শেষ হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনতার আলোচনার শীর্ষে ছিলেন মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী। সিলেট-৫ তথা জকিগঞ্জ-কানাইঘাট সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ, নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার পক্ষে গণজোয়ার এবং ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে বড় ব্যবধানের জয় এদেশের ইসলামী রাজনীতির আঙ্গিনায় সাড়া ফেলেছে তুমুলভাবে। মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর এ বিজয় কেবল একটি সংসদীয় আসনে বিজয় হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে না, বরং এ বিজয়কে ইসলামী ঘরানার রাজনৈতিক মহলের জন্য এক দিক দিশারী আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখছেন অনেকে।
নির্বাচনে প্রায় পনেরো হাজার ভোটের ব্যবধানে নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী এক নযীর স্থাপন করেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনী ইতিহাসে সম্ভবত তিনিই প্রথম কোনো ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদ যিনি কোন বড় জোটের অংশ না হয়ে বা সমর্থন না নিয়েই দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটি তথা আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছেন। যারা জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের নির্বাচনী হালচাল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা দেখেছেন এ আসনের সংখ্যালঘু তথা সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায় মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন এবং তাদের বিভিন্ন কেন্দ্রে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছেন। একজন আলিমের প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের এই বলিষ্ঠ সমর্থন নিঃসন্দেহে এ বার্তা দেয় যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান দেওয়াই একমাত্র পদ্ধতি নয়। বরং যারা সঠিকভাবে ইসলামের জীবনাদর্শ ধারণ করেন এবং সমাজে চর্চা করার চেষ্টা করেন তাদের প্রতি সংখ্যালঘুরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের থেকেও বেশি আস্থা ও বিশ্বাস রাখেন। আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর পরিবারের শতবর্ষের খিদমাত জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের হিন্দু সম্প্রদায় যুগের পর যুগ প্রত্যক্ষ করে আসছে৷ তারা নিশ্চিত জানে তাদের পরিবার, সম্মান, সম্পদ ফুলতলী পরিবারের কাছে নিরাপদ। এদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির সাথে যারা জড়িত তারা জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের এবারের নির্বাচন থেকে এ শিক্ষা নিতে পারেন যে সহনশীল আচরণ, বিপদে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য না করার নীতি অনুসরণ করলে যেকোন সম্প্রদায়ই নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের প্রতি আস্থা রাখতে পারে।
মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী নির্বাচনে প্রার্থীতা ঘোষণার পরপরই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সিলেটের সকল ঘরানার উলামায়ে কিরামের সাথে বৈঠক করেন, সবার সমর্থন কামনা করেন। দ্বীনের বৃহত্তর স্বার্থে নানা মাসলাকের উলামায়ে কিরামের তার প্রতি সমর্থনও ছিলো চোখে পড়ার মতো। জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের দেওবন্দী উলামাদের একটি বড় অংশ তাকে প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেন। আলিম-উলামাদের এই ঐক্যের ফলে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর পক্ষে যে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয় তা রুখে দিতে নির্বাচনের অন্যান্য প্রার্থীদের কিছু প্রচারণা থেকে এদেশের ইসলামপন্থীদের শেখার আছে অনেক কিছুই। উলামায়ে কিরামের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের ফলে যখন প্রতিয়মান হচ্ছিল মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলীর বিজয় সুনিশ্চিত তখনই অনেক প্রার্থী ছোট ছোট মাসআলায় কওমী-সুন্নী মতভেদের ইতিহাস টেনে এনে কওমী উলামা এবং তাদের সমর্থকদের নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করেন। ফুলতলী-কওমীর মাসআলাগত ছোট ছোট ইখতিলাফকে ফলাও করে যেসব প্রার্থীরা প্রচার করে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেন এরা সকলেই ধর্মনিরপেক্ষতার স্লোগান নিয়ে রাজনীতি করেন৷ তাদের এই কৌশল থেকে বুঝা যায় যে তারা নিশ্চিত জানেন ঐক্যবদ্ধ ইসলামী শক্তিকে পরাজিত করার শক্তি এদেশের সেক্যুলার সমাজের এখনো হয়নি, বরং উলামাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করাই তাদের কৌশল। তবে আশার কথা হলো জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের ধর্মপ্রাণ জনতা এবার আর তাদের ফাঁদে পা রাখেননি। আল্লামা ফুলতলী (র.) এর পরিবারের প্রতি সিলেট-৫ আসনের জনগণের অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা এবং মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর ব্যক্তিত্বের কাছে ভেস্তে গেছে সেক্যুলার সমাজের যাবতীয় প্রোপাগান্ডা।