রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের পবিত্র উপলক্ষ উদযাপন মুসলিম বিশ্বের এক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, যা আন্তরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মিলিত আনন্দ ও সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য্যে বহুমাত্রিক। এটি নিতান্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; বরং ঈদে মীলাদুন্নবী মুসলিম সমাজে একটি প্রাণবন্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে পালিত হয়। আলোকসজ্জা, শোভাযাত্রা, ওয়ায মাহফিল, দুরূদ-সালাম পাঠ, সুস্বাদু খাদ্য বিতরণ, হৃদয়ভরা না’ত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম ও বংশবৃত্তান্ত আলোচনা এবং কোথাও কোথাও বিশেষ পোশাক পরিধানের মতো জায়িয ও মুসতাহসান পদ্ধতির মাধ্যমে হাজার বছর ধরে মুসলিম বিশ্বে ঈদে মীলাদুন্নবী পালিত হয়ে আসছে। কায়রো থেকে দামেস্ক, ফেজ থেকে সানা, ইস্তাম্বুল থেকে সিলেট—সবখানেই মীলাদুন্নবী একটি গভীর সামাজিক-ধর্মীয় বন্ধনের অনুষঙ্গ। এ নিবন্ধে ইতিহাস, সাম্প্রতিক গবেষণা ও সাংস্কৃতিক উপলব্ধির আলোকে সুন্নী-মুসলিম বিশ্বে মীলাদুন্নবী উদযাপন, এর উদ্ভব, বিবর্তন, স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রাণবন্ত ভাবনার গল্প নিয়ে আলাপ করা হয়েছে।
ফাতেমীয় মিসর : মীলাদ উদযাপনের উদ্ভব
মীলাদ উদযাপনের প্রাচীনতম সুনির্দিষ্ট নযীর পাওয়া যায় ১১শ শতকের মিসরে, ফাতেমীয় শাসনামলে আনুমানিক ১০৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। ইতিহাসবিদ আল-মাকরিজি এবং পশ্চিমা গবেষকদের মধ্যে স্কট অ্যালান কুগল ও জি. লারসন প্রমুখের মতে, এসব উৎসব ছিল মূলত রাজদরবার-কেন্দ্রিক। প্রশংসাসূচক কবিতা, নাত, খুতবা, জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রা ও আপ্যায়নের মাধ্যমে মীলাদের উদযাপন হতো। সরকারি কর্মকর্তা, উলামা ও নেতৃবৃন্দ এসব উৎসবের মূল অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
একটি সন্দেহ নিরসন
মিশরের ফাতেমীয় খিলাফত (আমরা একে খিলাফত হিসেবে গণ্য করি না) শিআ আকীদার ছিল বিধায় বহু সমালোচক মীলাদুন্নবী উদযাপনের রেওয়াজকে শিআদের অনুকরণ বলে অভিহিত করেন। কেউ কেউ মীলাদ উদযাপনকে খ্রিস্টানদের বড়দিন উদযাপনের সাথেও তুলনা করেন। যদিও কোনো কাজ, যা তার আসল বা মূলের দিক থেকে অবৈধ নয়, সেটি যেই শুরু করুক না কেন, তা সমূলে অবৈধ হয়ে যায় না। সহীহ বুখারীতে হাদীস রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা শরীফে গিয়ে দেখলেন ইয়াহুদীরা আশুরার রোযা রাখে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রোযার কারণ জানলেন, তখন তিনি নিজেও আশুরার রোযা রাখলেন এবং সাহাবীদের রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, সাহাবীরা ইসলামপূর্ব যুগে রুকইয়া তথা ঝাড়ফুঁক করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এসব