মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র জন্ম তথা মীলাদকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা খাসভাবে রবীউল আউয়াল মাসে এবং আমভাবে সারা বছর দুরূদ শরীফ ও জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনার মাহফিল করে থাকেন। এ মাহফিলকে মীলাদ মাহফিল বলা হয়ে থাকে। যুগে যুগে হক্কানী-রব্বানী উলামায়ে কিরাম এ অনুষ্ঠানকে সমর্থন করেছেন এবং উদযাপনও করেছেন। ইদানিং একটি মহল থেকে মীলাদ-মাহফিলের এ অনুষ্ঠানের বৈধতা নিয়ে আপত্তি তোলা হচ্ছে। বক্ষমান নিবন্ধে আমরা সে আপত্তিগুলোর দলীলভিত্তিক জবাব দেয়ার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।
আপত্তি-০১
মীলাদ বা জন্মদিন পালন করা বিজাতীয় সংস্কৃতি।
জবাব
জন্মদিন পালন করা বিজাতীয় সংস্কৃতি কথাটি সঠিক নয়; বরং বিজাতির নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তা পালন করা বিজাতীয় সংস্কৃতি। কেননা, বিধর্মীরা কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম-কানূন মেনে জন্মদিন পালন করে থাকে। তাই উক্ত নিয়ম-কানূনের অনুসরণ করা নিষিদ্ধ হবে। কারণ, হাদীসে বলা হয়েছে, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ যে ব্যক্তি যার সাথে সাদৃশ্য রাখবে, তার সাথে তার হাশর হবে। (আবূ দাঊদ, হাদীস নং ৪০৩৩) তাই উক্ত নিয়ম-নীতির অনুসরণ না করলে শুধু জন্মদিন উদযাপন করা হারাম হবে না। কারণ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই নিজের জন্মদিন উদযাপন করেছেন রোযা রাখার মাধ্যমে। যেমন সহীহ মুসলিম শরীফে এসেছে- سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الاِثْنَيْنِ فَقَالَ : فِيهِ وُلِدْتُ وَفِيهِ أُنْزِلَ عَلَىَّ -রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সোমবারে রোযা রাখা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, সেদিন আমি জন্মলাভ করেছি এবং সেদিনেই আমার প্রতি (প্রথম) অহী নাযিল হয়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮০৭)
হাদীসটি দ্বারা বুঝা যায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় জন্মদিনে শুকরিয়া প্রকাশার্থে রোযা রেখেছিলেন। আর প্রতি সোমবার রোযা রাখা প্রমাণ করে যে, জন্মদিনের জন্য শুকরিয়া প্রকাশার্থে জন্মদিন পালন করা দোষনীয় নয়। এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মোল্লা আলী কারী (র.) বলেন, وفي الحديث دلالة على أن الزمان قد يتشرف بما يقع فيه -এ হাদীসে প্রমাণ রয়েছে যে, সময় তার মধ্যে সংঘটিত বিষয় দ্বারা মর্যাদাবান হয়ে থাকে। (মিরকাতুল মাফাতীহ, খ- ৬, পৃ ৩৭২) আর আমরাতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিন পালনের সময় বিজাতীয় আচার অনুষ্ঠান অনুসরণ করি না। তাই এ যুক্তি দিয়ে মীলাদ মাহফিলকে রদ করা যায় না।
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র.) বলেন,
عندي أن أصل عمل المولد الذي هو اجتماع الناس وقراءة ما تيسر من القرآن ورواية الأخبار الواردة في مبدأ أمر النبي صلى الله عليه وسلّم وما وقع في مولده من الآيات ثم يمد لهم سماط يأكلونه وينصرفون من غير زيادة على ذلك هو من البدع الحسنة التي يثاب عليها صاحبها لما فيه من تعظيم قدر النبي صلى الله عليه وسلّم وإظهار الفرح والاستبشار بمولده الشريف
-আমার মতে, মীলাদ মাহফিলের মূল কাজ হলো কিছু মানুষ একত্রিত হওয়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মকালীন সংঘটিত ঘটনাবলী এবং তাঁর প্রাথমিক জীবন সংক্রান্ত হাদীস আলোচনা করা, অতপর খাবার বিতরণ করা ও খাওয়া ইত্যাদি বিদআতে হাসানা, যা করলে ব্যক্তি সাওয়াব পাবে। কারণ, এতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তাযীম করা হয় এবং তাঁর পবিত্র জন্মে খুশি প্রকাশ করা হয়। (আল হাভী লিল ফাতাওয়া, খ- ১, পৃ ১৮২)
আপত্তি -০২
প্রচলিত মীলাদের সূচনাকারী কোন ভালো মানুষ ছিলেন না।
জবাব
এ আপত্তি মোটেও সঠিক নয়। ইমাম যুরকানী (র.) বলেন, প্রথম যিনি মীলাদ শরীফের মাহফিল চালু করেন তিনি হলেন- ইরাকের ইরবিল শহরের বাদশাহ আবূ সাঈদ মুযাফফারুদ্দীন। তার যুগের কোন আলেমই বিষয়টি অস্বীকার করেননি। হাফিয ইবনু কাসীর (র.), যিনি উক্ত বাদশাহের সমসাময়িক ছিলেনÑ তিনি বলেন, বাদশাহ আবূ সাঈদ রবীউল আউয়ালে মীলাদ মাহফিল করতেন এবং খুব গুরুত্বের সাথে তা উদযাপন করতেন। আর তিনি ছিলেন একজন বীরপুরুষ এবং আমলদার ব্যক্তি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ, ১৩: ৭)
আপত্তি -০৩
মীলাদ-কিয়াম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিঈনে ইযামের যামানায় ছিল না বিধায় তা বিদআত এবং পরিত্যাজ্য।
জবাব
উক্ত দাবী সর্বাংশে সঠিক নয়। কেননা, মীলাদের প্রচলিত রূপটি উক্ত যামানায় না থাকলেও মীলাদের মৌলিক রূপ তখনও ছিল। কেননা, মীলাদে যা করা হয় তা হলোÑ কুরআন তিলাওয়াত, দুরূদ শরীফ পাঠ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাম প্রদান করা, কিয়াম করা, দুআ করা এবং খাদ্য বিতরণ করা। এ সকল কাজ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ছিল। যার দলীল এ ছোট্ট নিবন্ধে প্রদান করা অনাবশ্যক। কেননা, বিষয়গুলো সবার কাছেই প্রমাণিত। আর উক্ত বৈধ বিষয়গুলো একত্রে আদায় করার কারণে বাহ্যিকভাবে এটি নতুন বলে মনে হচ্ছে। তাই এটিকে হাকীকী অর্থে বিদআত বলা ঠিক হবে না। সায়্যিদ আলাভী মালিকী (র.) বলেন, وما تركب من مشروع فهو مشروع বৈধ কাজের সমষ্টিও বৈধ।
আপত্তি-০৪
মীলাদের মাধ্যমে আপনারা কি প্রমাণ করতে চান যে, আপনারা সাহাবায়ে কিরামের চেয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বেশি মহব্বত করেন?