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবারের নির্বাচন বয়কট করলেও নিবন্ধিত ১১টি ইসলামী দলের ৭টিই নির্বাচনের অংশগ্রহণ করে। এসব দল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন হাফিজ্জি হুজুর (র.) এর সন্তান, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীর মাওলানা আতাউল্লাহ হাফিজ্জী, মুফতী আমিনী (র.) এর সন্তান ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসনাত আমিনী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারী, বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ সাইফুদ্দীন মাইজভান্ডারী, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ। দুঃখজনকভাবে তারা সকলেই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। এসব উলামায়ে কিরামের পরাজয়ের নানা কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হতে পারে নিবন্ধিত ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর অতি মাত্রায় বড় দলগুলোর সাথে জোটে সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা এবং জোটের নমিনেশনে বিএনপি অথবা আওয়ামীলীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার প্রবণতা। এভাবে নির্বাচন করে তারা অনেকে অনেকবার নির্বাচিত হলেও তাদের স্বতন্ত্র কোনো ভোট-ব্যাংক তৈরি হয়নি যাদের কাছে ইসলামী মূল্যবোধের স্লোগান নিয়ে ভোট চাইলে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে ভোট পাওয়া যাবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর এবারের ভরাডুবি আমাদের পরিষ্কারভাবে এ বার্তা দেয় যে বড় দলগুলোর সাথে রাজনৈতিক জোটের নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে নগণ্য সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা গেলেও মৌলিকভাবে এসব দল যে উদ্দেশ্যে গঠিত, তথা বাংলাদেশে জনগণের পূর্ণ সমর্থনে একটি পরিপূর্ণ ইসলামী মূল্যবোধ সম্পন্ন রাষ্ট্র তৈরি করা, সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে এসব জোটের বাইরে বেরিয়ে এসে সম্মিলিতভাবে ইসলামী দলসমূহের জোটবদ্ধ হওয়াই কার্যকর পদ্ধতি। শতভাগ নিশ্চিত না করা গেলেও দেশের ইসলামপন্থীদের বৃহৎ অংশকে একতাবদ্ধ করা গেলে যেকোন আসনেই যে বিজয়ী হওয়া সম্ভব এর প্রমাণ এবারের নির্বাচনে সিলেট-৫ আসনে এক আলিমের বিজয়।
এবারের নির্বাচনে যেকোন দলের বা প্রার্থীর অংশগ্রহণ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি ও তাদের মিত্রদের কর্মীরা ভালো চোখে দেখছেন না খুব স্বাভাবিকভাবেই। কেউ কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের বিষয়ে বেশ সমালোচনা মুখরও হচ্ছেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এসব সমালোচনা মৌলিক শিষ্টাচারকে অতিক্রম করে বিষোদগারে পরিণত হচ্ছে যা মোটেও কাম্য নয়। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো নৌকার এক হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করা মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীকে নির্বাচন বয়কটকারীদের একাংশের সমালোচনার কেন্দ্রে পরিণত করা। বিএনপি জোটের ঘনিষ্ঠ মিত্র কিছু ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও এসব সমালোচকরা তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন আবার একটি অনিবন্ধিত দলের নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় সমালোচনায় মুখর হওয়া তাদের মানসিক দৈন্যতারই প্রকাশ ঘটায়। বস্তুত এসব নেতা-কর্মীরা তাদের আসল প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মুকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে অন্যের উপর রাগ উগড়াচ্ছেন কিনা তা ভাবার বিষয়। এসব দলের নেতাকর্মীদের মাথায় রাখা উচিত এভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষোদগার করতে করতে এক সময় হয়তো তারা দেখতে পাবেন পুরো বাংলাদেশটাই তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে, সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হয়ে গেছে। তাদের বুঝতে হবে প্রতিপক্ষ যত ছোট, বিজয় তত সহজ। জোর করে কাউকে প্রতিপক্ষ বানানো আদতে নিজেরই ক্ষতি করে।
সমালোচকদের একটি অংশ হয়তো এমনও আছেন যাদের মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলীর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতা এত বিপুল যে তাদের নিজেদের কাঠামোবদ্ধ চিন্তা ভাবনার বাইরে গিয়ে তিনি নির্বাচন করবেন একথা মেনে নিতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। এমন যারা আছেন তাদের জন্য তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন তিনি সংসদে যেতে চান বর্তমান সরকারের ঘাড়ে যে বিদেশি রামবাদী ভূত চেপে বসেছে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে, শিক্ষাব্যবস্থায় যে রামরাজত্ব চলছে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে, মযলুমের পক্ষে কথা বলতে। গণতন্ত্র রক্ষার নামে যে আন্দোলন চলছে তাতে তো রাজনীতির রথী-মহারথীরা আছেনই। কিন্তু এ আন্দোলনের মধ্যেই দেশীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা যে বেজে যাচ্ছে এর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কি উম্মাহর প্রয়োজন নেই? তাই মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী কারো রাজনৈতিক আন্দোলনে বা স্বার্থে শরীক না হলেও মনঃকষ্টে না ভোগাই কর্তব্য, কারণ উম্মাহর কল্যাণে তিনি এমন অনেক বিষয়ে চাপপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন যেসব বিষয়ে সরকারকে চাপপ্রয়োগ করা সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব ছিলো। উম্মাহর জন্য ক্ষতিকর সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য রাজপথে হাজারো মানুষের মিছিলের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী ফোরামে এ মিছিলের যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য বলিষ্ঠ আওয়াজ তোলার মতো সৎসাহসী মানুষের প্রয়োজনীয়তা কতো বিপুল একথা যেদিন আমাদের ভাইয়েরা অনুধাবন করবেন সেদিনই তারা বুঝতে শুরু করবেন এবারের নির্বাচনে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর অংশগ্রহণ এবং বিজয় কেন এদেশের মুসলমানদের জন্য এক অনন্যসাধারণ ঘটনা।