ইসলাম শ্বাশত এক স্বভাবধর্ম। এ এমন এক ধর্ম, যে ধর্ম মানুষের প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয় উপস্থাপন করে এবং সাথে প্রয়োগ দিকটাও দেখিয়ে দেয়। এমনই একটি বিষয় হল তাসাওউফ বা আত্মশুদ্ধির চর্চা। তাসাওউফের অন্যতম অনুষঙ্গ হল মুরাকাবা, সহজ বাংলায় যাকে বলে ধ্যান। এটি আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের এমন এক ক্ষমতা যা মানুষকে সাধারণের স্তর থেকে নিয়ে যায় অন্যতমদের স্তরে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাত্রির আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।
তাঁরা ঐ সকল লোক যারা দাঁড়িয়ে,বসে,শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্ট রহস্য সম্পর্কে গভীর চিন্তা (তাফাক্কুর)করে আর বলে, হে আমাদের মালিক! তুমি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করোনি। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৯০-১৯১)
সূরা আলে ইমরানের শেষাংশ যখন নাযিল হয়,তখন বিলাল (রা.) ফজরের আযান দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ e এর নিকট এসে দেখলেন তিনি কাঁদছেন। বিলাল (রা.) প্রশ্ন করলেন,হে আল্লাহর রাসূল! কিসে আপনাকে কাঁদাচ্ছে? তিনি উত্তর দিলেন, কিসে আমাকে কাঁদা থেকে বিরত রাখবে, এই রাতে যা আমার উপর নাযিল হয়েছে। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দুর্ভোগ ওই ব্যক্তির জন্য, যে এই আয়াত পাঠ করল অথচ চিন্তা ফিকর করল না। (সহীহ ইবন হিব্বান, ৬২০; আদদুররুল মানসুর, ২/৪০৯)
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহকে স্মরণ এবং সৃষ্টি সম্পর্কে গভীর চিন্তার কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ e কুরআনের আয়াতকে শক্ত ভিত্তি দিতে বললেন,যে চিন্তা ফিকর করবে না সে দুর্ভোগের শিকার হবে। আর গভীর চিন্তার অপর নাম হচ্ছে মুরাকাবা বা ধ্যান। কুরআনে বলা হয়েছে তাফাক্কুর, হাদীসের ভাষায় ইহসান এবং যারা এর চর্চা করেন তাদের ভাষায় বলা হয় মুরাকাবা।
স্বাভাবিকভাবে মানুষ যেভাবে চিন্তা করে তাকে ধ্যান বলে না। মানুষ দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে সৃষ্টি। মানুষ যখন তার দেহ ও মনের সমন্বয়ে চিন্তা করে তখন তা হয় ধ্যান। প্রশ্ন হতে পারে চিন্তা করে মানুষের মন। তাহলে দেহ কিভাবে চিন্তা করতে পারে? সত্যি বলতে কী মানব দেহ চিন্তা করতে পারে না। চিন্তা হচ্ছে মনের কাজ। মন বা আত্মার আবাসস্থল হচ্ছে দেহ। মানুষের মনের চিন্তা যখন গভীর থেকে গভীরতর হয় তখন দেহও এর সাথে সাড়া দেয়। মানব মনের চিন্তার প্রভাব তার দেহের উপর পড়ে। আর একেই বলে দেহ মনের সমন্বয়ে চিন্তা। এ ধরণের গভীর চিন্তা যার ফলে মন একিভূত হয়ে যায় তাকে ইলমে তাসাওউফের ভাষায় বলা হয় মুরাকাবা। মানুষের চিন্তাশক্তির গভীরতা তিন স্তরে বিভক্ত। সচেতন মন, অচেতন মন ও অবচেতন মন। বিজ্ঞানের ভাষায় Conscious Mind, Unconscious Mind, Subconscious Mind. আমরা যখন স্বাভাবিক কাজকর্ম করি তখন আমাদের মন থাকে কনশাস মোডে,ঘুমের ঠিক আগ মুহূর্তে অর্ধজাগ্রত অবস্থায় সাব কনশাস মোডে,গভীর ঘুমে তখন থাকে আনকনশাস মোডে। কনশাস মাইন্ড মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে সহায়তা করে, যেখানে আন কনশাস মাইন্ডের ভাল মন্দ বোঝার ক্ষমতা নাই। এজন্য দুঃখের কোন অভিনয় দেখে মানুষ কাঁদে, যদিও জানে এটা অভিনয়। আর সাবকনশাস মাইন্ড হচ্ছে মানব মনের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। মানুষের শক্তির আসল উৎস তার মন বিশেষত অবচেতন মন। আর দেহ হচ্ছে মন নামক অসীম শক্তির বাসস্থান। এই শক্তিকে পুরোপুরি ব্যবহারের পদ্ধতি হচ্ছে মুরাকাবা।