জবাব
সাহাবায়ে কিরামের সাথে উম্মতের অন্য কাউকে তুলনা করাকে আমরা সমীচীন মনে করি না। তবে পরবর্তী কেউ পূর্ববর্তীদের অপেক্ষা সামগ্রিকভাবে না হলেও কোন কোন দিক থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বেশি মহব্বত করতে পারে এমন কথা হাদীস শরীফেও উল্লেখ রয়েছে। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, إن من أشد أمتي لي حبا ناسا يكونون بعدي يود أحدهم لو رآني بأهله وماله -আমার পরে আমার উম্মতের মাঝে এমন কিছু মানুষ হবে, যারা আমার প্রতি সর্বাধিক ভালোবাসা স্থাপনকারী বলে বিবেচিত হবে। তাদের কেউ কেউ কামনা করবে যে, যদি সে তার পরিবার-পরিজন এবং সম্পদের বিনিময়েও আমাকে দেখতে পেত!। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮৩২)
তাছাড়া সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন দ্বীনের বড় বড় কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এসব নফল নিয়ে তাদের চিন্তা করার এতো সময় কোথায়? তবে তাদের মাঝে ব্যক্তি পর্যায়ে নবী (সা.) এর প্রতি মহব্বত প্রকাশের জন্য অধিক হারে দুরূদ পড়ার প্রচলন ছিল।
আপত্তি-০৫
মীলাদ ছাড়া কি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহব্বত প্রকাশ করা যায় না?
জবাব
আমরা এ কথা কখনো বলি না যে, মীলাদ শরীফই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহব্বত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম; বরং আমরা বলি, অন্যতম মাধ্যম। কেননা, এর মাধ্যমে দুরূদ ও সালাম পাঠ করা হয়। তাই আমরা কাউকে মীলাদ শরীফ পড়তে বাধ্য করি না। তবে, বিরোধীদেরও উচিত সহনীয় পর্যায়ে কথা বলা।
আপত্তি-০৬
ইবাদতের ক্ষেত্রে পদ্ধতি আবিষ্কার করা বিদআত এবং কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী।
জবাব:
এ কথা আমরাও স্বীকার করি যে, ইবাদত আবিষ্কার করা অবৈধ। কিন্তু যদি কোন ইবাদতের পদ্ধতি শরীআতে নির্ধারিত না থাকে সেক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সহজীকরণার্থে পদ্ধতি বানানো দোষের কিছু নয়। যেমন; কুরআন শিক্ষা করা একটি ইবাদত। অথচ বর্তমানে নানা পদ্ধতিতে আমরা তা শিক্ষা করে থাকি। যেমন: বোগদাদী, নূরানী, নাদিয়া, বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি পদ্ধতি। কেননা, এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য হলো কুরআন শিক্ষা করা; পদ্ধতি কোন ব্যাপার নয়। তদ্রুপ উদ্দেশ্য হলো দুরূদ পড়া। তা একাকী হোক বা মীলাদ মাহফিলের মাধ্যমে হোক।
তাছাড়া মীলাদ মাহফিল স্বতন্ত্র কোন ইবাদত নয়; বরং এটা কতগুলো মাশরু’ (বৈধ) ইবাদতের সমাহার। মীলাদ মাহফিল যদি কোন স্বতন্ত্র ইবাদত হিসেবে আবিষ্কৃত হতো তবে তা সব অঞ্চলে একই রকম অনুষ্ঠিত হতো এবং এর জন্য নির্ধারিত সাওয়াবের ঘোষণা থাকত। অথচ ব্যাপারটি তদ্রƒপ নয়।
আপত্তি-০৭
দ্বীনের জন্য বিদআত (বিদআত লিদ্দীন) জায়িয, কিন্তু দ্বীনের ভেতরে বিদআত (বিদআত ফিদ্দীন) নাজায়িয।
জবাব
কে বলেছে দ্বীনের জন্য বিদআত জায়িয আর দ্বীনের ভেতরে বিদআত করা নাজায়িয? বিদআত তো বিদআতই। তাছাড়া আপনারা যেটা করেন সেটা দ্বীনের জন্য আর মীলাদ মাহফিল দ্বীনের ভেতরের বিদআত সেটা কে নির্ধারণ করলো? মূলনীতি হলো শরীআর দলীলের অনুকূলে হলে সেটা সুন্নাতে হাসানা এবং গ্রহণযোগ্য হবে। আর সাংঘর্ষিক হলে তা বিদআতে দলালাহ ও পরিত্যাজ্য হবে।
আপত্তি-০৮
বিদআত আবিষ্কার করা অপেক্ষা সুন্নাত জীবিত করা অধিক উত্তম।
জবাব
এ আপত্তিটি একটি হাদীসেরই অর্থ বিশেষ। যেখানে বলা হয়েছে, বিদআত আবিষ্কার করা অপেক্ষা সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা উত্তম। তবে এটাও প্রকাশ্য কথা যে, হাদীসে বিদআত বলে শরঈ বিদআত তথা পারিভাষিক বিদআত উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। শাব্দিক অর্থে যা বিদআত তা এখানে উদ্দেশ্য নয়। কারণ, শাব্দিক বিদআতের মধ্যে যা প্রশংসনীয় তাকে হাদীসের পরিভাষায় সুন্নাতে হাসানা বলা হয়। এ আপত্তির দ্বারাও মীলাদ মাহফিলকে বানচাল করা যায় না। কারণ, মীলাদ মাহফিল প্রকৃতপক্ষে বিদআত নয়; বরং তা সুন্নাতে হাসানা।
আপত্তি-০৯
মূলনীতি আছে, সুন্নাত ও বিদআতের মধ্যে এখতেলাফ হলে তা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়।
জবাব
কোন কাজ সুন্নাত না বিদআত তা নিয়ে এখতেলাফ হলে সে কাজ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। এ নীতি অবশ্যই একটি সঠিক নীতি। তবে শর্ত এই যে, এখতেলাফ বা মতবিরোধটি দালীলিক এবং যৌক্তিক হতে হবে। বিনা প্রমাণে কোন বিষয়কে বিদআত দাবী করা বা যে আমলটি মূলতঃ সুন্নাতে হাসানা বা শাব্দিক অর্থে বিদআত তথা প্রকৃত অর্থে বিদআত নয়, তাকে বিদআত বলে সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে দাঁড় করানো সঠিক নয়। প্রচলিত মীলাদ মাহফিল আসলে সুন্নাতে হাসানা। এটিকে অনেকে বিদআতে হাসানা বলে থাকেন। তা অবশ্য শাব্দিক অর্থে। পারিভাষিক অর্থে এটি বিদআত নয়। তাই এটি সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক নয়।
আপত্তি-১০
রবীউল আউয়াল মাসকে খাস করার কারণ কি?
