কুরবানী শব্দের অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন, নৈকট্যলাভ ইত্যাদি। ফিকহের পরিভাষায় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে উদ্বহিয়্যাহ বা কুরবানী বলা হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল যুগে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সকল শরীআতেই কুরবানীর বিধান বিদ্যমান ছিল। তবে তা আদায়ের পন্থা এক ছিল না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
-وَلِكُلِّ أُمَّةٍۢ جَعَلْنَا مَنسَكًا لِّيَذْكُرُواْ ٱسْمَ ٱللهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلْأَنْعَٰمِ
-আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছি। আল্লাহ তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুস্পদ জন্তু দিয়েছেন সেগুলোর উপর যেন তারা (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। (সূরা হাজ্জ, আয়াত-৩৪)
নেক আমলসমূহের মধ্যে কুরবানী অন্যতম আমল। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি গুরুত্ব সহকারে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। সামর্থবান নর-নারীর উপর এটি ওয়াজিব। এটি মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কুরবানী তরক করেননি বরং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করে না এরূপ ব্যক্তিকে কঠোর সতর্ক করেছেন।
আলোচ্য নিবন্ধে কুরবানীর কতিপয় জরুরি মাসাঈল সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পাব, যাতে করে কুরবানী সংক্রান্ত বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত হয়ে এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা সম্ভব হয়।
কুরবানী করা সামর্থবানদের উপর ওয়াজিব
মহান আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর কুরবানী ওয়াজিব করে দিয়েছেন। কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার দলীল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
-فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنْحَرْ
-সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায আদায় করুন এবং পশু কুরবানী করুন। (সূরা কাওসার, আয়াত-০২)
আয়াতের আলোকে উলামায়ে কিরাম বলেন, কুরবানী ওয়াজিব। তাছাড়া হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
عن أبي هريرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: مَن كان له سَعَة، ولمْ يُضَحِّ، فلا يَقْرَبَنّ مُصَلّانا (رواه ابن ماجه وأحمد)
-হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। (ইবনু মাজাহ, মুসনাদ আহমদ)
যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদীস একটি সতর্কবাণী। যদি কুরবানী করা সুন্নাত বা নফল হত অথবা ঐচ্ছিক কোন বিষয় হত তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ ধমকের দ্বারা উম্মতকে সাবধান করতেন না। এরূপ ধমক সুন্নাতের ক্ষেত্রে আসে না, কেবল ওয়াজিবের ক্ষেত্রেই আসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
عَنْ مِخْنَفِ بْنِ سُلَيْمٍ قَالَ كُنَّا وُقُوفًا عِنْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم بِعَرَفَةَ فَقَالَ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِى كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّةً وَعَتِيرَةً. (رواه ابن ماجه)
-হযরত মিখনাফ বিন সুলাইম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আরাফার ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে বসা অবস্থায় ছিলাম এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে মানব সকল! প্রত্যেক পরিবারের উপর আবশ্যক হল প্রতি বছর কুরবানী ও আতীরা আদায় করা। (আতীরা হলো রাজাবিয়্যাহ অর্থাৎ রজব মাসের প্রথম দিকে যে পশু জবাই করা হয় তাকে আতীরা বলা হয়। এটির বিধান পরবর্তীতে রহিত হয়েছে।) (ইবনু মাজাহ, বাবুল আদাহী ওয়াজিবাতুন হিয়া আম লা)
উপরোক্ত পবিত্র কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার আলোকে ইমাম আযম আবূ হানীফাসহ ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম যুফার, ইমাম রাবীয়া, ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস বিন সাআদ, সুফিয়ান সাওরী প্রমুখের মতে এবং ইমাম আবূ ইউসুফ, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ (র.) থেকে বর্ণিত একটি মতানুসারে কুরবানী ওয়াজিব। ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ এর অপর মতানুসারে এবং ইমাম শাফিঈ (র.) এর মতে কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। কিন্তু তারা আবার বলেন, সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানী পরিত্যাগ করা মাকরূহ। যদি কোনো জনপদের লোকেরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কুরবানী পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানী হল ইসলামের একটি শিআর বা মহান নিদর্শন।