আধুনিক বিজ্ঞান মতে ধ্যান হল সচেতনভাবে দেহ, মন ও মস্তিষ্ককে শিথিল করা। মানুষ যখন ধ্যান বা মুরাকাবায় মগ্ন থাকে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার দেহ মন প্রশান্ত থাকে। মুরাকাবা অবস্থায় মস্তিষ্ক থেকে Serotonin Hormone নিঃসৃত হয়। এর প্রভাবে শরীরে সুখানুভূতি তৈরী হয়, মন প্রশান্ত হয়। মানসিক চাপ কমতে থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণায় প্রমাণিত যে, মুরাকাবার প্রথম ও প্রধান উপকার হল টেনশন থেকে মুক্তি লাভ। বলা হয়ে থাকে যে, ধ্যান ও টেনশন এক সাথে থাকতে পারেনা। টেনশন থাকলে ধ্যান থাকেনা, ধ্যান থাকলে টেনশন পালিয়ে যায়। মুরাকাবার মাধ্যমে আমাদের শরীর শিথিল হয় যার ফলে অন্তর প্রশান্ত হয়, শরীরের স্বাভাবিক নিরাময় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দেহ মনে সুখের অনুভুতি তৈরী হয়। প্রতিটি কাজ সহজ ও সুন্দরভাবে আনন্দ নিয়ে করা যায়।
মানুষের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগের কারণ হলো টেনশন। মুরাকাবার ফলে টেনশন ও অস্থিরতাজনিত কারণে যেসকল রোগ হয় যেমন মাইগ্রেন, সাইনোসাইটিস, শরীরে যে কোন স্থানের ব্যথা, হজমের সমস্যা, আইবিএস, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অনিদ্রা প্রভৃতি রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। আর যদি কোন কারণবশত হয়ে যায়, তবে তা থেকে আরোগ্য সহজ হয়। বাকি ২৫ ভাগ রোগ ওষুধ ও সার্জারির মাধ্যমে নিরাময় লাভ সহজ হয়, যেখানে ধ্যান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন প্রতিদিন যদি কেউ ৩০ মিনিট পরিমাণ ধ্যান করেন তাহলে ২ ঘণ্টা ঘুমের উপকারিতা পাবেন। ‘The Relaxation Response’ Dr. Harbert Benson. যাদের ঘুম হয় না, তাদের জন্য ধ্যান উত্তম ওষুধ। এ জন্য সুফীসাধকগণকে দেখা যেত কম ঘুমিয়েও দিব্যি সুস্থ আছেন। কারণ তারা কম করে হলেও সকাল সন্ধ্যা মুরাকাবা করতেন।
তার মানে যেন কেউ এটা মনে না করেন যে এখন থেকে না ঘুমিয়ে শুধু মুরাকাবা করে যাব। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেন, কিছু সময় চিন্তাভাবনা করা এক রাত নফল ইবাদত-বন্দেগী করার চেয়ে উত্তম। (মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, ১৯/১৭৯, ৩৫৭২৮)
সালফে সালিহীন, আউলিয়ায়ে কিরামের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তাঁরা ছিলেন প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারী। হাজারো চাপে তাঁরা ছিলেন অটল, অবিচল। তাদের অসুখ, বিসুখ তেমন একটা হত না। বিশেষত তাদের হৃদরোগ ছিলই না বলা যায়। এর অন্যতম কারণ হলো তাদের প্রাত্যহিক রুটিনের অন্তর্ভুক্ত ছিল মুরাকাবা। তাদের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস যে, আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেনই। এই যে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস তথা আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল, এটা সাধারণ কোন বিষয় নয় যে আপনি চাইলেন আর হয়ে গেল। এটা ছিল মুরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহর দেওয়া অসীম শক্তি। ফল স্বরুপ মানুষ তাদের দেখলেই আকর্ষণ অনুভব করতো। এজন্য শাহজালাল ইয়ামানীর সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি গৌড়গোবিন্দ। আযানের আওয়াজে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তার রাজশক্তির সর্বস্ব। ইমাম সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) এর সামনে দাঁড়াতে পারেনি ব্রিটিশ বেনিয়ারা। সীমিত সময়ের জন্য হলেও বপন করেছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রশক্তির বীজ। তাদের উত্তরসূরিরা আজও তাসাওউফ চর্চা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
রাসূলুল্লাহ e বলেন, তোমরা মুমিনের অন্তর দৃষ্টিকে ভয় কর, কেননা তাঁরা আল্লাহর নূর দ্বারা দেখতে পায়। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩১২৭) মুরাকাবার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় অন্তর্দৃষ্টি, যাকে সুফীগণ কাশফ নামে অভিহিত করেন। যার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হয়ে যায়, তখন অজানা অদেখা অনেক বিষয় তার মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে। তেমনি একটি বাস্তব ঘটনা বলে শেষ করব। হিজরী ১১ শতকের সুফীসাধক হাতিফ ইসফাহানী তাঁর কোন এক কবিতায় বলেছিলেন-