জবাব
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম বৃত্তান্ত বিষয়ক অনুষ্ঠান তথা মীলাদ মাহফিল এর জন্য নির্ধারিত কোন সময় নেই; বরং যে কোন সময়ই তা উদযাপন করা যায়। দিনে, সপ্তাহে বা মাসে যতবেশি এ অনুষ্ঠান করা যাবে ততই মঙ্গল। তবে রবীউল আউয়াল মাস মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মমাস হওয়ায় বিষয়টি মনের মাঝে উজ্জীবিত হয় বেশি। আর আল্লাহ তাআলা মানুষের মনকে এ রকম স্বভাব দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। মানুষ প্রসঙ্গ ভালোবাসে। তাছাড়া কোন কারণ থাকলে সময়কে খাস করা বৈধ। হযরত ইবনু মাসউদ (রা.) প্রতি বৃহস্পতিবার ওয়ায করতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি শনিবার মদীনা থেকে কুবা মসজিদে যেতেন বলে হাদীস শরীফে প্রমাণ রয়েছে। (তাবারানী, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং ৮৩৪, হায়সামী (র.) বলেন, হাদীসটির রাবীগণ সকলে সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য।)
আপত্তি-১১
অনেকে বলে থাকেন, ১২ রবীউল আউয়াল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হয়েছে কি না তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে, কিন্তু ১২ রবীউল আউয়াল তাঁর ইন্তিকাল দিবস নিশ্চিত। তাই উক্ত দিন তো দুঃখের দিন। দুঃখের দিনে আনন্দ প্রকাশ করা উপহাসের শামিল। তাই এটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি তাযীম প্রদর্শন নয়; বরং তাকে তাওহীন বা অপমান করার শামিল, যা প্রকাশ্য কুফরী।
জবাব
আমরা বলব, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মের বছর যে হাতি সাল তথা আবরাহার হস্তীবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ করার বছর তা নিয়ে কোন মতভেদ নেই। ইবনু ইসহাক (র.) বলেন, এটি মাশহুর কথা। ইবনু দেহইয়া, ইবনুল জাওযী ও ইবনুল কায়্যিমসহ অনেকে বলেন, এ ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের মাঝে ইজমা সংঘটিত হয়েছে। হাদীস শরীফে রয়েছেÑ عن ابن عباس رضي الله عنهما قال : ولد النبي صلى الله عليه و سلم عام الفيل -হযরত ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) হাতি সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। (মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদীস নং ৪১৮০। ইমাম হাকিম (র.) বলেন, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মুতাবিক সহীহ।)
অনুরূপ, তার জন্ম বার যে সোমবার ছিল তা নিয়েও মতভেদ নেই। কেননা, হাদীস শরীফে রয়েছেÑ سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الاِثْنَيْنِ فَقَالَ : فِيهِ وُلِدْتُ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবারে রোযা রাখা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, সেদিন আমি জন্মলাভ করেছি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৮০৭)
তদ্রুপ হাফিয ইবনু কাসীর ও ইবনু হাজার (র.) বলেন, অধিকাংশ আলিমের মতে, তাঁর জন্ম মাস ছিল রবিউল আউয়াল। সুহাইলী (র.) বলেন, এটিই প্রসিদ্ধ মত। সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ কিতাবে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে কেউ কেউ ইজমা হওয়ার দাবীও করেছেন।
তবে তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে অনেকে মতভেদ করে থাকেন। মুস্তাদরাকে হাকিমে মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক (র.) থেকে বর্ণিত আছে, তাঁর জন্ম তারিখ ছিল ১২ রবিউল আউয়াল। গুরার কিতাবে বলা হয়েছে-এর ওপরই আমল চলছে। সিরাতে হালাবিয়া কিতাবে বলা হয়েছে, এটিই মাশহুর বা প্রসিদ্ধ মত। আলী মুহাম্মাদ আস সালাবী তার সীরাতে নববীয়া কিতাবে বলেছেন, এটি অধিকাংশের মত। সীরাতে ইবনু হিব্বান কিতাবেও এ মতটিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
তবে কেউ কেউ বলেন, তাঁর জন্ম তারিখ ৮ রবিউল আউয়াল। হাফিয ইবনু দেহইয়া এবং ইবনু হাজার (র.) এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর ইবনু হাযম এবং হুমাইদী (র.) এ মতটিকে পছন্দ করেছেন।
তাই, ১২ রবীউল আউয়াল ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) কে খাস করলে অধিকাংশ আলিমের মতামত বা প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী আমল করা হয়। এতে কোন অসুবিধা নেই। আর কোন কারণে দিনক্ষণ নির্ধারণ করার বৈধতা সম্পর্কে পূর্বে বলা হয়েছে।
