ষোড়শ শতকে ইরান থেকে অনেক সুন্নী মুসলিম পরিবারই ভারতীয় উপমহাদেশে অভিবাসনের জন্য আসে। এমনই একটি পরিবারে তার কয়েকশত বছর পর ১৮৩৯ সালে পাঞ্জাবে জন্ম গ্রহণ করে মির্জা গোলাম কাদিয়ানী। আর দশটি সাধারণ মুসলিম শিশুর মতোই বেড়ে ওঠে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মূলধারার আকীদাতেই বিশ্বাসী ছিল বলে জানা যায়, এমনকি প্রাথমিক জীবনে পরহেযগার আলিম হিসেবে খ্যাতিও ছিল। সে সময়ে খতমে নবুওয়তসহ কোন বিষয়েই ভিন্নমত পোষণ করতো না।
তারপর ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ এই মির্জা গোলাম । প্রথমে নিজেকে একজন ওলী, তারপর ওহীপ্রাপ্ত ওলী ও শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, তারপর প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.), তারপর প্রতিশ্রুত মাসীহ এবং সবশেষে সরাসরি নিজেকে নবীই দাবি করে বসে এই মানুষটি। তার ধারাবাহিক এই দাবিগুলো তাঁরই লেখা বিভিন্ন বইয়ে এখনো বিদ্যমান আছে, আর সেই সুযোগে তাঁর অনুসারীরা আজো মুসলিমদের মধ্যে নিজেদের ধর্মমত প্রচারের ক্ষেত্রে যেখানে যে দাবিটি প্রকাশ করলে মতবাদ প্রচার সহজ হবে, সেখানে সেটিই প্রচার করে। যে কারণে সহজেই বিভ্রান্ত করতে পারে সরলপ্রাণ মুসলিমদেরকে। এই প্রবন্ধে আমরা খুব সংক্ষেপে তাদের মৌলিক কিছু বিশ্বাস ও উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করবো।
গোলাম কাদিয়ানীর সর্বশেষ দাবি অনুযায়ী সে “শরীআতবিহীন নবী”, অর্থাৎ শরীআতে মুহাম্মদীর অনুসারী একজন নবী। কাদিয়ানীদের দাবি অনুযায়ী, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ শরীআতপ্রাপ্ত নবী, কিন্তু তারপরও ধর্ম সংস্কার ও পুনরুদ্ধারের জন্য এই উম্মতের নবী আসতে পারেন, এবং সে এরকমই একজন নবী। কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিজের নবুওতকে প্রতিষ্ঠার জন্য সে এমন দাবিও করে যে, হযরত ঈসা (আ.)কে আকাশে উত্তোলন করা হয়নি বরং তিনি ইয়াহুদীদের হাত থেকে বেঁচে কাশ্মীরে চলে আসেন, এবং এখানে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। ইসলামে শেষ যামানায় যে মাসীহ এর আগমনের কথা বলা আছে, তিনি আসলে ঈসা (আ.) নন, বরং সে নিজেই সেই মাসীহ! এমন অদ্ভুত আর উদ্ভট সব দাবি তার ধর্মমতে পাওয়া যায়।
গোলাম কাদিয়ানীর পরিবার ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের আস্থাভাজন উচ্চবিত্ত পরিবার ছিল। মির্জা গোলাম দাদা মির্জা আতা ছিলেন পাঞ্জাবের বিশিষ্ট জমিদার, কিন্তু শিখদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে তার সম্পত্তি হাতছাড়া হয়, শিখরা তার পরিবারকে কাদিয়ান থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে ১৮১৮ সালে ব্রিটিশদের সহায়তায় এই পরিবার কাদিয়ানে প্রত্যাবর্তন করে এবং ব্রিটিশদের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করে। কাদিয়ানীর নিজের লেখা থেকে জানা যায়, তার শৈশবেও তাদের পরিবারের অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ব্রিটিশরা তার বাবাকে কয়েকটি গ্রামের জমিদারি ফিরিয়ে দেয়।