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাযহাব অস্বীকারকারী ব্যক্তির বক্তব্য পাওয়া যায় যে, সম্পদশালী হওয়ার পরেও যদি কুরবানী না করে তবে তার কোন পাপ হবে না। কুরবানী হচ্ছে নেকীর কাজ, করলে নেকী পাবে, না করলে পাবে না। এমনকি কোটিপতিও যদি কুরবানী না দেয় কোন সমস্যা নেই। এরূপ বক্তব্য স্পষ্টত ভ্রান্ত, পথভ্রষ্টতা এবং গোমরাহী। এ বক্তব্য দ্বারা পক্ষান্তরে কুরআন কারীমের আয়াত ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনেক হাদীসকে অস্বীকার করা হয়ে থাকে।
কুরবানীর পরিবর্তে সাদকাহ দেওয়া
কুরবানী না করে তার সমপরিমাণ টাকা সাদকাহ করে দিলে কুরবানী আদায় হবে না। কুরবানী ব্যতীত অন্যান্য কোন সাদকাহ কুরবানীর সমকক্ষ হবে না। এমনকি কেউ যদি একটি জীবিত বকরী অথবা এর মূল্য কুরবানীর দিনসমূহে কাউকে দান করে দেয় তবুও তার উপর থেকে কুরবানীর আবশ্যকতা রহিত হবে না, তাকে অবশ্যই কুরবানী করতে হবে যেহেতু এটা তার উপর ওয়াজিব। আর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে সম্পর্কিত। কুরবানী অন্যান্য সকল সাদকাহ হতে উত্তম, কেননা ইহা ইসলামের অন্যতম একটি নিদর্শন এবং ওয়াজিব আমল।
কুরবানী যাদের উপর ওয়াজিব
জীবিকা নির্বাহের আবশ্যকীয় উপকরণ যেমন- বসবাসের ঘর, পরিধেয় বস্ত্র, খাদ্য দ্রব্য এবং ঘরের সরঞ্জামাদি ও অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যতীত ঋণ আদায়ের পর কোন স্বাধীন, জ্ঞানবান, প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর-নারী যদি সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) অথবা সাড়ে সাত ভরি সোনা (প্রায় ৮৮ গ্রাম) কিংবা এর যে কোনো একটির সমমূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসায়িক মাল বা অন্যান্য সম্পদের মালিক হয় তবে এ মালকে শরীআতের পরিভাষায় যাকাতের নিসাব বলা হয়। এক্ষেত্রে বর্তমান হিসাবে যেহেতু স্বর্ণের মূল্য থেকে রৌপ্যের মূল্য অনেক কম সেহেতু রৌপ্যের মূল্যই ধর্তব্য হবে। যদি কারো নিকট কিছু পরিমাণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবসার মাল, নগদ টাকা, স্বর্ণ ও রৌপ্য থাকে এবং কোনটাই পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না হয় তবে এগুলোর সম্মিলিত মূল্য যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মূল্যের সমপরিমাণ হয় (বর্তমান বাজারমূল্যে এটি ৫০ হাজার টাকা প্রায়) তবে এতে নিসাব পূর্ণ হবে।
যে ব্যক্তি উপরে উল্লিখিত পরিমাণ মালের মালিক তাকে মালিকে নিসাব বা সাহিবে-নিসাব বলা হয়। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। অবশ্য এ মাল ঋণমুক্ত এবং তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে হবে। যে ব্যক্তি ১০ যিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ যিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এ পরিমাণ মালের মালিক থাকবে তার উপর তার নিজের পক্ষ হতে কুরবানী আদায় করা আবশ্যক। কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য যাকাতের অনুরূপ নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং কেবল ১০ যিলহজ্ব থেকে ১২ যিলহজ্ব পর্যন্ত যে কোনো দিন উপরোক্ত পরিমাণ মালের মালিক থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে। যার উপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব, তার উপর কুরবানীও ওয়াজিব।
একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকের কাছে পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের উপর ভিন্ন ভিন্ন কুরবানী ওয়াজিব। পরিবারের যত সদস্যের উপর কুরবানী ওয়াজিব তাদের প্রত্যেককেই একটি করে পশু কুরবানী করতে হবে কিংবা বড় পশুতে পৃথক পৃথক অংশ দিতে হবে। একটি কুরবানী সকলের জন্য যথেষ্ট হবে না। কুরবানী শুধু নিজের পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয়। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্ততি বা যে সকল সম্পদশালী ব্যক্তি তাদের খাদেম বা চাকর বাকরের পৃষ্ঠপোষকতা ও ভরণ-পোষণ করেন তাদের পক্ষ থেকে অথবা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে একজন সম্পদশালী হলে অন্য জনের পক্ষ হতে বা সন্তান তার মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব নয়। কোন মহিলাকে দেওয়া নগদ মোহর যদি নিসাব পরিমান হয় তবে ঐ মহিলার উপর কুরবানী ওয়াজিব। কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানী করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানী করা যাবে না। যেসকল হাজী কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তাদের উপর ঈদুল আদহার কুরবানী ওয়াজিব নয়। কিন্তু যে হাজী কুরবানীর কোনো দিন মুকীম থাকবে সামর্থ্যবান হলে তার উপর ঈদুল আদহার কুরবানী করা জরুরি হবে। এটি সে নিজ এলাকায়ও করতে পারবে। কুরবানী করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কুরবানী করা সহীহ নয় এবং এক্ষেত্রে অন্য শরীকদের কুরবানীও সহীহ হবে না।