দেলে হার জাররাই কেহ বেশকাফী
আফতাবিশ দারমিয়ান বিনি।।
যদি তুমি প্রতিটি ক্ষুদ্রবস্তুর গভীরে প্রবেশ কর এবং আঘাত কর, তাহলে তার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি সূর্য দেখতে পাবে।
হাতিফ ইসফাহানী তাঁর দু’লাইনের কবিতায় অবলীলায় উপস্থাপন করলেন পারমাণবিক বোমা তৈরীর মূল থিওরী। কিভাবে সম্ভব মধ্যযুগের একজন সুফিসাধকের পক্ষে এমন তথ্য প্রদান করা? সেটা আর কিছু নয় তাঁর অন্তর্দৃষ্টি। যা ছিল প্রতিনিয়ত মুরাকাবার ফল। রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর স্বার্থক রুপায়ণ- তোমরা মুমিনের অন্তর দৃষ্টিকে ভয় কর, কেননা তাঁরা আল্লাহর নুর দ্বারা দেখতে পায়।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী যেকোন পদার্থ অতিক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত। পদার্থ যদি মৌলিক হয় তাহলে এই ক্ষুদ্র কণার নাম হয় পরমাণু,আর যদি পদার্থ যৌগিক হয় অর্থাৎ একাধিক পদার্থ মিশ্রিত থাকে তাহলে তার নাম হয় অণু। যা খালি চোখে দেখা যায় না। যদি আপনার দেখার প্রচণ্ড ইচ্ছা জাগে তাহলে প্রয়োজন হবে অতি শক্তিশালী ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণ যন্ত্র। এরপরও স্পষ্ট দেখতে পারবেন না।
মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা পরমাণুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে আমরা দেখতে পাব সেখানে আছে ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াস। আবার নিউক্লিয়াস কে কোনভাবে ভাঙতে পারলে সেখানে পাবো প্রোটন আর নিউট্রন। সৌরজগতে সূর্যের চারপাশে যেমন গ্রহগুলো ঘুরে,তেমনি পরমাণুতে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরে। নিউক্লিয়াসে কেন্দ্রীভূত আছে পরমাণুর সমস্ত শক্তি।
এখন পারমাণবিক বোমার ক্ষেত্রে যা ঘটে তা হলো– একটি নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আঘাত করলে সেটি ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায় এবং কয়েকটা নতুন নিউট্রন বের হয়ে আসে। তারপর এই নিউট্রন আরেকটা ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসে আঘাত করে, ফলে বের হয়ে আসে আরো কয়েকটা নিউট্রন, এভাবে চলতেই থাকে। পর্যায়ক্রমে চলতে থাকা এ বিক্রিয়াকে বলে ফিশন। এটা একবার চালু হলে পর্যায়ক্রমে চলতেই থাকে, বন্ধ হয় না। এভাবে ফিশন হওয়ার পর এক প্রচন্ড শক্তি তৈরী হয়, যা প্রায় ২০০ eV সমান। এটা কী পরিমাণ শক্তি তা বুঝাতে পরমাণু বিজ্ঞানী রবার্ট জাঙ্ক একটি বই লিখেছেন, Brighter than a Thousand Suns. অর্থাৎ এক হাজার সূর্যের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল। এ থেকে বোঝা যায় পদার্থের ভেতরের শক্তি কত বিরাট হতে পারে। হিরোশিমা-নাগাসাকি এ শক্তির বাস্তবরুপ দেখেছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়।
এখন চিন্তার বিষয় হলো মধ্যযুগের এক সুফীসাধক হাতিফ ইসফাহানী বিজ্ঞানেরও বুঝে ওঠার কয়েকশত বছর আগে কী করে এই অতি উচ্চপর্যায়ের বিজ্ঞানের বর্ণনা দিলেন মাত্র দু’লাইনের কবিতায়।
হাতিফ ইসফাহানী যে যুগে বসে এ কবিতা রচনা করেছিলেন, তখন অনু পরমাণু সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই ছিলনা। ১৯১২ সালের আগে নিউক্লিয়াসের ভিতরে কী আছে বিজ্ঞানও জানত না। তাহলে এত নিখুঁত বর্ণনা কিভাবে সম্ভব? এটা সম্ভব একমাত্র আল্লাহর নূর দ্বারা দেখার কারণে। আর এই নূর তিনি অর্জন করেছিলেন মুরাকাবার মাধ্যমে। যার ফল ছিল কাশফ বা অন্তর্দৃষ্টি। অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেলে সামনে উদ্ভাসিত হয় মহাসত্য। যার মধ্যে নিহিত থাকে হাজারো বিজ্ঞান।
আল্লাহ আমাদের সেই নূরপ্রাপ্ত মনীষীগণের পথ ও মতের উপর চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।