সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে নারী সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সম্প্রতি কমিশনটি একটি রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে উত্থাপন করে। রিপোর্টের বেশ কয়েকটি দাবি তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয়। তার মধ্যে অন্যতম দাবি হলো “মেরিটাল রেইপ আইন” প্রণয়ন। ফলে দেশের সচেতন নাগরিকরা, বিশ্বব্যাপী তুমুল সমালোচিত এ আইন প্রয়োগের বিরোধিতা করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে এ আইনের কার্যকারিতা ও যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে মেরিটাল রেইপ সম্পর্কে যথার্থ তথ্যের অভাবে কতিপয় ইসলামী নেতারা ভুল বক্তব্য দিয়ে দেশের কথিত নারীবাদীদেরকে ইসলামের দিকে পুনরায় আঙুল তোলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। এই সুযোগে তারা পুরনো পশ্চিমা নীতিতে উক্ত আন্দোলনের মোটিভকে অপব্যাখ্যা করে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে নারী উন্নয়নের বিরোধী হিসেবে প্রমাণ করার ঘৃণ্য চেষ্টায় লিপ্ত হন। নব্য এই ফিতনা থেকে বাঁচতে জানা প্রয়োজন, মেরিটাল রেইপ আইন মূলত কী? এদেশে তা প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? এসম্পর্কে ইসলামিক দৃষ্টিকোণ এবং আরো জানতে হবে উক্ত আইনের বিকল্প সম্পর্কে।
প্রথমেই “মেরিটাল রেইপ” এর পরিভাষা জানতে হবে। ইউএন-এর ভাষ্যানুযায়ী, কেউ যদি তার সঙ্গীর মৌন সম্মতি ব্যতীত শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে তবে তা মেরিটাল রেইপ হিসেবে পরিগণিত হবে, যদিও সেই মিলনে কোনো বিকৃত যৌনাচার কিংবা অত্যাচারের আলামত না থাকে। উল্লেখ্য, বিংশ শতাব্দীর আগ অবধি এই পরিভাষার কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি নারী-পুরুষ সমতা আন্দোলনের আবির্ভাবের ফলস্বরূপ উক্ত আইনের দাবি ওঠে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও ১৯৭০ এর আগে এরকম কোনো আইনের খোঁজ পাওয়া যায় না। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বৈবাহিক নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য আইন হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সম্মতিহীন মিলনকে সরাসরি “রেইপ” ট্যাগ দিতে অস্বীকার করে।
বিশেষ এই আইনের প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান, তবে লক্ষ্য অস্পষ্ট। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিকৃত যৌনতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফলে প্রায়শই শারীরিক মিলনকালীন নারীরা পৈশাচিক অত্যাচারের শিকার হন। স্বনামধন্য সংবাদমাধ্যম বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত এক জরিপের বরাতে জানা যায়, ব্রিটেনে শতকরা ২৯ শতাংশ নারী (সম্মতিক্রমে) মিলনের সময় বিবিধ অত্যাচারের শিকার হন। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই যথার্থ আইনের অভাবে কিংবা সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে এমন আচরণ অপ্রকাশিত রয়ে যায়। এমনকি সাধারণ নারী নির্যাতন আইনে বাহ্যিক অত্যাচারের বিচার করা গেলেও শারীরিক মিলনকালীন নির্যাতনের কথা গোপনই রয়ে যায়। ঠিক এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ‘ইন্টিমেইট পার্টনার ভায়োলেন্স’ (Intimate Partner Violence) আইনের। অথচ, কথিত নারীবাদীরা বৈবাহিক মিলনে সম্মতিকে মুখ্য করে মূল উদ্দেশ্যকেই গৌণ করে তুলেছেন; যার পরিণামে নীরবে নির্যাতিত অসহায় নারীদের আর্তনাদ আলোর মুখ দেখে না।
বিশ্বের অধিকাংশ সমাজেই বিবাহকে একটি পারস্পরিক চুক্তি হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। এবং এই চুক্তির মাধ্যমে স্ত্রী তার স্বামীকে মিলনের সাধারণ সম্মতি প্রদান করে থাকেন। সাধারণত এরপর আর সম্মতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন থাকে না। তবে, সঙ্গীর অবস্থার উপর লক্ষ্য রেখে সম্পর্কের সৌজন্যতা পালন করা উচিত। সম্মতি না নিয়েও যদি কেউ তাঁর স্ত্রীর সাথে মিলিত হয় এবং সে সময় কোনো অত্যাচার না করা হয়ে থাকে তবে সেটাকে ধর্ষণ সমতুল্য অপরাধ সাব্যস্ত করা নিতান্তই অযৌক্তিক। এটাকে অমানবিকতা ছাড়া বেশি কিছু বলাটাও সমীচীন নয়। মধ্যযুগীয় ব্রিটেনের খ্যাতনামা গবেষক স্যার ম্যাথেউ হল-এর মতেও, বিয়ে হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে একজন নারী তার যৌন সম্মতির অধিকার তার স্বামীর কাছে হস্তান্তর করেন। পরবর্তীতে তার মত নেওয়াটা স্বামীর জন্য ঐচ্ছিক।
“Rape” শব্দটির উৎপত্তিগত ইতিহাস জানলে বৈবাহিক কোনো মিলনকে (তা সম্মতিক্রমে হোক বা না হোক) রেইপ বা ধর্ষণ আখ্যায়িত করা যায় না। Rape এসেছে ল্যাটিন শব্দ Raptus থেকে, যার অর্থ— জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেওয়া। প্রাচীন রোমে নারীদেরকে বাবার অন্যান্য সম্পদের মতো সম্পত্তির একটি অংশ মনে করা হতো। তাই বাবার অনুমতি ছাড়া কেউ মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ালে বলা হতো সে রেইপ করেছে বা সেই বাবার সম্পদ ছিনতাই করেছে। কিন্তু একজন স্বামী, যে বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কের অধিকার লাভ করেছে, সে তার নিজের অধিকার নিজে ছিনতাই করবে কীভাবে?