নাবালিগ, দরিদ্র ব্যক্তি ও মুসাফিরের জন্য কুরবানী
অপ্রাপ্তবয়স্কদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। নাবালিগ শিশু এবং যে ব্যক্তি সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, এমন ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে না। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানী করলে তা সহীহ হবে। নাবালিগের পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া অভিভাবকের উপর ওয়াজিব নয়; বরং মুস্তাহাব। যদি কেউ সন্তানের পক্ষ থেকে কুরবানী করতে চায়, তবে তা নফল কুরবানী হিসাবে ধর্তব্য হবে। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্কের সম্পদ থেকে কিছুতেই কুরবানী হবে না।
দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও যদি কেউ কুরবানী করতে পারে, তবে সাওয়াব পাবে। দরিদ্র ব্যক্তি যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু ক্রয় করে তাহলে তার উপর এ পশু কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
যে ব্যক্তি কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে (অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করে) তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। কুরবানীর সময়ের প্রথম দিকে মুসাফির থাকার পরে ৩য় দিন কুরবানীর সময় শেষ হওয়ার পূর্বে মুকীম হয়ে গেলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। যদি কোন ব্যক্তি কুরবানীর পশু ক্রয় করার পর কুরবানীর দিনসমূহের মধ্যে সফরে বের হয়ে যায় তবে সফরের অবস্থায়ই তাকে কুরবানী করতে হবে।
কুরবানীর মেয়াদকাল ও কুরবানী করার উত্তম সময়
কুরবানী নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানী আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না। কুরবানীর সময়কাল মাত্র তিনদিন। এ দিনগুলো হলো- ১০, ১১ ও ১২ই যিলহজ্জ। উক্ত দিনগুলোর মধ্যে প্রথম দিন অর্থাৎ ১০ই যিলহজ্জ কুরবানী করা অধিক উত্তম। এরপর দ্বিতীয় দিন, এরপর তৃতীয় দিন। তবে এই তিন দিনের যে দিন ইচ্ছা কুরবানী করা যাবে। অতএব কোন কারণ ব্যতিত বিলম্ব না করা উত্তম। কুরবানীর তিনদিনের মধ্যে যে দুটি রাত অন্তর্ভুক্ত, সেই দুই রাতে অর্থাৎ ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতেও কুরবানী করা জায়িয। তবে দিনে কুরবানী করাই ভালো। রাতের বেলা জবাই করতে আলো স্বল্পতার দরুণ জবাইয়ে ত্রুটি হতে পারে বিধায় রাতে জবাই করা অনুত্তম। তবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে কোনো অসুবিধা নেই। কুরবানীদাতা এক স্থানে আর কুরবানীর পশু ভিন্ন স্থানে থাকলে কুরবানীদাতার ঈদের নামায পড়া বা না পড়া ধর্তব্য নয়; বরং পশু যে এলাকায় আছে ওই এলাকায় ঈদের জামাআত হয়ে গেলে পশু জবাই করা যাবে।
প্রথম দিন কখন থেকে কুরবানী করা যাবে
যেসব এলাকার লোকদের উপর ঈদের নামায ওয়াজিব তাদের জন্য প্রথম দিন ১০ই যিলহজ্জ ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করা জায়েয নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামায পড়া না হয় তাহলে ঈদের নামাযের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কুরবানী করা জায়িয। প্রথম দিন কখন থেকে কুরবানী করা যাবে এ বিষয়ে সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয় কিতাবে হযরত বারা বিন আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ আছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ الصَّلَاةِ فَإِنَّمَا يَذْبَحُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلَاةِ فَقَدْ تَمَّ نُسُكُهُ وَأَصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِينَ
-যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানীর পশু জবাই করবে সেটা তার নিজের জন্য সাধারণ জবাই হবে। আর যে নামায ও খুতবার পর জবাই করবে তার কুরবানী পূর্ণ হবে এবং সে-ই মুসলমানদের রীতি অনুসরণ করেছে। (সহীহ বুখারী, বাবুন ফী উদ্বহিয়্যাতিন নাবীয়্যি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম… ও সহীহ মুসলিম, কিতাবুল আদ্বাহী বাবু ওয়াকতিহা)