পক্ষান্তরে, যদিও অনেক আলিমের মত হলো- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তিকাল ১২ রবীউল আউয়াল হয়েছে কিন্তু যৌক্তিক কারণে উক্ত দিন তাঁর ইন্তিকালের দিন হতে পারে না। তাই উক্ত দিনে দুঃখ ও খুশির সংমিশ্রণ ঘটেনি। কেননা, তার ইন্তিকালের দিন সোমবার হওয়া সুপ্রমাণিত। আর বিদায় হজ্জ তথা ৯ যিলহজ্জ শুক্রবার হওয়াও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। অথচ সেখান থেকে দিন গুণে আসলে ১২ রবীউল আউয়াল কোন ক্রমেই সোমবার হয় না। কেননা, যিলহজ্জ, মহররম, সফর এ তিনটি মাসের প্রত্যেকটি যদি ২৯ দিনে ধরা হয় তবে ১২ রবীউল আউয়াল হয় বৃহস্পতিবার, যদি ২মাস ২৯ দিনে এবং ১মাস ৩০দিনে ধরা হয় তবে ১২ রবীউল আউয়াল হয় শুক্রবার আর ২মাস ৩০ দিনে এবং ১ মাস ২৯ দিনে ধরা হলে ১২ রবীউল আউয়াল হয় শনিবার।
আল্লামা সুহাইলী (র.) বলেন, রাসূল (সা.) এর ইন্তিকাল দিবস ছিল ২ রবীউল আউয়াল। আর সবগুলো মাস ২৯ দিন ধরলে ২ রবীউল আউয়াল সোমবার হয়। হযরত ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সা.) বিদায় হজ্জের পর মাত্র ৮০ দিন জীবিত ছিলেন। আর বিদায় হজ্জ থেকে ৮০ দিন গণনা করলেও সোমবার পড়ে ২ রবীউল আউয়াল।
সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ কিতাবে বলা হয়েছে, এই কওলটি জমহুরের মতের বিপরীত হলেও তা সঠিক ও বিশুদ্ধ।
মুস্তাদরাকে হাকিমে বর্ণিত আছে-
اشتكى في النصف من صفر ثم قبض يوم الإثنين ليومين مضيا من شهر ربيع الأول
-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফর মাসের মধ্যবর্তী সময়ে অসুস্থ হলেন, অতঃপর রবীউল আউয়াল মাসের ২ তারিখ সোমবার ইন্তিকাল করেন। (মুস্তাদরাকে হাকিম, খ- ৪, পৃষ্ঠা- ৪০)
তাছাড়া জমহুরের কওল মুতাবেক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১২ রবীউল আউয়াল ইন্তিকাল করলেও সেদিন দুঃখ প্রকাশের দিন হিসেবে আর বাকী নেই। কারণ, কারো মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য শরীআত তিন দিন সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। এছাড়া হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তিকালকেও উম্মতের জন্য কল্যাণকর বলা হয়েছে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনÑ
حياتي خير لكم تحدثون ويحدث لكم ووفاتي خير لكم تعرض علي أعمالكم فما رأيت من خير حمدت الله عليه وما رأيت من شر استغفرت الله لكم
-আমার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তোমরা কথা বল এবং তোমাদের সাথেও কথা বলা হয়। আর আমার ইন্তিকালও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তোমাদের আমল আমার সামনে পেশ করা হবে। যদি আমি তাতে ভালো কিছু দেখি তবে সেজন্য আমি আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করব। আর খারাপ কোন কিছু দেখলে তোমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব। (মুসনাদে বায্যার, মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস নং ১৪২৫০; ইমাম হায়সামী (র.) বলেন, এ হাদীসের রাবীগণ সকলে সহীহ হাদীসের রাবী।)
আপত্তি-১২
অনেকেই দুরূদ ও সালাম পড়তে গিয়ে ভুল উচ্চারণ করে থাকে। তাই এতে সাওয়াবের পরিবর্তে গোনাহ হতে পারে।
জবাব
কেউ যদি দুরূদ ও সালাম পড়তে গিয়ে ভুল উচ্চারণ করে থাকে, তবে সে কারণে অন্যদের জন্য মীলাদ মাহফিল নাজায়িয হতে পারে না। হ্যাঁ, উক্ত ব্যক্তির উচিত যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সঠিক উচ্চারণ শিক্ষা করে নেয়া। কারণ, কোন ব্যক্তি যদি নামাযে সূরা-কিরাত, দুআ-দুরূদ ইত্যাদি ভুল পড়ে তবে সে কারণে অন্যদের জন্য নামায পড়া নিষিদ্ধ করে দেয়া যায় না; বরং বলতে হবে যে, ভুল উচ্চারণকারী দ্রুত সঠিক উচ্চারণ শিখে নিবে।
আপত্তি-১৩
মীলাদ মাহফিলে বানোয়াট দুরূদ ও সালাম পড়া হয়ে থাকে।
জবাব
আপত্তি করা হয় যে, মীলাদ মাহফিলে যে দুরূদ বা সালাম পড়া হয়ে থাকে তার প্রায় সবই কোন না কোন আলিম কর্তৃক বানানো; হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এর উত্তরে বলা যায় যে, দুরূদ ও সালাম কোন নির্ধারিত নিয়মে পড়া শরীআতে বাধ্য করা হয়নি। অথবা হাদীসে বর্ণিত শব্দের বাইরে অন্য শব্দে পড়াকে হারামও করা হয়নি। তার প্রমাণ হলো, যুগে যুগে আলিমগণ তাঁদের কিতাবের শুরুতে যে দুরূদ লিখেছেন তার কোনটার শব্দই হুবহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাছাড়া মুহাদ্দিসীনসহ আম জনতার মাঝে যে সংক্ষিপ্ত দুরূদটি বেশি প্রসিদ্ধ তাও কোন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। দুরূদটি হলোÑصلى الله عليه وسلم (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র নাম শুনে এ দুরূদটি পড়লে কেউ তো আপত্তি করে না। এমনকি মীলাদ মাহফিলে বানানো দুরূদ পড়ার বিরোধিতকারীরাও উক্ত দুরূদ পড়ে থাকেন। উলামায়ে কিরামের এ ইজমায়ে ফেলী (কর্মগত ঐক্যমত) এর কারণ সম্ভবত এটা যে, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেনÑ صلوا عليه وسلموا تسليما তোমরা তাঁর (নবীর) প্রতি দুরূদ ও সালাম প্রেরণ কর। এখানে আল্লাহ তাআলা কোন পদ্ধতিকে শর্ত করেননি; বরং আয়াতটিকে মুতলাক রেখেছেন। আর উসূল মুতাবিক মুতলাককে মুকাইয়াদ না করে মুতলাক রাখাই শ্রেয়।
