1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মালেক (র.): জীবনালেখ্য ও অবদান
আব্দুল্লাহ জুবায়ের
  • ৫ মে, ২০২১

[অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মালেক (র.) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্বানামধন্য অধ্যাপক ছিলেন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শী এ মহান শিক্ষাবিদ গতমাসের ৯ তারিখ ইন্তিকাল করেন। আমরা আল্লাহ তাআলার দরবারে তাঁর মাগফিরাত ও দরজা বুলন্দি কামনা করছি। -সম্পাদক]

আল্লাহ তাআলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এরপর মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম উম্মত করেছেন উম্মতে মুহাম্মদীকে। জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, মর্যাদা, সরলতা ও নিষ্কলুষতায় উম্মতে মুহাম্মদী এক অনন্য ভূষণে ভূষিত। এই উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যেই আরও নির্দিষ্ট কিছু মানুষ উচ্চতর মর্যাদায় আসীন। তাঁরা কুরআনের বাহক, খাদিম, শিক্ষক ও সমগ্র মানবজাতির হিদায়াতের আলোকবর্তিকা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অত্যন্ত প্রসিদ্ধ একটি হাদিস আমরা জানি- خَيْرُكُمْ مَّنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ -তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে নিজে কুরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মালেক (র.) ছিলেন তেমনই একজন ব্যক্তিত্ব। অসাধারণ বিদ্যা-বুদ্ধি আর চারিত্রিক সৌন্দর্য দিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলো ছড়িয়েছেন অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে। এমন স্তরের দ্বিতীয় আরেকজন আলিমকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এত দীর্ঘ সময় ধরে পেয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

এ মহান ব্যক্তিত্ব ১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার স্বরূপকাঠী থানার (বর্তমান বরিশাল জেলার নেছারাবাদ উপজেলা) মাগুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ মুসলেম আলী মিঞা এবং মা মোসাম্মাৎ সবুরা খাতুন।
শৈশব থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। মাতৃগৃহেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তিনি। ছারছীনা দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা ও যুগের অন্যতম আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব পীর নিছারুদ্দীন (র.) তখনও বেঁচে ছিলেন। বাড়ির পাশে মাদরাসা হওয়ায় প্রথমেই তিনি সেখানে ভর্তি হন।
অধ্যাপক আব্দুল মালেক স্যার পবিত্র কুরআনের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আল্লামা নিছারুদ্দীন (র.) কে। আল্লামা নিছারুদ্দীন (র.) নিজেই তাঁকে পবিত্র কুরআনের সবক দিয়েছিলেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মালেক ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬০ ও ১৯৬২ সালে যথাক্রমে দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল পাশ করেন। অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর হিসেবে তিনি সকল পরীক্ষাতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়াসহ বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান অর্জন করেন। এরই মধ্যে ১৯৬১ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৬৪ সালে যশোর বোর্ডের অধীনে ফজলুল হক কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। সে সময় শুধু অনার্স শ্রেণিতে একটি স্বর্ণপদক চালু ছিল। তিনি সে পদক লাভ করেন। এছাড়া আলাদাভাবে ১৯৭৩ সালে তিনি ফারসি ভাষাতেও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মালেক (র.) এমএ তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হবার পরই যোগ দেন শেরে বাংলার স্মৃতিবিজড়িত চাষারের ফজলুল হক কলেজে। সেখানে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে লেকচারার হিসেবে ১৯৬৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় দু’বছর কর্মরত ছিলেন।
এরপর ১৯৭০ সালের ১৯ আগস্ট তিনি প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অস্থায়ী লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। প্রথমবারের এই নিয়োগে তিনি ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ সাত মাসের মতো কর্মরত ছিলেন।
পরবর্তীতে তিনি ১১ আগস্ট ১৯৭১ থেকে ১৩ মার্চ ১৯৭২ পর্যন্ত কবি নজরুল সরকারি কলেজে প্রভাষক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ঐ সময় কলেজটির নাম ছিল ইসলামিয়া কলেজ।
এরপর ৪ এপ্রিল ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। আমৃত্যু তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া প্রয়োজন অনুসারে অলঙ্কৃত করেছিলেন বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৭৮ সালে সহকারী অধ্যাপক, ১৯৮৬ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ইতোমধ্যে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ আলাদা হয়ে গেলে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগকে বেছে নেন। ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অনারারি অধ্যাপক পদে কর্মরত ছিলেন।

জাতীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন
অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মালেক (র.) মূলত ছিলেন নির্ভৃতচারী জ্ঞানসাধক। জ্ঞানার্জন আর অর্জিত জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়া-এই দুটি বিষয়কে তিনি সারাজীবন গুরুত্বের সাথে আনজাম দিয়েছেন। এরপর দেশ, জাতি ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে তিনি বেশ কিছু প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেছেন। যেমন- চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাবি (১৯৯২-১৯৯৫)। আবাসিক শিক্ষক, জহুরুল হক হল, ঢাবি (১৯৮০-১৯৮৯)। সদস্য, সিলেকশন বোর্ড, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাবি। সদস্য, সিলেকশন বোর্ড, আরবি বিভাগ, রাবি। সদস্য, সিলেকশন বোর্ড, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাবি। সদস্য, সিলেকশন বোর্ড, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইবি। সদস্য, ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত কামিল মাদরাসা এডভাইজরি বোর্ড, পিরোজপুর।

গবেষণামূলক কার্যক্রম
অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মালেক (র.) রচিত ও সম্পাদিত বহু গ্রন্থ ও গবেষণাকর্ম রয়েছে। তন্মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ: ৪টি; প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ: ০৮; প্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ: ০২; প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রবন্ধ: ১৮।
তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তাফসীরে মাযহারী (১৩ খণ্ড) এর সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। এর বাইরে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ, সীরাতে ইবনে হিশাম ও আল হিদায়া এর সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। অধিকন্তু তিনি তাফসীরে রুহুল মাআনী ২য় ও ৩য় খণ্ড, তাফসীরে কাবীর ১ম খণ্ড, ইলাউস সুনান ৭ম খণ্ড, এবং আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৬ষ্ঠ খণ্ডের একক সম্পাদনা করেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামী বিশ্বকোষে তাঁর ২১ টি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ষষ্ঠ-দশম শ্রেণির ইসলাম শিক্ষা বই রচনার সাথে যুক্ত ছিলেন।

এ মহান জ্ঞানসাধক গত ৯ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার দিবাগত রাত ১০ টায় আল্লাহ তাআলার যিম্মায় চলে যান। তাঁর ইন্তিকালের ফলে ইসলামী জ্ঞানচর্চার আকাশে এক ধ্রুবতারা অদৃশ্য হয়েছে সত্য, এরপরও তিনি তাঁর লেখনী ও শিষ্যদের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।

স্যারের এই আনুষ্ঠানিক জীবন বৃত্তান্তের বাইরেও তাঁর ব্যক্তি জীবনের উপর আলোকপাত করা প্রয়োজন। কারণ শুধু আনুষ্ঠানিক পরিচয় দিয়ে ব্যক্তি সস্পর্কে খুব কমই জানা যায়। স্যারের সাথে এ নিবন্ধকারের সম্পর্ক দশ বছরের। এর মধ্যে অনেকটা ঘনিষ্ট যোগাযোগ পরবর্তী বছরগুলোতে। অনেকেই আছেন, যাদের সাথে স্যারের সম্পর্ক দীর্ঘ কয়েক যুগের। এরপরও স্যারের চরিত্রের নানা দিক খুবই সংক্ষেপে আমি নিজে যতটুকু বুঝেছি ও দেখেছি তুলে ধরছি:

সবার প্রথমেই আসে পাঠদানের কথা। এক্ষেত্রে অধ্যাপক আব্দুল মালেক স্যার পুরোনো যুগের আলিমদের রীতি অনুসরণ করতেন। অর্থাৎ পড়ানোর সময় সরাসরি মূল গ্রন্থ নিয়ে আসতেন সাথে করে। কোনো ধরনের নোট, গাইড বা বাংলা লেখা আনতেন না। এক হাতে মাইক্রোফোন মুখের কাছে ধরে অত্যন্ত দুর্বোধ্য বিষয়ও সাবলীলভাবে পড়িয়ে যেতেন। সাধারণত বিভাগের সবচেয়ে জটিল কিতাবটিই তাঁকে পড়াতে দেওয়া হতো। সবার আস্থা ছিল বলেই এমন ছিল। সবাই জানতেন এই কিতাব যথাযোগ্য হক আদায় করে তিনিই পড়াতে পারবেন।
বছর দুয়েক আগে তিনি নিবন্ধকারের কাছে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কাশশাফ আর পড়াবেন না। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, এখন আর শরীর আগের মতো সায় দেয় না। কারণ ৪০ মিনিটের একটি ক্লাসের জন্য তিনি দীর্ঘ সময় ধরে যে মুতাআলা করতেন, তা করার মতো সময় এখন আর পাচ্ছেন না।
তিনি কখনও নিজের জানাটাকে যথেষ্ট মনে করতেন না। দীর্ঘদিন ধরে কাশশাফ-বায়যাভীর মতো জটিল সব তাফসীর পড়িয়েও ভাবতেন, এই তাফসীরের আরও কোনো কোনো দিক হয়তো অজানা রয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের হক হয়তো আদায় হচ্ছে না। আমার তখন এই ভেবে আফসোস হচ্ছিল, স্যার যা পড়াচ্ছেন, তা ধারণ করার মতো যোগ্যতা কি শিক্ষার্থীদের আছে?
পাঠ্যগ্রন্থ যখন পড়াতেন, তখন তাঁর ভেতরকার অনুপম আখলাক, তাকওয়া, নবীপ্রেম ইত্যাদি ফুটে উঠত। সূরা নূরের তাফসীর পড়ানোর সময় আয়িশা (রা.) এর ঘটনা বলতে গিয়ে কখনও কখনও কেঁদেও ফেলতেন তিনি।
অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল মালেক স্যার সবসময় শিক্ষার্থীদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কজন শিক্ষার্থী এমন শিক্ষক পেয়েছেন, তা গবেষণার দাবি রাখে। কখনও কখনও শিক্ষার্থীদের গ্রেট মাওলানা এন্ড স্কলার্স বলে সম্বোধন করতেন। বলতেন আপনারা জুনিয়র স্কলার।
তাঁর বাসায় যে গিয়েছে তাঁকেই তিনি এমনভাবে আপ্যায়ন করতেন যে, তাতে অতিথিরই লজ্জায় পড়তে হতো। নিজেই বাসার ভেতর থেকে ট্রেতে করে হরেক রকম খাবার নিয়ে আসতেন। অতিথি খেতে না চাইলে একরকম শাসন করে হলেও খাওয়াতেন।
বৃদ্ধ বয়সেও যখন তাঁর কৃত্রিম পেসমেকারে হৃদস্পন্দনের গতি ধীর হয়ে এসেছে, তখনও পাঁচ তলা থেকে নেমে মসজিদে জামাআতে শরীক হতেন।
লেনদেনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিলেন। আমরা কতবার কলাভবনের নিচতলায় তাঁর জন্য রিকশা ডেকেছি। তাঁর ব্যাগ আর লাঠিটা নিয়ে দাঁড়িয়েছি। তিনি রিকশায় উঠে বাসায় রওয়ানা হয়েছেন। আমাদের শত অনুরোধেও এ পর্যন্ত কেউ তাঁকে রিকশা ভাড়া দিয়ে দিতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। তাঁর সাথে যারাই কাজ করেছেন, তাদেরকে পাই পাই হিসাব বুঝিয়ে দিতেন।
তাঁর চরিত্রের একটা দিক হলো আত্মমর্যাদাবোধ। কখনও কোনো প্রয়োজন পড়লেও তা তাঁর একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কেউ জানতে পারত না। তিনি পেনশনের প্রাপ্ত অর্থ আর সমস্ত সঞ্চয়ের সিংহভাগ তাঁর গ্রামের মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করেছিলেন, আমার বিশ্বাস তাও তার একান্ত কাছের কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না।