ঝাড়ফুঁক আমার সামনে উপস্থাপন করো। যদি এতে শিরক না থাকে, তাহলে তোমরা তা চালিয়ে যেতে পারো। এতে বুঝা যায়, যদি একটি কাজ তার মূল প্রকৃতিগতভাবে বৈধ হয়, তাহলে ভিন্নধারার কিছু মানুষ তা শুরু করলেই সেটি অবৈধ হয় না। এমনকি, ইমাম সুয়ূতী তাঁর ‘হুসনুল মাকসিদ’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন, জগতশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ ইমাম ইবন হাজার আসকালানী সহীহ বুখারীতে বর্ণিত মদীনার ইয়াহুদীদের আশুরার রোযা রাখা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক এর সমর্থনের ঘটনা দ্বারা মীলাদ উদযাপনকে মৌলিকভাবে বৈধতা দিয়েছেন।
সুন্নী জগতে ঈদে মীলাদুন্নবীর উদ্ভব ও বিবর্তন
মহাবীর সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর সুন্নী শাসনামলে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের ধারায় নতুন গতি আসে। ইরবিলের গভর্নর মুযাফফার উদ্দীন কাউকাবুরী (মৃ. ১২৩২) প্রথম সুন্নী মুসলিম শাসক, যিনি সরকারিভাবে মীলাদুন্নবী উদযাপনের সূচনা করেন। তিনি পশু কুরবানী, দান-খাইরাত, না’ত, কবিতা, আলোকসজ্জা, শোভাযাত্রা, ফল বিতরণসহ নানাবিধ কার্যক্রম চালু করেন, যার মূলভাব ছিল এই দিনকে কেন্দ্র করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি হৃদয়াবেগকে মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করা। এই উন্মুক্ত ও সম্মিলিত উদযাপনের দ্বারা মীলাদুন্নবী সুন্নী জগতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মিসর, সিরিয়া, ইরাক, উত্তর আফ্রিকা—সবখানেই মীলাদুন্নবী উদযাপন সূফী ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মীলাদে প্রধানত সূফী বুযুর্গ ও মুরীদানের সম্মিলিত যিকর, তাবাররুক বিতরণ, না’ত, আরবী ভাষাভাষী এলাকায় ইমাম জাফর ইবন হুসাইনের লিখিত ‘বারযিঞ্জী’ (যা তাওয়াল্লুদ নামেও পরিচিত) এবং তুর্কিভাষী এলাকায় সুলেমান চেলেবির লিখিত ‘ওয়াসিলাতুন নাজাত’ (Vesîletü’n-Necât) গ্রন্থের আবৃত্তি সাংস্কৃতিক স্তরে প্রথাবদ্ধ হয়ে গেছে।
আরব বিশ্বে মীলাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি
মিসর তার ঐতিহ্যবাহী মীলাদ আয়োজনে সর্বদাই মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানে ছিল। মিশরে মীলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে শিশুদের জন্য এক প্রকার মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়, যার নাম ‘আরুস ওয়া হিসান আল মাওলিদ’। শহরের পথে পথে বাতি, জমকালো মেলা এবং আল হুসাইন মসজিদ অভিমুখে বিভিন্ন সূফী তরীকার শোভাযাত্রা ঘটে। মীলাদ মাহফিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মকালীন কাহিনি (ইরহাসাত), না’ত ও দুআর পাশাপাশি থাকে সেমসেমিয়া, ফুলিয়া, হামিসিয়া ও পুডিং জাতীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার। সাউদী আরবে মীলাদ মাহফিলের ওপর