বর্ণিত আছে, সাহাবায়ে কিরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমরা তো সালামের নিয়ম জানি, কিন্তু আপনার ওপর সালাত তথা দুরূদ পড়ব কিভাবে? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে একটি দুরূদ শিক্ষা দিলেন। এর দ্বারা হয়তো কেউ বলতে পারে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রদত্ত তালীম মুতাবিকই দুরূদ পড়তে হবে।
এর জবাবে আমরা বলব, যদি পদ্ধতি নির্ধারিত হতো তবে তো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে জীবনে একটিই দুরূদ শিক্ষা দিতেন। অথচ হাদীস শরীফে বিভিন্ন শব্দের দুরূদ প্রমাণিত রয়েছে। তাছাড়া কোন হাদীসে তিনি বলেননি, আমি তোমাদেরকে যে দুরূদ শিক্ষা দিয়েছি তার বাইরে দুরূদ পড়া যাবে না। এছাড়া দুরূদ মানে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য কল্যাণ বা রহমত কামনা করা। আর তা যে কোন শব্দে হতে পারে। তবে হাঁ, এটা বলা যেতে পারে যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তালীম দেয়া শব্দে দুরূদ পড়া উত্তম হবে। কিন্তু এটা বলা বৈধ নয় যে, এর বাইরের দুরূদগুলো পাঠ করা নাজায়িয; বরং তা অবশ্যই জায়িয।
অনেকে আবার দুরূদে ইবরাহীম পড়ার কথা বলে থাকেন। কিন্তু ইবনু হাজার হায়তামী (র.) নামাযের বাইরে শুধু দুরূদে ইবরাহীম পড়া মাকরূহ বলেছেন। কারণ, আল্লাহ তাআলার আদেশ হলো দুরূদ ও সালাম উভয়টি পাঠ করা। আর উক্ত দুরূদে ইবরাহীমে শুধু দুরূদ আছে, কিন্তু সালাম নাই। নামাযে যেহেতেু তাশাহহুদ এর মধ্যে সালাম রয়েছে তাই সেখানে উক্ত দুরূদ পড়াতে কোন সমস্যা নেই।
আপত্তি-১৪
তাওয়াল্লুদ এর মধ্যে মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। অথচ জাল হাদীস বর্ণনা করা হারাম।
জবাব
আমরা বলব, তাওয়াললুদের মাঝে বানোয়াট রিওয়ায়েত থাকলে তা বর্ণনা করা অবশ্যই ঠিক হবে না। কিন্তু সে কারণে মীলাদ মাহফিলকে হারাম বলা যায় না; বরং হুকুমটি শুধু তাওয়াললুদের প্রতিই যায়। আপনি পারেন সহীহ রিওয়ায়েতের তাওয়াললুদ পাঠ করতে। কারণ, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির রচিত তাওয়াললুদ পাঠ করা জরুরী নয়। অবশ্য আমাদের দেশে মাওলূদে বারযাঞ্জী থেকে তাওয়াললূদ পাঠ করা হয়ে থাকে। তাতে দূর্বল বর্ণনা থাকতে পারে, জাল বর্ণনা আছে বলে আমাদের জানা নেই। বিনা প্রমাণে জাল বলাও সঠিক নয়।
আপত্তি-১৫
মীলাদের প্রথম থেকে না দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে কেন দাঁড়ানো হয়? সম্মান কি প্রথম থেকে করা কাম্য নয়?
জবাব
মীলাদ মাহফিলের প্রথমে তো সালাত পাঠ করা হয় তাই তখন দাঁড়ানো হয় না। কিন্তু যখন সালাম প্রদানের সময় আসে তখন সম্মানার্থে দাঁড়ানো হয়। কারণ, দাঁড়িয়ে সালাম দেওয়া আদব। রওদ্বা শরীফের সামনে গিয়ে আমরা আদব প্রদর্শনার্থে দাড়িয়ে সালাম দিয়ে থাকি। হুসাইন আহমদ মাদানী (র.) রওদ্বার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দেওয়াকে আদব লিখেছেন। আর মীলাদের সময় যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমরা দেখি না কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, গায়েবকেও তাযীম করা যায়। যেমন কা’বা শরীফকেও আমরা দূর থেকে সম্মান করে থাকি এবং সে দিকে ফিরে পেশাব বা পায়খানা করাকে হারাম মনে করি। তবে, দাঁড়িয়ে সালাম দেয়া তা’যীম হলেও এটাকে আমরা ফরয মনে করি না; বরং মুস্তাহাব মনে করে থাকি। কোন কোন আলিম বলে থাকেন এটা কিয়ামে তা’যীমী নয়, বরং কিয়ামে ফারহাত বা আনন্দের জন্য দাঁড়ানো। কেননা, তাওয়াললুদে যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র বেলাদাতের কথা বলা হয় তখন শ্রোতা কল্পনা করে যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ধরায় আবির্ভাবে বিশ্ববাসী খুশি প্রকাশ করছে। তাই সেও সেই খুশিতে দাঁড়িয়ে যায়। এমন ব্যাখ্যাও কোন কোন আলিম দিয়ে থাকেন। এটা মুস্তাহসান, মুস্তাহাব নয় এবং জায়িয।
যেহেতু দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে সর্বাবস্থায় সালাম প্রদান করা বৈধ তাই কোন মূহুর্তে দাঁড়িয়ে সালাম প্রদান করলে কোন সমস্যা নেই। যদি না এটাকে জরুরী মনে করা হয়। আর আমরা তা করিও না।
আপত্তি-১৬
মুস্তাহাব কাকে বলে এবং তা কিভাবে প্রমাণিত হয়ে থাকে?
