সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির স্বকীয়তার ধারক-বাহক, একটি জাতির আত্মপরিচয়ের নিদর্শন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-কর্ম, শিল্পকলা, নৈতিকতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সৌন্দর্যানুভূতি, অভিব্যক্তি, মনন, পরিপার্শ্বিকতা, স্থাপত্য প্রভৃতি সবকিছু মিলিয়ে একটি জাতির সাংস্কৃতিক বলয় বিকশিত হয়। যে যা সেটাই তার সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তাই এখানে যে সংস্কৃতির আঙিনা সহস্রাধিক বছর ধরে নির্মিত হয়েছে তা এখানকার মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বুলন্দ করেছে। এদেশের মানুষের নিজস্ব স্থাপত্য ঐতিহ্য রয়েছে, নিজস্ব কথা বলার ধরন রয়েছে, নিজস্ব পোশাক রয়েছে, খাবার-দাবার নিজস্ব রীতি রয়েছে, আদান-প্রদান নিজস্ব অভিব্যক্তি রয়েছে। এখানে শিশু ভূমিষ্ঠ হয় আযানের ধ্বনি শুনতে শুনতে, তার আকীকা হয়, পুত্র সন্তানের খতনা হয়। মৃত্যুর পর কবরে দাফন করা হয়। এখানকার মানুষ কাজ শুরু করে বিসমিল্লাহ বলে। এখানকার মানুষের বিয়ে-শাদী হয় নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনে। দুলহা-দুলহীন, ইজাব-কবূল, আকদ, কাবিননামা, মোহরানা, রুসমত, ওয়ালিমা এসবই এদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক শব্দমালা, এখানকার ৯০ ভাগ মানুষের আনন্দ-আহলাদ, বিশ্বাস ও আদর্শ তাদের ইবাদত, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, শবে-বরাত, শবে-কদর, মিলাদ-মাহফিল, উরস মুবারক, ঈসালে সাওয়াব, ওয়ায মাহফিল, খোদা হাফিয, আল্লাহ হাফিয, ইনশাআল্লাহ, আসসালামু আলাইকুম, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, পুরুষের দাঁড়ি রাখা, টুপি পরা, মেয়েদের পর্দা করা, বোরকা পরিধান করা, সবকিছুই এদেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে সমুন্নত ও সুসংহত করেছে। এগুলোকে বাদ দেওয়ার অর্থ এদেশের মানুষকে বাদ দেওয়া, তাদের ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করা। এসবই তাদের সাংস্কৃতিক নিজস্বতার বাহন।
সংস্কৃতির ব্যাপ্তি সুবিশাল। সংস্কৃত বা কর্ষিত জীবন-কর্ম ও অভ্যাস-আচরণ প্রভৃতিই সংস্কৃতি বা তামাদ্দুন এর আবেদন হৃদয়ের গভীরে সংস্থাপিত। সংস্কৃতির উপাদানও অনেক। সন বা বর্ষ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উপাদান। হিজরী সন ও বাংলা সন এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সন। বিস্ময়কর হলেও এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, হিজরী সন থেকেই বাংলা সনের উৎপত্তি। সে নিরিখে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, হিজরী সনের স্থানীয় রূপ হচ্ছে বাংলা সন। ইদানীং বাংলা সনের সঙ্গে শশাংকের নাম জড়িয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করার প্রয়াস চলছে। বাংলা সনকে রাজা শশাংকের সিংহাসন আরোহণের স্মৃতি হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা সত্যিই দুঃখজনক। যিনি এই চেষ্টা করছেন তিনি তার কথার সত্যতা প্রমাণ করবার মতো কোনো অকাট্য দলীল পেশ করতে পারেননি। আর তিনি যে তা পারবেন না এটা তিনি নিজেও ভালোভাবে জানেন। রাজা শশাংকের ব্যাপারে কোনো সত্য-নির্ভর ইতিহাস নেই। তবে তিনি যে অত্যন্ত নিষ্ঠুর সামন্ত প্রভু ছিলেন এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণ ঐকমত্য পোষণ করেন। এই শশাংক বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে কনৌজের রাজ্য বর্ধনকে হত্যা করেন। তাঁর অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ তদানীন্তন প্রধান ধর্মাবলম্বী বৌদ্ধদের পাইকারি হারে নিধন করে। যেসব বৌদ্ধ জানে বেঁচেছিলেন তাদেরকে ব্রাহ্মণের পদসেবীতে পরিণত করা হয়। ‘আট মঞ্জুশ্রী মূল কল্প’ দলীল। এতে অত্যাচারী ও সাম্প্রদায়িক রাজা শশাংকের অমানবিক নিষ্ঠুর অত্যাচারের বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। এই রাজা শশাংক বৌদ্ধ ধর্মকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি পাটলিপুত্রের বোধিদ্রুম বা বোধিবৃক্ষ উৎপাটন করেন। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধদের এই অতি পবিত্র বৃক্ষটিকে সমূল আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। বুদ্ধ গয়ার বৌদ্ধ স্মৃতি বিনষ্ট করেন। কুশিনগর বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধদের বহিষ্কার করেন। শশাংককে বলা হয় গৌড় ভুজংগ অর্থাৎ গৌড়ের বিষাক্ত সর্প। প্রকৃতির অমোঘ বিধানে গৌড়ের এই ঘৃণ্য সাপটির করুন মৃত্যু ঘটে। তিনি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর সারা শরীরে এমন পচন ধরে যে, হাড় থেকে মাংস খসে খসে পড়ে এবং বেশকিছু দিন অসহ্য যন্ত্রণা আর তীব্র দাহের সাথে কষ্টকর যুদ্ধ করে তাঁর মৃত্যু ঘটে। বৌদ্ধগণ তাঁর এই মৃত্যুকে অপমৃত্যু বলে ব্যক্ত করেছেন।
অথচ এই নিষ্ঠুর রাজ্যকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস যে কেন চালানো হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। বাংলা সনের সঙ্গে শশাংকের কোনো সম্পর্কই থাকতে পারে না। ৯৬৩ হিজরী থেকে চন্দ্রবর্ষ গণনার বদলে সৌর গণনায় এনে যে সনটি উদ্ভাবিত হয় সেটাই বাংলা সন। এতে সন্দেহ থাকার কোনো অবকাশ নেই। বর্তমান বাংলা সন আর হিজরী সনের মধ্যে যে ১৪ বছরের ব্যবধান রয়েছে সেটাই বলে দেয় বাংলা সন হিজরী সনেরই সৌর গণনার ফসল। হিজরী সন প্রবর্তন করেন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)। তিনি তাঁর খিলাফতকালে একটি ইসলামী সনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখন মানুষের মুখে মুখে হিজরতের ঘটনা স্মরণ করে হিজরতের বছর প্রচলিত ছিল। কিন্তু তার কোনো রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। হযরত উমর (রা.) এর আমলে মুসলিম জাহানের সীমানা সুদূর চীন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। তিনি ইসলামী ক্যালেণ্ডারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে হিজরী সনের প্রবর্তন করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবীউল আউয়াল মাসে। কিন্তু আরবের প্রচলিত তদানীন্তন বর্ষ গণনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য হিজরতের বছর পয়লা মুহাররাম থেকে এই নতুন সন গণনা শুরু করা হয়। এই সন বাংলাদেশের যমীনে এসে উপনীত হয় এর প্রবর্তনের বছরেই অর্থাৎ ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে অথবা ২-১ বছর পরে। আমরা জানি ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে কিংবা এর ২-১ বছর আগে বা পরে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। যদিও ৭ম শতাব্দীর বিশ দশকের দ্বিতীয়ার্ধেই এখানে ইসলামের খবর চলে এসেছে আরব বণিকদের মাধ্যমে কিংবা চীনগামী ইসলাম প্রচারকদের সন্দ্বীপ বন্দরে ক্ষণিক নোঙরকালীন সময়ে। এখানে যে ইসলাম প্রচারক দলটি হযরত উমর ফারুক (রা.) এর আমলে আগমন করেন সে দলে কয়েকজন সাহাবীও ছিলেন বলে জানা যায়। হিজরী সন তখন থেকেই এখানে পরিচিত হয়ে যায়। এদেশের সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ স্থাপনে হিজরী সন বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের নব্বই ভাগ মানুষের চিন্তা-চেতনায়, হৃদয় গভীরের লালিত বিশ্বাসে, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে হিজরী সন একক প্রভাব ফেলেছে। মুহাররাম হিজরী সনের প্রথম মাস, যিলহজ্জ হিজরী সনের শেষ মাস। যিলহজ্জ মাস হজ্জ ও কুরবানীর মাস। ঈদুল আদহা উদযাপনের মাস। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ঈদুল আদহা কুরবানী, বকরা ঈদ নামে আত্মোৎসর্গ ও আত্মসমর্পণের মহিমায় ভাস্বর হয়ে রয়েছে। মুহাররাম মাস বাঙালি মুসলমানের চেতনাকে সমুন্নত করে ত্যাগের অপূর্ব অনুভবে। এই মুহাররামকে নিয়ে বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে পুথি সাহিত্য জঙ্গনামা, কাব্যগাঁথা জারি, মর্সিয়া, কবিতা। আমাদের জাতীয় কবি তো গেয়েই উঠেছেন এইভাবে-
নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া
আম্মা লাল তেরী খুন কিয়া খুনিয়া
অথবা, ফিরে এলো আজি সেই মুহররাম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।।
হিজরী সনের দ্বিতীয় মাসে আখিরী চাহার সোম্বা। সফর মাসের শেষ বুধবারে প্রিয়নবী e শেষবারের মতো সুস্থ হয়েছিলেন, সে কারণে মুসলিম জাহানের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। রবীউল আউয়াল মাসে পালিত হয় ঈদে মীলাদুন্নবী। চতুর্থ মাস রবীউস সানীর ১১ তারিখে পালিত হয় গাউসুল আযম আবূ মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী (র.) এর ওফাত দিবস হিসেবে ফাতিহা ই ইয়াযদাহম। এমনিভাবে রজব মাসের ২৭ তারিখে পালিত হয় শবে মিরাজ, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে পালিত হয় শবে বরাত, রামাদান মুবারকে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও আত্মোপলব্ধির মহাপ্রশিক্ষণ লাভ করে এদেশের মানুষ। মাহে রামাদানে তারাবী, ইফতার, সেহরী প্রভৃতি। রামাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ, শবে কদর প্রভৃতি বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে পরিচ্ছন্ন জীবন বিম্বিত বিভায় সমুন্নত করেছে। ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর। ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দ আর ঈদের আনন্দ একাকার হয়ে মহাআনন্দে রূপ নেয়। এমনিভাবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সিংহভাগ জুড়ে হিজরী সনের প্রভাব রয়েছে। আগেই বলেছি বাংলা সন হিজরী সনেরই সৌর গণনার ফসল। সম্রাট আকবর চন্দ্র সনের হিসাবে রাজস্ব আদায়ের সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা সম্ভব নয় দেখে তিনি হিজরী সনের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে নতুন সন প্রবর্তনের চিন্তা-ভাবনা করেন। তিনি পণ্ডিতদের এ বিষয়ে নতুন সন উদ্ভাবনের নির্দেশ দিলে তদানীন্তন কালের শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষ পণ্ডিত আমীর ফাতিহ উল্লাহ সিরাজী এগিয়ে আসেন এবং তিনি গভীর গবেষণার মাধ্যমে হিজরী সনকে সৌরসনে পরিবর্তন করে যে সন উদ্ভাবন করেন সেটাই আমাদের বাংলা সন। আমরা জানি, সৌরবর্ষ গণনা হয় মোটামুটিভাবে ৩৬৫ দিনে আর চন্দ্রবর্ষ গণনা করা হয় মোটামুটিভাবে ৩৫৪ দিনে। চন্দ্রসন ঋতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। নতুন চন্দ্রের উদয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক। চন্দ্র মাস কোনো নির্দিষ্ট ঋতুতে স্থির থাকতে পারে না। যেমনি পারে না চন্দ্রবর্ষ। চন্দ্রসনের প্রতিটি মাস ১০-১১-১২ করে পিছাতে পিছাতে প্রতিটি ঋতু স্পর্শ করে এবং যেখান থেকে তার সফর শুরু হয় সেখানে আসতে তার প্রায় ৩৩ বছর লাগে। আর সৌরবর্ষের প্রতিটি মাস সংশ্লিষ্ট ঋতুর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে স্থির থাকে। আমীর ফাতিহ উল্লাহ সিরাজী সম্রাট জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবরের ক্ষমতা লাভের বছরকে তার উদ্ভাবিত সনের সূচনাস্থল ধরেন। ৯৬৩ হিজরী মুতাবিক ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ হয় সেই সূচনা সন। প্রচলিত হিজরী সনকে তিনি সৌর গণনায় এনে এই নতুন সন উদ্ভাবন করেন। অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরী ৩৫৪ দিনে শেষ না হয়ে ৩৬৫ দিনে শেষ হয়েছিল। ৯৬৪ হিজরী সন ৩৫৪ দিনে এগুতে থাকলেও সৌর গণনায় আনীত হিজরী সনটি ৩৬৫ দিনে এগুতে থাকে। ফলে একই সন গণনার কারণে ১০-১১ দিনের ব্যবধান এগুতে থাকে। সৌর গণনার হিজরী সনে বাংলাদেশে প্রচলিত মাসগুলো জুড়ে দেওয়া হয় এবং এর নাম হয় বাংলা সন। বর্তমানে হিজরী সন ও বাংলা সনের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তা এ গণনার ব্যবধানের কারণেই হয়েছে।
বাংলা ও হিজরী সন আমাদের সাংস্কৃতিক আঙিনায় ঋজুতার বৈভবে নবতর জীবন চেতনায় ভাস্বর হয়ে রয়েছে। একে লালন করতে হবে জাতীয় চেতনার সর্বত্র-সবখানে।