নানা বিধিনিষেধ থাকলেও আহলে বাইতের বুযুর্গরা মক্কা-মদীনাসহ বিভিন্ন শহরে নিজ নিজ বাসভবনে মীলাদের আয়োজন করেন। শাইখুল হাদীস সায়্যিদ মুহাম্মাদ ইবন আলাওয়ী আল মালিকী (মৃ. ২০০৪) সৌদি আরবে মীলাদ মাহফিলসহ সুন্নীয়তের নানামুখী কার্যক্রমের প্রসার ঘটিয়ে গেছেন, যার রেশ বাকি সায়্যিদ পরিবারের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। সিরিয়ার শহর ও গ্রামে মীলাদ উদযাপনের সংস্কৃতি রয়েছে। দামেস্ক ও আলেপ্পো শহরে মীলাদ উপলক্ষ্যে মানুষ পরিবারসহ সবুজ পতাকা নিয়ে শোভাযাত্রায় বের হন। শোভাযাত্রায় ছন্দময় আরবী নাশীদ গাওয়া হয়। মানুষ তাদের প্রতিবেশীদের জন্য বিশেষ মিষ্টান্ন, ভেড়ার গোশত ও পোলাওয়ের ব্যবস্থা করে। পুরুষেরা নকশা করা জোব্বা ও নারীরা সাজানো স্কার্ফে সজ্জিত হয়। আলোকসজ্জা, প্যারেড, রাত্রি জাগরণ, ফল বিতরণ ও সুর মিলিয়ে না’ত পাঠ করার মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসা ও পরস্পর মমত্ববোধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ইরাকে মীলাদ উদযাপনের মূল কেন্দ্র হচ্ছে বাগদাদের ইমাম আবূ হানীফা মসজিদ। মসজিদকেন্দ্রিক রাস্তাগুলো ফুল ও বাতি দিয়ে সজ্জিত হয় এবং এক সপ্তাহব্যাপী মীলাদুন্নবী উদযাপন চলে। পুরুষেরা দিশদাশা (বিশেষ ধরণের কুর্তা) ও কেফ্যিয়াহ পরে, লন্ঠনের শোভাযাত্রা হয়, মেয়েরা মেহেদি পরিধান করে এবং ডলমা, কাবাব, বাকলাভা, জলাবিয়া প্রমুখ নানা মুখরোচক খাবার বিতরণ করা হয়। মীলাদ উদযাপন উপলক্ষ্যে বিয়ে, খতনা ও কবর যিয়ারতের মতো ধর্মীয়-সামাজিক কাজও ইরাকী ঐতিহ্যের অংশ। কুর্দিস্তানে মীলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে ‘মান আল সামা’ নামক মিষ্টি বিনিময় ও সপ্তাহব্যাপী আধ্যাত্মিক সম্মেলনের রেওয়াজ আছে। ইয়ামানের সানা, হাদরামাউত প্রমুখ শহরে লাখো মানুষ সবুজ পতাকা ও ফ্যাস্টুন হাতে শোভাযাত্রা করে। সুন্নী-সূফী উলামা-মাশাইখ মীলাদ উপলক্ষ্যে বিশেষ মাহফিল করেন, যাতে ছন্দময় যিকর ও না’তের আয়োজন করা হয়। ইয়ামানে মীলাদ উদযাপনে সূফী ধারার প্রখ্যাত আলিম হাবীব উমর বিন হাফিযের নাম ও প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উসমানী (অটোমান) সালতানাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে মীলাদুন্নবী
১৬শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে উসমানী সালতানাত মীলাদুন্নবী উদযাপনকে রাজকীয় অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করেছে। ইস্তাম্বুল ও বিভিন্ন প্রদেশের গ্র্যান্ড মসজিদ এবং অন্যান্য সরকারি স্থানে মীলাদ উদযাপন হতো। না’ত গেয়ে গেয়ে মিছিল করা হতো, সুলেমান চেলেবির ‘ওয়াসিলাতুন নাজাত’ (Vesîletü’n-Necât) গ্রন্থের আবৃত্তি করা হতো এবং সরকারি ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ মানুষের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকত। ১৯শ শতাব্দীতে সরকারি