নিরীহ জেলে। নিরহংকার ও সাদামাটা তাঁর জীবনাচার। নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে। কোনোদিন ভাগ্যে মাছ না জুটলে চুলায় হাঁড়ি বসে না। না খেয়ে দিন গুজরান করতে হয়।
একদিনের কথা। সকাল বেলা সে বের হয়েছে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। মাছ ধরে বিক্রি করবে, বিক্রিত টাকা দিয়ে ছেলে মেয়েদের জন্য খাবার নিয়ে ফিরবে। জেলে চলে যায় নদী অভিমুখে। এদিকে ছেলেমেয়েরা অপেক্ষমান। পিতা সন্ধ্যায় বাজার থেকে খাবার নিয়ে আসবে আর তারা আনন্দ ভরে খাবে। জেলে নদীতে গেল মাছও ধরল। মনে মনে খুব খুশি, আজকে তাহলে বাড়িতে ভালো কিছু খাবার নেওয়া যাবে। সন্তানগুলোও অনেকদিন যাবত ভালো কোনো খাবার চোখে দেখেনি। জেলের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! মাছগুলো নিয়ে বাজারে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে স্থানীয় মাস্তান তাকে আক্রমণ করে বসে। ছিনিয়ে নেয় তার পুরো দিনের পরিশ্রমে ধরা মাছগুলো। গরীব জেলে আক্রমণকারীর সাথে শক্তিতে পারবে না মনে করে নিরুপায় হয়ে মাছগুলো দিয়ে দিলে সকল আনন্দ নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে গেল। কষ্টভরা মন নিয়ে খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হলো। সন্তানগুলোও বাবার খালি হাত দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অসহায়ের মতো। অপরদিকে ছিনতাইকারী চরম খুশিতে মাছগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিল। হঠাৎ মাছের একটি কাঁটা ফুটে যায় তার আঙ্গুলে। ব্যথা নিয়েই বাড়ি ফিরল। চরম আয়েশে পেটপুরে খেল মাছগুলো। এদিকে আঙ্গুলের ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। ব্যথা মাত্রাতিরিক্ত হলে, স্মরণাপন্ন হলো ডাক্তারের। ডাক্তার ঔষধপত্র দিয়ে বললেন, যাও ব্যথা কমে যাবে। ঔষধ সেবন করেও কোনো কাজ হলো না ছিনতাইকারীর। আবারও ডাক্তারের কাছে ফিরে গেল। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন, আপনার একমাত্র সমাধান হলো, যে আঙ্গুলে ব্যথা সে আঙ্গুলটা কেটে ফেলতে হবে। অগত্যা তার আঙ্গুলটি কাটতেই হলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! আঙ্গুল কাটার পরও ব্যথা কিন্তু কমলো না। সময়ের ব্যবধানে অন্যান্য আঙ্গুলেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল বিষক্রিয়া। আবারও ডাক্তারের কাছে ছুটল। ডাক্তার এবার আরও কঠিন অপারেশনের সিদ্ধান্ত দিলেন। ডাক্তার তার হাতের কব্জি পর্যন্ত না কাটলে কোনো উপশমের সম্ভাবনা নেই বলে সিদ্ধান্ত দিলেন। কোনো উপায়ন্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত হাতের কব্জি পর্যন্ত কাটতে বাধ্য হলো। কথায় আছে ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। কব্জি কাটার পর ব্যথা কিন্তু একটুও কমেনি। উপায়ন্তর না দেখে আবারও ছুটল ডাক্তারের কাছে, ডাক্তারও খুব আশ্চর্য হন। আবারও পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে আরও কঠিন সিদ্ধান্ত দিলেন। ডাক্তার এবার বললেন আপনার পুরো হাতেই এর বিষক্রিয়া সংক্রমিত হয়ে গেছে। সুতরাং পুরো হাত কাঁধ পর্যন্ত আপনাকে কেটে ফেলতে হবে। শেষ পর্যন্ত পুরো হাত কেটে দেওয়া হলো। ব্যথা কমল কিন্তু হারাতে হলো তার একটি হাত ও উপার্জন ক্ষমতা। আসবাবপত্র সবকিছু বিক্রি করে একপর্যায়ে নিঃস্ব ভিখারীতে পরিণত হলো। হঠাৎ তার পূর্বপরিচিত এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা। লোকটি তার এক হাত না দেখে বিস্মিত হন এবং হাত হারানোর কারণ জানতে চান। তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী কখনও কারো উপর যুলম করেছ? লোকটি তার কৃত মাছ ছিনতাইয়ের কথা বর্ণনা করল। তখন পরিচিত ভদ্র লোক তাকে বললেন, ওই লোকের উপর যুলম করার কারণেই তোমার এই পরিণতি। কারণ, মযলুমের দুআ আল্লাহ সাথে সাথে কবূল করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মযলুমের বদদুআকে ভয় করো। তার আর আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, তিন ব্যক্তির দুআ অবশ্যই কবূল করা হয়। এর মধ্যে একজন হলেন মযলুম।
লোকটি তার কৃতকর্মের কথা বুঝতে পারল। সে ঐ জেলে ব্যক্তির খুঁজে বের হলো। পেয়েও গেল ঐ জেলেকে। দেখতে পেল জেলে এক জায়গায় দিনমজুরের কাজ করছেন। লোকটি জেলের কাছে সে সময়ের ঘটনা খুলে বলল। জেলে বলল, আপনি যখন আমার সন্তানদের আহার আমার হাত থেকে কেড়ে নেন, তখন আমি একমাত্র আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছি। কারণ ঐ সময় আমার ফরিয়াদের জায়গা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ ছিল না। আপনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আর এ পথে শক্তি থাকলেও কখনও পা বাড়াবেন না। হয়তো আল্লাহ আপনাকে অনুগ্রহ করবেন।