ্বেষের উদাহরণ। সর্বোপরি, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ভারতের মুসলমানদেরকে দেশটির অভ্যন্তরে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলেছে। ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব হ্রাস পেয়েছে, তাদের আত্মপরিচয় সংকটে পড়েছে এবং তারা মানবাধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন। মুসলমানদের নাগরিকত্ব, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক অধিকার সবকিছুই হুমকির মুখে পড়েছে, যা তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।

ভারত তো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। অবিভক্ত ভারত ভেঙে মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান ও পরবর্তীতে সৃষ্ট মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আমাদের এই বাংলাদেশেও ইসলাম আশানুরূপ ভালো অবস্থানে নেই। পশ্চিমা মদদে ক্লাশ অব সিভিলাইজেশনের উপজাত হিসেবে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো ইসলাম বিদ্বেষের প্রভাব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উপরও বেশ প্রবল। ফলে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশ দুটো কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষে আক্রান্ত। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসন এবং অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন দেশটিকে দীর্ঘ সময় ধরে স্থবির করে রেখেছে। তদুপরি পশ্চিমা আধিপত্যের প্রতি নতজানু নীতির কারণে সেখানেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ইসলামবিদ্বেষের প্রতি প্রশ্রয় রয়েছে। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা দাবি করলেও স্বাধীনতার পর ভারতের মদদে এদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এদেশে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামবিদ্বেষ রগরগে ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতের সমর্থনপুষ্ট আওয়ামীলীগের পতনের পর রাষ্ট্রকাঠামোতে ইসলামবিদ্বেষ পূর্বের মতো পৃষ্ঠপোষকতা পাবে না বলে আশা করা হলেও সম্প্রতি নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনায় সে আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ইসলামবিদ্বেষের যে ছড়াছড়ি, এর প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গণে স্বকীয়তার জানান দেওয়া প্রয়োজন। সায়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) এর চিন্তা ও কর্ম এমন সংকট উত্তরণের বলিষ্ঠ পরামর্শ ও পথনির্দেশ নিয়ে হাজির হয়।

রায় বেরেলীর পীর সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) এর আন্দোলন ছিল সামগ্রিক দাওয়াত থেকে অবিচ্ছিন্ন, কিন্তু তা একই সাথে এটি ছিল বিপ্লবী ও সূফী মনোভাবাপন্ন। তাছাড়া এই আন্দোলন আরো বৃহৎ পরিসরে প্রবেশ করে একসময় ধর্মীয়-রাজনৈতিক প্রকৃতি গ্রহণ করেছিল। সায়্যিদ আহমদ (র.) তার সমাজ সংস্কার ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদ প্রচেষ্টার সাথে তাসাওউফের সমন্বয় সাধন করে অভূতপূর্ব দরদভিত্তিক এক দাওয়াত আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন। তার এই কর্মপন্থাকে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ‘Neo-Sufism’ কিংবা ‘Neo-Sufism par excellence’ হিসেবে শনাক্ত করেছেন। ইতিহাস বিশ্লেষক ড. মুইন উদ্দীন আহমদ খান বলেন- Tariqah-e-Muhammadiyah movement had taken its birth as a form of neo-Sufism aimed at bringing the Muslims back to the true path of Islam and purging Muslim society of un-Islamic customs and usages. (Tariqah-e-Muhammadiyah Movement: An Analytical Study by Dr. Muin-ud-Din Ahmad Khan)

সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) এর এমন সংস্কার ও রাষ্ট্রসাধনা ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে পুরো উপমহাদেশের মুসলমানের মধ্যে এক শক্তিশালী সংহতির জন্ম দিয়েছিল। ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়, তাঁর সংগ্রামের অংশী হওয়ার জন্য ভারতের সীমান্ত অঞ্চল হতে সুদূরে অবস্থিত বাংলার নারীরা নিজেদের অলংকার বিক্রি করে অনুদান পাঠিয়েছিলেন। (দি ইন্ডিয়ান মুসলমান্স, হান্টার)

সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) এর জিহাদ আন্দোলনের অন্যতম উজ্জ্বল একটি দিক হলো, তিনি জীবন দিয়ে উপমহাদেশের মুসলমানের কাছে ব্রিটিশ শাসনকে Rule of Enemies এবং আগ্রাসন হিসেবে শনাক্ত করে গেছেন। তাঁর প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও আত্মোৎসর্গের পর মুসলমানদের জন্য ব্রিটিশকে শাসক হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) জিহাদের ধারণা এর প্রকৃত ও মৌলিক অর্থে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন মুসলমানদের মধ্যে। তার এই সময়কাল বিবেচনা করলে দেখা যাবে, বিভিন্ন নেতা ও নৃপতি যখন নিজের উদ্দেশ্য উদ্ধারের জন্য দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে জিহাদ নামে আখ্যা দিয়ে ইসলামের একটি অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়কে ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করছে। সে সময়েই সায়্যিদ আহমদের শরঈ নির্দেশনা অনুসৃত জিহাদ, মুসলিম সমাজে জিহাদের একটি আদি স্কেচ এঁকে রেখেছে। আমরা দেখি, পশ্চিমা আধুনিকতা উৎপাদিত জ্ঞানতাত্ত্বিক উপনিবেশায়নের মারফতে বিশ্বব্যাপী জিহাদের যে চিত্র প্রচার করা হয়েছে এবং ১/১১ এর পরে যেটি আরো বর্ধিত মাত্রায় বেগবান হয়েছে, বালাকোটের জিহাদের রূপ ও ধরণ এসব মিথ্যাচারকে দারুণভাবে মুকাবিলা করে প্রতিহত করতে সক্ষম। কতিপয় বুদ্ধিবৃত্তিক দাস ছাড়া এই উপমহাদেশের সব মুসলমানের কাছে জিহাদ তার নিজস্ব ধরণেই অবিকৃতভাবে পরিচিত। সায়্যিদ আহমদ বেরলভীর অভূতপূর্ব সাহসিকতার মাধ্যমে জিহাদের যে দুর্দান্ত আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তা কেবল তার প্রতিপক্ষকেই নাড়া দেয়নি, বরং তার ইন্তিকালের পরেও ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের ঘরদোরকে পর্যন্ত স্পর্শ করে গেছে।

আজকে ভারতে যে হিন্দুত্ববাদী সহিংসতার আড়ম্বর প্রস্তুতি, সেখানে আমরা দেখতে পাই আরএসএস কর্মীদেরকে সামরিকভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের “শত্রু” হিসেবে চিহ্নিত করা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক ধরনের মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি বৈরিতার আবহ তৈরি করতে এবং হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রগঠনের লক্ষ্যে তারা এমন সংগঠিত সহিংসতার আয়োজন করছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা এক ধরনের মিলিটারাইজড (সামরিকীকৃত) রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। এমতাবস্থায় মুসলিম প্রতিরোধ হিসেবে জিহাদের ধারণার তাজা স্মৃতি হয়ে সামনে আসে বালাকোট। দ্বীনের জন্য, ন্যায়ের জন্য হাসতে হাসতে মরে যাওয়া এবং প্রয়োজনে ভেঙ্গে গেলেও মচকে না যাওয়ার বীরোচিত চেতনা সরবরাহ করে বালাকোট। এ দিক থেকেও সায়্যিদ আহমদ বেরলভীর কর্মপ্রয়াসে এই অঞ্চলে মুসলমানের জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

এ কালে মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত যে ইসলামী রাজনীতি, এর বহুলাংশই জামালুদ্দীন আফগানীর ‘প্যান ইসলামজম’ থেকে অনুপ্রাণিত। প্যান ইসলামিজম চিন্তা গঠনে আফগানীকে উদ্বুদ্ধ করেছে সায়্যিদ আহমদ শহীদের জীবনালেখ্য। আফগানীর জীবনী গবেষক আমেরিকান অধ্যাপক Nikki R. Keddie লিখেন– জামালুদ্দীন আফগানী ভারতে সায়্যিদ আহমদ বেরলভীর বৈপ্লবিক কার্যক্রম ও চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হোন। সায়্যিদ আহমদের চিন্তাভাবনা তাকে পাশ্চাত্যবিমুখ করে তোলে এবং একই সাথে তা তাকে সমসাময়িক ইসলামের সংকটগুলোকে বাস্তবতার সাথে বিচার- বিশ্লেষণে উদ্বুদ্ধ করে। (An Islamic Response to Imperialism: Political and Religious Writings of Sayyid Jamal-ud-Din ‘al-Afghani by Nikki R. Keddie)

যদিও বালাকোটের মহান যোদ্ধা, সায়্যিদ আহমদ শহীদের দেখিয়ে যাওয়া আপোসকামিতামুক্ত ও উন্নতশির রাজনীতির সাথে সমসাময়িক ইসলামী রাজনীতির বেশ কিছু অসামঞ্জস্য রয়েছে, তা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, মুসলিম বিশ্বের প্রচলিত ইসলামী রাজনীতিকে এখনো আলো দিয়ে যাচ্ছে তাঁর পুনরুজ্জীবনচিন্তা ও জিহাদ আন্দোলন। তিনি তাসাওউফ, তাজদীদ ও জিহাদ– এই বৈশিষ্ট্যত্রয়ের মারফতে এ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণের সাথে শিকড়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের মধ্যে যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, তা এ অঞ্চলের বর্তমান ভৌগোলিক ভাগ-বিভাজন সত্ত্বেও এখানকার মুসলমানদের অস্তিত্বের সংগ্রামে দরকারি জনসংহতি গঠনের উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছে এখনো। একবিংশ শতকে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম নিধনের প্রতিশ্রুতিতে ভারতে গর্জে ওঠা লোমহর্ষক সহিংস মতবাদ হিন্দুত্ববাদের মুকাবিলার জন্য, নিজের কর্ম ও চিন্তার মাধ্যমে ঊনবিংশ শতকেই কর্মকৌশল প্রণয়ন করে রেখে গেছেন ‘রায় বেরেলীর জঙ্গী পীর’ সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি রাহমাতান ওয়াসিআহ)

ফেইসবুকে আমরা...