প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, দরবিশ লজ, এমনকি স্কুলেও মীলাদ মাহফিল আয়োজন করা হতো, যেখানে সূফী বুযুর্গ, নাশীদ শিল্পী ও উলামা ছন্দময় যিকর ও না’ত পাঠ করতেন। উসমানীদের মাঝে মীলাদুন্নবী উপলক্ষে দরিদ্রদেরকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সহায়তা করার রেওয়াজ ছিল। সে সময় মীলাদ বিষয়ক গ্রন্থাবলী বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় অনুদিত হয়, যা উসমানী সালতানাতের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে। বিশেষ করে সুলতান ২য় আবদুল হামিদের (মৃ. ১৯১৮) সময় মীলাদসহ বিভিন্ন দ্বীনি মাহফিলকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুরুত্বের সাথে আয়োজন করা হতো।
দক্ষিণ এশিয়ায় মীলাদুন্নবীর প্রাণবন্ত আয়োজন
ভারতে ঈদে মীলাদুন্নবীর ঐতিহ্য রঙ, সুর ও গভীর শ্রদ্ধার সাথে অনুরণিত হয়। দিল্লী, হায়দ্রাবাদ, মুম্বাই ও লখনৌতে মীলাদুন্নবী সবুজ পতাকা-সজ্জিত মিছিল নিয়ে আসে—পুরুষরা কুর্তা এবং মহিলারা সূচিকর্মযুক্ত পোশাকে সাজে। আলোকিত ফ্লোট, স্মৃতিচিহ্ন প্রদর্শন এবং ওলী-আউলিয়ার মাযারে লোকসমাগম মোঘল আমলের মহিমা ও আধুনিক শহুরে বৈচিত্র্যকে মিশ্রিত করে। জর্দা, শির খুরমা, হালওয়া প্রমুখ মিষ্টান্ন খাবারের থালিকে ভরে তোলে। আযমীর দরগায় আয়োজিত হয় বিশেষ কাওয়ালী। দিল্লীর জামা মসজিদে ছন্দময় নাশীদ, ইফতার এবং উর্দু, ফার্সি, আরবী ও স্থানীয় ভাষায় কবিতা পাঠ প্রজন্মকে সংযুক্ত করে নবীর প্রতি ভালোবাসায়। মীলাদুন্নবীর আয়োজনে পশ্চিম বাংলায় পিঠা ও মালাবার এলাকায় পায়াসাম নামক মিষ্টান্নের তৈরি করা হয়। দক্ষিণ ভারতের কেরালার গ্রামীণ এলাকায় ছোট ছোট র্যা লি, বিশেষ খাবার রান্না এবং কাব্যিক পাঠ ইসলামী এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্যকে মিশ্রিত করে। ভারতে মীলাদুন্নবী আয়োজনে বড় অবদান রেখে যাচ্ছেন খ্যাতনামা আলিম শাইখ আবূ বকর আহমদ, যিনি অল ইন্ডিয়া সুন্নী জমিয়াতুল উলামার প্রধান নির্বাহী। পাকিস্তানে মীলাদুন্নবী একটি জাতীয় ছুটি, যা ইসলামাবাদে ৩১-বন্দুক স্যালুট ও অন্যান্য প্রদেশে ২১-বন্দুক স্যালুট দিয়ে উদযাপিত হয়। রাস্তা এবং মসজিদ আলো, পতাকা ও ব্যানারে জ্বলজ্বল করে। নাশীদ শিল্পীদের না’ত পাঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মুমিন-হৃদয়ের আবেগকে উদ্দীপ্ত করে। খাবারে বিরিয়ানি, মিষ্টি চাল, কাবাব ও হালওয়া বিতরণ করা হয়। প্রখ্যাত আলিম ড. মুহাম্মদ তাহিরুল কাদরী আয়োজিত মীলাদ মাহফিল পাকিস্তানের মীলাদ উদযাপনের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বাংলাদেশে ঈদে মীলাদুন্নবী এক আধ্যাত্মিক ও তালীমী আয়োজন, যা ওয়াজ মাহফিল, না’ত গেয়ে শোভাযাত্রা এবং মীলাদ পাঠের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে সুন্নী-সূফী উলামার নেতৃত্বে মীলাদের জুলূস ও র্যা লি বের হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও খানেকায় সপ্তাহব্যাপী চলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম ও বংশবৃত্তান্ত এবং সীরাত আলোচনা। বাংলাদেশে মীলাদ মাহফিলের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য একটি নাম হচ্ছে আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলার, যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে সুন্নীয়তের ভিত মজবুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মীলাদুন্নবীর সংস্কৃতি
ইন্দোনেশিয়ার বিস্তীর্ণ দ্বীপপুঞ্জে নবী-প্রেম ও স্থানীয় আদতের মিশ্রণে আড়ম্বরপূর্ণ মীলাদ আয়োজন হয়। জাভা দ্বীপে মীলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী ইয়োগিয়াকার্তার সেকাতেন উৎসবে বাটিক-পরিহিত অংশগ্রহণকারীরা গ্যামেলান সঙ্গীত গায়। মিছিলের শেষে চাল, ফল ও দইয়ের আপ্যায়ন থাকে। সূফী বুযুর্গদের কণ্ঠে মসজিদ ও খানেকাতে বারযিঞ্জী পাঠ শোনা যায়। পালেমবাঙ্গের আলাভিয়িন বংশধরদের মধ্যে চল্লিশ দিনব্যাপী মীলাদ উদযাপন এবং চিকোয়াঙ্গের সূফী সমাগম ইন্দোনেশিয়ার বহুস্তরীয় আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। মালয়েশিয়ায় ‘মাওলিদুর রাসূল’ একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, যাতে ঐতিহ্যবাহী বাজু কুরুং ও সাংকেত পোশাক পরে মিছিল এবং সেইসাথে নাসি দাগাঙ্গ, রেন্ডাঙ্গ প্রভৃতি খাবারের আয়োজন থাকে। মীলাদ মাহফিলে আরবী না’ত পড়া হয়। গ্রামের কেন্দুরি, তাবাররুক বিতরণ এবং উজ্জ্বল মিছিলগুলো আরবের ঐতিহ্যের সাথে লোকজ সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায়।
আফ্রিকায় স্থানীয় উৎসবে মীলাদুন্নবী উদযাপন
মরোক্কোতে এক সপ্তাহ ধরে বিশাল প্যারেড, আন্দালুসিয়ান ধাঁচের সঙ্গীত ও স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের মাধ্যমে মীলাদ উদযাপন হয়। পুরো রবীউল আউয়াল মাসে মসজিদে কুরআন তিলাওয়াত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মসংক্রান্ত আলোচনা চলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মকে স্মরণের মুহূর্তে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে সালাম পাঠ করে এবং মীলাদ শেষে খেজুর ও দুধ বিতরণ করা হয়। ফেজ শহরে কিছু সূফী তরীকার লোকজন দফ বাজিয়ে জাঘারীত নামক বিশেষ ছন্দময় কাসীদা পাঠ করেন। আপ্যায়নের মধ্যে থাকে আসিদা পুডিং ও কুসকুসের মতো মুখরোচক খাবার। মীলাদুন্নবী উপলক্ষে তিউনিসিয়ার কাইরোয়ান শহরে প্রতিযোগিতা ও মাহফিল হয়। তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ায় মীলাদ মাহফিলে ‘আসিদা যাকুকু’ নামক এক ধরণের মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়। আলজেরিয়ায় সাজানো যানবাহনের শোভাযাত্রা, নাশীদ আবৃত্তি ও দান-খাইরাতের মাধ্যমে শহরগুলোতে উদযাপনের সাথে আধ্যাত্মিকতার আবহ তৈরি করে। মীলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে পশ্চিম আফ্রিকার সুদানে হাওলিয়ে, মালিতে দোনবা, নাইজেরিয়ায় গানি-গানি প্রমুখ বৈচিত্র্যময় উদযাপন, সেনেগালের তওবা মসজিদে হাজারো মানুষের সমাগম, মাহফিল ও খাবার বিতরণ এবং কেনিয়াতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ইসলামী সংস্কৃতির সাথে আফ্রিকার স্থানীয় ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটায়।