মির্জ া গোলাম জীবনভর ব্রিটিশদের এই অবদানকে স্মরণ রাখে, এবং তাদের দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে। ব্রিটিশদের সম্পর্কে মীর্জা গোলামের বিভিন্ন লেখা থেকেই তা উপলব্ধি করা যায়। এমনকি তার ভাষ্যমতে, ইসলামের দুটি অংশ রয়েছে; ১. আল্লাহর আনুগত্য, আর ২. ব্রিটিশ শাসকদের আনুগত্য। ব্রিটিশদের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের তিনটি কারণও সে স্পষ্ট করে; ১. তার বাবার প্রতি ব্রিটিশদের অনুগ্রহ (জমিদারি ফিরিয়ে দেওয়া), ২. তার ধর্মমত প্রচারে সহায়তা এবং ৩. আল্লাহর পক্ষ থেকে কথিত ওহীর নির্দেশনা। তৃতীয় কারণটি নিছক ভণ্ডামী হলেও প্রথম দুটি কারণই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলিমদের উপর বহুবিধ নির্যাতন চললেও গোলাম আহমদের পরিবারের আনুগত্যের দরুণ তাদেরকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী জমিদারি ফিরিয়ে দেওয়াসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। এমনকি স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসকের কার্যালয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গোলাম আহমদের বাবার জন্য বিশেষ আসন বরাদ্দ থাকতো বলেও কথিত আছে। গর্বের সাথে কাদিয়ানী তার লেখায় লিখেছে, “আমার পরিবার ইংরেজ শাসকদের সেবায় রক্ত দিতে কখনো কার্পণ্য কিংবা কাপুরুষতা করেনি, আর কখনো করবেও না।” মোদ্দাকথা, ব্রিটিশদের আনুগত্যের ব্যাপারে প্রকাশ্যে বিবরণ দিতেও মির্জা গোলাম কখনো কার্পণ্য করেনি, বরং নিজেই দাবি করেছে যে সবাইকে ব্রিটিশদের আনুগত্যের দিকে আহবান করতেই সে তার পুরো জীবন ব্যয় করছে। আর তার ধর্মমত প্রচারে ব্রিটিশদের সহায়তার বিষয়েও তার মধ্যে কোন রাখঢাখ ছিল না।
মীর্জা গোলাম কাদিয়ানীর ধর্মীয় মতের ক্রমবিকাশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শুরুর দিকে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ নবী দাবি না করলেও ধীরে ধীরে সে সেদিকেই এগিয়ে যায়। একইভাবে শুরুর দিকে যে সকল মুসলিম তাকে অনুসরণ করেন না, তাদেরকে কেবল গোমরাহ আখ্যায়িত করলেও পরবর্তীতে তার অনুসারী ছাড়া অন্য সকলকে “আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য” এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলে ঘোষণা করে।
একইভাবে ঈসা (আ.) এর পুনরাবির্ভাব অস্বীকার করে নিজেকে মাসীহ দাবি করার সাথে সাথে দাজ্জাল সম্পর্কিত হাদীসসমূহেরও অপব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখা দেয়। এর ফলে প্রথমদিকে সে দাবি করে যে, দাজ্জাল আসলে মানুষ নয়, বরং জিন ও শয়তানদের মধ্য থেকে হবে। পরবর্তীতে এ দাবি থেকে সরে এসে দাবি করতে শুরু করে যে, দাজ্জাল কোন একক ব্যক্তি নয়, বরং আসলে পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান সভ্যতাই দাজ্জাল, বিশেষত খ্রিষ্টান মিশনারিদেরকেই সে দাজ্জাল বলে আখ্যায়িত করে, যদিও একই সাথে সে ব্রিটিশদেরকে “আল্লাহর রহমত” আখ্যায়িত করে এবং ব্রিটিশদের আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্যের পরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করে। মূলত এরকম বহু স্ববিরোধী দাবি গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মতবাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গোলাম কাদিয়ানীর সময়ে যেহেতু উপমহাদেশের উলামায়ে কিরাম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফাতওয়া দিচ্ছিলেন, এবং সে ছিল ব্রিটিশদের নিরঙ্কুশ অনুগত, সেই জায়গা থেকে সে সশস্ত্র জিহাদকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তার ভাষ্যমতে, তার নবুওয়াতের অন্যতম বার্তাই হলো জিহাদকে নিষিদ্ধ করা। সেই প্রতিশ্রুত মাসীহ, তার আগমনের পর আর কোন জিহাদ নেই, এরপর যারা জিহাদ করবে, তারা আল্লাহর অবাধ্যতা করবে, কেননা আল্লাহ জিহাদকে নিষিদ্ধ করেছেন।