জবাব
মুস্তাহাব অর্থ প্রিয় বা পছন্দনীয় কাজ। পরিভাষায় মুস্তাহাব হলো ঐ পছন্দনীয় কাজ, যা সুন্নাত অপেক্ষা নিচে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল কাজ করতে উৎসাহিত করেছেন, কিন্তু নিজে করেননি অথবা নিজে উক্ত কাজ দু’এক বার করেছেন তা মুস্তাহাব। মুস্তাহাব এর আরেকটি দিক হলো- যা উলামায়ে কিরাম ভালো মনে করেন। হাদীস শরীফে আছে- ما رآه المؤمنون حسنا فهو عند الله حسن মুমিনগণ যা ভালো মনে করেন, তা আল্লাহ তাআলার নিকটেও ভালো। আর মীলাদ-কিয়ামকে বহু হক্কানী উলামায়ে কিরাম ভালো মনে করেছেন। তাই এটা অবশ্যই মুস্তাহাব কাজ।
আপত্তি-১৭
মীলাদ মাহফিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে হাযির জেনে কিয়াম করা হয়। এটা শিরকতুল্য গুনাহ।
জবাব
মীলাদ মাহফিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বশরীরে হাযির হন এটা মনে করে আমরা কিয়াম করি না। তাই শিরক হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। যদিও আমরা মনে করি যে, তিনি আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় যেখানে খুশি রূহানীভাবে ভ্রমণ করতে পারেন। আল্লামা আলূসী (র.) বলেন, أنه حي بروحه وجسده يسير حيث شاء في أقطار الأرض والملكوت -তিনি (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় শরীর এবং রূহসহকারে (কবরে) জীবিত। তিনি আসমান জমীনের যেখানে ইচ্ছা ভ্রমণ করতে পারেন। (রূহুল মাআনী, ২২ : ৪৫)
আপত্তি-১৮
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য দাঁড়ানোকে অপছন্দ করতেন বলে হাদীসে বর্ণনা রয়েছে। যেমন হাদীস শরীফে আছে-
عن أنس بن مالك قال : لم يكن شخص أحب إليهم من رسول الله صلى الله عليه وسلم وكانوا إذا رأوه لم يقوموا لما يعلمون من كراهيته لذلك
-হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরামের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপেক্ষা প্রিয় ব্যক্তি আর কেউ ছিল না। অথচ তারা যখন তাঁকে দেখতেন, তখন কিয়ামের প্রতি তাঁর অপছন্দের কথা জানায় দাঁড়াতেন না (মিশকাত, হাদীস নং ৪৬৯৮)। এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্যে দাঁড়ানো অপছন্দ করতেন।
জবাব
এর জবাবে বলা যায় যে, এ অপছন্দ কিয়াম হারাম বা মাকরূহ হওয়ার জন্য নয়; বরং বিনয়বশত ছিল। যেমনটা মোল্লা আলী কারী (র.) মিরকাত কিতাবে বলেছেন। কারণ অন্য হাদীসে আমরা দেখতে পাই সাহাবায়ে কিরাম তাঁর জন্য দাঁড়িয়েছেন, তিনি অন্যদের জন্য দাঁড়িয়েছেন এবং দাঁড়ানোর জন্য হুকুম করেছেন।
যেমন হাদীস শরীফে আছেÑ
عن أبي هريرة قال : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجلس معنا في المسجد يحدثنا فإذا قام قمنا قياما حتى نراه قد دخل بعض بيوت أزواجه.
-হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সাথে মসজিদে বসে কথাবার্তা বলতেন, অতঃপর যখন তিনি দাঁড়াতেন, আমরাও দাঁড়িয়ে যেতাম। যতক্ষণ না দেখতাম তিনি তাঁর কোন স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করেছেন। (মিশকাত, হাদীস নং ৪৭০৫)
অন্য হাদীসে আছেÑ
عن أبي سعيد الخدري قال : لما نزلت بنو قريظة على حكم سعد بعث رسول الله صلى الله عليه وسلم إليه وكان قريبا منه فجاء على حمار فلما دنا من المسجد قال رسول الله صلى الله عليه وسلم للأنصار : ” قوموا إلى سيدكم ” . متفق عليه
-হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বনূ কুরাইযা গোত্র যখন হযরত সা’দের বিচার মেনে দুর্গ থেকে নেমে আসলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি মসজিদের কাছেই ছিলেন। তিনি একটি গাধায় চড়ে আসলেন। তিনি মসজিদের নিকটবর্তী হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আনসারদেরকে বললেন, তোমরা তোমাদের নেতার জন্য দাঁড়িয়ে যাও। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত, হাদীস নং ৪৬৯৫)
অন্য হাদীসে আছেÑ
عن عائشة رضي الله عنها قالت : ما رأيت أحدا كان أشبه سمتا وهديا ودلا . وفي رواية حديثا وكلاما برسول الله صلى الله عليه وسلم من فاطمة كانت إذا دخلت عليه قام إليها فأخذ بيدها فقبلها وأجلسها في مجلسه وكان إذا دخل عليها قامت إليه فأخذت بيده فقبلته وأجلسته في مجلسها . رواه أبو داود
-হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আচরণ, চরিত্র, নির্দেশনা, কথা ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ফাতিমার চেয়ে কাউকে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ দেখিনি। তিনি যখন তাঁর নিকট প্রবেশ করতেন, তিনি [রাসূল (সা.)] তার জন্য দাঁড়াতেন, তার হাত ধরে চুমু খেতেন এবং স্বীয় মজলিসে বসাতেন। আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার [ফাতিমা (রা.)-এর] নিকট প্রবেশ করতেন, তিনি তাঁর জন্য উঠে দাঁড়াতেন, তাঁর হাত ধরে চুমু খেতেন এবং স্বীয় মজলিসে বসাতেন। (আবূ দাঊদ, হাদীস নং ৫২১৭)
এসব হাদীসকে সামনে রেখে বলা যায় যে, কিয়ামে ফারহাত এবং কিয়ামে তা’যীমী বৈধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু বিনয়বশত কিয়াম করতে নিষেধ করতেন। আর হারাম হলো শুধু কিয়ামে তাকাব্বুরী। যেমন হাদীস শরীফে আছেÑ হযরত মুআবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনÑ
من سره أن يتمثل له الرجال قياما فليتبوأ مقعده من النار
-যে ব্যক্তি চায় তার জন্য মানুষেরা মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।
আপত্তি-১৯
মীলাদ মাহফিলে কিয়ামের সময় যে কাসীদাসমূহ পাঠ করা হয় তার মধ্যে অনেক সময় শিরকপূর্ণ কাসীদা থাকে।
জবাব
আমরা বলব, কোন কাসীদার (কবিতার) মাঝে শিরকপূর্ণ কথা থাকলে তা শুধু মীলাদ মাহফিলে কেন, যে কোন মজলিসেই পাঠ করা হারাম হবে। তবে, তাহকীক না করে ওসীলা সংক্রান্ত এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গুণাবলী সংক্রান্ত কাসীদাকে শিরকপূর্ণ বলা সঠিক নয়। শিরককে আমরাও ভয় করি এবং তা থেকে দূরে থাকাকে ফরয মনে করি। আর কোন এক ব্যক্তির শিরকপূর্ণ কাসীদা পাঠের কারণে আমভাবে মীলাদ মাহফিলকে হারাম ও নাজয়িয বলা যায় না।
আপত্তি-২০
সালাম পূর্বে দেয়া কর্তব্য। অথচ আপনারা কিয়ামের সময় প্রথমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সম্বোধন করেন অতঃপর সালাম দেন। আপনারা বলেন, يا نبي سلام عليك (ইয়া নবী সালাম আলাইকা) এটা হাদীস বিরোধী। যেমন হাদীস শরীফে আছে-
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: السَّلاَمُ قَبْلَ الكَلاَمِ.
-হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কথা বলার পূর্বে সালাম দিতে হবে। (তিরমিযী, হাদীস নং- ২৬৯৯)
জবাব
আমরা বলবো, উক্ত হাদীসটি এতই দুর্বল যে, তা দ্বারা দলীল প্রদান করা যায় না। উক্ত হাদীস প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিযী (র.) বলেন:
هَذَا حَدِيثٌ مُنْكَرٌ، لاَ نَعْرِفُهُ إِلاَّ مِنْ هَذَا الوَجْهِ. سَمِعْتُ مُحَمَّدًا، يَقُولُ: عَنْبَسَةُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ضَعِيفٌ فِي الحَدِيثِ ذَاهِبٌ وَمُحَمَّدُ بْنُ زَاذَانَ مُنْكَرُ الحَدِيثِ.
-এ হাদীসটি মুনকার। এটি এ সনদ ব্যতীত আমরা জানি না। আমি ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বুখারী (র.) কে বলতে শুনেছি, (উক্ত হাদীসের সনদে উল্লেখিত) আম্বাসা ইবনু আব্দির রহমান হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল এবং তার সব চলে গেছে। আর মুহাম্মদ ইবনু যাযান এর হাদীস মুনকার। (তিরমিযী, ৪: ৩৫৬)
সুতরাং এ হাদীস দিয়ে দলীল দেয়া সঠিক নয়। কেননা, এ পর্যায়ের দুর্বল হাদীস দ্বারা মুস্তাহাবের ক্ষেত্রেও প্রমাণ পেশ করা যায় না; যদিও আমাদের মতে সাধারণ পর্যায়ের দুর্বল হাদীস দ্বারা মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে প্রমাণ দেয়া জায়িয। ( তাইসীরু মুস্তালাহিল হাদীস, পৃ.-৩৪)
উল্লেখ্য যে, কোথাও প্রবেশের ক্ষেত্রে অনুমতি গ্রহণের পূর্বে সালাম দেয়ার কথা যদিও কুরআনের সূরা নূরে রয়েছে, কিন্তু তা প্রবেশের ক্ষেত্রেই, নিজে কথা বলার ক্ষেত্রে নয়। আর এখানের বিষয়টি কোন প্রবেশ সংক্রান্ত নয়; বরং কথা সংক্রান্ত। তাই আয়াত দ্বারাও এখানে দলীল প্রদান করা সঠিক হবে না।
আপত্তি-২১
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আহবান করে يا نبي বলা নাজায়েয। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত মাজলিসে উপস্থিত নেই।
জবাব
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে يا (ইয়া) হরফে নেদা দ্বারা সম্বোধন করা জায়িয। আর এজন্য তাঁকে কবর থেকে উঠে আসতে হবে না। কারণ, দূরবর্তী ব্যক্তিকে ‘ইয়া’ হরফ দ্বারা ডাকা যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদিও দূরে কিন্তু তিনি মৃত নন; বরং তিনি কবরে জীবিত। তিনি আমাদের ডাক না শুনলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ নাহুবিদদের মতে, ‘ইয়া’ হরফটি নিকটবর্তী ও দূরবর্তী সকলকে ডাকার জন্য ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া يا نبي দ্বারা يا أيها النبي উদ্দেশ্য। সুতরাং ইলমে নাহুর দৃষ্টিতেও কোন বাঁধা নাই। যেমন নাহুবিদ মুবাররাদ (র.) তার المقتضب কিতাবে বলেন- يا رجل أقبل. فإنما تقديره: يا أيها الرجل أقبل অনুরূপ আছে শরহে জামী কিতাবে।
আপত্তি-২২
কখনো ফরয আমলের চেয়ে মীলাদ মাহফিলকে বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা যায়। নামায পড়ে না কিন্তু মীলাদের ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়।
জবাব
কোন ব্যক্তি যদি কখনো ফরয আমল অপেক্ষা মীলাদ মাহফিলকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তবে নিশ্চিত সেটা তার পক্ষে অন্যায়। এ জন্য মীলাদ মাহফিলকে খারাপ বলা যায় না। কেননা, এটা অন্যান্য নফল আমলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তাছাড়া আপনি তো মীলাদ মাহফিলে হাযির হয়ে উক্ত ব্যক্তিকে তার এ মূর্খতাসুলভ কর্মকা- সম্পর্কে সতর্ক করতে পারেন; এমনকি মীলাদ মাহফিল দাওয়াতের একটা উত্তম মাধ্যম হতে পারে। তাই এটাকে অস্বীকার করা অপেক্ষা স্বীকার করাই শ্রেয়।
আপত্তি-২৩
অনেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহব্বতে নয়; বরং খাওয়ার উদ্দেশ্যে মীলাদ পড়ে থাকে।
জবাব
এটা ঐ ব্যক্তির মহব্বত ও ইখলাসের কমতির কারণে। এজন্যে মূল আমলটিকে খারাপ বলা যায় না। কেউ যদি রিয়ার জন্য ফরয নামায পড়ে তবে সে গুনাহগার হবে, কিন্তু নামায পড়া অন্যদের জন্য হারাম হবে না। তাই বলব, মীলাদ শরীফ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহব্বত হাসিলের জন্যই পড়া কর্তব্য। অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে তা সংশোধন করতে হবে।
আপত্তি-২৪
বুযুর্গদের কর্ম ও বাণী শরীআতের দলীল বা হুজ্জাত নয়। তাই অমুক বুযুর্গ মীলাদ পড়েন বলে মীলাদকে জায়িয বলা যাবে না।
জবাব