ইসলামের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে ঈদে মীলাদুন্নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি মুমিনের হৃদয়গ্রাহী ভালোবাসা ও ভৌগলিকভাবে ভিন্ন মুসলিম সমাজের সৃজনশীলতার প্রতীক। হাদীস বিশারদ ইমাম ইবনুল জাওযী (মৃ. ১২০১) প্রায় আট শতাব্দী আগে মুসলিম বিশ্বজুড়ে মীলাদুন্নবী আয়োজনের সাক্ষী দিয়ে গেছেন। ‘বায়ানুল মীলাদুন নাবাওয়ী’ কিতাবে তিনি লিখেছেন, “মক্কা ও মদীনা, মিশর, ইয়ামান, শাম এবং পূর্ব ও পশ্চিমের সমস্ত আরব দেশের লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মীলাদ উদযাপন করে। তারা রবীউল আউয়াল মাসের অর্ধচন্দ্রের আগমনে আনন্দ করে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের কথা শোনা এবং পড়ার প্রতি খুব মনোযোগ দেয় এবং এর মাধ্যমে তারা একটি মহান প্রতিদান এবং একটি মহান সাফল্য অর্জন করে।”
সময় ও স্থানের সাথে উদযাপনের ধরণ-প্রকৃতি কিছুটা পরিবর্তিত হলেও ঈদে মীলাদুন্নবীর মূলে রয়ে গেছে একটি চেতনা—শুকুর। এই শুকুর আল্লাহ তাআলার প্রতি, যে তিনি আমাদের মাঝে তাঁর প্রিয়তম ও শ্রেষ্ঠতম রাসূল পাঠিয়েছেন। প্রতি বছর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মীলাদ উদযাপনে মুসলমানরা সময়, ভাষা, স্থান সব ছাড়িয়ে করুণা ও ভালোবাসার ঐতিহ্য ধরে রাখে। কায়রোর আলোকসজ্জা, ইয়ামানের জনসমাগম, ইস্তাম্বুলের মসজিদ, বাংলার মাহফিলে মীলাদ একইসঙ্গে স্মৃতি ও জীবন্ত ঐতিহ্য, ধর্ম ও দৈনন্দিন জীবনের এক সেতুবন্ধন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আহমদ জি. ইসলাম, “বাসিলানের আলেমদের দৃষ্টিতে মীলাদ উদযাপন,” IJMSSR, ২০২৩
২. এরমান হারুন করাদুমান, “অটোমান সাম্রাজ্যে রাজকীয় মীলাদ উৎসব (১৭৮৯-১৯০৮),” বিলকেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬
৩. SunnaFiles, “আরব জাতির মীলাদ উদযাপনের ইতিহাস,” ২০২৪
৪. ম্যারিয়ন এইচ. কাতজ, “দ্য বার্থ অফ দ্য প্রফেট মুহাম্মাদ: ডেভোশনাল পাইয়টি ইন সুন্নি ইসলাম,” Routledge, ২০০৭
৫. নিকো জে. কাপটেইন, “মুহাম্মাদ্স বার্থডে ফেস্টিভাল,” ই. জে. ব্রিল, ১৯৯৩।
৬. স্কট অ্যালান কুগল, “সুফিস অ্যান্ড সেন্টস বডিস,” ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা প্রেস, ২০০৭
৭. জোনাথন ব্রাউন, “দ্য ক্যানোনাইজেশন অফ ইসলামিক ল, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৩
৮. এমাদ কুরেশি, “দ্য মীলাদ: ইটস হিস্টোরিকাল অ্যান্ড রিলিজিয়াস সিগনিফিকেন্স,” IslamiCity, ২০২০