যথাসময়ে কুরবানী করতে না পারলে
কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সাদকাহ করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করে ছিল, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া হয়নি তাহলে ঐ পশু জীবিত সাদকাহ করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সাদকাহ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তাও সাদকাহ করতে হবে।
কুরবানীর পশুর বিবরণ ও বয়সসীমা
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, বকরী, পাঠা, খাসি, ভেড়া ও দুম্বা এ ধরনের গৃহপালিত পশু দ্বারা কুরবানী করতে হবে। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্য কোনো পশু যেমন হরিণ, বন্য গরু ও অন্যান্য হালাল বন্যপশু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী আদায় হবে না। তদ্রুপ হাঁস-মুরগি বা কোনো পাখি দ্বারাও কুরবানী জায়িয নয়। কুরবানীর দিনে মোরগ জবাই করা নিষেধ নয়, তবে কুরবানীর নিয়তে করা যাবে না। গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হল কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত ও দেখতে সুন্দর হওয়া। যেসব পশু কুরবানী করা জায়িয সেগুলোর নর-মাদী উভয় প্রকার দিয়েই কুরবানী করা যায়। খাসী দ্বারাও কুরবানী করা বৈধ। যে পশুটি কুরবানী করা হবে তার উপর কুরবানীদাতার পূর্ণ মালিকানা সত্ত্ব থাকতে হবে। আমানতের পশু, বন্ধকি পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু দ্বারা কুরবানী আদায় হবে না। চোর হতে চুরির পশু খরিদ করে তা দ্বারা কুরবানী করা জায়িয নেই। যে সকল পশুর নাপাকী খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে সে গুলোকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বেঁধে না রেখে কুরবানী দেওয়া জায়িয নেই। এ জাতীয় উট চল্লিশ দিন, গরু ও মহিষ বিশ দিন এবং বকরী দশ দিন বেঁধে রাখতে হবে এরপর কুরবানী করতে হবে।
উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। এর থেকে এক দিন কম হলেও তা দ্বারা কুরবানী সহীহ হবে না। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া যদি এক বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে এক বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়িয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ছয় মাস বয়সের হতে হবে। হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে-
-عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم:لاَ تَذْبَحُوا إِلاَّ مُسِنَّةً إِلاَّ أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ الضَّأْنِ
-হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা (কুরবানীর জন্য) মুসিন্নাহ ব্যতীত জবাই করো না। (মুসিন্নাহ হলো এক বছর বয়সী ছাগল যেটি দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছে, দুই বছর বয়সী গরু যেটি তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছে এবং পাঁচ বছর বয়সী উট যেটি ষষ্ঠ বর্ষে পদার্পণ করেছে) তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের থেকে বেশী বয়স্ক মেষ শাবক কুরবানী করতে পার। (সহীহ মুসলিম, বাবু সিন্নিল উদ্বহিয়্যাতি)
উল্লেখ্য, ছাগল যত মোটা তাজাই হোকনা কেন এর বয়স এক বছর থেকে এক দিন কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়িয হবে না। কোনো পশু দেখতে পূর্ণবয়স্ক মনে হয়, অথচ প্রকৃতভাবে এর বয়স পূর্ণ হয়নি এ ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা সহীহ হবে না। তবে কোনো পশু দেখতে কম বয়স্ক মনে হয় কিন্তু আসলে তার বয়স পুরো হয়ে গেছে এ ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা সহীহ হবে। যদি বিক্রেতা কুরবানীর পশুর বয়স পূর্ণ হয়েছে বলে স্বীকার করে আর পশুর শরীরের অবস্থা দেখেও তাই মনে হয় তাহলে বিক্রেতার কথার উপর নির্ভর করে পশু কেনা এবং তা দ্বারা কুরবানী করা যাবে।
এক পশুতে কয়েকজন শরীক হয়ে কুরবানী
একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারো কুরবানীই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে-
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ- (رواه مسلم)
-হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা হুদাইবিয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছি। (সহীহ মুসলিম, বাবুল ইশরাকি ফীল হাদয়ী…)
উল্লেখ্য যে ইমাম তিরমিযী (র.) উক্ত হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন,
هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ وَالْعَمَلُ عَلَى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَغَيْرِهِمْ وَهُوَ قَوْلُ سُفْيَانَ الثَّوْرِىِّ وَابْنِ الْمُبَارَكِ وَالشَّافِعِىِّ وَأَحْمَدَ وَإِسْحَاقَ
হাদীসটি হাসান ও সহীহ, আর শরীক হয়ে কুরবানী করার এ বিষয়টি আহলে ইলম তথা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবায়ে কিরাম ও অন্যান্যদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এটি সুফিয়ান সাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক, ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমদ ও ইসহাক (র.) এর অভিমত।
এ বিষয়ে হাদীসের কিতাবসমূহে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যা থেকে বুঝা যায়, কয়েকজন মিলে শরীক হয়ে কুরবানী করার এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত এবং এটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনা। এর উপর আমল করে আসছেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবায়ে কিরাম ও যুগে যুগে তাদের অনুসারী প্রায় সকল মাযহাবের ইমাম ও মুজতাহিদগণ। এটিই হযরত আলী, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আয়িশা (রা.) এর অভিমত, আর এটিই হচ্ছে ইমাম আযম আবূ হানীফা, ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমাদ, সুফিয়ান সাওরী, আওযাঈ, হাসান বসরী, আমর বিন দিনার, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক, ইসহাক, সালিম, আতা, তাউস (র.) এর অভিমত।
কোন ব্যক্তি যদি দাবী করেন,একটা গরুতে সাত ভাগ হওয়ার ব্যাপারে কোন হাদীস নেই’ তবে এরূপ বক্তব্য স্পষ্ট গোমরাহী। এ বক্তব্য দ্বারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনেক হাদীসকে শুধু অস্বীকার করা হয়নি বরং সাহাবায়ে কিরাম ও উম্মতে মুসলিমার বিখ্যাত ইমাম ও মুজতাহিদগণকে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে।
সাতজনে মিলে কুরবানী করলে কুরবানী জায়িয হওয়ার জন্য শর্ত হলো কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড়ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না। যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী সহীহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীক নির্বাচন করতে হবে। শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কুরবানী দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয় তাহলে ইচ্ছা করলে অন্যকে শরীক করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে একা কুরবানী করাই শ্রেয়। শরীক করলে সে টাকা সাদকাহ করে দেওয়া উত্তম। আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরীব হয়, যার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়, তাহলে যেহেতু কুরবানীর নিয়তে পশুটি ক্রয় করার মাধ্যমে লোকটি তার পুরোটাই আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে তাই তার জন্য এ পশুতে অন্যকে শরীক করা জায়িয নয়। এমন গরীব ব্যক্তি যদি কাউকে শরীক করতে চায় তাহলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিবে। কয়েকজন মিলে কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়িয হবে। নতুবা ওই শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে।
কুরবানীর পশুতে আকীকা ও হজ্জের কুরবানীর নিয়তে শরীক হওয়া
এক কুরবানীর গরু, মহিষ বা উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এক বা একাধিক আকীকাও করা যেতে পারে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে। অনুরূপভাবে এক কুরবানীর পশুতে আকীকা ও হজ্জের কুরবানীর নিয়তও করা যাবে। এতে প্রত্যেকের নিয়তকৃত ইবাদত আদায় হয়ে যাবে তবে এ পশু হেরেম এলাকায় জবাই করতে হবে। অন্যথায় হজ্জের কুরবানী আদায় হবে না।
শৈশবে আকীকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকীকা করা যাবে। যার আকীকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকীকার গোশত খেতে পারবে। কেউ কেউ কুরবানীর পশুর সাথে আকীকা দিলে আকীকা সহীহ হবে না বলে মত দেন, কিন্তু নির্ভরযোগ্য আলিমগণ এ মতটি গ্রহণ করেননি। কোনো হাদীসে কুরবানীর সাথে আকীকা করতে নিষেধ করা হয়নি; বরং কুরবানীর সাথে হজ্জের কুরবানী, জরিমানা দম একত্রে এক পশুতে দেওয়ারও প্রমাণ আছে। অর্থাৎ কুরবানীর পশুতে অন্য ইবাদতের নিয়তে শরীক হওয়া জায়িয। সুতরাং আকীকার নিয়তে শরীক হওয়াও জায়িয। আতা ইবনে আবী রাবাহ (রা.) বলেন, উট-গরু সাতজনের পক্ষ হতে কুরবানী হতে পারে। আর এতে শরীক হতে পারে কুরবানীকারী, তামাত্তু হজ্জকারী এবং হজ্জের ইহরাম গ্রহণের পর হজ্জ আদায়ে অপারগ ব্যক্তি। এছাড়া ফাতাওয়ায়ে শামীসহ অন্যান্য কিতাবাদিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কুরবানীর সাথে আকীকা সহীহ। (রদ্দুল মুহতার, হাশিয়াতুত তাহতাবী)