মীলাদ মাহফিলের প্রমাণে যখন বলা হয় অমুক আল্লাহর ওলী এটা করেছেন এবং অমুক আলিম এটাকে সঠিক প্রমাণ করেছেন। তখন আপত্তি করে বলা হয় যে, বুযুর্গদের কর্ম ও বাণী শরীআতের দলীল বা হুজ্জাত নয়। আমরা বলব, সত্যিকারের বুযুর্গ তো সেই ব্যক্তি, যার কথা ও কাজ শরীআতের অনুকূলে হবে। আর যার কথা বা কাজ শরীআতে গ্রহণযোগ্য হবে না সে তো বুযুর্গ বা ওলীই হতে পারে না। তাই কাউকে বুযুর্গ বলে তার কথা বা কাজ অনুসরণ না করা স্ববিরোধী বলে মনে হয়। তাছাড়া বুযুর্গ বান্দারা সর্বদা সর্বোত্তম বিষয় এবং সাবধানতামূলক বিষয় আমল করে থাকেন। তাই তাদের কথা বা কাজ মান্য করলে তো সঠিকভাবে শরীআতের ওপর আমল করা সম্ভব হয়। তদুপরি ইজতেহাদী মাসআলায় বুযুর্গদের মতামতের উপর গুরুত্ব দেয়ার বিষয় হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যেমনÑ
عن علي قال: قلت: يا رسول الله إن نزل بنا أمر ليس فيه بيان أمر ولا نهي فما تأمرنا؟ قال :”شاوروا فيه الفقهاء والعابدين ولا تمضوا فيه رأي خاصة”
-হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যদি আমাদের মধ্যে কোন নতুন ঘটনা ঘটে আর সে ব্যাপারে (কুরআন বা হাদীসে) কোন আদেশ বা নিষেধ না থাকে, তখন আপনি আমাদেরকে কি করতে বলেন? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে ব্যাপারে তোমরা ফকীহ এবং আবিদ (ইবাদতকারী) ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করবে এবং কোন বিশেষ ব্যক্তির রায় চালিয়ে দিবে না। (মাজমাউয যাওযাইদ, ১/৩৬২)
এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেল, যে বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহতে সরাসরি কোন বিধান পাওয়া যায় না সে বিষয়ে বুযুর্গদের মতামত গ্রহণীয় হবে।
আপত্তি-২৫
মীলাদ বলতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত সংক্রান্ত আলোচনাকে বুঝায়। যে কোনভাবেই তা করা যায়। কিন্তু আপনারা তা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পালন করেন কেন ?
জবাব
মীলাদ মাহফিল বলতে যদিও শাব্দিক অর্থে শুধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্তমূলক আলোচনাকে বুঝায়, কিন্তু পারিভাষিক অর্থে জন্মবৃত্তান্ত আলোচনার সাথে দুরূদ, সালাম, তিলাওয়াত, কাসীদা পাঠ, দুআ এবং তাবাররুক বিতরণ ইত্যাদির সমষ্টিগত অনুষ্ঠানকে বুঝায়। আর একটি বিষয়কে তার অংশ দ্বারা নামকরণ করা বৈধ। যেমন, সূরা বাকারার সব স্থানে বাকারা বা গরুর আলোচনা নেই। একে বলে তাসমিয়াতুল কুল বিসমিল জুয। তবে, আমরা উক্ত নির্ধারিত পদ্ধতিতে মীলাদ মাহফিল করাকে জরূরী মনে করি না। তার প্রমাণ হলো- যারা মীলাদ মাহফিল করে থাকেন এলাকাভিত্তিক তাদের অনুষ্ঠানের ভিন্নতা রয়েছে। আমরা মনে করি, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত তাঁর পবিত্র সীরাতের অংশ। তাই এটি আলোচনা করা অবশ্যই বরকতের কারণ। আর জন্মবৃত্তান্তের সাথে শরীআত সমর্থিত অন্যান্য নেক আমল করলে তাতে বাধা দেয়া যায় না। কিন্তু সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, মীলাদ পালনকারীরা কোন নির্ধারিত পন্থায় মীলাদ অনুষ্ঠান করাকে জরূরী মনে করে না। আর তা উচিতও নয়।
আপত্তি-২৬
মীলাদ নিয়ে সমাজে ফিৎনা ছড়াচ্ছে, দলাদলি হচ্ছে। অথচ এর দ্বারা যা উপকার হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। তাই এটা নাজায়িয।
জবাব
মীলাদের কারণে সমাজে ফিতনা ছড়াচ্ছে এ দাবী সত্য থেকে বহুদূরে অবস্থিত; বরং মীলাদ নিয়ে বাড়াবড়ি ও ছাড়াছাড়ির কারণে ফিতনা ছড়াচ্ছে। যারা মীলাদের ন্যায় মুস্তাহাব কাজ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চায় বা যারা এ বৈধ কাজটি বিনা প্রমাণে ও অযৌক্তিকভাবে বাঁধা দিতে চায় আমরা মনে করি, উভয় দলের কোন দলই ভ্রান্তিমুক্ত নয়। তাই সবাই সচেতন হলে ফিতনা ছড়াবে না; বরং মীলাদ মাহফিলকে দ্বীনী দাওয়াতের একটি উত্তম মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো যাবে। এতে মীলাদের মাধ্যমে সমাজে শান্তি আসবে; ফিতনা ছড়াবে না।
আপত্তি-২৭
অনেক সময় হারাম কাজ- যেমন সিনেমা হল উদ্বোধন-এর সময় মীলাদ পড়া হয়।
জবাব
হারাম কাজের উদ্বোধন শুধু মীলাদ দ্বারা কেন কুরআন তিলাওয়াত বা নামায দ্বারা করলেও তা নিষিদ্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে মীলাদ মাহফিলের দোষ কোথায়? এ কারণে মীলাদ মাহফিল নিষিদ্ধ হতে পারে না; বরং হারাম কাজের শুরুতে মীলাদ মাহফিলসহ পবিত্র যে কোন কাজ দ্বারা বরকত নেয়ার চিন্তা করাও পাপ হবে। আমাদের কর্তব্য হলো, যদি কোন মূর্খ এ ধরনের কাজ করে তবে তাকে বাধা দেওয়া।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই, এ আপত্তিগুলো মীলাদ বিরোধীদের কোন কিতাব থেকে সংগৃহীত নয়; বরং তাদের সাথে বাক-বিত-াকালে তাদের থেকে প্রকাশিত আপত্তিগুলোকে এখানে একত্র করে জবাব দেয়া হয়েছে। কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় অনেক দলীল বাদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।