এমন মতবাদের কারণে শুধু ব্রিটিশদের নিকটই নয়, বরং পরবর্তীতেও মুসলিমদের বিরোধীদের মধ্যে তাদের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। পশ্চিমা বিশ্বে মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে এখনো কাদিয়ানীদেরকেই প্রজেক্ট করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাঈলে কাদিয়ানীদের অবাধ বিচরণের সুযোগ প্রদান করা হয় এবং কাদিয়ানীরাও “ফিলিস্তিনের প্রাণকেন্দ্রে” তাদের কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে গর্ববোধ করে। কাদিয়ানীরা যদিও মনে করে যে, মসজিদুল আকসার উপর ইয়াহুদী কিংবা খ্রিষ্টানদের কোন অধিকার নেই, কিন্তু তারা যেহেতু জিহাদকে নিষিদ্ধ মনে করে এবং কোনভাবেই জিহাদ করা যাবে বলে বিশ্বাস করে না তাই যায়োনিস্টদের নিকট কাদিয়ানীরা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো “মুসলমান।” কেননা হামাসসহ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাযোদ্ধাদের যুদ্ধের অন্যতম অনুপ্রেরণা হচ্ছে ইসলামের জিহাদের নির্দেশনা, আর কাদিয়ানীরা ঠিক এই জায়গাতেই সবচেয়ে নিরাপদ। তাছাড়া ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও কাদিয়ানিদের কথিত দ্বিতীয় খলিফা বশিরুদ্দীন মাহমুদের সমর্থন ছিল, এবং ইসরাঈলের বিষয়ে তার বক্তব্য হলো— “নিঃসন্দেহে ইউরোপ এবং আফ্রিকায় আমাদের যে অবস্থান, আরবে আমাদের সেরকম অবস্থান নেই। তবে ফিলিস্তিনের প্রাণকেন্দ্রে (ইসরাঈলের দখলকৃত ভূখণ্ডে) আমরা ছাড়া আর কারো বসবাসের অনুমতি নাই।”
মির্জা গোলাম কাদিয়ানী ও তার অনুসারীদের ধূর্ততা সর্বত্র লক্ষণীয়। তারা সকল মুসলিমকে কাফির মনে করলেও উপমহাদেশে হিন্দুদের নিয়ে আবার প্রশংসাও করেছে। বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় মীর্জা গোলাম হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলতো যে কৃষ্ণ নবী ছিলেন, তার নিকট জিবরাঈল (আ.) আসতেন, তিনি আবার পুনরাবির্ভূত হবেন ইত্যাদি। মূলত উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের তুষ্টির জন্যই এমন সব কথা বলা হতো।
পরিশেষে বলা যায়, খতমে নবুওয়াতের মতো আকীদা অস্বীকার থেকে শুরু করে ব্রিটিশদের কিংবা ইসরাঈলের আনুগত্য কিংবা জিহাদ অস্বীকারসহ পবিত্র ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করার কোন প্রচেষ্টাতেই সে কোন ধরনের ত্রুটি রাখেনি। ইসলাম ধর্মের মৌলিক সব বিধান অস্বীকার করেও নিজেকে মুসলিম দাবি করে কাদিয়ানিরা সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে এখন অবধি অমুসলিমদের চক্ষু শীতলকারী গোষ্ঠী হিসেবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীও বিভিন্ন সময় মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে এই কাদিয়ানিদের তুলে ধরার চেষ্টা করে এবং কাদিয়ানীদের অধিকার নিয়ে সব সময় সোচ্চার থাকে, কারণ তার যেমন মুসলিম প্রত্যাশা করে, কাদিয়ানীরা ঠিক তেমনই। কিন্তু ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান অস্বীকারের কারনে মুসলিমদের সর্বসম্মতিক্রমেই কাদিয়ানীরা কাফির। এ বিষয়ে মুসলিমদের মধ্যে কোন ভিন্নমত নেই।