রুগ্ন, খোড়া, দুর্বল, ত্রুটিযুক্ত, গর্ভবতী ও খাসীকৃতপশু কুরবানীর হুকুম
যে পশু তিন পায়ে চলে, এক পা মাটিতে রাখতে পারে না বা ভর করতে পারে না এমন পশুর কুরবানী জায়েয নয়। এমন শুকনো দুর্বল পশু, যা জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না তা দ্বারা কুরবানী করা জায়িয নয়। যে পশুর একটি দাঁতও নেই বা এতো বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না এমন পশু দ্বারাও কুরবানী করা জায়িয নয়। অধিকাংশ দাঁত না থাকলেও যে কয়টি দাঁত আছে তা দ্বারা যদি ঘাস চিবিয়ে খেতে পারে তবে সেটি দ্বারা কুরবানী সহীহ। যে পশুর শিং একেবারে গোড়া থেকে ভেঙ্গে গেছে, যে কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়িয নয়। পক্ষান্তরে যে পশুর অর্ধেক শিং বা কিছু শিং ফেটে বা ভেঙ্গে গেছে বা শিং একেবারে উঠেইনি সে পশু কুরবানী করা জায়িয। যে পশুর লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তারও বেশি কাটা সে পশুর কুরবানী জায়িয নয়। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তাহলে তার কুরবানী জায়িয। তবে জন্মগতভাবেই যদি কান ছোট হয় তাহলে অসুবিধা নেই। হযরত আলী (রা.) বলেন, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন, আমরা যেন কুরবানীর পশুর চোখ ও কান ভালো করে দেখে নিই এবং কান কাটা, কান ছেঁড়া বা কানে গোলাকার ছিদ্র করা পশু দ্বারা কুরবানী না করি। (মুসনাদে আহমদ, ১/৮০; সুনানে আবু দাউদ, ২৮০৪)
যে পশুর দুটি চোখই অন্ধ বা এক চোখ পুরো নষ্ট সে পশু কুরবানী করা জায়িয নয়। কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদীসে এসেছে-
وَعَنِ اَلْبَرَاءِ بنِ عَازِبٍ رَضِيَ اَللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: قَامَ فِينَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: أَرْبَعٌ لَا تَجُوزُ فِي اَلضَّحَايَا: اَلْعَوْرَاءُ اَلْبَيِّنُ عَوَرُهَا, وَالْمَرِيضَةُ اَلْبَيِّنُ مَرَضُهَا, وَالْعَرْجَاءُ اَلْبَيِّنُ ظَلْعُهَا وَالْكَسِيرَةُ اَلَّتِي لَا تُنْقِي-(رواه أبو داود، والنسائي، والترمذي)
-হযরত বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন অতপর বললেন, ‘চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কুরবানী জায়িয হবে না। অন্ধ; যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু; যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত; যার কোনো অঙ্গ ভেঙ্গে গেছে। (আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী)
খাসিকৃত ছাগল দ্বারা কুরবানী করা জায়িয। পাগল পশু কুরবানী করা জায়েয। তবে যদি এমন পাগল হয় যে, ঘাস পানি দিলে খায় না এবং মাঠেও চরে না তাহলে সেটার কুরবানী জায়িয হবে না। বন্ধ্যা পশুর দ্বারা কুরবানী করা জায়িয। গর্ভবতী পশু কুরবানী করা জায়িয। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কুরবানী করা মাকরূহ। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে। কুরবানীর নিয়তে ভালো পশু কেনার পর যদি তাতে এমন কোনো দোষ দেখা দেয় যে কারণে কুরবানী জায়িয হয় না তাহলে ওই পশুর কুরবানী সহীহ হবে না। এর স্থলে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবে। তবে ক্রেতা তুলনামূলক গরীব হলে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাই কুরবানী করতে পারবে।
কুরবানীর পশু হারিয়ে গেলে, চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে
কুরবানীর পশু যদি হারিয়ে যায়, চুরি হয়ে যায় বা মরে যায় আর কুরবানীদাতার উপর পূর্ব থেকে কুরবানী ওয়াজিব থাকে তাহলে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবে। গরীব হলে (যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়) তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানী করা ওয়াজিব নয়।
কুরবানীর পশু হারিয়ে যাওয়ার পরে যদি আরেকটি কেনা হয় এবং পরে হারানোটিও পাওয়া যায় তাহলে কুরবানীদাতা ধনী হলে দুটির একটি কুরবানী করলেই চলবে। তবে দুটি কুরবানী করাই উত্তম। উল্লেখ্য যে, গরীব ব্যক্তির ক্রয়কৃত পশু হারিয়ে গেলে তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানী করা আবশ্যকীয় নয়, তারপরও যদি সে আরেকটি পশু কুরবানীর জন্য কিনে ফেলে তবে সেটি জবাই করা জরুরি হয়ে যায় এবং হারানোটি পাওয়া গেলে তাও জবাই করতে হবে। তবে যদি গরীব ব্যক্তি দ্বিতীয় পশু খরিদ করার সময় এ নিয়ত করে যে, যে পশুটি হারানো গেছে তার বদলে এটি খরিদ করছি, তাহলে একটিই যথেষ্ট হবে।