একাকী যখন তাঁর বাসার বৈঠকখানায় অথবা বিভাগে তাঁর নিজস্ব রুমে বসার সুযোগ হতো, পুরোনো দিনের নানা কথা বলতেন। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর বছর আগের যেসব মানুষের স্মৃতিচারণ তিনি করতেন, তাঁরা বহু আগেই গত হয়েছেন। এসব বিষয় বইয়েও আর পাওয়া যায় না। একদিন অনেক কথা হলো। স্যার তখন তাঁদের শিক্ষক শায়খ আবদুর রহীম ছাহেবের নাম বললেন। বিরাট বড় মাওলানা। প্রচলিত প্রায় সমস্ত বিদ্যাই তাঁর হস্তগত ছিল। তাঁর আসল বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদে। কোর্ট-এ প্র্যাকটিস করতেন। একবার জনৈক জমিদারের বিপক্ষে গরীব এক হিন্দু প্রজা তাঁর সাহায্যপ্রার্থী হলেন। তিনি ভাবলেন, গরীব মানুষ, সাহায্য করতেই হয়। শর্ত দিলেন, যা বলবো তোমাকে তাই শুনতে হবে। প্রথম কথা হলো গোঁফদাড়ি, চুল এসব কাটা যাবে না। বড় হোক ধীরে ধীরে। কোর্ট-এ কিছুদিন পর মামলা ওঠার পর তিনি বললেন, মাই লর্ড। এর অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এ নিতান্তই নিরীহ গোবেচারা। দেখেন না দাড়ি-চুলের কী অবস্থা। ব্যাস। মামলা খতম। নিরীহ (!) প্রজা জিতে গেল। এদিকে ওকালতির উপর থেকেও ওনার মন উঠে গেল। যে পেশায় মিথ্যা না বললে চলছে না, তাতে আর না। তিনি শিক্ষকতায় ঢুকলেন- আমাদের ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে।
এককথা দুকথা- এরপর পড়ল ছারছীনা মাদরাসার কথা। নিছারুদ্দীন (র.) কে স্যার ছোটবেলায় দেখেছেন। বললেন, দাদা হুযূর নিছারুদ্দীন (র.) আকর্ষণীয় চরিত্রের একজন মানুষ ছিলেন। নামাযের সময় ছাড়া সারাদিন বইপত্র নিয়ে সময় কেটে যেত। তিনি যখন খানকা থেকে বের হতেন, চারপাশে লোকজন ঘিরে থাকত। কখনও কখনও তাঁর দু’ছেলে সাথে থাকতেন। কখনও অন্যরা।

যখন বাথরুমে যেতেন, আলাদা একটি সেলাইবিহীন লুঙ্গি পরে যেতেন। এরপর মোড়ায় বসে উযূ করতেন। একটি বড় কেতলি ছিল। সেখান থেকে পানি ঢালা হতো। আগে মিসওয়াক করতেন। মজার ব্যাপার হলো, মিসওয়াক করার আগে সময় নিয়ে মিসওয়াক ঝাড়তেন- কোন পিঁপড়া যেন মারা না যায়। অনেক সময় মিসওয়াকে পিঁপড়া জমা হয়।

স্যারের বিনয়ের কথা না বললেই নয়। প্রবাদ আছে, ফলবান বৃক্ষ ফলের ভারে নুয়ে পড়ে। জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় বিনয়ের ভারে অধ্যাপক আব্দুল মালেক স্যার ঠিক সেভাবেই বিন¤্র হয়ে জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাঁর ইন্তিকালের কয়েক দিন আগের কথা। অধ্যাপক আব্দুর রশীদ স্যারের আব্বা ইন্তিকাল করেছেন। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। আব্দুল মালেক স্যার পাশেই একটি চেয়ারে বসে আছেন। সেন্ট্রাল মসজিদের খতিব সাহেবও এসেছেন। তিনি স্যারের পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। স্যার ঐ কঠিন মুহূর্তেও খতিব সাহেবকে বললেন, আপনি বসুন। আমি দাঁড়াই। খতিব সাহেব তাঁর নাতি ছাত্রেরও ছাত্রের বয়সি। তিনি অত্যন্ত বিব্রত হয়ে বললেন, কি বলছেন স্যার। আপনি বসুন।
একজন আদর্শ শিক্ষক যে শুধু ক্লাসরুমেই শিক্ষক নন, বরং জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে সবসময় তাঁর থেকে শেখার আছে, তা স্যারের জীবন থেকে আমরা পদে পদে শিখেছি। আল্লাহ তাআলা স্যারের কবরকে আলোকিত করে দিন। আমীন।

লেখক: সম্পাদক, মাসিক সওতুল মদীনা 

ফেইসবুকে আমরা...