ইসলামী শরীআত নারীদের অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠ। ফলে, ইসলাম শারীরিক মিলনে নারীদের সম্মতি থাকবে কি না— এই গণ্ডির মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে শারীরিক মিলনে বিস্তৃত নারী নির্যাতনের বিরোধিতা করে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামে নারীদের কষ্টলাঘবের জন্য মাসিক ঋতুস্রাবের সময় মিলন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে যতক্ষণ না তারা পুরোপুরি পবিত্র হয়। বিকৃতভাবে মিলন করা অর্থাৎ পায়ুপথে গমন করাও নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ e তার উম্মতদেরকে মিলনের আদব শিক্ষা দিয়ে গেছেন। হাদীসের বড় বড় গ্রন্থগুলোতে আদাবুল জিমা (সহবাসের আদব) সম্পর্কে স্বতন্ত্র অধ্যায় পর্যন্ত রয়েছে। ইমাম গাযালী (র.) তার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ‘ইহইয়াউ উলূমুদ্দীন’ গ্রন্থে এ বিষয়ে একটি চমৎকার হাদীস এনেছেন। সেখানে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ e স্ত্রীর উপর বন্য মহিষের মতো লাফিয়ে পড়া থেকে নিষেধ করেছেন। বরং মিলনের পূর্বে সঙ্গীকে মিলনের উপযোগী করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারই সাথে স্বামীর ছোঁয়াচে রোগ থাকলে ইসলাম স্ত্রীকে অধিকার দেয় মিলনে রাজি না হওয়ার। তাছাড়া মিলনকালীন এমন কোনো কাজ যা তাকে কষ্ট দেয়, এমন কাজের বাধা দেওয়ার অধিকারও ইসলামে আছে। ইসলাম নারীদের উৎসাহিত করে স্বামীর আনুগত্যের জন্য এবং স্বামীদের নিষেধ করে স্ত্রীদের সাথে অসাদাচরণ করা থেকে। অতএব, শুধুমাত্র অযৌক্তিক একটা আইনের বিরোধিতার জন্য পুরো ইসলামী শরীআতকে নারীর নির্যাতনকারী রূপে তুলে ধরা সম্পূর্ণই অযৌক্তিক।
এবার আসা যাক বাংলাদেশে উক্ত আইনের যথার্থতা সম্পর্কে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির আইন অনুযায়ী “বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ” একটি অপরাধ। অথচ বর্তমানে এই আইন অসৎ নারীদের জন্য ভাঁওতাবাজির একটি পথমাত্র। এই আইনের শতকরা ৯০ ভাগ মামলা হয় প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের জটিলতার কারণে। দেখা যায় যে, দিনের পর দিন উভয়পক্ষের সম্মতিতে যৌন সম্পর্কের পর, সম্পর্কে টানাপোড়েন আসতেই সেটা বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ হয়ে যায়। অতএব, যদি “মেরিটাল রেইপ” আইন কার্যকর হয়, তখন মিথ্যা মামলার হার কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৫ (ধর্ষণ সংক্রান্ত) অনুযায়ী: “একজন পুরুষ তার নিজের স্ত্রীর সাথে যৌন মিলন, যার স্ত্রীর বয়স তেরো বছরের কম নয়, ধর্ষণ নয়। তবে, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।” সংস্কার কমিশন এই আইনকে আরো কার্যকর করার জন্য বিতর্কিত “মেরিটাল রেইপ” আইন প্রণয়নের আবেদন না করে, “ইন্টিমেসি ভায়োলেন্স অ্যাক্ট” মিলনকালীন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের আবেদন করতে পারত। শারীরিক মিলনে কারো সম্মতি ছিলো এবং কার ছিল না তা প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন। অপরদিকে শারীরিক সম্পর্কে নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়াটা তুলনামূলক সহজ। ফলে মিথ্যা মামলায় শাস্তির সম্ভাবনাটাও কমে যেত।
ইসলাম কখনোই إفراط (বাড়াবাড়ি) কিংবা تفريط (ছাড়াছাড়ি) সমর্থন করে না। মানবজীবনের সব সমস্যার সমাধান ইসলামে বিদ্যমান। দাম্পত্য জীবনেও ইসলাম উভয়ের কারো প্রতি কোনো নির্যাতন করে না। চীন, রাশিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুরের মতো বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতেও এখন পর্যন্ত মেরিটাল রেইপ আইন কার্যকর হয়নি। তারা বিকল্প পদ্ধতিতে পারিবারিক সহিংসতা (Domestic Violence) প্রতিরোধ করছে। অথচ, এদেশের কথিত নারীবাদীরা শুধু ইসলামকেই দোষারোপ করেন। যতদিন তারা পশ্চিমা এজেন্ডার চশমা চোখে এঁটে রাখবে, ইসলামের অতিমানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকেও তাদের কাছে বর্বর মনে হবে।