যুলকারনাইন ছিলেন পৃথিবী শাসনকারী অন্যতম সৎ ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। আল্লাহ তাআলা তাকে রাজত্ব দান করেছিলেন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেন, আমি তাকে পৃথিবীতে কতৃর্ত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপর উপায়—উপকরণ দান করেছিলাম। (সূরা কাহফ, আয়াত ৮৪)
তিনি একদিন সফর করতে করতে পৃথিবীর একপ্রান্তে দুটি পাহাড়ি এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে বসবাসকারী এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট গিয়ে পৌঁছলেন, যারা তার ভাষা বুঝতে পারছিল না। পাহাড়ে বসবাসকারী সেই সম্পদায় বা জনগোষ্ঠীকে ইয়াজুজ—মাজুজ নামক একশ্রেণির মানুষরূপী দানব অমানবিক নির্যাতন করতো। তারা বাদশাহ যুলকারনাইনকে বললো, ইয়াজুজ—মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি ও গোলযোগ সৃষ্টি করছে। তাদের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। আপনি ইয়াজুজ—মাজুজ ও আমাদের মধ্যখানে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিন। প্রয়োজনে আমরা আপনাকে যাবতীয় খরচ দিব। যুলকারনাইন বললেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ আমাকে যা দান করেছেন তা—ই আমার জন্য যথেষ্ট। তোমরা আমাকে শুধু শ্রম ও প্রাচীর নির্মাণের সরঞ্জাম এনে দিয়ে সহযোগিতা করো, তাহলেই আমি ইয়াজুজ—মাজুজ ও তোমাদের মধ্যখানে একটি শক্ত প্রাচীর নির্মাণ করে দেব। এরপর তিনি লোকদিগকে বললেন, তোমরা সবাই মিলে লোহার পাত সংগ্রহ করে নিয়ে এসো। লোকেরা দলে দলে লোহার পাত আনতে থাকলো আর তিনি সেই পাত সমূহ একটার উপর আরেকটা রেখে দৈর্ঘ্য—প্রস্থ সমান করতে লাগলেন। প্রাচীরের দৈর্ঘ্য—প্রস্থ সমান করার পর বাদশাহ যুলকারনাইন বললেন, এবার তোমরা হাপরে দম দিতে থাকো যেন লোহাতে আগুন উৎপন্ন হয়। হাপরে দম দিতে দিতে লোহার পাতসমূহ যখন গরম হয়ে আগুনের আঙ্গারে পরিণত হলো তখন তিনি বললেন, তোমরা এবার গলিত তামা নিয়ে এসো, আমি প্রাচীরের চতুর্দিকে গলিত তামা ঢেলে দেব। যেই কথা সেই কাজ। বাদশাহ যুলকারনাইন লোহার নির্মিত প্রাচীরের উপর গলিত তামা ঢেলে দেওয়ার পর যখন তা ঠান্ডা হলো, তখন দূর থেকে দেখে মনে হলো সজ্জিত চাদর দ্বারা আবৃত একটি সুদৃঢ় প্রাচীর। আজ অবধি ইয়াজুজ—মাজুজ সেই শিশাঢালা প্রাচীর ভেদ করে বের হতে পারেনি।
আল্লাহ তাআলা কুরআনের সূরা কাহফের শেষাংশে উপরোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবেÑ
চলতে চলতে সে (যুলকারনাইন) যখন দুই পর্বত—প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থলে পৌঁছলেন তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেলো যারা তার কোনো কথা বুঝবার মতো ছিলো না। তারা বললো, হে যুলকারনাইন! ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা কি আপনাকে খরচ দিবো যাতে আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রাচীর গড়ে দেন। তিনি বললেন, আমার প্রতিপালক আমাকে এই বিষয়ে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা—ই উৎকৃষ্ট। তোমরা আমাকে শ্রম দ্বারা সাহায্য করো, আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যস্থলে এক মযবুত প্রাচীর গড়ে দিব। তোমরা আমার নিকট লৌহপিণ্ডসমূহ নিয়ে এসো, অতঃপর মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে যখন লৌহস্তুপ দুই পর্বতের সমান হলো তখন তিনি বললেন, তোমরা হাপরে দম দিতে থাকো। যখন লোহা উত্তপ্ত হলো তখন তিনি বললেন, তোমরা গলিত তামা নিয়ে আসো আমি সেটা লোহার উপর ঢেলে দেই। এরপর, ইয়াজুজ—মাজুজ তা অতিক্রম করতে পারলো না এবং ভেদও করতে পারলো না। (সূরা কাহফ, আয়াত ৯৩—৯৭)