জবাইয়ের আগে কুরবানীর পশু থেকে উপকৃত হওয়া
কুরবানীর পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। যেমন হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি। সুতরাং কুরবানীর পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সাদকাহ করে দিবে। কুরবানীর পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাইয়ের সময় আসন্ন হয় আর দুধ দোহন না করলে পশুর কষ্ট হবে না বলে মনে হয় তাহলে দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেবে। এতে দুধের চাপ কমে যাবে। যদি দুধ দোহন করে ফেলে তাহলে তা সাদকাহ করে দিতে হবে। নিজে পান করে থাকলে মূল্য সাদকাহ করে দিবে। কুরবানীর পশু বাচ্চা দিলে ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সাদকাহ করে দেওয়া উত্তম। যদি সাদকাহ না করে তবে কুরবানীর পশুর সাথে বাচ্চাকেও জবাই করবে এবং গোশত সাদকাহ করে দিবে। কুরবানীর পশু বিক্রয় করা উচিত নয়। যদি কেউ বিক্রয় করে কম মূল্যে অন্য পশু খরিদ করে কুরবানী করে তবে বিক্রিত পশু থেকে যা লাভ আসবে তা সাদকাহ করে দিতে হবে।
অন্যের পক্ষ থেকে কুরবানী
মৃতের পক্ষ থেকে ঈসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানী করা জায়িয বরং সাওয়াবের কাজ। এতে মৃতের রূহে সাওয়াব পৌঁছে। কুরবানী একটি সাদকাহ। আর মৃত ব্যক্তির নামে যেমন সাদকাহ করা যায় তেমনি তার নামে কুরবানীও দেওয়া যায়। কুরবানীর দিনে মৃত ব্যক্তির জন্য টাকা পয়সা সাদকাহ করার চেয়ে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে সাওয়াব পৌঁছানো উত্তম। সম্পদশালী ব্যক্তি পশু খরিদ করে যদি মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করে দেয় তাতে মৃত ব্যক্তি সাওয়াব পাবে কিন্তু এ দ্বারা তার নিজের কুরবানী আদায় হবে না। তাকে অন্য পশু কুরবানী করে তার নিজের ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে হবে। মৃত ব্যক্তি যদি ওসিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কুরবানী হিসেবে গণ্য হবে। কুরবানীর স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কুরবানীর ওসিয়ত করে গিয়ে থাকে তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরীব-মিসকীনদের মাঝে সাদকাহ করে দিতে হবে।
যেমনিভাবে মৃতের পক্ষ থেকে ঈসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানী করা জায়িয তদ্রুপ জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার ঈসালে সাওয়াবের জন্য নফল কুরবানী করা জায়িয। এ কুরবানীর গোশত দাতা ও তার পরিবারও খেতে পারবে। বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানী করা জায়িয।
অন্যের ওয়াজিব কুরবানী দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি নিলে এর দ্বারা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। নতুবা ওই ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকে কুরবানী করা
সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকে কুরবানী করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী (রা.) কে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসীয়ত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ থেকেও কুরবানী দিতেন।
জবাই সংক্রান্ত মাসআলা
ধারালো অস্ত্র দ্বারা কুরবানীর পশু জবাই করা উত্তম। কুরবানীর পশু নিজ হাতে জবাই করা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ষাটের অধিক উট নিজ হাতে কুরবানী করেছিলেন। পরে তিনি হযরত আলীকে ছুরি দিয়েছেন, তিনি বাকীগুলো কুরবানী করেছেন। যদি নিজে জবাই করতে না পারে, তবে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। মেয়েরা পর্দার ব্যাঘাত হয় বলে যদি সামনে উপস্থিত না থাকতে পারে, তবে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কুরবানী করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দুআ উচ্চারণ করা জরুরি নয়। শুধু মনে চিন্তা করে নিয়ত করে মুখে শুধু ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলে তার কুরবানীও জায়িয হবে। কিন্তু স্মরণে থাকলে জায়িয হলেও নিয়ত ও দুআ পড়া বেশি উত্তম। জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরীক হলে অনেক সময় জবাইকারীর জবাই পুরোপুরী সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানী সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ। এক পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই করবে না। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে প্রয়োজনের অধিক কষ্ট দিবে না।