কুরআন ও হাদসের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, ইয়াজুজ—মাজুজ মানব সম্প্রদায়ভুক্ত। অন্যান্য মানুষের মতো তারাও নূহ আলাইহিস সালামের বংশধর হবে। কেননা, সূরা সাফফাত এর ৭৭ নং আয়াত অনুযায়ী হযরত নূহ আলাইহিস সালামের যুগের মহাপ্লাবনের পর দুনিয়াতে যত মানুষ আছে এবং থাকবে, তারা সবাই নূহ আলাইহিস সালামের বংশধর। হাম, সাম ও ইয়াফেস নামে নূহ আলাইহিস সালামের তিনজন সন্তান ছিলো। মানুষের পরবর্তী জন্মধারা তাদের থেকেই চলে আসছে। ঐতিহাসিকগণ এ ব্যাপারে একমত যে, ইয়াজুজ—মাজুজ ইয়াফেসের বংশধর।
মুসলিম, তিরমিযী, ইবন মাজাহ, মুসনাদ আহমাদ, মুস্তাদরাক হাকিমসহ বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থের বর্ণনামতে ইয়াজুজ—মাজুজ যুলকারনাইনের নির্মিত সেই প্রাচীরটি প্রত্যেকদিন ছিদ্র করতে চেষ্টা করে। এমনকি তারা ছিদ্র করতে করতে যখন সূর্যের আলো দেখার কাছাকাছি চলে আসে তখন তাদের নেতা বলে, আজ এখানেই থাক, আগামীকাল আমরা বাকি অংশ সম্পন্ন করে ফেলবো। কিন্তু আল্লাহ তাআলা প্রাচীরটিকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেন। পরদিন ইয়াজুজ—মাজুজ সম্প্রদায় আবার ছিদ্র করতে শুরু করে কিন্তু তারা ছিদ্র শেষ করতে বের হতে পারে না। এভাবেই প্রতিদিন তারা সেই প্রাচীর ভেদ করে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের আগে যখন তাদেরকে বের করার ইচ্ছা করবেন তখনই তারা প্রাচীর ভেদ করতে সক্ষম হবে এবং তারা হিং¯্র ও উপোস প্রাণীর ন্যায় পৃথিবীর সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, সেই দিন আমি তাদেরকে ছেড়ে দেব এই অবস্থায় যে, একদল আরেকদলের উপর তরঙ্গের ন্যায় পতিত হবে। (সূরা কাহাফ, আয়াত ৯৯)
ইয়াজুজ—মাজুজ এর প্রথম দলটি তাবারিয়া উপসাগরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তার পানি পান করে এমন অবস্থা করে ফেলবে যে, দ্বিতীয় দলটি এসে সেখানে কোনোদিন পানি ছিল, একথা বিশ্বাস করতে পারবে না। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীরা তূর পর্বতে আশ্রয় নেবেন। অন্যান্য মানুষেরা তাদের ভয়ে কেল্লায় আশ্রয় গ্রহণ করবে। পুরো পৃথিবীকে তারা অশান্তিময় করে তুলবে। একসময় তারা আসমানের দিকেও তির নিক্ষেপ করবে, আল্লাহর ইচ্ছায় সেগুলো রক্ত মিশ্রিত হয়ে যমীনে ফিরে আসবে। তখন তারা উল্লাস করবে যে, আমরা পৃথিবী জয় করে আসমানও জয়ে করে ফেলেছি। মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে এসেছে তারা বলবে, আমরা পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীকে হত্যা করেছি। এখন আকাশের অধিবাসীদের খতম করার পালা। সে মতে তারা আকাশের দিকে তির নিক্ষেপ করবে। আল্লাহর আদেশে সে তির রক্তরঞ্জিত হয়ে তাদের কাছে ফিরে আসবে। যাতে বোকারা এই ভেবে আনন্দিত হয় যে, আকাশের অধিবাসীরাও শেষ হয়ে গেছে। (মুসলিম ২৯৩৭) ঈসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য মুসলিমরা কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করবেন। অতঃপর ইয়াজুজ—মাজুজ সম্প্রদায়ের ঘাড়ে পোকাড় কামড়ে এক ধরনের ফোঁড়া বের হবে এবং আস্তে আস্তে তারা সকলেই মৃত্যুবরণ করবে। ইয়াজুজ—মাজুজ সম্প্রদায়ের মরা—পচা লাশে যমীন ভরপুর হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা তখন উটের গর্দানের মতো লম্বা লম্বা একদল পাখি পাঠাবেন। সেই পাখিগুলো লাশসমূহ অন্যত্র নিয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। পৃথিবী আবার আগের মতো পরিস্কার হয়ে যাবে।