কুরবানীর গোশত খাওয়া ও বণ্টন
কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর গোশত খাওয়া মুস্তাহাব। এ বিষয়ে নিম্নোক্ত দুটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা নির্দেশনা প্রদান করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ- [الحج]، فَإِذَا وَجَبَتْ جُنُوبُهَا فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ-[الحج]
-অতঃপর তোমরা উহা হতে আহার কর এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। (সূরা হাজ্জ, আয়াত-২৮),-যখন উহারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তোমরা উহা হতে আহার কর এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্থকে এবং সাহায্যপ্রার্থী অভাবগ্রস্থকে। (সূরা হাজ্জ, আয়াত-৩৬)
এছাড়াও নিম্নোক্ত হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা প্রদান করেন
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا ضَحَّى أَحَدُكُمْ فَلْيَأْكُلْ مِنْ أُضْحِيَّتِهِ- (أخرجه أحمد)
-হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি যখন কুরবানী করবে তখন সে যেন তার কুরবানীর গোশত আহার করে। (মুসনাদু আহমদ, মুসনাদু আবূ হুরাইরা)
ঈদুল আদহার দিন সম্ভব হলে সর্বপ্রথম নিজ কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নাত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নাত। এই সুন্নাত শুধু ১০ যিলহজ্জের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নাত নয়। কুরবানীর গোশত তিনদিনেরও অধিক জমিয়ে রেখে খাওয়া জায়িয। কুরবানীর গোশত ফ্রিজে রাখা বা প্রক্রিয়াজাত করে রাখা জায়িয। কুরবানীর গোশত হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীকে দেওয়া জায়িয। শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়িয নয়। কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনকে সাদকাহ করে দিবে এবং এক তৃতীয়াংশ দ্বারা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবে এবং অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ নিজের জন্য রাখবে। কুরবানীর গোশত গরীব ধনী সকলকে দান করতে পারবে। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। কুরবানীর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়িয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সাদকাহ করে দিতে হবে।
কুরবানীর চামড়া
কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজে ব্যবহার করতে পারবে। এটা দিয়ে মুসাল্লা বা চামড়ার পাত্র ইত্যাদি বানানো যাবে। এই চামড়া ধনী বা গরীব যে কাউকে হাদিয়া হিসাবেও দিতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিয়লব্ধ মূল্য পুরোটা সাদকাহ করা জরুরি। কুরবানীর পশুর চামড়া বিক্রি করলে মূল্য সাদকাহ করে দেওয়ার নিয়তে বিক্রি করবে। সাদকাহর নিয়ত না করে নিজের খরচের নিয়ত করা নাজায়িয ও গুনাহ। নিয়ত যাই হোক বিক্রিয়লব্ধ অর্থ পুরোটাই সাদকাহ করে দেওয়া জরুরি। কুরবানীর চামড়ার প্রাপ্য হল সমাজের গরীব মিসকিন, শুধুমাত্র যারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত। কুরবানীর চামড়ার টাকা দিয়ে মসজিদ, মাদরাসা, ঈদগাহ নির্মাণ করা বা মেরামত করা অথবা জনহিতকর কোন কাজ করা যেমন রাস্তাঘাট ও ব্রীজ নির্মাণ ও মেরামত জায়িয নেই।
কুরবানীর পশুর গোশত, চর্বি, হাড় ও পাকস্থলি বিক্রি
কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর গোশত, চর্বি, হাড় ও পাকস্থলি ইত্যাদি কোনো কিছু বিক্রি করা জায়িয হবে না। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সাদকাহ করে দিতে হবে। কুরবানীর মৌসুমে অনেক মহাজন কুরবানীর হাড় ক্রয় করে থাকে। টোকাইরা বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। এদের ক্রয়-বিক্রয় জায়িয। এতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে জেনে শুনে মহাজনদের জন্য কুরবানীদাতার কাছ থেকে ক্রয় করা বৈধ হবে না।
জবাইকারী বা কাজের লোককে পারিশ্রমিক
কুরবানীর পশু জবাই করে বা এ সংক্রান্ত অন্যান্য কাজে অংশগ্রহণ করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়িয। তবে জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে কুরবানীর পশুর গোশত, চামড়া বা কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। অবশ্য এ সময় ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো জবাইকারী বা কাজের লোকদেরকে গোশত খাওয়ানো যাবে। এবং নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসেবে গোশত বা তরকারী দেওয়া যাবে।